সরি,বাবা

‘তুমি কি মানুষ? কি দায়িত্ব পালন করছ তুমি? যখন আমার পাশে তোমার সবচেয়ে বেশি দরকার , তখন তো তুমি আমার পাশে নাই। এই কসম করে কি বিয়ে করেছিলে?’

ফোনের ওপাশ থেকে আসা প্রচন্ড আক্রোশভরা কথাগুলো চুপ করে শুনলাম। কিছু বলার সুযোগ পচ্ছিলাম না। আমি জানি না কাল হাসরের ময়দানে যখন আমার গোনাহের পাল্লা ভারি হবে তখন আমি কেমন লজ্জিত হব বা তখন ঠিক কতটা বিবেকের দংশনে দংশিত হব, তবে সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল আমি যেন মারা যাচ্ছি। আমি যেন ঘৃনিত কোন এক কীট, যাকে পায়ের তলায় পিষে মেরে ফেলা উচিত। আমি কিছুই করি নি। কারন তখন আমি ছিলাম আমার স্ত্রীর থেকে হাজার মাইল দূরে। প্রলাপ বকার পর হয়তবা ঠিক দুমিনিট পর আমার স্ত্রী স্বাভাবিক হয়ে আসে। আমি তাকে সাহস দেই। তার বাবা মা আত্মীয় স্বজনের কথা বলি। স্বান্ত্বনা দেই নিজেকে “আগের রিপোর্ট অনুযায়ি যে ডেট দিয়েছিল সেভাবেই তো আমি ছুটির পরিকল্পনা করেছিলাম, হয়তো সব ভালয় ভালয় হয়ে যাবে।”

এর পর অপেক্ষার পালা আর একটি ফোনের জন্য। অবশেষে সেই ফোন এল। আমি বাবা হয়েছি। কি সুন্দর ফুটফুটে আমার সন্তান! আমার সন্তান ! আমার রক্ত, আমার মাংসের টুকরা থেকে তার এই পৃঠিবীতে আগমন। সে আমার সন্তান! আমি হতবাক, নিশ্চুপ। সন্তানের মাও ভাল আছে। ক্লান্ত, সুখমিশ্রিত তার কন্ঠস্বর! আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই।

জন্মের ঠিক ছয় দিন পর আমার ছেলের সাথে আমার দেখা।
আমি তাকে দেখলাম। না কোলে নেইনি। গোসল করলাম, পরিষ্কার হলাম। মনে পড়ল জীবনে তো এত ছোট বাচ্চা খুব একটা কোলে নেইনি। কিভাবে ধরব? যদি ঘাড়ে ব্যাথা পায়! যদি আমার কোলে এসেই কেঁদে ফেলে! কী সুন্দর নিষ্পাপ চেহারা! গোলাপী রঙ, পাখির পালকের মত তুলতুলে গা। নরম হাত-পা -এ কোথা থেকে এল !! ইয়া আল্লাহ এ কি তুমি আমার কোলে দিলে? আমার হাথ কেঁপে ওঠে। মানুষ কী আসলেই এত ছোট জন্মে! সত্যিই কি ! আমি পাথরের মত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার নড়াচড়ায় যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়! যদি কেঁদে ওঠে! আমার স্ত্রী আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। আমার মা কাছে এসে আমার কোলে আমার সন্তানকে ঠিক ঠাক করে দেয়। আর আমি অবাক হয়ে দেখি…আমার রক্ত, আমার মাংস আমার হাতে…

দরজায় কড়া নড়ে। আমার বাবা এসে দাঁড়ান আমার পাশে। আমি অবাক হয়ে তাকাই আমার বাবার দিকে। ভাবতে থাকি আমি যখন এভাবে প্রথম আমার বাবার কোলে গিয়েছিলাম তিনি কি ভেবেছিলেন? তিনি কি করেছিলেন? সেদিনকার হাজারো বিরক্তিকর কথা বলা আমার বাবা তার সেই দিন টিতে ঠিক কী করেছিলেন জানতে ইচ্ছে হয়। আমি কিছু বলতে পারি না। তাকিয়ে থাকি। আমার বাবা তার নাতিকে আদর করেন। তিন পুরুষের ফটোগ্রাফি হয়। শুরু হয় জীবনের এক অজানা অধ্যায়।

বাচ্চাকে রেখে আমি আবার কর্মস্থলে। একা। না সন্তান, না স্ত্রী, না পরিবারের অন্য কেউ। আমি দিন গুনতে থাকি। আরো একটা দিন গেল। কর্মব্যাস্ততায় দিন পার হয়ে যায়, তবে রাত যেন কত লম্বা ! রাতটা শেষ হতে চায়না যেন। ঘড়ি দেখি। সেকেন্ডের কাটাকে অনুসরন করে মিনিট, ঘন্টার কাটাও ঘুরে আসে। আমার মোবাইলে সেভ করা আমার সন্তানের সব ছবি একবার দেখা হয়। খানিক পরে আবার ভাবতে বসি হয়তো আমার ছেলে এখন ঘুমিয়ে, অথবা মায়ের কোলে শুয়ে অবাক পৃথিবী দেখে। রাতটা যেন কত শতাব্দি ধরে বয়ে চলেছে!
ল্যাপটপে নাটক দেখতে বসি। পিচ্চি বাচ্চাটা ব্যাথা পেলে ভাইবারে বউকে জিজ্ঞেস করি বাবু কী করে। অফিসিয়াল হাজারো ছবি আপলোড হতে দেখে মেজাজ খারাপ হয়। ইন্টারনেট স্পীডের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ফেলি আমার ছেলের ভিডিও দেখতে পারি না বলে। জানতে ইচ্ছে হয় এরকম হলে আমার বাবা কী করতেন। সেদিনের সবচেয়ে বিরক্তিকর মানুষটি আমার অবস্থায় কী করতেন এটা জানা যেন কত জরুরী! ফোনে বউ বল্লো “আজ বাবু খুব কাঁদছে, একদমই ঘুমাচ্ছে না। সামনে টিকা দিতে হবে। খুব কষ্ট হবে বাবুর।” শুনে আমি চঞ্চল হই। আমি অস্থির হই। অফিসিয়াল কাজে ঠিকমত মন বসাতে পারি না। খালি মনে হয় আমার এই অবস্থায় আমার বাবা থাকলে কী করতেন! সেদিনের সবচেয়ে রক্ষনশীল, আমার আবেগ বুঝতে ব্যর্থ আমার বাবা আজ আমার পরিস্থিতিতে কী করতেন জানা যেন কত জরুরি!
আমার ছেলের বয়স ৪২দিন, আর আমার ৩০বছর। আমি মাত্র ৪২ দিনের একটা শিশুর জন্য ছটফট করি, আমার মত এরকম শতশত পরিস্থিতে আমার বাবা কী করতেন জানতে খুব ইচ্ছে হয়!
“সরি বাবা। জীবনে অনেক বেয়াদবি করেছি। প্লিজ মাফ করে দিও।”

১,৬০৮ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “সরি,বাবা”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    শিবলী,
    কতদিন পর এলে বল ত?
    কি যে ভালো লাগছে তোমার খবরটা পেয়ে! অভিনন্দন এক লক্ষ! কী নাম দিয়েছো? একটা ছবি অন্তত দেয়া উচিত ছিলো। আর এক হাঁড়ি মিষ্টির ছবি। 🙂 🙂
    অনেক ভালো থেকো।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।