সবুজ প্রজাপতি (প্রথম পর্ব)

লোকটা ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই আমার চোখে পড়লো তার চেহারা বেশ সুদর্শন । শুধু সুদর্শন না, ফিল্মি হিরো মার্কা সুদর্শন। প্রথম দেখায় ভেবেছিলাম সদ্যই তিরিশের কোঠায় পা দেয়া, কিন্তু চল্লিশের ঘরে তার বয়স; সেটা পড়ে জেনেছি। বয়সের ছাপ পড়েনি মোটেও। ফিটফাট একহারা গড়ন। নিয়মিত শরীরচর্চার নিদর্শন হয়ে আছে মেদহীন শরীর। হালকা লেমন-গ্রীন পোলোর হাফ-হাতা আস্তিন কেটে সুগঠিত পেশী বের হয়ে আছে। ঢেউয়ের মতো অল্প কোঁকড়া লম্বা ধূসর চুল। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। হাতের ঘড়ি থেকে শুরু করে পায়ের মোকাসিন- সবকিছুতে প্রাচুর্যের স্পর্শ। লম্বাটে মুখের গড়ন। আমি দেখেছি, সাধারণত, বৈভবে মানুষের মুখে একটা গোলগাল তেলতেলে ভাব চলে আসে। ইনার পোশক-পরিচ্ছদে ধনাঢ্যাতার সব লক্ষণ বিদ্যমান অথচ মুখটাতে আশ্চর্য একটা পোড়খাওয়া কাঠিন্য। আমি এই দ্বৈততায় প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম। ছোটবেলা একটা প্রবাদ শুনেছিলাম, “আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারি”। গ্রামাঞ্চলের প্রবাদগুলোতে একটা সরল,অনস্বীকার্য ধর্ম আছে। সবচে অনাড়ম্বর প্রবচনও তাই প্রাত্যহিক জীবনে আবশ্যক সত্য হয়ে যায়। এই লোকটার কথাই ধরি, তাকে প্রথমে দেখে একটা অযাচিত শ্রদ্ধাবোধ নিজে থেকেই আমার ভেতরে কাজ করেছিলো। বেশভূষার কারণেই কি না, আমি ধরেই নিয়েছিলাম তার এখানে আসার একমাত্র কারণ, বেচারা হয়ত কোন অপরাধের শিকার হয়েছে। কত মানুষ আসে আমার কাছে প্রতিদিন- তাদের পদের,রকমের অন্ত নেই। হাসপাতাল আর থানার মাঝে এই এক অদ্ভুত মিল। এখানে আসে সব শ্রেণীর মানুষ,জীবন আর মরণ, দুইয়ের তাগিদেই আসতে হয়। জাঁদরেল অফিসার হিসেবে সুনাম আছে আমার। দেখেই মানুষ চিনতে পারি, ভেতরে ভেতরে এমন একটা গর্ব-ও কাজ করে। দোষী,নির্দোষ,সৎ,ভণ্ড,চোর,ফটকাবাজ,বাটপার,অসহায়,হিংস্র,ধুরন্ধর,বেআক্কেল-সব টাইপই আমার দেখা আছে। অন্তত আমি তাই ভাবতাম। কিন্তু আজ এই ফাল্গুন মাসের দুপুরে আমার সব বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ধ্যান-ধারণার ভিত প্রবলভাবে নড়ে উঠলো।

শুরু থেকেই তবে শুরু করা যাক।

-বসুন। তা কি প্রবলেমে পড়েছেন বলুন। আজকাল মাগিং-বার্গলারি সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বড় বেড়েছে শহরে। অবস্থাশীল অনেকেই আসছেন কমপ্লেন নিয়ে। আপনার ঘটনা কি বাসায় হয়েছে না রাস্তায়?
বলে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। হড়বড় করে কথা বলার অভ্যাস আমার একেবারেই নেই। অথচ আমার সামনে বসা মানুষটির প্রবল ব্যাক্তিত্বের সামনে আমি যেন অল্প নুইয়ে গেলাম। অদ্ভুত! অথচ কত মন্ত্রী –এমপি,ঘাঘু অপরাধীর সামনে আমি আশ্চর্য সাবলীল।
লোকটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শুরু করলো। যেনো আমার একটা কথাও তার কানে যায়নি।
-আমি এখানে এসেছি গ্রেপ্তার হতে।
-মানে?
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম।
– আমার কিছু কথা শুনুন। একবারও ইন্টারাপ্ট করবেন না। আই উড রিয়েলি এপ্রেশিয়েট ইফ ইউ কুড ক্লোজ দা ডোর। আর হ্যাঁ, আমার কথার মাঝখানে আপনার হয়ত ইচ্ছা করবে আমাকে শুট করতে। চিৎকার করে লোক জড়ো করতে। আপনি দুটোই করতে পারেন। বাট প্লিজ, আমার কথা শেষ হবার আগে না।
পাগল নাকি ব্যাটা?! পাগল হলে এর সামনে হন্তদন্ত হওয়ার জন্য মনে মনে নিজেকে নিয়ে বিব্রত ও হলাম। কিন্তু আমি ততক্ষণে নিজের কৌতূহলের কাছেও পরাজিত।
-দরজা বন্ধ করা যাবেনা। বাট কেউ আসবেনা সে ব্যাবস্থা করছি।
কনস্টেবলকে ডেকে বললাম আমি না ডাকা অব্দি কেউ যাতে আমাকে বিরক্ত না করে ।
-চা খাবেন? সামনের রাস্তাটার ওপাশের দোকানে ফার্স্টক্লাস চা বানায়।
-না, ধন্যবাদ। আমি কি শুরু করতে পারি?
তাড়া দেয়ার সুরে লোকটা বলে।
-অবশ্যই।
অল্প একটু কাশির মতো আওয়াজ করে লোকটা গলা পরিষ্কার করলো। আমার অভিজ্ঞ চোখ বুঝল সে কথা গোছাচ্ছে। আমি নড়েচড়ে বসলাম।

-আমার মতো অনেককেই পৃথিবী দেখেছে, যুগে যুগে। আমাদের সনাক্ত করতে প্রোফাইলিং বলে একটা জিনিসের চল আছে তাই আইনরক্ষা বাহিনীতে।
আমি চমকে উঠলাম। বলে কি এই লোক! আমি প্রশ্ন করতে গিয়েও থামলাম। দেখাই যাক না, পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়।
-তাই তাদের সাথে মিলিয়ে যে কেউ ভাবতে পারে আমার শৈশব হয়ত ভয়ানক অত্যাচারে,অনাচারে কেটেছে। ধারণা করতে পারে, কোনো এক ভয়াবহ ঘটনা আমার সাথে ঘটেছিলো যা আমাকে এমন করে দিয়েছে । কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমার শৈশব ছিলো প্রাচুর্যে ভরা। আমার বাবা-মা উভয়ই ছিলেন নিখাদ ভালোমানুষ। সন্তানদের মাঝে সবার ছোট হওয়াতে আমি, যাকে বলে, মাথায় ওঠার মতো লাই পেতাম। তাঁরা দুজন খুব সচেতন ছিলেন, তাই অনেক শিশুর যে অনভিপ্রেত অভিজ্ঞতা হয়, তা আমার কখনোই হয়নি। কোন বয়স্ক আত্মীয় আমাকে কোলে বসিয়ে আদরের অভিনয়ে আনন্দ নেয়ার চেষ্টা করেনি। অনেকে বলে শৈশবে যৌন হয়রানি মানুষকে আমার মতো করে তোলার পেছনে বড় কারণ। দে হ্যাভ নো আইডিয়া। যাই হোক, আমি মুখে যা চাইতাম তাই আমার সামনে হাজির করা হোতো। কিন্তু যা আমি মনে মনে চাইতাম,কেন চাইতাম তা না বুঝলেও সেই ইচ্ছাগুলি যে মুখে আনা যাবেনা সে ধারণা আমার ভেতর প্রাকৃতিক ভাবেই ছিলো। আমার নাটকের শুরু তাই নিষ্পাপ শৈশব থেকেই। আমার সমবয়সীরা যখন আদর্শ-লিপি পড়ায় ব্যাস্ত, আমি ততদিনে একজন পাকা অভিনেতা।
সত্যি বলতে, আমার আশপাশটা ছিলো প্রচণ্ড সাদামাটা, রীতিমত একঘেয়ে। অন্যদিকে আমার নিজের ভেতরের গল্পটা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন।

আমি আবেগী নই। আবেগের ব্যাপারে আমার খুব ঝাপসা একটা ধারণা আছে। শব্দটা জানি,অনেকবার শুনেছি এর গুরুত্বের কথা, কিন্তু আবেগের সাথে জড়িত অনুভূতিগুলোর সাথে পরিচয় নেই আমার। রাগ,অভিমান,জেদ,ভালোবাসা,হিংসা,সহানুভূতি-এ সব আমার কাছে শুধুই পরিচিত শব্দ। আমার বাবা মা ও জানতোনা আমি কে। তারা সন্তান হিসেবে যাকে চেনে, সে আজীবন স্কুলে,কলেজে,বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো করা, আদব কায়দা মেনে চলা, শান্ত, দায়িত্বশীল আর আদর্শবান মানুষ। অনেক যত্নে,অনেক সাবধানে আমাকে এই মূর্তি গড়তে হয়েছে।

আমার ভেতরে একটা শুন্যতার অস্তিত্ব টের পাই বোধ হওয়ার সাথে সাথে। খুব ছোট থাকতে আমার ইঞ্জিনিয়ার মামা আমাকে দেখিয়েছিলেন, ম্যাগনিফায়িং কাঁচ হাতে খুব সহজেই বারান্দায় সারি ধরে হেঁটে যাওয়া পিঁপড়াগুলির জীবন মৃত্যুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া যায়। সেদিনই সতিকারের উল্লাসের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে একটা ভুল করে ফেলেছিলাম। মাকে ডেকে এনে এক দুটা পিঁপড়া পুড়িয়ে দেখাতেই তীব্রভাবে তিরস্কার করলেন। আমাকে জীবে দয়া করতে বললেন। আর আমি বুঝে গেলাম, নিষ্ঠুরতা পর্দার আড়ালের কাজ। সেদিন থেকেই আমার মুখোশ পড়া শুরু।

পাশের বাসায় এক বুড়ো হিন্দু একা একা থাকতো,বিমলানন্দ নাম, ছেলেবুড়ো সবাই ক্যাবলা জ্যাঠা বলে ডাকতো। বিশাল বড় বাড়িতে সে একলা মানুষ। পৃথিবীতে তার আপনজন কেউ ছিলো বলে মনে পড়েনা। দূরের কিছু আত্মীয় ছিলো। সবাই কলকাতায় পাড়ি জমানো। কিন্তু বুড়ো মরার পর সব এসে ভীড় করেছিলো সম্পত্তির দাবিতে। যাই হোক, সে নিজের পূর্বপুরুষের ঘর আগলে পড়ে ছিলো। তার নিঃসঙ্গতায় সঙ্গী ছিলো চার-পাঁচটা পোষা বিড়াল। বুড়োর খুব মায়া ছিলো বিড়ালগুলির ওপর। বিড়ালগুলিও সবার কাছে ঘেঁষত। বাড়ি বাড়ি ঘুরত খাবারের আশায়। আমি নিজেই অনেক খেলেছি ওদের সাথে। ফুটফুটে সুন্দর ছিলো সবকটা তাই এলাকার সবাই খুব আদর করতো। একদিন একটাকে কোলে নিয়ে খেলতে খেলতে নিতান্ত কৌতূহলের বশে আমি চাপ দিয়ে ঘাড় ভেঙে দিয়েছিলাম। শব্দ করতে যাতে না পারে সেজন্যে চোয়াল চেপে ধরেছিলাম। ওটা ছিলো সবচে ছোট। ছানাই বলা যায়। আমার সাথে গায়ের জোরে পারার কোন সম্ভাবনা ছিলোনা। ও চোখভর্তি অবিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। ছানাটার ছটফট করতে থাকা শরীর থেকে প্রাণ চলে যেতেই আমাকে যেন কি একটা ভর করলো। একটা অদ্ভুত ঘোরে চলে গেলাম আমি, টেনে ছিড়লাম ওটার পা,একটা একটা করে। এরপর মাথাটা। আমার বয়স তখন আট। আমার ভেতরে সেদিন প্রবল আনন্দ হয়েছিল। সে আনন্দের কোন ব্যাখ্যা নেই। শুধু দুর্নিবার আকর্ষণ আছে। আমার সারা জীবন আমি কাটিয়ে দিয়েছি সেই ব্যাখ্যাতীত উল্লাসের নেশায়। বিড়ালটার চোখের সেই দৃষ্টি আমার মাথায় ঢুকে গেছিলো আজীবনের জন্য।
-কি! বলছেন কি এসব আপনি!
নিজের কানকে আমি এতোটা অবিশ্বাস কখনো করিনি!
– আপনি কথার মাঝে থামালে আমি এখান থেকে চুপচাপ বেরিয়ে যাবো।
লোকটার চোখে দানবের কাঠিন্য। কি ভয়াবহ সেই দৃষ্টি। অবাক হয়ে টের পেলাম আমার শিরদাঁড়া ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে!
অপরাধীদের যম, আপোষহীন, নির্ভীক ইশতিয়াক আহমেদের মনে এক চাহনিতে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল অদ্ভুত আগন্তুক।
আমি মিইয়ে গেলাম।
কে এই লোক?
তারচে বড় প্রশ্ন- “কি’’ এই লোক?

-নিজ থেকে না আসলে আমার অস্তিত্ব আপনারা কখনই জানতেন না। তা আমি নিশ্চিত করে রেখেছিলাম। এভাবে আমাকে আসতে হবে আমি কখনো ভাবিনি। আমার বলা শেষ হলে আপনি যা খুশি করতে পারেন। বাট লেট মি ফিনিশ মাই স্টোরি।

আমি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে করতে বললাম, আপনি বলে যান,আমি আর থামাবোনা। গো অন।

-আমার পরিবারে আমি,আমার স্ত্রী আর আমার এক সন্তান। মেয়ে। এ বছর ১৭ তে পা দিয়েছে। বাইরে থেকে দেখলে রীতিমত পিকচার পারফেক্ট সংসার। আমার স্ত্রী উচ্চশিক্ষিতা, নাম -ডাকঅলা ঘরের মেয়ে। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা যে একটা প্রহসন ছাড়া কিছুইনা, এটা শুধু আমি ছাড়া আর কেউ জানেনা। দুই দশকের নিখুঁত নাট্যমঞ্চ। বিয়েটা করতে হয়েছে কারণ এটাই প্রথা। না করলেই অযাচিত প্রশ্ন আর কৌতূহল। ভেতর থেকে কখনই ইচ্ছা না জাগা সত্ত্বেও তাই স্ত্রীর সাথে রাতের পর রাত শুয়েছি, বিছানার সাথে সাথে শরীরও ভাগাভাগি করতে হয়েছে। কখনোই আমি একঘেয়েমি ছাড়া কিছু অনুভব করিনি। ওর নগ্ন শরীর দেখে আমার কখনো ইরেকশন হয়নি। সন্দেহে এড়াতে তাই আমি চোখ বন্ধ করে নিজের অবচেতনে লুকিয়ে রাখা দৃশ্য কল্পনা করে শরীরে উত্তেজনা আনতাম। আমার শরীরের নিচে চাপা পড়ে আমার স্ত্রী গোঙাত। তা আমার কানে বাজেনি কখনো,ওর মুখের দিকে কখনো প্রকৃত ভালোবাসা নিয়ে কোনদিনও আমি তাকাইনি। চিত্রনাট্যের অংশ হিসেবেই মিলিত হবার সময় বলেছি ভালোবাসি। সেই ডাহা মিথ্যে ওর কানে সত্য হয়ে ঢুকেছে। সবাই বলে আমার স্ত্রী সুদর্শনা। মেকি কিছু বন্ধু বানিয়ে রেখেছিলাম মুখোশ টিকিয়ে রাখার স্বার্থে,তারা বলে আমার নাকি রাজকপাল, আমার স্ত্রীর ফিগারের মেয়ে পাওয়ার জন্য নাকি জীবন দিয়ে দেয়া যায়। আমি প্রত্যুত্তরে কিছু বলিনা। ওরা জানেনা জীবন দেয়ার ব্যাপারে আমার তেমন আগ্রহ ছিলোনা কখনোই। জীবন নিতেই আমার বেশী ভালো লাগে।
আদর্শ সন্তান হিসেবে পরিবারে এমনিতেই সব সন্দেহের বাইরে থাকতে পেরেছি। কিন্তু বিয়ের পর তার জন্য আমাকে অনেক খাটতে হয়েছে। পা ফেলতে হয়েছে আরো সতর্কভাবে।

ঐন্দ্রিলার জন্ম নেয়াটা তাই আমার কাছে একটা অলৌকিক বিষয়, অথচ অলৌকিকতায় আমার কোন বিশ্বাস নেই।

-আপনি হয়ত আমার কথায় এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন, আর যদি না বুঝে থাকেন তাহলে ভেঙে বলি, আমি একজন সিরিয়াল কিলার। যদিও এই উপাধিটা আমার পছন্দ না। কেননা আমার কাজটা মানুষকে শুধু ‘কিল’ করা না। দেখুন, চাইলেই যে কাউকে মেরে ফেলা যায়। মানুষ খুব দুর্বল প্রাণী। ঢোক গিলতে গিয়েও মরার রেকর্ড ইতিহাসে আছে, এমন কি হাসতে গিয়েও মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সো নো, আমি মানুষ মারিনা, আমি তাদের অমরত্ব দেই। আমার এই ঘটনা শিঘ্রি মিডিয়ায় আসবে, সবাই জানবে। ছি ছি করে মুখে ফেনা তুলবে। অথচ যারা সবচে বেশী আমার শাস্তি চাইবে তারাই মহাবিশ্বের সবচে বড় সিরিয়াল কিলারের উপাসনা করে যায় একাগ্র চিত্তে। ইশ্বরের চে বড় ক্রমিক খুনি কি কেউ আছে?

আমি টের পেলাম আমি দরদর করে ঘামছি। মনে হচ্ছে আমার সামনে পরাবাস্তব কিছু একটা ঘটছে। আমি যার কূল কিনারা পাচ্ছিনা। নিজেকে অবাক করে দিয়ে আমি লোকটাকে থামালাম না। বলে যাক।

-আমার ফুপাতো বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে আমরা সপরিবারে গিয়েছিলাম তাদের গ্রামের বাড়ি। তখন আমার বয়স এগারো। বাড়ী ভর্তি মেহমান । বাবার একমাত্র ভাগ্নির বিয়ে তাই আমার ফুপা-ফুপির চেয়েও বেশী ব্যাস্ততায় ছিলেন আমার বাবা-মা। দুদিনের জন্য আমার দেখভালের দায়িত্ব ছিলো এক চাচীর হাতে। কমবয়সী। নদীর ঢেউয়ের মতো আওয়াজ করে হাসতেন। হাসিটা মুখে আটকে থাকতোনা, শরীরে এসে নামত। আমাকে প্রথম দেখে তিনি আদর করে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আমি দেখতে ভালো ছিলাম, সবচে বুদ্ধিমান আর শান্ত ছিলাম। তাই অন্য বাচ্চদের চেয়ে বড়দের আদর বেশী পাওয়া একটা স্বাভাবিক বিষয় ছিলো। আমাকে সবাই হয় জড়িয়ে ধরতো,চুমু খেতো নয়ত গাল টেনে দিতো। আমার এগুলোতে কিছু আসতো যেতোনা। কিন্তু সিমরান চাচী সেদিন জড়িয়ে ধরার পড় তার বুকের হালকা ফুলেল ঘ্রাণ আর বগলের ঘামের সোঁদা ঘ্রাণ আমার সত্ত্বা নাড়িয়ে দিয়েছিলো। তার সাথে আমার কিছু একটা করতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু কি করতে মন চেয়েছিলো সেটা ওই মুহূর্তে বুঝতে পারিনি। পেরেছিলাম দুদিন বাদেই। রাতে। সবাই ঘুমিয়ে যাবার পর।

‘স্যার, একটু ঝামেলা অইয়া গ্যাসে! এমপি সাবের গাড়িতে ইডা মিইল্লা মারসে চরের পোলাফাইন!’-হন্তদন্ত হয়ে কন্সট্যাবল জব্বার ঘরে ঢুকল। আমার চেহারায় বোধয় কিছু একটা ছিলো তাই যতটা ব্যাস্ত ভাবে এসেছিলো তারচে অনেক বেশী থতমত খেয়ে গেলো।

আমার মাথায় আগুন ধরে গেলো। আমি বেশ জোর দিয়ে আসতে মানা করেছিলাম।

-পু*কি মারা বোঝো? চরের পোলাপান যদি এমপির গাড়ির পু*কিও মারে, তবু এই রুমে আমি ডাকার আগে ঢুকবানা! ভাগো এই মুহূর্তে! আর শোনো…শুধু এম্পির গাড়ির না…এম্পির পু*কি মারলেও এদিকে আসবানা! খবরদার!

আমার মেজাজ সম্পর্কে জব্বারের ভালো ধারণা আছে। কিন্তু তাই বলে হুট করে এমন কেনো করলাম সেটা ওর মাথায় ঢুকলোনা। ইতস্তত করতে করতে চলে গেলো মাফ-টাফ চেয়ে।

-আপনি কি জানেন কারো গলা প্রচণ্ড জোরে চেপে ধরলে কি হয়?
হয়ত বলবেন মরে যায়। উত্তর সেক্ষেত্রে একই সাথে সঠিক এবং ভুল। চেপে ধরার কারণে ব্রেইন অক্সিজেন পায় না। ফলে মানুষ মরার আগে প্রথমে জ্ঞান হারায়।
দশ সেকেন্ড গলা চেপে রাখলে সাধারণত কেউ মরেনা। শরীরটা সারভাইভাল স্টেটে চলে যায়। নির্জীব হয়ে পড়ে। কিন্তু মরে না! ঘাড় ভেঙ্গে না গেলে বেঁচে থাকার চান্সই বেশী থাকে। এই তথ্যটা আমাদের গল্পে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

টেনে দেয়া পর্দার আড়ালে জব্বারের অবয়ব সরে গেছে। আমি আমার সামনে বসা মালটার দিকে ভালোমত তাকালাম।
………………(চলবে)

পরের পর্বের লিঙ্ক
সবুজ প্রজাপতি (পরব-২)- দ্বিতীয় পর্ব

৩,৪৫৪ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “সবুজ প্রজাপতি (প্রথম পর্ব)”

  1. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    গল্প ভালোই এগুচ্ছে। তবে প্রথম বাক্যটা যথেষ্ট ক্লিশে মনে হয়েছে। গল্প-উপন্যাসে প্রথম বাক্যের গুরুত্ব কিন্তু অনেক।


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
    • আরিফুল হক শোয়েব (২০০২-২০০৮)

      এই ক্লিশেটা গল্পের পরের প্রেক্ষাপট তৈরিতে খুব জরুরী হয়ে দাঁড়াবে। চরিত্রটার জট খুলতে প্রথম দর্শনের গুরুত্ব সামনে আরো প্রকাশিত হবে। মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া।

      জবাব দিন
      • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

        সেটা না হয় মানা গেল, সবুরে মেওয়া ফলার অপেক্ষায় থাকলাম। কিন্তু, দু'বার কতৃকারকের ব্যবহার হবে কেন?

        লোকটা ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই আমার চোখে পড়লো বেশ সুদর্শন চেহারা লোকটার।

        লোকটা ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই বেশ সুদর্শন চেহারাটা আমার চোখে পড়লো। এমন লেখা যেত না কী?


        দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

        জবাব দিন
  2. সাইদুল (৭৬-৮২)

    তোমার লেখার আমি একজন মনোযোগৗ পাঠক, ইন্টারনেট সংযোগের অভাবে, ঠিকমত সিসিবিতে ঢোকা হচ্ছেনা, তবুও অপেক্ষায় আছি


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ১। দুইটি ঘটনাই (বিড়াল মারা এবং যা দিয়ে প্রথম পর্ব শেষ হল) কি লোকটির ১১ বছর বয়সে ঘটা?
    ঘটনা কি ঘটবে যেহেতু এখনো অজানা, তাই বেশি কিছু বলতে পারছি না। তবে, এক বছরের গ্যাপে হলে মনে হয় ভাল হত।

    ২। ১১ বছরের ছেলের মুখে ঐ রকম আক্রমণাত্মক ভাষা কেন যেন মানতে পারলাম না। বড্ড বেশিই কর্কশ!

    ৩। লোকটির বাবা যে এমপি এটা কেমন হঠাৎ করেই আসল। প্রথম দিকের শৈশবের বর্ণনা শুনে এটা ধারনাই করতে পারি নি...

    তোমার বর্ণনা খুবই আকর্ষণীয়। লেখার ভাষাও অনেক সাবলীল, ঝরঝরে।
    পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম!


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. আরিফুল হক শোয়েব (২০০২-২০০৮)

    ভাইয়া এমপির গাড়ির ঘটনা পুলিশ অফিসারের রুমে এসে কন্সট্যাবল বলছে। লোকটা তখন সামনে বসা। গালি দিয়েছে পুলিশ অফিসার। মানা করার পরেও রুমে ঢোকার কারণে। 🙂 🙂 🙂 🙂 অনেক ধন্যবাদ। পরের পর্ব লেখা হয়েছে। পাবলিশের অপেক্ষায় রয়েছে। (সম্পাদিত)

    জবাব দিন
  5. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    ক্রমশঃ তাড়িয়ে নিয়ে গেছে গল্প তার শব্দের স্রোত বেয়ে ।
    অনবদ্য । দারুনভাবে ফুটে উঠেছে সব দৃশ্যভাবনা ।
    শিউরে উঠবার মতোন ধারালো হয়েছে ।
    ( অন্য কারো কেমন লাগলো জানিনা । অন্তত আমার এমনটাই মনে হয়েছে ।)
    চোখে পড়েছে একটা টাইপো - "ধন্যাঢ্যতার" যা হবে "ধনাঢ্যতার" ।

    পরের পর্বে না জানি কি আছে !

    জবাব দিন
  6. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    :clap: :clap:

    বাংলায় মৌলিক সাইকো থ্রিলার কম পড়েছি, ভাইয়া! তোমার লেখা মন দিয়ে পড়ছি তাই। কিছুদিন আগে আ্যন্ডেজ পাহাড়ের রাক্ষসের রিয়েল লাইফ গল্প পড়েছি। মানুষের লুকিয়ে রাখা অন্ধকারের গল্প সবাই বলতে পারেনা, তুমি পারছো, ভাইয়া! শুরুটা চমৎকার বলতেই হবে। টানটান উত্তেজনা নিয়ে আমি অপেক্ষা করছি পরবর্তী পর্বের জন্য।

    জবাব দিন
  7. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    🙂 🙂 🙂 🙂

    কে যে কার অহংকার সেটি আর নাইবা বলি। তোমার লেখার হাত পাকা। অনেকদিন পর সিসিবিতে ভাল গল্প পড়ছি।
    সভ্যতার আগ্রাসনে ফুলেদের ঠাই হয়না। 🙁 🙁
    ছোট একটা মানুষ তুমি অথচ কী চমৎকার করেই না কথা বলতে পারো তুমি, ভাইয়া!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : হক (২০০২-২০০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।