মন্দায় সব কিছুই মন্দ

এর নাম হচ্ছে যৌক্তিক প্রত্যাশা। এই যৌক্তিক প্রত্যাশার তত্ত্ব দিয়েই ১৯৯৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন রবার্ট এমারসন লুকাস জুনিয়র। লুকাসকে বলা হয় সেরা ১০ অর্থনীতিবিদদের একজন। তিনি যদি সেরাদের অন্যতম হন তাহলে তার প্রাক্তন স্ত্রী কী?
রিটা লুকাসের সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয় ১৯৮৮ সালে। তালাকনামায় একটা শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন রিটা। যদি রবার্ট লুকাস পরের সাত বছরের মধ্যে নোবেল পান তাহলে পুরস্কার মূল্যের অর্ধেক প্রাক্তন স্ত্রীকে দিয়ে দিতে হবে। রবার্ট লুকাস নোবেল পান ১৯৯৫ সালে। ঠিক সাত বছরের মাথায়। অর্থনীতিবিদ স্বামীর সাথে থেকে স্ত্রী রিটা খানিকটা অর্থনীতি যে শিখেছিলেন তা বলাই বাহুল্য।
অথচ বছরের পর বছর ধরে যারা অর্থনীতির মধ্যে রইলেন, তারাই ভাল করে শিখলেন না অর্থনীতি। ফলে অসংখ্য ভুল নীতির কারণে বড় ধরণের মন্দায় আক্রান্ত হয়ে গেল সারা বিশ্ব। আর শুরুটা হলো সেরা অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। জানেন তো যে, আমেরিকানরা নতুন ধরণের এক মারণাস্ত্র আবিস্কার করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকার সময়ের সেই আনবিক বোমার চেয়েও ভয়াবহ। এই অস্ত্রের আঘাতে মানুষ একটিও বাঁচে না, কিন্তু ভবনের কোনো তিই হয় না। আর এই অস্ত্রটার নাম হচ্ছে শেয়ার বাজার।
রিটা লুকাসের কাহিনী পড়ে এই সময়ের এক বিনিয়োগ ব্যাংকার কি বলেছেন জানেন তো? বলেছেন, বিশ্বমন্দা স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পরিস্থিতি থেকেও খারাপ। স্ত্রীকে তালাক দিলে সম্পদের অর্ধেক দিয়ে দিতে হয় ঠিকই, কিন্তু বউয়ের হাত থেকে তো বাঁচা যায়। আর এখন সম্পদের অর্ধেক চলে যাচ্ছে, আবার বিরক্তিকর বউও ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে এ কথা কেন? এই বিনিয়োগ ব্যাংকারের স্ত্রী একদিন হঠাৎ করে স্বামীর অফিসে হাজির। গিয়ে দেখে সুন্দরী প্রাইভেট সেক্রেটারিকে কোলে নিয়ে অফিস করছে তার স্বামী। ব্যাংকার হিসেবে যতই খারাপ হোক, স্ত্রী ব্যবস্থাপনায় সে মোটেই খারাপ না। লাফ দিয়ে উঠে বলতে লাগলো, ‘যতই মন্দা হোক, যতই ব্যয় সংকোচন হোক। এক চেয়ারে দুজন মিলে কিছুতেই অফিসের কাজ করা সম্ভব না।’
এই বিনিয়োগ ব্যাংকারের আর দোষ কি? ধনী দেশগুলোতে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, এখন সবচেয়ে সস্তা হয়ে গেছে বিনিয়োগ ব্যাংক কেনা। তাও আবার একটা কিনলে আরেকটা নাকি ফ্রি পাওয়া যাচ্ছে। এতে সস্তা কেন? তাহলে এক লাইনের এই প্রশ্নোত্তরের গল্পটা বলি। বিনিয়োগ ব্যাংক এবং বড় আকারের পিৎজা মধ্যে পার্থক্য কী? উত্তর হচ্ছে একটা বড় আকারের পিৎজা অন্তত চারজনের একটা পরিবারের এক বেলা খাবারের জোগান দিতে পারে। বিনিয়োগ ব্যাংক এখন তাও পারছে না।
সবচেয়ে দুরাবস্থা এখন এই সব বিনিয়োগ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের। এতদিন লাখ লাখ ডলার বেতন নিয়েছেন। অথচ দেউলিয়া হয়ে গেছে এসব ব্যাংক। এরকম এক দেউলিয়া ব্যাংকের দেউলিয়া প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে বসলেন। হুমকি দিয়ে বললেন, কিছু আর্থিক সহায়তা না পেলে পেট্রোল ঢেলে আÍহত্যা করবেন। সহায়তার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন অনেকেই। সর্বশেষ তথ্য হচ্ছে ৪০ গ্যালন পেট্রোল জমা হয়েছে। আরও পেট্রোল আসছে। তাঁর বাড়ির সামনে নাকি লম্বা লাইন।
এইরকম এক অবস্থায় সবগুলো সরকার হাজার হাজার কোটি অর্থ নিয়ে পুনরুদ্ধার বা বেইল আউট পরিকল্পনা নিয়া মাঠে নামছে। তাতে কতখানি লাভবান হওয়া যাবে সেই সংশয় সবাই করছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাম ওবামার সমস্যা অবশ্য সবচেয়ে বেশি। মার্কিন সরকার চাচ্ছে দেশের মানুষ ব্যয় করুক। খরচ করতে থাকলেই নাকি অর্থনীতি সচল থাকবে। সমস্যা হচ্ছে ব্যয় করলে শেষ পর্যন্ত লাভবান কে হবে?
১. যদি ওয়াল-মার্টে গিয়ে একজন মার্কিন নাগরিক শার্ট কেনে তাহলে সেই অর্থ আসলে যাবে চীন, ভিয়েতনাম বা বাংলাদেশে।
২. যদি গাড়ি ভর্তি তেল নিয়ে ঘুরতে বের হয় তাহলে সেই টাকা বা ডলার যাবে আরব দেশগুলোতে।
৩. কম্পিউটার কিনলে অর্থ যাবে ভারতে
৪. আর যদি ফলমূল বা তরিতরকারি কেনে তাহলে ডলার চলে যাবে মেক্সিকো, হন্ডুরাস এবং গুয়াতেমালায়।
৫. এসব বাদ দিয়ে ভাল একটা গাড়ি কিনলে সে অর্থও চলে যাবে জাপানে।
৬. আর যদি ব্যবহার অযোগ্য কিছু কেনে তাহলে অর্থ চলে যাবে তাইওয়ানে!
এই যদি অবস্থা হয় তাহলে আমেরিকার কি হবে? অনেক গবেষণা করে মার্কিন অর্থনীতিবিদরা নাকি বের করেছেন, দেশটির নাগরিকরা যদি কেবল বিয়ার আর সিগারেট কেনে তাহলেই মার্কিণ অর্থনীতি লাভবান হবে। কেননা এই দুইটি ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর কিছুই নাকি উৎপাদন করে না।
আমেরিকার যাই হোক, তারা খরচ করুক, ওয়াল-মার্টে বেশি বেশি যাক। তাহলে লাভ বাংলাদেশেরই। এই আশায় বসে আছে অনেকেই। কেননা বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা বা বেইল আউট কর্মসূচী করা সহজ নয়। বিশ্বমন্দা কেটে যাবে এটাই এখন সবার যৌক্তিক প্রত্যাশা।

(এই লেখার সংক্ষিপ্ত রুপ আজ ছাপা হয়েছে প্রথম আলোর রসআলোতে। এখানে পুরাটা দিলাম। এটা কেবলই রম্য। অন্য কিছু না)

২,৮১৫ বার দেখা হয়েছে

৪০ টি মন্তব্য : “মন্দায় সব কিছুই মন্দ”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    রস আলোতে পড়েই মজা পেয়েছিলাম, বুঝি নাই ঐটা আপনার লেখা 😛 এখানে পুরাটা পড়ে আরো বেশি মজা পেলাম :boss: :boss:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
    ‘যতই মন্দা হোক, যতই ব্যয় সংকোচন হোক। এক চেয়ারে দুজন মিলে কিছুতেই অফিসের কাজ করা সম্ভব না।

    :khekz: :khekz: :pira:

    শওকত ভাই, জট্টিল লিখছেন :boss: :boss:

    আমেরিকা এখন নিজেদের চালু করা 'মুক্তবাজার' অর্থনীতির মাইনক্যা চিপায় পড়ছে। মন্দা কাটানোর একটাই উপায় জানা আছে, বেশি বেশি করে অর্থ ব্যয় করা। কিন্তু বাজার ত পুরাই মুক্ত! কাজেই ১৯৩০এর দশকে (আমেরিকার protectionist economy-তে) New Deal এর মাধ্যমে যেভাবে অর্থের ব্যয়>সার্কুলেশন বাড়িয়ে মন্দা রোধ করেছিল, এইবার আর সেটা করার উপায় নাই।

    মুক্তবাজার অর্থনীতির ফাঁদে ফেলে আমেরিকা এতোদিন বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলার 'ইয়ে' মেরেছে, এখন সেই ফাঁদে পড়েই নিজেরটাও... :)) :)) :))


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  3. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    যাউগ্যা, আমি বিনিয়োগ ব্যাংকার না, আবার নোবেল লরিয়েটও না!! আমি কিছুই পাবো না বা হারাবো না। কারণ আমার আসলে কিছুই নেই। এমনকি নেংটিটাও!! 😉 😉 😉


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  4. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    মন্দার প্রভাব প্রেমের বাজারেও পড়ছে।
    ইদানীং গার্ল ফ্রেন্ডের খুব আকাল যাচ্ছে !! 😉


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  5. সামি হক (৯০-৯৬)

    এমনিতেই চাকুরী পাওয়া কঠিন ছিল এখন এই মন্দার ঠেলায় আরো কঠিন। এরকম আর কিছুদিন চললে তো দেশে ফিরা লাগবে। বাংলাদেশে এখনো যদিও সেইভাবে ঠেলা লাগে নাই কিন্তু আর কিছুদিন পর বাংলাদেশেও লাগবে। সামার এসে গেলো তাও মানুষ কাপড় জামা কিনে না, বাংলাদেশ তাইলে যাবে কই? আর সোয়াইন ফ্লুএর ঠেলায় এইবার সামারেতো মানুষ মনে হয় বেড়াতেও যাবে না 🙁 , আরো এক ঠেলা। আমাদের ঘোরতর দুর্দিন আসতেছে।

    শওকত ভাই আপনার লিখা পড়ে ভালো লাগল। কিন্তু মন্দার জন্যে মন খুলে হাসতে পারতেছি না।

    জবাব দিন
  6. তারেক (৯৪ - ০০)

    লেখাটা চ্রম।
    এখানে আমার পরিচিত কয়েক্জন মন্দার কবলে পড়ে চাকরি খুইয়েছেন। কয়েকজন নতুন চাকরি ম্যানেজ করতে পারছেন না। টিভিতে সেদিন দেখালো কোন একটা কোম্পানীর এডমিন পোস্টে থাকা ভদ্রলোক চাকরি হারিয়ে এখন কার-ওয়াশ করা ধরেছেন, ঘন্টায় ১৪ ডলার বেতনে।
    এইসব দেখলে বড় ভয় লাগে।


    www.tareqnurulhasan.com

    জবাব দিন
  7. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    ভাইয়া, রস-আলোর নামটা তো মনে হয় দেখেছিলাম অন্য নাম দেখছিলাম, ওইটা কি আপনার ছদ্দ নাম নাকি?

    অফঃ ভাইয়া অনেক অনেক দিন আগে একটা মেইল করেছিলাম, মন্দার ঠেলায় আবার ভুইল্লা গেছেন কিনা এইটা নিয়া ব্যপাক টেনশিত আছি 🙁

    "ভুলেন নাই" এইটা যদি একটু বলতেন।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  8. ফাহিম (৯৯-০৫)

    মন্দার কারণে চাকুরি ক্ষেত্রে যে মন্দন দেখা দিয়েছে তা দেখে ছাত্র জীবন দীর্ঘায়িত করার কোন বিকল্প খুজে পাচ্ছি না। :bash: :bash:
    কবে আমরা আবার গতি ফিরে পাব কেউ কি বলতে পারেন? কোন অনুমান?? 😕 😕

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জাহিদ (১৯৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।