মাননীয় অর্থমন্ত্রী, আইএমএফকে না বলুন

imf-trapping-countries-in-debt
১.
২০০৪-০৫ অর্থবছরের বাজেট দেওয়ার সময় পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ছিলেন শওকত আজিজ। শওকত আজিজ তার বাজেট বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে বাজেটের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) ‘গুড বাই’ জানানোর মধ্য দিয়ে বাজেটে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।’ বক্তৃতায়ই এর কারণ হিসেবে তিনি দারিদ্র বিমোচন প্রবৃদ্ধি সুবিধার (পিআরজিএফ) আওতায় ঋণ কর্মসূচি থেকে তারা বের হয়ে আসতে পারার কথা বলেছিলেন।
২.
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ একদমই পছন্দ করতো না। তাঁদের পছন্দের মানুষ ছিল এম সাইফুর রহমান। মনে আছে, গত জোট সরকারের শুরুতে অর্থমন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে আমীর খসরু মাহমুদকে অর্থমন্ত্রী করার একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। একজন সাংবাদিক হিসেবে দেখেছি বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তাযুক্ত কপালের ভাঁজ। তারা চাননি অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সাইফুর রহমান চলে যাক। কারণ সাইফুর রহমান দাতাদের সব কথাই শুনতেন। আর এস এ এম এস কিবরিয়া ৫ বছরে আইএমএফ থেকে একটা ডলারও ঋণ নেননি। এর পরিবর্তে তিনি শেষ দিকে এসে রিজার্ভ বাড়াতে স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যদিও তিনি দাতাদের চাপিয়ে দেওয়া পিআরএসপি মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভারতের মতো বলতে পারেননি যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা আছে, এটা মানলে মানো, তা না হলে চলে যাও।
৩.
অনেক খোঁজাখুজি করেও আইএমএফের সাফল্য তেমন কিছু পাওয়া গেল না। সর্বশেষ ব্যর্থতা হচ্ছে বিশ্বমন্দাকে বুঝতে না পারা। বরং তারা বলেছিল, মন্দা হলেও তা হবে নিয়ন্ত্রণসাধ্য। ১৯৯৭-৯৮ সালের পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক সমস্যার সামাধানেও আইএমএফ ছিল চরম ব্যর্থ। আর ব্যর্থতার চরম উদাহরণ হচ্ছে আর্জেন্টিনা ও কেনিয়া। আইএমএফের নীতি মেনে এই দুটি দেশ চরম বিপদে পড়েছিল। উইকিপিডিয়ায় ঢুকলে খুব ভাল একটা পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে। আর সেটি হচ্ছে সামরিক একনায়কতন্ত্রের প্রতি তাদের পপাত। সামরিক একনায়কতন্ত্র থাকলেই তাদের ঋণ দেওয়ার পরিমান বেড়ে যায়।
৪.
আইএমএফ সম্বন্ধে জানতে হলে পড়তে পারেন জোসেফ স্টিগলিজের ‘গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ডিজকন্টেন্ট’ বইটি। তিনি একবার ঢাকায় এসেছিলেন। শুনতে গিয়েছিলাম তার বক্তৃতা। তীব্র সমালোচনা করেছিলেন আইএমএফের কর্মপদ্ধতির।
আমি একটু ব্যাখ্যা দেই। আইএমএফ বাংলাদেশ কার্যালয় হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটা অংশ তারা দখল করে রেখেছে। একজন কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ থাকেন। আর হাতে গোনা কয়েকজন সহাকারী। স্থায়ী কর্মকর্তা বলতে তাদের আর কেউ নেই। অথচ এই কার্যালয় থেকেই ঠিক হয় বাংলাদেশের মুদ্রা নীতি। মুদ্রা সরবরাহ কত হবে, বাজেট ঘাটতি কত শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে, রাজস্ব নীতি কি হবে-মোটামুটি সব কিছুই ঠিক করে দেয় তারা। কিভাবে তারা ঠিক করে? বছরে আইএমএফের একটা মিশন আসে ওয়াশিংটন থেকে বাজেটের আগে। নেতৃত্বে থাকেন মধ্যম পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা। তারা ২ সপ্তাহ ঢাকায় থাকে, বিভিন্ন মন্ত্রী ও সচিবের সাথে বৈঠক করে আর ওয়াশিংটন ফিরে গিয়ে লম্বা একটা রিপোর্ট দেয়। আর সেখানেই বলা থাকে কী করতে হবে, কী করা যাবে না। মাত্র ২ সপ্তাহে ঠিক হয় বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি। আর ঠিক করে দেয় কয়েকজন দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মকর্তা।
৫.
সামিষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলার এখন একচেটিয়া অধিকার আইএমএফের। এটাই দাতাদের মধ্যে বোঝাপড়া। অর্থাৎ সামষ্টিক অর্থনীতির নীতি নিয়ে কথা বলবে একমাত্র আইএমএফ এবং আর বিশ্বব্যাংক, এডিবি সহ সবাই এটা মেনে নেবে। এটা একটা বড় ফাঁদ। এই ফাঁদে পা দিতে হচ্ছে অনেককেই। কেননা, আইএমএফের কথা মেনে না চললে অন্যরা ঋণ সহায়তা দেবে না। ফলে বাধ্য হয়ে অনেককেই আইএমএফের ঋণ নিতে হচ্ছে। অর্থাৎ একটা দেশ ঋণ পাওয়ার যোগ্য কীনা নেই সার্টিফিকেট দেয় আইএমএফ, আর বাকিরা তা মেনে নেয়।
৬.
আবার আসছে আইএমএফের ফাঁদ। এবারের ফাঁদের নাম বিশ্বমন্দা। জি-২০ বৈঠকে আইএমএফের জন্য এক ট্রিলিয়ন ডলারের একটা তহবিল গঠনের কথা বলা হয়েছে, এখান থেকে ঋণ দেওয়া হবে তিগ্রস্ত দেশগুলোকে।
আমাদের মন্ত্রী ও আমলাদেরও চোখে লোভের লালসা ফুটে উঠেছে। মনে হচ্ছে আবারো বাংলাদেশ আইএমএফের খপ্পরে পড়তে যাচ্ছে। আইএমএফের ঋণ মানেই তাদের কথা অনুযায়ী নীতি তৈরি করা। আইএমএফ একবারে সব অর্থ দেওয়া না। একটা কিস্তি দেয়, তারপর দেখে কথা শোনা হচ্ছে কিনা। অর্থমন্ত্রীর আনুগত্যে সস্তুষ্ট হলে দ্বিতীয় কিস্তি। শেষ পিআরজিএফ ঋণ ছিল সাত কিস্তির।
অর্থমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ, দয়া করে নিজের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব হারাবেন না। অর্থনৈতিক নীতি আপনিই নিন, আইএমএফকে এ থেকে দূরে রাখুন। ভারত বলেছে, তারা আইএমএফের ঋণ নেবে না। আরও বড় সংকটে থাকা শ্রীলংকাও একই কথা বলেছে। তাহলে আমরা বলতে পারবো না কেন?
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলামের একটি কথা মনে করিয়ে দেই। ‘আমরা যখন বলি সবকিছু দাতানির্ভর হয়ে গেছে তার মানে এই নয় যে, দাতারা অনেক বেশি মতা অর্জন করেছে। বরং আমাদের দেউলিয়াত্বের জন্যই এমনটি ঘটেছে।’

১,৫২৭ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “মাননীয় অর্থমন্ত্রী, আইএমএফকে না বলুন”

  1. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    মুহিত কে কেনো জানি সেরকম বুকের পাটার মনে হচ্ছেনা 🙁 বুঝতেছিনা, এইরকম কেনো মনে হচ্ছে।
    আই এম এফ সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম।
    শওকত ভাই, দৃশ্যত তো সাফল্য নেইই, কাগজে কলমেও এরকম দুর্বৃত্তপনার ব্যাপক প্রমাণাদি থাকার পরও শুধুমাত্র নিজেদের দেউলিয়াত্বই কি আমাদের এদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে? নাকি অপারগতা টাইপ অন্য কোন কারণ আছে? মানে আমি বলতে চাচ্ছিলাম ব্যক্তির ইচ্ছাতেই কি আমরা বার বার এদের মুখে পড়ে যাচ্ছি? পেছনে কি আরো কোন কিন্তু আছে? এদেরকে নিয়ে আরো বিশদ কিছু লিখবেনকি বস্‌ ?


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  2. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    খুবই প্রয়োজনীয় এবং সময়োপযোগী পোষ্ট। শওকত ভাইকে :salute:

    আইএমএফ/বিশ্বব্যাংক/এডিবি'র "ঋণ-সহায়তা" কি জিনিস তা বাস্তবে বোঝার জন্য খুব বেশি কষ্ট করা লাগেনা আসলে। দেশেই যেকোন গ্রামে গিয়ে (অথবা না গিয়েও) যেকোন মাইক্রোক্রেডিট গ্রহীতার অভিজ্ঞতা শুনলেই এই বিষয়টা স্পষ্ট হবে। দুটো একই জিনিস, পার্থক্য শুধু পরিসরে।

    এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোনদেশ এইসব সংস্থার ঋণ নিয়ে 'ক্ষতি ছাড়া লাভের মুখ দেখেছে' এমন নজীর একটাও নেই। :grr: :thumbdown: সেই কারনেই, প্রকৃতপক্ষে যারা নিজ দেশের কথা ভাবে (বা ভাবতে বাধ্য হয়) তাদের পক্ষে এইসব ঋণ নেওয়া সম্ভব নয়। আর তাই এইসব সংস্থা একনায়ক পছন্দ করে বেশি। কারন, একনায়কের ত দেশের প্রতি (আসলে জনগনের প্রতি) দায়বদ্ধতা কম। সে শুধু বোঝে টাকা, তা সে যেভাবেই আসুক তার হাতে (কপিরাইটঃ আমাদের লেজেহোমো চাচা)।

    এইসব ঋণ-সহায়তা আসলেই যে খারাপ তা বোঝার আরেকটা উপায় হল- এখানে লক্ষ্যনীয় যে, কেউ আগ্রহী হয়ে তাদের কাছে ঋণের আবেদন করে না। তারা নানা কায়দায় গ্রহীতাকে বাধ্য করে ঋণ নিতে। এটাও আবার মাইক্রোক্রেডিটের মধ্যে দেখা যায়। এই ঋণ যদি আসলেই গরীবের উপকার করতো, তাহলে ত গ্রামীন ব্যাংকের (এবং এই মডেলের যাবতীয় ঋণদাতা এনজিও/সংস্থা) প্রত্যেকটা শাখার সামনে প্রতিদিন, সারাদিন ঋণ-আবেদনকারীদের লাইন পড়ে থাকত। তা না হয়ে, এখনো লাইন পড়ে সরকারী ব্যাংকের সামনে, আর গ্রামীন ব্যাংকের মাঠকর্মীরা সারা মাস জুড়ে বাড়ী বাড়ী গিয়ে লোকজনকে মোটিভেইট করে তাদের ঋণ নেওয়ার জন্য। কেন?- এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে আসল ঋণ-গ্রহীতার কাছে থেকে, এসিরুমে বসে যে কন্সালটেন্সী/তথ্য-বিশ্লেষণ/স্বপ্ন-বিতরন করে তার কাছে থেকে নয়।

    উন্নয়ন-বিষয়ক জ্ঞানের ডিসকোর্সে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক-এডিবি এরা নানা ভাবে ঋণকে উন্নয়নের পূর্বশত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে, কোনপ্রকার বাস্তবভিত্তিক প্রমান ছাড়াই। কিভাবে তারা এটা করছে সেই প্রকৃয়ার একটা দারুন পর্যালোনচা হচ্ছে মাইকেল গোল্ডম্যানের Imperial Nature. ইচ্ছে থাকল কোন এক সময় এই বিষয়ে লিখার।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  3. জাহিদ (১৯৮৯-৯৫)

    শওকত ভাই,

    যথারীতি অসাধারণ লেখা!

    ঋণ দিয়ে চিরঋণী করার ব্যবস্থা। মেরুদন্ড ভাঙ্গার ব্যবস্থা।

    আগে ভাবতাম, মানুষের জমানো টাকা ব্যাংক আমাদের ধার দিয়ে সুদ নেয়। এখন নাকি আমার ধারের টাকা তারা তৈরী করে আমাকে দেয় আর সুদ নেয়। এমনকি দেশের লেভেলেও এই সমস্ত ঘটনা ঘটে। রেজার্ভ রেশিও নামক প্যাচে নাকি জমা রাখা টাকার দশ গুন টাকা সার্কুলেট করে। অর্থনীতিতে আমার জ্ঞান ২ ক্রেডিট কোর্সের সমান। আপনি বিস্তারিত লিখলে, আমি ও জনগন উপকৃত হতাম। লিংক দিলাম, যদিও আপনার বোধহয় প্রয়োজন নাই।

    Modern Money Mechanics

    বাংলাদেশের ব্যাঙ্কগুলোও কি এই পদ্ধতি শুরু করেছে? এখন দেখি তারা টিভি কিনতেও লোন দেয়!

    আমাদের দেশ গরীব। টাকা গুলি ধার এনে এমপি মন্ত্রীরা আখের গুছাবে আর দেশের বারোটা বাজাবে ভবিষ্যতে। তাদের ছেলে-পেলে তো সব আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডে! শেষে আমরা মরব আরকি!

    জবাব দিন
  4. শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)

    আমার নানী একটা কথা বলেন, "ঋণে অর্থক্ষয়, বেশি ঋণ ঋণ করলে মানুষ গোল্লায় যায়"। কথাটা ব্যক্তিগত জীবনে যেমন সত্যি, জাতীয় জীবনে আরও নির্মম ভাবে সত্যি।

    জবাব দিন
  5. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    তথ্যবহুল পোস্টের জন্য অনেক ধন্যবাদ শওকত ভাই :boss:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  6. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    লুটেরা বিশ্বব্যাংক নিপাত যাক।
    বুর্জোয়া আইএমএফ ধবংস হউক।
    বাংলার অর্থনীতি মুক্তি পাক ।

    মুহিত সাহেবের সুবুদ্ধি হউক।

    (বাজেট আসার আগেই বেনসনের দাম বাড়াইয়া দিছে, কই যে যাই ! শেষ পর্যন্ত না খাইয়া মরতে হবে দেখি 🙁 )


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কামরুল হাসান (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।