ইস্তানবুলের ডায়েরি

সময়কে যদি বহমান এক নদীর সাথে তুলনা করি তাহলে জীবনের ওই দুঃখগুলোকে বলতে হবে বহমান ওই নদীতে ভেসে থাকা ছোট ছোট কচুরিপানা। প্রবাসী জীবনের কেটে যাওয়া ৪ টি বছরে পরিকল্পনার ছকে এসেছে নানা রকমের পরিবর্তন আর জীবন পেয়েছে বাস্তবতাকে মুখোমুখি করে দেখার সুযোগ। পরিচিতি লাভ করেছে সেই সব সংগ্রামী মানুষের যারা হয়তবা ছোট ছোট স্বপ্ন বুকে বেঁধে পাড়ি দিয়েছিল মাতৃভূমিকে ছেড়ে হাজার হাজার মাইলের পথ…দেখেছিল রঙিন এক স্বপ্ন আর যাদের বুকের আশায় ছিল মাতৃভূমিতে ফেলে আসা আত্মীয় স্বজন ও মা বাবা…উন্নয়নশীল দেশের কিছু খেটে খাওয়া মানুষজনের সেই স্বপ্নগুলোকে আমি হয়তবা আমার ডায়রিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আবদ্ধ করতে পারব না কিন্তু হয়তবা আমি পরিচয় করিয়ে দিতে পারব তাদের আশা নিয়ে বেঁচে থাকার সেই সংগ্রামকে…

স্বভাবগতভাবেই আমি আজকের এই লেখার মূল চরিত্রটির একটি কাল্পনিক নাম ব্যাবহার করলাম। গল্পটি রফিককে নিয়েই লেখা। রফিকের সাথে আমার পরিচয় কাকতালীয়ভাবে…বসন্তের কোন এক পড়ন্ত বিকেলে ব্যস্ত ইস্তানবুল নগরীর ব্যস্ত জনপথে একাকী হেঁটে চলছিলাম আমি। কাঁধে বই খাতার সেই ঝোলা আর ছিল কপালের কোনে এক কিঞ্চিৎ রেখা। যার উদ্ভব ঘটেছিল সেইদিন দুপুর বেলার পরীক্ষার পর। স্বাভাবিকভাবেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশ থেকে আসার কারনে আমার গায়ের রঙটিও যেন ইস্তানবুলে কিছুটা বেমানানই ছিল। তামাটে বর্ণের এক যুবক, কাঁধে তার একটি ঝোলা আর কপালের সেই  কিঞ্চিৎ রেখা ইস্তানবুলের রাস্তায় হুইল চেয়ারে বসে পথ এগিয়ে চলা রফিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল…হয়তবা সে কারনেই রফিকের কণ্ঠ থেকে বের হয়ে এসেছিল ‘এই যে ভাই একটু দাঁড়াবেন’ নামক বাক্যটি। হটাৎ করেই অচেনা এক জনপদে বাঙ্গালী ভাষায় সম্বোধন শুনে আমার অচেতন মন আপনা আপনিতেই থমকে দাঁড়িয়েছিল আর  বলেছিল ‘জী, আমাকে বলছেন’…জানিনা কেন হটাৎ এভাবে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম কিন্তু উপলব্ধি করছিলাম মাতৃভাষার ব্যাবহার না করতে পারার সেই ব্যাকুলতাটাকে। দেখলাম আমার থেকে বেশ খানিকটা ব্যবধানে হুইল চেয়ারে করে আমার দিকেই আসছেন…কাছাকাছি এসেই বললেন ‘ভাই কিছু মনে করবেন না, দেখে আপনাকে বাঙ্গালী মনে হল তাই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না’। আমিও আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘আমি যে বাঙ্গালী এটি আপনি বুঝলেন কিভাবে…আমি তো ইন্ডিয়ান কিংবা পাকিস্তানিও হতে পারতাম’। আমাকে হতবাক করে দিয়ে রফিক বললেন ‘আমি কিন্তু আপনাকে বাংলাতেই ডেকেছি, আপনি যদি বাঙ্গালী না হতেন তাহলে এইভাবে থমকে দাঁড়াতেন না আর আর বলেতেন না যে, “জী আমাকে বলছেন”। ’ রফিকের এই বাকপটুতা আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করল…ফলাফল হিসাবে কথায় কথায় কাটিয়ে দিলাম আমরা প্রায় ১ ঘণ্টা… কাছে থেকে চেনার চেষ্টা করলাম এক সংগ্রামী মানুষকে…জানলাম বাঙ্গালীদের সেই রোমহর্ষক কিছু কাহিনী আর প্রায় ১৫ বছর আগে স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছেড়ে হাজার মাইল দূরে পাড়ি জমানো রফিকের কথা…

ঠিক ১৫ বছর আগে আর সবকটি বাঙ্গালী গৃহস্থ পরিবারে বেড়ে ওঠা যুবকদের মতই বিদেশের রঙ্গিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে বাঙ্গালী দালালদের হাতে জমি জমা বেচে টাকা তুলে দিয়েছিলেন বাবা হারানো রফিক…চোখে তখন তার গ্রীসে যাওয়ার রঙ্গিন স্বপ্ন। গ্রীস যাবেন, কাজ করবেন , টাকা কামাবেন আর মাকে টাকা পাঠাবেন এবং সময় সুযোগমত মাকে দেখতে আসবেন…জিজ্ঞাসা করছিলাম সারাজীবন কি বিদেশে থাকার কথা চিন্তা করেছিলেন নাকি। উত্তরে বলছিলেন যে মাত্র ৭ টি বছরের চিন্তা করে দেশ ছেড়ে ছিলেন। ইচ্ছা ছিল ২৭ বছর বয়সে টাকা পয়সা রোজগার করে দেশে ফিরবেন। নিজের মায়ের মুখে হাসি ফোটাবেন আর নিজের সংসার গুছাবেন। কিন্তু আজ সময়ের স্রোতে ১৫ টি বছর পেরিয়ে গেছে… টাকা পয়সার দেখা কিছুটা হয়ত পেয়েছেন কিন্তু সংসারের স্বপ্ন আর মায়ের মুখের হাসি এই দুটি যেন নিয়তির পরিহাস হয়ে রয়েছে তার জীবনে। দালালদের হাত ধরে বাংলাদেশ ছেড়ে ইউরোপের গেট বলে পরিচিত তুরস্কতে তার আগমন।ইস্তানবুলের বিমান বন্দরের কেচ্ছা কাহিনী শেষে এক ৫ তালা বিল্ডিং এ মাথা গোঁজার ঠাই মেলে তার। পকেটে রয়েছে কিছু বিদেশী মুদ্রা আর বাসায় রয়েছে তাঁরই মত স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছাড়া আরও কিছু বাঙ্গালী। সময়টা ছিল শীতকাল। চারপাশে ছিল সাদা শুভ্রের ছোঁয়া। নতুন জায়গা আর সাদা শুভ্রের মোহে দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছিল দুটি দিন। কথায় কথায় ভালো খাতির হয়েছিল আরিফ আর শাহীনের সাথে। হটাৎ করেই তৃতীয় দিনে দুপুরে খবর আসলো আজ রাতে সবাইকে গ্রীস নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু যাওয়ার ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতির কথাটি বর্ণনা করেছিল দালালেরা টা দেখে খুব সহজ মনে হলেও বেশ কিছুটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল।কথা ছিল দালালেরা তাদেরকে নিয়ে গিয়ে একটি জায়গায় নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে গ্রীস দৌড়িয়ে ১৫ মিনিটের পথ।এখানে বলে রাখি যেখানে দালালেরা তাদের নামিয়ে দেবেন সেটা একটি কোন স্থলপথ নয়। বরং ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া একটি জলপথ… যেখানে বরফ প্রায় হাঁটু পর্যন্ত পুরু। দুপুর গড়িয়ে এল রাত। এল সেই অপেক্ষার অবসানের পালা। রাত তখন ১০ টা। একটি কাল মাইক্রোবাসে করে দালালদের সাথে রউনা হলেন রফিক এবং তাঁরই মত গ্রীস পথযাত্রী আরও কয়েকজন। ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২ টা ৩০ মিনিটে সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এসে থামল কাল মাইক্রবাসটি। দালালদের একজন সব কিছু ভালো মতন নজর করে রফিক সহ বাকি সবাইকে নামিয়ে দূরে সীমানা দেখিয়ে বললেন যে ‘হাতে সময় কম…অই যে গ্রীস দেখা যায়। যাও গিয়া…’। বলেই দালাল তার মাইক্রবাসটি নিয়ে পগারপার। এদিকে স্বপ্নকে সফল করার আশায় দৌড় শুরু করলেন রফিক এবং তার সহযাত্রীগণ। কিন্তু ইতিমধ্যেই সীমান্ত পুলিশ খবর পেয়ে গাড়ি নিয়ে রউনা দিয়েছে। তাদের সাইরেনের শব্দ কানে আসছিল রফিকের… আর মাত্র কয়েকটা মিনিট। তাহলেই গ্রীস। স্বপ্নের দেশে পৌঁছে যাবেন তিনি। কিন্তু নিয়তি তার স্বপ্নকে ছিনিয়ে নিল। রঙ্গিন স্বপ্নের বুকে ছুঁড়ে দিল কাল কালির নির্মম ছোরাটাকে। রফিক দৌড়চ্ছেন…সামনে গ্রীস… কিন্তু হটাৎ  করেই পা দিয়ে ফেললেন একটু কম জমে যাওয়া এক বরফের উপরে…যার মাশুল তিনি আজও বয়ে বেরাচ্ছেন… মোটা বরফের চাইয়ের ভিতরে হাঁটু পর্যন্ত আটকা পড়ে গেল রফিকের পা…নিজের অজান্তেই হয়তবা তার মুখ দিয়ে চিৎকার বেরিয়ে এসেছিল… সেই চিৎকারে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছিল আরিফ আর শাহীন। একেতো হাতে সময় কম তার উপর এত পুরু বরফ… মেশিন দিয়ে না কাটলে কিংবা খুব সতর্কতার সাথে কাজ না করলে এই বরফের হাত থেকে রফিককে উদ্ধার করা কঠিন …কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে…একদিকে সীমান্ত পুলিশ আর একদিকে সময় স্বল্পতা। কিছু না বুঝেই হয়তবা আরিফ আর শাহীন রফিককে টানা শুরু করল। কিন্তু গাড়ল বরফের সাথে কি আর পারে তারা…এদিকে রফিকও তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে আরও জোরে টান… ততক্ষণে সীমান্ত পুলিশ কাছাকাছি প্রায়…আরিফ আর শাহীন বলল যে পুলিশ চলে আসতেছে আমরা যাব কিভাবে…রফিক বলল শেষবারের মত এক চেষ্টা করে দেখ।এবার তারা টানতেই লাগলো রফিকও মুখ দিয়ে এবার আর কোন শব্দ করল না…কিন্তু যখন শব্দ খানা বের হল ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে…আরিফ আর শাহীন দৌড়ে পালিয়েছে গ্রীসের জঙ্গলে আর রফিক হারিয়েছে তার ডান পা টাকে…গ্রীস স্বপ্নে বিভোর রফিক পড়ে রইল বরফের সাথে আর তার সহযোগীরা চলে গেল গ্রীসে…রেখে গেল এক পঙ্গু রফিককে…সীমান্ত পুলিশ পরবর্তীতে রফিককে উদ্ধার করে তার চিকিৎসা করায় এবং তার কাহিনী শুনে তাঁকে এদেশে থাকার বন্দবস্ত করে দেয়… হয়ত আজ রফিক তার টাকার দেখা কিছুটা পেয়েছে কিন্তু যে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে আজও রফিক তাকে জোড়া দিতে পারেনি…আজ মায়ের মুখে হাসির পরিবর্তে রফিক এক করুন ছায়ার দুঃস্বপ্ন দেখে…সুস্থ স্বাভাবিক সেই হেসে খেলা দিনগুলিকে চিন্তা করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মাঝে মাঝে…কথা গুলো রফিক যখন বলছিল আমি তার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না…কিন্তু রফিক দমে যাবার পাত্র নয়…বাঙ্গালি মায়ের সন্তান… দুঃখকে ভুলে অচেনা গন্তব্যকে জয় করার আশায় বুক বেঁধে চলে…আর তাইতো সময়ের সাথে সাথে ১৫ টি বছর পরেও আজও এক সংগ্রামী রফিককে আমার দেখা হল…জানা হল বোঝা হল বাঙ্গালী দমে যাবার পাত্র নয়… শিখলাম বাস্তবতাকে জানলাম সংগ্রামী এক বাঙ্গালী রফিকের কথা…

১,৮১৪ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “ইস্তানবুলের ডায়েরি”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    মন ছুঁয়ে গেল তোমার লেখা। নিয়মিত লিখতে থাক।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।