সবুজ প্রজাপতি (চতুর্থ পর্ব)

(ঐন্দ্রিলা-কাহন)

রুমী

রেনোয়ার শহুরে কপোত-কপোতী আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে নেচে চলেছে, পাশ থেকেই অবাক হয়ে তা তাকিয়ে দেখছে ভারমিরের মুক্তোর দুল পড়া মিষ্টি মেয়েটা। ছবি দুটি ঝুলছে উত্তরের দেয়ালে। ঘর জুড়ে আরো ছড়ানো তিশান, মোনে,টার্নার, দালি। দক্ষিনের লম্বা ব্যালকনির সীমারেখা টেনে দেয়া কালো কাঁচের স্লাইডিং ডোর আধখোলা। সাদা কালো ঝাপসা আলো খেলা করছে মার্বেলের মেঝেতে। ঘরের মাঝখানে সিলিকা কাঁচের নিচু টি-টেবিল, সেটাকে ঘিরে রাখা চেস্টারফিল্ড সোফাগুলির ব্যয়বহুল চামড়ায় ভোঁতা ঔজ্জ্বল্য। পারস্যের ইশফাহান গালিচায় মেঝের অল্প অংশ ঢেকে আছে। ঈশান কোণে রাখা বার্চ কাঠের শোপিস রাখার তাক। তাতে থরে থরে সাজানো ক্রিস্টালের দাবার ছক, উপলের রাজহাঁস, পান্নার অপ্সরী, জেইডের প্রেমদেবতা কিউপিড। তাক করে রাখা ধনুকের একটা পাশ ভেঙ্গে আছে, তা খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝা যায়না। ঐন্দ্রিলার হামাগুড়ি দিয়ে ঘরময় ঘোরার অভ্যাস ছিলো। তাতেই আজ থেকে ষোল বছর আগে কিউপিডের প্রেমাস্ত্রের ভগ্নদশা। পূর্বদিকের দেয়ালে ঢাউস দেয়ালঘড়ির পেন্ডুলাম যেনো অদৃশ্য কোনো হাতের পৌনঃপুনিক ধাক্কায় নড়েই চলেছে। মৃদু আওয়াজ করে চলেছে। টিক..টিক..টিক..টিক…। ওকের ডিভানের ওপর আধশোয়া হয়ে আছি আমি। আমার সামনে ঐন্দ্রিলা হন্তদন্ত হয়ে কি একটা খুঁজে চলেছে। আমার মাথার পেছনের দেয়ালে ফ্রান্সিস্কো গয়ার স্যাটার্ন আস্ত গিলে খাচ্ছে তার ঔরসজাত সন্তানকে। হুট করে চোখ পড়লে ঘাবড়ে যায় দুর্বলচিত্তের মানুষ। বাসায় আসা অতিথিরা এই ছবির উপস্থিতিতে শিউড়ে ওঠে। আমি ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করি। আমার মত একজন ‘গোবেচারা’ মানুষ কেন এই বেখাপ্পা, অলক্ষ্মী পেইন্টিং দিয়ে এত সুন্দর একটা ঘর ভরেছি সেই প্রশ্ন ছুড়ে দেয় অনেকে। আমি মুচকি,বোকা-বোকা,লাজুক হাসি দেই,আর কল্পনায় প্রশ্নকারীর জীবন্ত ব্যাবচ্ছেদ করি। সে কথা অতিথির জানা হয়না। আমি সামনেই তাকিয়ে আছি, কিন্তু বিশেষ কিছু দেখছিনা। ত্রস্ত-ছন্নছাড়া মেঘের মত মাথার ভেতর নানান চিন্তা দল বেঁধে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি কেনো এমন? এই প্রশ্নটা আমার ভেতর বুদ্ধি হবার পর থেকেই কাজ করেছে। আমি নিজে কিন্তু তেমন কোন পার্থক্য দেখিনা। প্রাণী হিসেবেমানুষ নাকি বিপদ চিনতে ওস্তাদ। অথচ আমার আসল রঙ তাদের দ্ৃষ্টিগোচর হয়না । আর অভিনয় দক্ষতায় আড়াল হয়ে থাকে আমার অন্যান্য ভিন্নতা। জাদুকরী টপ হ্যাটের নিচে আমি লুকিয়ে রাখি মন্টি পাইথনের রক্তখেকো খরগোশ। যার সামনে এই বিভ্রমের জাল খুলি, সে কাউকে জানানোর সুযোগ পায়না। শুধু সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় আমি একটি জিনিস নিজের ব্যাপারে নিশ্চিত করে জানতে শিখেছি। আই হ্যাভ নো সেন্স অভ এটাচমেন্ট। আমাকে কিনে দেয়া ল্যাব্রাডোরের ছানাকে এক মাসের মাথায় টেনে টেনে ছিঁড়তে আমার এক মুহূর্ত দ্বিধা হয়নি। ছিটকে ছিটকে যখন ওটার রক্ত আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো, আমার মুখে তখন উদ্ভাসিত উচ্ছ্বাস। ২১ বছরের সংসারে মুনকে আমার অনেকবারই কেটে টুকরো করতে ইচ্ছে করেছে। মুখোশ খুলে যাবে, তাই করা হয়ে ওঠেনি। বাবা-মায়ের প্রতিও বিশেষ টান ছিলোনা কখনই। মিল রেখে রাখা হয়েছিলো আমাদের ভাই-বোনদের নাম। রুমান,রুমা,রুমু,রুমী। এ ছাড়া ওদের সাথে আর কোন কিছুতেই কোন মিল নেই আমার। আমি সবার ছোট। আদরে কখনো কমতি পড়েনি আমার। কিন্তু স্নেহ-মমতায় আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিলোনা। মমতার মুখাপেক্ষী নই আমি।

তাই আমি একটা সময়ে নিশ্চিত ছিলাম, আমার সন্তানের জন্য আমার ভেতর যা কাজ করে, তাকে গতানুগতিক পিতৃত্বের অনুভূতি কোনোভাবেই বলা চলেনা। ওকে দেখলে আমার ভেতর গর্ব হয়। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। আমার সৃষ্টি। আমার আদলে যাকে আমি গড়েছি। ওর মাঝে আমার স্ত্রীর বৈশিষ্ট্যও কিছু ঢুকেছে। যা কি না ওকে আরো সুন্দর করে তুলেছে। স্রষ্টা হওয়ার দম্ভ থেকেই আমি ওকে পৃথিবীর কাছ থেকে সামলে রাখি। ওর ভালো-মন্দ নিয়ে আমার মাঝে এক ধরণের চিন্তা কাজ করে। কিন্তু, বাবার ভালোবাসা? না…সেটা ওর পাওয়া হবেনা। আমার খুব অবাক লাগে যখন দেখি, আমার জন্য ওর প্রবল মায়া। ছোটবেলা থেকেই আমাকে না দেখলে খেতে চাইতনা, কান্না থামত কেবল আমার কোলে এলে। আমার কাছে বায়না করে সব আবদার মেটানোর একটা অযৌক্তিক জেদ নিয়ে বড় হয়েছে ও। আমার স্ত্রী, মুন, ওকে ইঁদুর ডাকার ব্যাপারে আপত্তি করেছে ও কোলে থাকার সময় থেকেই, তাই নিজে ওকে ছোট্ট করে ”ঐ” ডাকে। ইঁদুরের চেয়ে ঐ-এর দ্যোতনা অনেক সম্মানজনক। তবু আমার মুখের ডাকই ওর বেশী প্রিয়। ও বেড়ে ওঠার সময় আমার ভেতর কৌতূহল কাজ করতো। আমার জন্য বেশ স্বাভাবিক কৌতূহল। কেমন হবে যদি ও আমার মত হয়?দুজন মিলে দল বেঁধে শিকারে বের হবো এরকম চিন্তাতেও আমি আমোদিত হতাম। আমি খুব কাছ থেকে ওকে খেয়াল করতাম। কিন্তু লক্ষণ শুরু থেকেই অন্যরকম ছিলো। আট বছর বয়সে তিনটি ছয় মাসের বাচ্চার মাথা ইট দিয়ে থেঁতলে দেওয়া ভারতের অমরদিপকে বলা হয় পৃথিবীর কনিষ্ঠতম সিরিয়াল কিলার। আমিও জীবনের প্রথম খুন করেছিলাম আট বছর বয়সেই। তাই ঐ-এর বয়স আট হবার পর খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম এক্সাইটিং কিছু দেখার আশায়। কিন্তু আমাকে হতাশ করে দিয়ে ও আর আট-দশটা বাচ্চার মতোই বড় হয়ে উঠলো। আমি হতাশ হলাম যেমন, তেমনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলামও। আমার জীবনের স্বাভাবিক গতিতে পরিবর্তন আসবেনা ভেবে স্বস্তি হল। পুতুল আর রান্নাবাটি খেলার মত পার্থিব কাজে মগ্ন থেকেই ধীরে ধীরে বড় হতে থাকলো। আমার সাথে এক আশ্চর্য বৈপরীত্ব রেখে ওর বেড়ে ওঠা। সবকিছুর প্রতি অসম্ভব মায়া। টেডি বিয়ারের সুতো উঠে গেছে…সে নিয়ে কি কান্না! বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করা বৃদ্ধার একটা হাত নেই…তাতে ওর ছোট মুখ চোখের জলে প্লাবিত। স্কুলে ভর্তি করার পর, প্রায় ই নিজের খাতা,পেন্সিল টুকিটাকি অন্যদের দিয়ে দেয়ার অভ্যাস দেখা দেয় ওর মাঝে। আমাদের প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশী আছে এটা নিয়ে একটা বালসুলভ অপরাধবোধ বয়ে বেড়াচ্ছে একটু বড় হবার পর থেকেই। এই অনাচারের অনুযোগ আমাকেই এসে শুনিয়েছে। মানুষের চোখে আদর্শ পিতার ভ্রম সৃষ্টি করতেই ওর সব আবদার আমি রাখি। ওর জন্য বাধ্য হয়েই আমাকে এতিমখানা খুলতে হয়েছে। হাসপাতালে, বৃদ্ধাশ্রমে দেদারসে টাকা দিয়েছি জোরাজোরিতে পড়ে। এতে অবশ্য বেশী লাভ আমারই হয়েছে। আমার নাম হয়ে গেছে এলাকার ‘হাতেম তাঈ’। আত্মীয়-অনাত্মীয় যে-ই ওকে দেখেছে, ওর মায়ায় মুগ্ধ হয়েছে। ওর বাহ্যিক সৌন্দর্যও আমি যতদূর বুঝি অতুলনীয়। আমার রক্ত শিরায় আছে বলেই হয়ত ও মানুষের চোখে এত সুন্দর,নিজের ক্রিয়েশনে আমি গর্বিত হই । ওর মত সুশ্রী মেয়ে সারা জীবনে দেখিনি- এমন কথা আমি রোজ পরিচিত-স্বল্প পরিচিতদের মুখে অসংখ্যবার শুনি আমার বড় ভাই আমাকে একদিন হুট করে বললো, ‘রুমী, তোর কন্যাভাগ্য ঈর্ষা করার মত। মেয়েটার মনটা যেমন মায়াবতী, দেখতেও মাশাল্লাহ অপূর্ব হয়েছে। মুন আর তোর চেহারা মিলিয়েই পেয়েছে। দেখা হলেই এমন হাসি দিয়ে চাচা বলে ডাকে,বুকটা ভরে যায়।’ অথচ রাশভারী অগ্রজকে আমি অন্য কিছুতে কখনোই উচ্ছ্বসিত হতে দেখিনি। অনেক আগে থেকেই সে ঐন্দ্রিলা বলতে পাগল। ও যখন আধো আধো বোলে, তাকে ‘রুমাল’ চাচা ডাকতো, তখন গম্ভীর প্রকৃতির রুমান মোস্তফা ঘর ফাটানো আওয়াজ তুলে হাসতেন। আমার সৃষ্টি বলেই হয়ত ওর মাঝে এক অদ্ভুত চিত্তহারী কিছু একটা আছে। সবাই ওকে সত্যিকারের মুগ্ধতা নিয়ে দেখে। আমার এতেও কেমন একটা গর্ব হয়। কিন্তু,না। আমি আর দশটা বাবার মতো আমার সন্তানকে ভালোবাসি না। হোয়াটএভার দ্যাট ওয়ার্ড মিনস। ভালোবাসার সামর্থ্য আমার মাঝে নেই বলেই হয়ত। কিন্তু আমি জানি, আমার ভেতর ওর জন্য কিছু একটা কাজ করে। এই প্রথম কাউকে আমার কেটে টুকরো করার ইচ্ছে জাগেনি। এই বা কম কিসে!

প্রায় দু’মাস হতে চলল। সত্তায় ডাক এসে গেছে। বেরিয়ে পড়তে হবে। ভাবতে ভাবতেই আমার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।
…………………………………………………..

ঐন্দ্রিলা

আমার মেজাজ সপ্তমে চড়ে আছে। ক্লাস শুরু হতে দশ মিনিট ও বাকি নেই। অথচ কোথাও চুলের ক্লিপটা খুঁজে পাচ্ছিনা। মা-কে বলতেই চোখ উল্টিয়ে এমনভাবে তাকালো যে আর দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা চলে গেলো। আর লিভিং রুমে এসে দেখি বাবা ডিভানে বসে নিজের চিন্তায় ডুব দিয়ে আছে। আমার বাবার মত সুন্দর মানুষ পৃথিবীতে আর একটাও নেই। আমার মা অসম্ভব সুন্দরী অথচ তবু বাবার সামনে তাকে ফিকে লাগে। এমন কি আমার ক্লাসের মেয়েরাও বাবাকে দেখলে এমন কিছু দৃষ্টিকটু ভাব করে, আমার পিত্তি জ্বলে যায়। আজকালকার মেয়েরা অনেক পাকনামো পারে। আমার মাঝে এসব নেই। মাঝে মাঝে আবার খুব গর্ব ও হয়। শুধু বাবার চেহারা সুন্দর বলে না। আমি অতো শ্যালো না। উনার মন অসম্ভব ভালো। আমার বাবার চেয়ে ভালো মনের মানুষ ও পৃথিবীতে আর একটা নেই। চুপচাপ,শান্ত নিরীহ ধরণের মানুষ। কারো সাতে পাঁচে নেই। আমার সাথে যে বাবা অনেক অনেক কথা বলে এমন না। সে স্বল্পভাষী মানুষ। কিন্তু আমার কোনো আবদার সে অপূর্ণ রাখেনা। তাই বাবা না বললেও আমি টের পাই, আমাকে সে অনেক ভালোবাসে। সব মানুষের উপকার করে বেড়ায় লোকটা। পরিচিত-অপরিচিত সবাই বাবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এটা গর্ব হবার বিষয় না?!

জলদি বের হতে হবে। প্রথমে যেতে হবে শ্রাবন্তীদের বাসায়। শ্রাবন্তীদের অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছল না। কিন্তু মেয়ে হিসেবে ও খুব ভালো। একদম ক্লাস টু থেকে আমার প্রিয় বান্ধবী ও। আমাদের বাসায় পাঁচটা গাড়ি। আমার প্রয়োজনে চাইলেই আমি যে কোন একটা নিয়ে বের হতে পারি। বাবা-মা সবসময়ই জোর করে। কিন্তু আমার ভালো লাগেনা। শ্রাবন্তি অস্বস্তি বোধ করে। আমি সবসময় পায়ে হেঁটেই যাই। তারপর একসাথে রিকশা করে রওনা হই। আমাদের বাসার কাছেই ওদের টিনশেড বাড়ী। যেতে পথে একটা বিশ্রী ডাস্টবিন পড়ে। আমার এতো বাজে লাগে! তবু প্রতিদিন নিয়ম করে ওখান দিয়ে যেতে যেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু গন্ধটা এখন পর্যন্ত গা-সওয়া হয়নি। এই যা! টেবিলের ওপরে রেখে এতো খোঁজাখুঁজি করলাম! ক্লিপটা পেয়ে নিজেকে মনে মনে খানিকটা বকে দিলাম। আয়নার সামনে দাঁড়ালাম চুল ঠিক করবো বলে। আয়নায় নিজের মুখ দেখে আমি চমকে উঠি।আমার মাঝে একটু ও অহংকার নেই। থাকলে দেমাগে আমার মাটিতে পা পড়তোনা হয়ত। সারাজীবনে অনেকবার দেখেছি। তবু নিজের লাগামছাড়া সৌন্দর্য আমাকে আরো একবার অবাক করে দেয়।’কি গো সুন্দরী, কেমন আছো তুমি?’ বলে আমি মিটি মিটি হাসি। আমার ঝকঝকে দাঁত আয়নার রূপালী ঔজ্জ্বল্যকে ফিকে করে দেয়। আমি আরো একটু সময় নিয়ে নিজেকে দেখি। গত দু বছরে অনেক খানি পালটে গেছি। ফিফটিন হবার পর পরই পূর্ণবয়স্কাদের পোশাক পড়া শুরু করেছি ফ্রক ছেড়ে। কিন্তু ইদানীং পোশাকগুলো ভরাট হয়ে উঠেছে। শরীরে বাঁক এসেছে। আমার গাল লাল হয়ে যায় ভাবতে ভাবতে। আমার মায়ের চুল একদম সিল্কি। আমার চুলে অল্প ঢেউ খেলানো একটা ব্যাপার আছে। আমি বাবার চুল পেয়েছি। লালচে রঙের একটা আভা আছে তাতে,যদিও আমি চুলে কালার করিনি কখনো। কি সুন্দর লম্বাটে মুখের গড়ন! গাঢ় তামাটে চোখের মণিতে আমার নিজের রূপের প্রশংসা ফুটে ওঠে। গালে আবছা লালচে রঙ। আমার ত্বকে হলদে একটা ভাব আছে, মা’র মতো ধবধবে ফর্সা হইনি আমি। আমাকে শ্রাবন্তী সবসময় বলে, ”তুই এত স্পটলেস থাকিস কিভাবে বল তো? কি খেয়ে থাকিস? এই দেখ না আমার মুখে কতগুলি দাগ, তোর মুখে একটা দাগ ও নেই। কি হাইট তোর। চাঁদের পর্যন্ত কলংক থাকে! তোর জামাই এর হিংসায় দুনিয়ার বেবাক ছেলে পুড়ে খাক হবে।” আমার যদিও পছন্দের কেউ নেই। আমি যেমন চাই তেমন ছেলে আছে নাকি এই জগতে? তারপরেও এরকম কাউকে কোন একদিন পাবো তা মাঝে মাঝে ভাবতে ভালোই লাগে। সেই ছেলেকে হতে হবে আমার বাবার মত। রূপে-গুণে, দুইয়েই। এরকম কাউকে পেলে তবেই আমি গলবো। আমি আয়নাই আরেকবার নিজের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাই। প্রতিদিন যে এভাবে আত্ম-প্রশংসায় মগ্ন হই তা-ও না…আজকে আমাকে একটু বেশী-ই সুন্দর লাগছে।আমি বের হওয়ার আগে প্রতিদিনের মত নিয়ম করে মা’কে একবার জড়িয়ে ধরি। মা রান্না ঘরে পাতিল নাড়তে নাড়তে ঘামছিলো। তারপরেও কি সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে!সব ঠিকঠাক গুছিয়ে নিয়েছি কি না এই প্রশ্নের উত্তরে আমি মাথা নাড়তেই বললো, ‘সাবধানে যাস।’ আমি মাথা নেড়ে দৌড়ে লিভিং রুমে চলে আসি। সারা পৃথিবীতে আমার সবচে প্রিয় উদাসী মানুষটা সেখানে চিন্তায় খেই হারিয়ে বসে আছে। গল্প উপন্যাসের রাজপুত্রের মত দেখাচ্ছে তাকে। কে বলবে এই লোকের বয়স আটচল্লিশ! আমি ঝপ করে তার কোলে যেয়ে পড়ি! সম্বিৎ পেয়ে বাবা অল্প চমকে ওঠে।
-কোথায় যাচ্ছ?
-এ সময় কোথায় যাই তুমি জানোনা? কলেজে! সারাদিন কি ভাবো বলো তো! তোমার মত উদাসী মানুষ এত বড় ব্যাবসা কিভাবে সামলাও আল্লাহ জানে!
বাবা মুচকি হেসে তাকায় আমার দিকে। এটা ছাড়া আর কোন হাসি সে পারেনা। আমি আজ অব্দি তাকে দাঁত বের করে হাসতে দেখিনি।
-যাও। সন্ধ্যার আগে আগে চলে এসো। তোমার মা নইলে দুশ্চিন্তা করে। -আচ্ছা বাবা। তোমরা মিস করা শুরু করার আগেই দেখবে আমি জ্বালাবার জন্য হাজির! আমি বাবাকেও একবার জড়িয়ে ধরি। হুট করে এভাবে ধরলে বাবা খুব অপ্রস্তুত হয়ে যায়। আমার খুব মজা লাগে ব্যাপারটা। গুনগুন করতে করতে আমি বাইরে এসে বের হই। কি সুন্দর ঝকঝকে রোদ! মনে হচ্ছে সাদা রোদের পর্দা টেনে দিয়েছে কেউ এই শহরের ওপরে। অসহ্য নীল রঙা আকাশ। তাতে পেঁজা তুলোর মত মেঘ। আমার প্রচণ্ড আনন্দ লাগতে থাকে।
বাসার সামনে গোলাপী চেরি গাছে ফুলে ফুলে ভরে গেছে। মনে হচ্ছে যেনো সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে গোলাপি আগুন ধরে আছে।

আচমকাই আমার আনন্দে ছেদ পড়ে। পিলে চমকে ওঠে ওদের দেখে। বাসার সামনের মোড়ে আগেও দেখেছি। আজো দেখছি। পাঁচটা ছেলে। তার মধ্যে অন্তত দুটো আমাদের ক্লাসের। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কমবয়সী ছেলেরা সুন্দরী মেয়ে দেখলে যেমন দেবীদর্শনের মোহাবিষ্টতা নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে দেখে, ওদের দৃষ্টি তার চে সম্পূর্ণ আলাদা। চোখেমুখে কি বীভৎস লোলুপতা! আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আগে এতো বেশী পিছু নিতোনা। গত কিছুদিনে ওদের সাহস বেড়েছে। বাবাকে বলতে হবে। আমার বুক ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। আমি হাঁটার গতি বাড়াই। ওরাও আসতে থাকে পিছু পিছু। আমি পেছনে না তাকিয়েও ওদের অনুসরণ টের পাই। মেয়েদেরকে আল্লাহ এ ধরণের বিপদ বুঝতে পারার বিশেষ রাডার দিয়ে দুনিয়াতে পাঠান। ভর দুপুরেও একটা রিকশা চোখে পড়ে।-এই খালি! যাবে?রিকশা আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমি রিকশাওয়ালাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে পড়ি। আড়চোখে দেখতে পাই ছেলেগুলি পেছন ফিরে গেছে। হাঁফ ছেড়ে আমার শরীরে প্রাণ আসে। ……………………………………………………….

ঐন্দ্রিলা জানতোনা, উত্যাক্তকারীদের পাঁচজনের একজনের নাম মোরশেদ। সে এই গ্রুপের লিডার। তার চাচা এলাকার সবচে ক্ষমতাশালী লোক। রফিক কমিশনারের নামে পুরো শহর কাঁপে। মোরশেদ নিজেও অবশ্য কম যায়না। চাঁদা তোলার কাজ সে হাফ-প্যান্ট ছাড়ার আগে থেকে করে আসছে। বয়সে বড়রাও তাকে সমীহ করে চলে। এতোদিন পকেটে অলটাইম নাপিতদের ক্ষুর থাকতো। সেই ক্ষুরের পোচ শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে এমন মানুষ খুঁজলে শহরে অন্তত দুই ডজন পাওয়া যাবে। কলেজে ওঠার পর চাচা মেশিন দিয়েছে। ক্ষুরটা ওর খুব প্রিয় তাই ওটা এখনো পকেটে থাকে, কিন্তু যন্ত্রটা হাতে আসার পর তার শরীরে অন্যরকম তেজ এসেছে। রাস্তার মানুষজন সব অতিথি পাখি মনে হয়। সে মনে মনে টিপ ঠিক করে একটা একটা ফেলে…ঠুস…ঠুস…ঠুস…তিনটা শেষ! এতে তার বেশ আনন্দ হয়। কিন্তু তার সবচে আনন্দ হয় মেয়েছেলেদের শরীর ধরতে পারলে। তার চেহারা খুব সুদর্শন নয়। তাই কোনো মেয়ে তাকে স্বেচ্ছায় থাপ্পড় ও দিবেনা। কিন্তু একটু বড় হতেই সে জেনে গেছে বিশেষ জায়গায় শ খানেক টাকা খরচ করলেই বেশ আয়েশ করে ফেলা যায়। মেয়েছেলেদের গায়ের ঘ্রাণ প্রতিদিন না পেলে তাই তার শরীরে জুত হয়না। মোরশেদের পড়ালেখা এইটের পর আর হয়নি। তাই নিজের মান-ইজ্জত বাড়াতে কলেজ-পড়ুয়া বেশ-কটা চামচা জুটিয়েছে সে। ওর কথায় ওঠে বসে। তাদের একটার নাম সোহেল। সে পারলে মোরশেদের পূজা করে। দলপতির মন রাখার মোক্ষম উপায় আবিষ্কার করে সোহেলই তাকে ঐন্দ্রিলার খোঁজ এনে দিয়েছে। প্রথম যেদিন সে ঐন্দ্রিলাকে দেখে, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, শিরায় শিরায় প্রলয় নাচন শুরু হয়ে গিয়েছিলো। খারাপ পাড়ার মেয়েগুলির শরীরে অনেক খুঁত।গালে মেছতা। নিচের ওই জায়গাটা কুচকুচে কালো। আর এই মেয়েটা! উফ! কদিন আগেই হলে গিয়ে শ্রীদেবীর নাগিন দেখে এসেছে। তার মনে হয়েছিলো শ্রীদেবীর মত এত সুন্দর মেয়েমানুষ তার আশেপাশে নেই।এই মেয়ে শ্রীদেবীকে চাইলে নিজের কাজের বেটি বানিয়ে রাখতে পারবে! টসটসে আঙ্গুরের মত রসালো পাতলা ঠোঁট, ভরাট বুক আর তারচেয়েও ভরাট পা**। জামাকাপড় টাইট হয়ে লেগে আছে নাগিনের মতো আঁকাবাঁকা শরীরের সাথে। এই মেয়েটার বিশেষ জায়গা ব্লু ফিল্মের বিদেশী মেয়েগুলার মত গোলাপী হবে এই ব্যাপারে মোরশেদ নিশ্চিত। আর কতটা টাইট হবে ভেবে মোরশেদের তলপেটের একটু নিচে শক্ত হয়ে আসে। নাহ! এই জিনিসটা তার লাগবেই। তা যেভাবেই হোক। খুশি খুশিতে দিবেনা সেটা সে ভালোভাবেই জানে। কুছ পরোয়া নেই…কিভাবে জোর করে আদায় করতে হয় তার মত ‘কাবিল পোলা’ বেশ ভালোভাবেই জানে। আর একবার জায়গামত পেলেই হলো। এরকম সুযোগ আসলে কি কি করা যাবে ভেবে তার রক্ত খলবল করে ওঠে।

হাতের ইশারায় সে তার চ্যালাদের সরে আসতে বলে।

বড় সিগারেটের তেষ্টা পেয়েছে। মোরশেদ প্যাকেট থেকে বের করে বেনসন ধরায়। হালকাভাবে ধোঁয়া ছেড়ে সে রিকশা নিয়ে কেটে পড়া ঐন্দ্রিলার পথের দিকে ঘুরে তাকায়। তার চোখ শ্বাপদের মত চকচক করছে। শরীরে প্রবৃত্তির ডাক এসেছে। এই ডাকে সাড়া না দেয়ার সামর্থ্য তার নেই।
……………………………………(চলবে)

১,৫৩৫ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “সবুজ প্রজাপতি (চতুর্থ পর্ব)”

  1. সাইদুল (৭৬-৮২)

    মনে হচ্ছে খুব কঠিন একটা লড়াই সামনে আসছে।দু'টি একেবারে বিপরীত চরিত্রের বোঝাপড়া টা কেমন হয় দেখার অপেক্ষায় আছি।


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    পল্পটা দেখি বেশ আঁটঘাট বেঁধে এগোচ্ছে ।
    একের পাশাপাশি দুই ও তিন এসে দাঁড়ালো মনে হচ্ছে ...
    থ্রিলার কিলার ইজ রাবিং ব্লাডি হ্যান্ডজ অন দ্য টুইস্ট অব স্টোরি ...
    দেখি কি হয় !

    জবাব দিন
  3. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    টোটালি ফ্ল্যাবারগাসটেড, ছোট ভাইয়া! :clap: :clap:

    তোমার লেখাটি পড়েছিলাম প্রথমদিনই। বাড়িতে অতিথি ছিলেন বলে জুত করে মন্তব্য করতে পারছিলাম না। আমি জানি অতি যত্নে লেখাটি শুরুতেই পাঠকের মন্তব্য না পেলে লেখক খানিক কনফিউজড হয়ে পড়েন! ভাবতে থাকেন নিজের লেখার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। ধারাবাহিক গল্প লেখার অবশ্য হ্যাপা এটিই, ভাইয়া। পাঠক পড়ছেন ঠিকই কিন্তু প্রতি পর্বে লগ ইন করে জানান দেয়া হয়না।

    ঐন্দ্রিলা চরিত্রটির মাঝে আমার পরিচিত একটি টিনএজ মেয়ের ছায়া আছে।
    নাইসলি পোট্রেড! তোমার ডিটেইলগুলো পড়তেও ভাল লাগে, জানো।

    খুব ভাল লেগেছে, ভাইয়া! পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।