দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার পদ্মা

কিছু করার নাই। মানিক বন্দোপাধ্যায় সেই কবে পদ্মা নদীর মাঝি লিখেছিলেন। উপন্যাসের নায়ক বা ভিলেন যাই বলেন, তার নাম হোসেন মিয়া। সেই থেকে পদ্মা নদী নিয়ে সব গল্পের নায়কের নামই হোসেন মিয়া। তবে খানিকটা আধুনিকতা দিতে এই গল্পের নায়ক হোসেনের নামের শেষে মিয়া না লিখে নামের শুরুতেই সৈয়দ লেখা যেতে পারে।
আমাদের এই হোসেন মিয়া আবার রাজনীতি করেন। তার এলাকা পদ্মা নদী থেকে একটু দূরে। ফলে ঠিক সেতু না, সাকো দিয়ে পেশা শুরু করেছিলেন তিনি। তখন দেশটি স্বাধীন হয়েছে বেশি দিন হয়নি। তাই স্থানীয় এক নির্বাচনের আগে হোসেন মিয়া একটা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন। বলা যায় পাঁচ মাইল দীর্ঘ প্রতিশ্র“তি দিলেন। সবশেষে বললেন, নির্বাচিত হলে তিনি এই এলাকায় একটি সাকো বানিয়ে দেবেন, যাতে গ্রামবাসী সহজে খাল পারাপার করতে পারেন। গ্রামের এক বোকা লোক কাচুমুচু হয়ে বললো, আমাদের এখানে তো খালই নেই, সাকো বানাবেন কেমনে? আমাদের গল্পের হোসেন মিয়া এবার গলা ফুলিয়ে বললো, প্রয়োজনে খাল বানানো হবে আগে, তারপর সেই খালের উপর হবে সাকো।
তখন আবার খাল কাটার যুগ। ফলে খাল কাটার টাকা আসতে মোটেই সময় লাগলো না। প্রথমে খাল কাটা হলো। তারপর সেই খালের উপর উঠলো সাকো। আমাদের হোসেন মিয়া সেই সাকোর মালিক হয়ে গেলেন। এর নাম হচ্ছে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ।
সাকো তো হল, সেই সাকো রক্ষণাবেক্ষনের জন্য প্রতি বছর ঢাকা থেকে বরাদ্দও এলো। মাঝে মধ্যেই সাকোর নাটবল্টু খুলে যেতে লাগলো। ফলে মেরামতের প্রয়োজনে আবারও বরাদ্দ এলো। মোটকথা, সাকোটাকে ঠিকঠাক রাখা আর হাতি পালা হোসেন মিয়ার জন্য একই হয়ে গেল।
কিন্তু বিপত্তি বাধলো সরকার বদল হতেই। খাল কাটা নিয়ে নতুন সরকারের মাথাব্যথা নেই। বরং আগ্রহ আছে সাকো নিয়ে। সাকো পরিদর্শনে লোক আসবে শুনে দৌড়ে আসলো হোসেন মিয়ার এপিএস কুবের। দুশ্চিন্তায় পড়লেন হোসেন মিয়া। দ্রুত ঢাকায় একটা চিঠি লেখা হলো। লিখলেন, এলাকার একমাত্র খালটির পানি নষ্ট হয়ে গেছে। এই পানি খেয়ে মানুষজনের ব্যাপকভাবে পানিবাহিত রোগ হচ্ছে। ডায়রিয়ায় মারাও যাচ্ছে অনেক মানুষ। সুতরাং অবিলম্বে খালটি ভরাট করা প্রয়োজন। তাছাড়া আগের সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে এখানে খাল কাটা হয়েছিল। এসব রাজনৈতিক খাল থাকলে মানুষের ভুল ধারণা হবে।
চিঠি পেয়েই টনক নড়লো নতুন সরকারের। আগের সরকারের কোনো কিছু যে থাকবে না, সে সিদ্ধান্ত তো যে কোনো নতুন সরকারেরই থাকে। জ্ঞানী লোকেরা বলেন, একমাত্র জর্জ ওয়াশিংটন ছাড়া আর বাকি সব প্রেসিডেন্টই দুরাবস্থার জন্য আগের সরকারকে দায়ি করে আসছে।
হোসেন মিয়া দ্রুতই নতুন বরাদ্দ পেলেন। সেই বরাদ্দ দিয়ে খাল ভরাট হলো। পকেট ভরলো হোসেন মিয়ার। এরপর অনেক দিন গেছে। আমাদের হোসেন মিয়া ফুলে ফেঁপে আরও বড় হয়েছে। তবে হোসেন মিয়া যে ক্ষণজন্মা ও বিরল প্রতিভা, তারও অনেক প্রমান তিনি বছর বছর ধরে রেখে যাচ্ছেন। সবচেয়ে বড় প্রমান হচ্ছে, যে সাকো কখনো তৈরিই হয়নি, সেই সাকোর জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছে, রক্ষণাবেক্ষনের জন্য অর্থ এসেছে, নিয়মিত মেরামত করা হয়েছে এবং এক সময় নতুন বরাদ্দ নিয়ে সেই সাকো খুলেও ফেলা হয়েছে। যারা মনে করছেন, আমাদের হোসেন মিয়ার কোনো তুলনা নেই, তাদের তো আসল কথাই বলা হয়নি। আসলে সেখানে কখনো কোনো খালই ছিল না, খাল কাটাও হয়নি, ভরাটের তো কোনো প্রশ্নই আসে না। কোনো সাকোও কখনোই তৈরি হয়নি।
সৈয়দ হোসেন বা হোসেন মিয়ার গল্প এখানেই শেষ নয়। এর পর সরকার বদল হয়েছে, নতুন সরকার এসেছে। রাজা গেছে, আবার রাজা আসছে। কিন্তু হোসেন মিয়া ঠিকই রয়ে গেছে। বরং জেল্লা অনেকগুন বেড়েছে। তবে সে মোটেই অকৃতজ্ঞ না। সাকো দিয়েই উন্নতি, তাই সাকো নামটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে হোসেন মিয়া।
এরপরের গল্প আরও চমকপ্রদ। আমাদের হোসেন মিয়া একসময় মন্ত্রীও হয়ে গেল। নতুন নেতা তাকে মন্ত্রী বানিয়ে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তোমার তো সাকো নিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা, সেই অভিজ্ঞতা এবার কাজে লাগাও। পদ্মা নদীর উপর একটা সেতু করতে চাই। এইটা অনেক দিনের স্বপ্ন। আবার নির্বাচনে প্রতিশ্র“তিও দেওয়া আছে, পদ্মার উপর একটা সেতু একটা না করলেই নয়। এটা দক্ষিণবঙ্গের মানুষদের দীর্ঘদিনের দাবি।’
এবার একটু জ্ঞানের কথা আলোচনা করা যাক। কারণ হোসেন মিয়া আজকাল খানিকটা লেখাপড়া করেন। বক্তৃতা দিতে লেখাপড়া থাকলে একটু কাজে লাগে। প্রাক্তন সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ বলেছিলেন, ‘রাজনীতিবিদেরা সর্বত্রই এক। তারা সব সময় সেতু তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দেন, যদিও সেখানে কোনো নদীই নেই।’ আমাদের হোসেন মিয়া এবার ভাবলেন, তার জন্য এটি দারুণ একটি সুযোগ। কারণ সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি আছে, আবার পদ্মার মতো বিশাল একটা নদীও আছে। সুতরাং এই সুযোগ ছাড়া যাবে না।
হোসেন মিয়া গেলেন কোনো এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। সেখানে দেখা হয়ে গেল ওই দেশের যোগাযোগ মন্ত্রীর সঙ্গে। সেই মন্ত্রীর বিত্ত-বৈভব দেখে আশ্চর্য হলেন হোসেন মিয়া। বিশাল প্রসাদসম বাড়িতে থাকেন, দুয়ারে সদা প্রস্তুত মার্সিডিজ, রোলস রয়েলস আর বিএমডব্লিউ। অথচ ক’বছর আগেও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন এই লোকটি। মন্ত্রী হয়েই রাতারাতি উন্নতি।
হোসেন মিয়া চুপ থাকতে পারলেন না। প্রশ্ন করেই ফেললেন, ‘হঠাৎ করে কি হল, এতো টাকা-পয়সা কীভাবে করলেন?’। ওই মন্ত্রী হোসেন মিয়াকে নিয়ে গেল একটা নদীর তীরে। দূরে একটা সেতু দেখা যায়। সেতুটি দেখিয়ে বললেন, ‘এটার বাজেট ছিল ১০০ কোটি ডলার। কিন্তু ৮০ কোটি ডলারে বানিয়ে ২০ কোটি ডলার নিজের পকেটে রেখে দিয়েছি। এই এক ব্রীজেই আমার জীবন পালটে গেছে।’
তারপর সেই মন্ত্রী এবার সফরে এলেন এখানে। দেখা হলো হোসেন মিয়ার সঙ্গে। এবার হোসেন মিয়ার অবস্থা দেখে তিনি অবাক। তাঁর চেয়ে হাজারগুন বেশি বিত্ত-বৈভব। তিনিও চুপ থাকলেন না। জানতে চাইলেন এর রহস্য। হোসেন মিয়া তাকে নিয়ে গেলেন পদ্মা নদীর পারে, জাজিরা-মাওয়া পয়েন্টে। সেখানে আঙুল উচিয়ে অনেক দূর দেখিয়ে বললেন, ‘ওই পদ্মা সেতুটি বানাতে খরচ হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার।’ কিন্তু মন্ত্রী অবাক হয়ে বললেন, ‘কোথায় ব্রিজ, কিছুই তো দেখছি না।’ এবার আমাদের মন্ত্রী হোসেন মিয়া মুচকি হেসে বললেন, ‘ব্রিজ কিভাবে দেখবেন। পুরো অর্থই তো আমার পকেটে।’

পাদটিকা: হোসেন মিয়া একদিন মন্ত্রণালয়ে বসে আছেন। তার এপিএস কুবের দুঃখ দুঃখ চেহারা বানিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। হাতে একটা খাম। দেশের এক সাধারণ মানুষ চিঠিটি দিয়েছেন। ঠিকানা দেখে অবাক হলেন হোসেন মিয়া। সেখানে লেখা, ‘প্রাপক, দেশের সেরা চোর।’ কুবের তাঁর স্যারকে স্বান্তনা দিয়ে বললেন, ‘দেখেন স্যার, কত বড় সাহস। এভাবে ঠিকানা লিখলো! এভাবে কেউ লিখে?’ হোসেন মিয়া উদাস গলায় বললো, ‘বুঝলা কুবের, লিখছে সেটা নিয়ে আমার দুঃখ নাই। কিন্তু ওই বেটা পোস্টম্যান এই চিঠি কেন ঠিক আমার কাছেই পাঠিয়ে দিল?’

পদ্মা সেতু নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ বা বক্তব্য থাকলে আপনারাও চিঠি পাঠিয়ে দিন, খামের উপরে খালি লিখবেন, ‘প্রাপক, দেশের সেরা চোর’। ঠিকই হোসেন মিয়া পেয়ে যাবেন।

# ছবিটা নেট থেকে নেওয়া, লোকালটকের করা এটি।

২,৯৩০ বার দেখা হয়েছে

১৫ টি মন্তব্য : “দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার পদ্মা”

  1. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    =)) =)) =))
    হোসেন মিয়া হইতে মঞ্চায় 😕


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  2. রাব্বী (৯২-৯৮)

    নামটা দেখে দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কওয়াইয়ের কথা মনে হলো। কথা হইলো, হোসেন মিয়াদের যারা পেলেপুষে বড় করে এবং পেঁজগিতে পড়লে রক্ষা করে তাদের দায়টা কোন অংশে কম না।


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    কয়েকদিন আগেই প্রথম আলোতে এরকম লেখা পড়েছিলাম; ব্রিজ নিয়ে বাইরের এক মন্ত্রীর সাথে আলোচনাটা ঐখানে ছিলো।
    কথা সেইটা না, অনবদ্য লেখা হইছে।
    বিশেষ কইরা হোসেন মিয়ার নামকরণ, আর শেষটা।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  4. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    সিসিবিতে অনেকদিন পরে আপনাকে দেখে ভাল লাগলো মাসুম ভাই, লেখা জব্বর হইছে 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  5. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    "মহান জাতীয়তাবাদী চেতনা"য় উজ্জীবিত হয়ে পদ্মা সেতু তহবিলে এক বস্তা বালু, এক ব্যাগ সিমেন্ট আর ১০০টা ইট দিমু.........


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  6. মুহিব (৯৬-০২)

    আমরা হোসেন মিয়াদের দোষ দিচ্ছি। আমরাই তো আবার নির্বাচনের আগে হোসেন মিয়াদের নিয়ে দিনকে রাত আর রাতকে দিন করে দিচ্ছি। তাদের নিয়ে দেশের কোনায় কোনায় চা ষ্টলে মুখর হয়ে উঠছি। আমাদেরও মনে হয় কিছুটা দায়বদ্ধতা আছে এখানে।

    মাসুম ভাই আমি কিন্তু আপনার লিখার একজন বিশাল ভক্ত। অনেকদিন পরে আপনার এত্ত সুন্দর একটা রূপক গল্প পড়ে খুবই ভাল অনুভুতি হচ্ছে। (সম্পাদিত)

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাব্বী (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।