অপেক্ষা

সেই আটটা পঞ্চাশ থেকে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছি, ক্ষিলখেত ওভার ব্রিজ এর একটু সামনে। পকেট থেকে মোবাইলটা আনমনে বের করে পর্দার দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলাম। নয়টা তিরিশ বাজে। হলোটা কি, এখনো আসছেন না! আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম অনেক দূর চলে এসেছি – লোটাস কামাল টাওয়ার এর পাশে। অনেক্ষণ অন্যমনস্ক ছিলাম, তাই খেয়াল করিনি।

দিনের এই সময়টাতে আমি সাধারণত অন্যমনস্ক থাকি না। যন্ত্রের পিঁ পিঁ পিঁ শব্দে সকালে ঘুম ভাঙ্গে, তার পর থেকে নিজেই যন্ত্র হয়ে যাই। (কলেজে ঘুম ভাঙত জানালার কাঁচে মোরশেদ ভাইয়ের চাবির রিঙের বারিতে)। নয়টার সময় যখন অফিস এ পৌঁছাই তখন প্রায়ই মনে হয় জীবনটা বোধকরি গণকমহাশয় এর অসীম চক্রের (infinite loop: গনক মিস্ত্রিদের কাছে এর মানে হল – একই কাজ, একই নিয়মে অনন্তকাল ধরে করে যাওয়া) মত কোন এক দুষ্ট চক্রে পরে গেল। ঘুম ভাঙার পর থেকে যান্ত্রিকতার এই দাপটে অন্যমনস্ক হ্হওয়ার সুযোগই থাকেনা। কিন্তু আজকের দিনটা অন্য দিনের মত নয়। নয়টা পেরিয়ে দশটা বাজতে চলল, আমি এখনো অফিসে পৌছাইনি।
আমি তাঁর জন্য অপেক্ষা করছি।

এভাবে যখন কারও জন্য অপেক্ষা করি, তখন পারতপক্ষে কিছু করার থাকেনা, আর সেই সুযোগে আনমনা হয়ে যাই। আজকে আনমনা হয়ে ভাবছিলাম – এই দেশটার কি হবে! দুই বছর আগে যা ছিল, তাই? যেই লাউ, সেই কদু, নাকি আরেকটু ভাল? ভাল হলে কতটুকু ভাল? ওইটুকুতে কি আমাদের চলবে? ইত্যাদি, ইত্যাদি….। ভাবনার মাঝে মাঝে বাসের সহযাত্রীদের টুকটাক কথাবার্তা কানে আসছে। সবার আলোচ্য বিষয় একই – এই দেশের কিচ্ছু হবেনা….. শেখ হাসিনা দেশে আসছেন, তাই বলে পুরো এয়ারপোর্ট রোড ব্লক করে রাখতে হবে? শুধু আমার বাস নয়, আমার সামনে পিছনে শত শত বাস, তাতে হাজার হাজার যাত্রী। আমার মত সবাই অপেক্ষা করছেন, তাঁর জন্য। তিনি কখন আসবেন, কখন সবার মুক্তি….

বাসের ভিতর কেউ আমার মত ঝিম মেরে বসে আছেন, কেউবা রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের নিয়ে নানাবিধ মুখরোচক মন্তব্য করে যাচ্ছেন। আমার পাশের ভদ্রলোক (মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র) মোবাইল টিপে কাকে যেন ফোন করলেনঃ
হ্যা, কি করতেছো?
………
এক কাজ করতো, টিভিটা একটু ছাড়, দেখ হাসিনা আফা কদ্দুর আইল।
………
আর কইওনা, দেড় ঘন্টা দইরা ক্ষিলখেত পইড়া আছি। আফা চইলা গেলে গাড়ি ছাড়বো।
………
হুমম, কি আর করুম, তাই ভাবলাম তোমারে ফোন দেই। (কথাবার্তা অন্য লাইনে চলে গেল)

পিছনে অন্য আরেকজনের মোবাইল বেজে উঠল। মনে হয় তাঁর পরিচিত কেউ এই দিকেই রওনা দিয়েছেন। তিনি চেঁচিয়ে বললেন “আরে মিঞা করছেন কি, তাড়াতাড়ি সি এন জি ছাইড়া বাসায় যান, টিভিতে যখন দেখবেন হাসিনা বাসায় গিয়া ফ্রেশ হইতাছে তখন আপনি বাইর হন”। এর মধ্যেই দুজন লেগে গেলেন – আওয়ামীলীগ না বিএনপি কারা বেশি খারাপ তাই নিয়ে। একজন বলছেন “শেখ হাসিনা আজকে ঢাকার ১২ টা বাজাবে”। উত্তর আসলো “আজ বারটা বাজলে যেদিন খালেদা জেল থাইকা বাইর ওইলো সেইদিন তেরটা বাজছিল”। জ্যামের কারণে এমনিতেই বিরক্তির চূড়ান্তে, তার উপর মতের অমিল – সুতরাং দুজনেরই গলার আওয়াজ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকল। গলা যতই বড় করুন, এরা দুজনেই আম জনতা। হয়তো সে কারণেই এদের আওয়াজ চাঁপা পড়ে গেল রাস্তার স্লোগানের শব্দে – “জয় বাংলা, জয় শেখ হাসিনা”। মনে হয় সেই মহেন্দ্রক্ষণ এল। ওপারের রাস্তায় বেশ সোরগোল লক্ষ করলাম। স্লোগান চলছে, ১৫/২০ টি বাইক চলে গেল, সাঁইরেন বাজছে। গাড়ির মিছিলে পুষ্পস্নাত রুপালী মারসিডিজটি চোখে পড়ল। অবশেষে আমার অপেক্ষা বুঝি শেষ হল।
সুমনের একটা গান মনে পড়লো।
হেলিকাপ্টার, হেলিকাপ্টার
নেতা আসছেন, নেতা আসছেন
পাখা ঘুরছে, পাখা ঘুরছে
নেতা ভাসছেন, নেতা ভাসছেন
আচ্ছা কবীর সুমনও কি আমার মতো এমন অবস্থায় পড়েছিলেন কখনো?
উনি আসছেন, আমি দেখছি, উনি হাসছেন, কর্মীরা দুলছেন, যাত্রীরা মাথার চুল ছিঁড়ছেন।

অফিসে পৌঁছতে দশটা চল্লিশ বেজে গেল। দেরি হয়ে গেছে, তাই কাজে বুঁদ হয়ে গেলাম। কাজের ভিতর একবার ঢুকে গেলে সাধারণত অন্য কিছু খেয়াল থাকেনা। কিন্তু আজকে অন্যরকম হল। বাসে বসে অপেক্ষা করার কথা মনে পড়ে গেল। হঠাৎ মনে হল আমি এখনো অপেক্ষা করছি। তবে রাস্তায় যাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলাম তাঁর জন্য নয়। একজন মহানয়কের জন্য। একজন মহান নেতার জন্য। তিনি কখন আসবেন, কখন সবার মুক্তি….

২,১৩৪ বার দেখা হয়েছে

২৬ টি মন্তব্য : “অপেক্ষা”

  1. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)
    নেতা আসছেন, নেতা আসছেন
    পাখা ঘুরছে, পাখা ঘুরছে
    নেতা ভাসছেন, নেতা ভাসছেন
    উনি আসছেন, আমি দেখছি, উনি হাসছেন, কর্মীরা দুলছেন, যাত্রীরা মাথার চুল ছিঁড়ছেন

    ভালো লিখেছ। সহমত


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  2. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    আফসোস হইলো আবার আমরা এইগুলারেই ভোটে জিতায়া আনুম :((

    একজন মহানয়কের জন্য। একজন মহান নেতার জন্য। তিনি কখন আসবেন, কখন সবার মুক্তি….

    একমাত্র উপরওয়ালাই জানে কবে আমাগো মুক্তি 😕

    লেখা ভালোইছে শোয়েব :boss:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  3. পলাশ (৯৪-০০)

    দোস্ত এত ভাল লিখতে পারস তুই আমি চিন্তাও করতে পারতেছিনা...পড়তাছিলাম আর চিন্তা করতেছিলাম যে এইডা শোয়েব লিখছে... চালায়া যা। পিচ্চি ২ টা রে ফোন দিতেছিলাম...আজকে জন্মদিন। তোর এইডা পড়তে গিয়া পুরা ভুইলা গেছিরে... :clap: :clap:

    জবাব দিন
  4. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    এ সময়ের কথা বললেন।
    নেতা আসার কোন লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না। তবে একদিন অবশ্যই দেখা যাবে। সেই দিনের অপেক্ষায় আমিও...
    তবে এটা মানি, নেতা আসলে গণতন্ত্রের মাধ্যমেই আসবে। তাই গণতন্ত্রের উত্তরণ কামনা করি।

    জবাব দিন
  5. টিটো রহমান (৯৪-০০)

    শোয়েব,
    অনেকদিন পর একটা ম্যাচিউরড লেখা পড়লাম। :salute:
    তোর মত আমরাও সবাই তার অপেক্ষায় আছি।বাড়তি যোগ হল তোর লেখা পাবার অপেক্ষা


    আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : শোয়েব (৯৪ - ০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।