ফ্রস্ট/নিক্সন, ইয়াজউদ্দিন/?

১.
ফ্রস্ট/নিক্সন। ছবিটার নাম শোনার পর থেকেই দেখার আগ্রহ ছিল। অস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারের তালিকা বা নমিনেশন দেখে আগ্রহ বেড়ে যায় অনেক। তাই ঢাকায় ডিভিডি দেখেই কিনতে সময় লাগেনি একদম। প্রিন্টও ভাল। বলা যায় এক নিঃশ্বাসে মুভিটা দেখেছি।
২.
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কারণে। ওয়াইট হাউজ থেকে বের হয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় জীবন যাপন করছেন তিনি। ডেভিড ফ্রস্ট একজন সাংবাদিক, বলা যায় টক শো হোস্ট। ফ্রস্টের ইচ্ছা হলো নিক্সনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার। নিক্সনের তখন গ্লানিময় জীবন। দেশের মানুষ পছন্দ করে না। ইতিহাসের অন্যতম সেরা কেলেঙ্কারির জন্মদাতা সে। এই নিক্সন রাজী হলেন ফ্রস্টটে সাক্ষাৎকার দিতে। তবে এ জন্য দর হাকলেন ৫ লাখ ডলার। রাজী হয়ে গেলেন ফ্রস্ট। শেষ পর্যন্ত দিতে হয়েছে আরও বেশি, ৬ লাখ ডলার। শর্ত হচ্ছে ৪টা পর্ব হবে চার বিষয়ে। ওয়াটারগেট, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ নীতি ও ব্যক্তি নিক্সন। এর মধ্যে ওয়াটারগেট কোনো ভাবেই মোট সাক্ষাৎকারের ২৫ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।
নিক্সন ভাবলেন এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি আবার নিজের ইমেজ উদ্ধার করবেন। ফ্রস্ট তার সাথে কথায় পারবে না বলেই সবার ধারণা। বিষয়টি সহজ ভাবে নিলো না আমেরিকানরাও। তারা মনে করে, যে লোকটির জেলে থাকা উচিৎ সেই লোককে ধনী করে দিচ্ছে ফ্রস্ট। ফ্রস্টের তখন জীবন-মরণ সমস্যা। নিজের অর্থ, ঋণ আর স্পন্সর জোগার করতেই হিমসিম অবস্থা। আবার নিয়োগ দিলেন চার জন গবেষক। আছে একজন প্রেমিকা। সাক্ষাৎকার ফ্লপ হলে দেউলিয়া হবে ফ্রস্ট, ক্যারিয়ারও শেষ।
৩.
শুরু হলো মনস্তাত্বিক খেলা। সাক্ষাৎকারে সুবিধা করতে পারছে না ফ্রস্ট। নিক্সন বলা যায় দাঁড়াতেই দিলো না ফ্রস্টকে। ফ্রস্ট শিবিরে চরম হতাশা। বাকি আছে ওয়াটারগেট পর্ব। শুরু হলো আসল খেলা। কথার তোরে নিক্সন একসময় বলেই ফেললো যে, প্রেসিডেন্ট যা করে সেটাই আইনসঙ্গত!!। ফ্রস্ট প্রমান করলো এ সংক্রান্ত বিচারকার্যে বাধা দিয়েছিল নিক্সন। কিভাবে সেটা ছবিটা যারা দেখবেন তাদের জন্যই থাক।
১৯৭৭ সালে এই চার পর্বের সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দেখা সাক্ষাৎকারের রেকর্ড এটি। এ থেকে ফ্রস্টের আয় হয়েছিল ১০ লাখ ডলার।
৪.
একজন সাংবাদিক হিসেবে ছবিটা দেখে মুগ্ধ হয়েছি বলা যায়। আর মুগ্ধ হয়েছি নিক্সন চরিত্রে ফ্রাঙ্ক লংগেলার অভিনয়। আমার হাতে মতা থাকলে সেরা অভিনেতার পুরস্কার আমি তুলে দিতাম তাকে। পুরোটাই সত্যি কাহিনী। প্রশ্নমালাও একই রাখা হয়েছে। চরিত্রগুলোও কাল্পনিক নয়। ডেভিড ফ্রস্ট এখনো বেঁচে আছেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিক হিসেবে সে এখন কিংবদন্তীতূল্য।
৫.
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কারণে নিক্সনের কোনো বিচার হয়নি। আমেরিকানরা এ জন্য ক্ষুব্ধ ছিলো। অনেকেই মনে করেন এ জন্য নিক্সনের বিচার হওয়া উচিৎ ছিল। কেননা সে পদ এবং রাষ্ট্রকে অবমাননা করেছে। তাছাড়া মূল ঘটনা প্রকাশ পাওয়া উচিৎ বলেও সেসময় সবাই মনে করতেন।
এতোদিন হয়ে গেলো এখনো কোনো ধরনের রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির জন্য গেট নামটা জুড়ে দেওয়া হয়। আগ্রহীরা এ ছবির সঙ্গে আরও দুটি ছবি দেখতে পারেন।

একটি হলো অল দি প্রেসিডেন্ট ম্যান। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির রহস্য উদঘাটন করেছিল ওয়াশিংটন পোস্টের দুই সাংবাদিক। সেই ঘটনা নিয়ে ছবি। রবাট রেডফোর্ড আর ডাস্টিন হফম্যান অভিনয় করেন দুই সাংবাদিকের চরিত্রে।

আরেকটি হল নিক্সন। অলিভার স্টোনের ছবি। এটি হচ্ছে নিক্সনের জীবনী নিয়ে। জীবনী মানেই তো বড় অংশ জুড়ে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি।
৬.
ছবিটা দেখেই আমার আমাদের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনের কথা খুব বেশি মনে পড়ছিল। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের অনেক মানুষ একমত হবেন যে এই লোকটিরও বিচার হওয়া উচিৎ। বাংলাদেশে ইতিহাসের গতিমুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে এই লোকটি। কি হয়েছিল সে সময়? কেন ইয়াজউদ্দিন প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিলেন, তারপর কেন উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত বদলে যেতো বাইরের ফোন পেয়ে। কি হয়েছিল ১১ জানুয়ারির বিকেলবেলা।
সাংবাদিকরা কিছু কিছু লিখেছেন। জেনারেল মঈন উ আহমেদও দেখলাম লিখেছেন। কিন্তু বিষয়টা এরকম শান্তিপূর্ণ এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে হয়েছে সেটা আমি কোনোদিনও বিশ্বাস করবো না। বাকি আছে ইয়াজউদ্দিন যদি কখনো আত্মজীবনী লেখেন। তপন রায় চৌধুরী তাঁর বাঙ্গালীনামায় শুরুতেই বলেছেন যে, ‘এটি তার আত্মজীবনী নয়। আত্মজীবনী লিখতে যে পরিমান সাহস লাগে সেটি তার নাই।’ তসলিমা নাসরিনের হয়তো সেই ছিল সাহস ছিল। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন আহমেদের যে সাহস ও মেরুদন্ড নেই সেটি সবারই জানা। তাহলে কিভাবে জানবো আসল সত্য?
৭.
মনে আছে ২০০২ সালে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিমন্ত্রণে একমাসের জন্য আমেরিকা যাই আমরা ৭ সাংবাদিক। আমরা কোথায় যেতে চাই জানতে চাইলে আমাদের কেউ কেউ বলেছিলেন ক্লিনটনের
moviefnnixonall-thepresident-iajuddin
সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা। আমাদের সাথে যে মহিলা ছিলেন তিনি হেসে বলেছিলেন তার এক সাক্ষাৎকার নিতে কত টাকা লাগে তা আমাদের জানা আছে কীনা।
১৯৭৬ সালে যদি এ জন্য নিক্সনকে দিতে হয় ৬ লাখ ডলার তাহলে কিনটনকে কতো? বাংলাদেশে আমরা যে ধরণের সাক্ষাৎকার নেই তাতে কঠিন প্রশ্ন খুবই কম করা যায়। আবার সাক্ষাৎকার ছেপে উল্টা অর্থ নেওয়ার উদাহরণও আছে। কিন্তু আমেরিকার মতো অর্থের বিনিময়ে সক্ষাৎকার নিলে মনে হয় অনেক কঠিন প্রশ্নও করা যেত।
আমার খুব মনে হচ্ছে জনাব ইয়াজউদ্দিনকে বলি আপনাকে টাকা দেবো, একটা সাক্ষাৎকারের জন্য। কিন্তু বলতে হবে সব কথা। শর্ত যদি প্রমান হয় যে মিথ্যা বলেছেন তাহলে মামলা হবে, শাস্তি হবে। আপনাকে খুলে বলতে হবে সব কথা। আপনি বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিলেন তার মাশুল আপনাকে দিতে হবে। জাতি আসলে সব কথা জানতে চায়।

তাজা লেখা, একই সঙ্গে সামুতে প্রকাশিত

৩,৭১৩ বার দেখা হয়েছে

৪৪ টি মন্তব্য : “ফ্রস্ট/নিক্সন, ইয়াজউদ্দিন/?”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)
    এটি তার আÍজীবনী নয়। আÍজীবনী লিখতে যে পরিমান সাহস লাগে সেটি তার নাই

    আহমেদ ছফা তো মনে হয় খুব হাসাহাসি করতেন এই সব আত্নজীবনী নিয়ে। "হতে পারত আত্নজীবনী"

    আত্নজীবনী পড়লে মনে হয় মানুষ না, ফেরেস্তার জীবন বৃত্তান্ত পড়ছি। কোন পাপ নাই। 😀

    তবে ইয়াজউদ্দিনের আইডিয়া খুব ভাল লাগছে। এটা দরকার। আমরা জানতে চাই কি হয়েছে। এটা আমাদের অধিকার।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. ১.
    ফ্রস্ট/নিক্সন দেখিনি। ভালো প্রিন্টের অপেক্ষায় ছিলাম। কালকে নেট ঘেটে দেখলাম বেশ ভালো প্রিন্ট এসেছে। ডাউনলোড দিয়ে ফেলবো।
    শওকত ভাইয়ের রিভিউ পড়ে উৎসাহ আরো বেড়ে গেলো।
    ২.
    ১/১১ এর অনেক কিছুই আমাদের কাছে পরিষ্কার না। আমার ধারনা আমার মতো দেশের বাকি সব সাধারন মানুষের কাছেও এটা ধোয়াটে ঘটনা। বইমেলায় জেনারেল মইন ইউ. আহমেদের এই নিয়ে একটা বই বেরোচ্ছে, সেটা কিনে পড়ার প্রচন্ড ইচ্ছা আছে। তবে প্রথম আলোতে প্রকাশিত অংশবিশেষ পড়ে আমারো মনে হয়েছে বিষয়টা এরকম শান্তিপূর্ণ এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে হয়েছে সেটা আমি কোনোদিনও বিশ্বাস করবো না। । কিন্তু এই নিয়ে আরো কিছু লেখা পড়লে বা কাছ থেকে দেখা মানুষদের অভিজ্ঞতা জানতে পারলে তখন এই বইটার সাথে তা মেলানো যাবে ভেবেই পড়বো।
    ৩.
    বেশ কদিন ধরেই টিভিতে বিভিন্ন টক শো'তে দেখেছি , অনেক রাজনীতিবিদ, আইনজীবি বা বুদ্ধিজীবি ইয়াজুদ্দিন সাহেবের ইম্পিচম্যান্ট চাইছেন। যুক্তি সঙ্গত দাবি। দেশকে অনিয়শ্চতার মুখে ফেলে দেয়ার জন্যে তার শাস্তি হওয়া দরকার। তিনি প্রেসিডেন্ট হবার সময় যে শপথ নেয়েছিলেন তা ভংগ করেছেন।
    তবে আমার একটু অবাক লাগলো যখন দেখলাম, বিএনপির'র অনেকেই এমনকি সংসদে ইয়াজুদ্দিন সাহেবের ইম্পিচম্যান্ট চাইছেন।
    একেই মনে হয় বলে 'যার জন্যে করলাম চুরি সেই বলে চোর'। তারা কেন চাইছে সেটা আমি জানিনা, তবে আমি মনে করি ইয়াজুদ্দিনের উদাহরনমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।
    ৪.
    একেবারে সত্যি কথা বললে আমি বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের' আত্মজীবনী ' পড়ে খুব একটা মুগ্ধ হইনি । দু'একটা ব্যাতিক্রম অবশ্যই আছে তবে গড়পরতা বেশিরভাগ 'আত্মজীবনী'কেই অতিরিঞ্জিত বা সচেতন ভাবে এড়িয়ে যাওয়া মনে হয়েছে। অনেকেরতো রীতিমতো মিথ্যে লেখার অভ্যাস আছে।
    আত্মজীবনী লিখতে আসলেও সাহস লাগে। বেশি দূরের উদাহরন দেবো না, কাছের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই তার 'অর্ধেক জীবন'এ যে সাহস দেখিয়েছেন তা আমাদের এখানে লেখকদের মধ্যে বিরল। রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবি , আমলা , সাংবাদিক, খেলোয়াড়দের কথা বাদই দিলাম।
    তাই ইয়াজুদ্দিনের আত্মজীবনী যদি লেখাও হয় কখনো, পড়ার কোন আগ্রহ পাচ্ছি না।
    ৫.
    বরং তার সাক্ষাৎকার যদি কোনদিন নিতে পারেন ফ্রস্টের মতো করে, সেটা জানাইয়েন। আমি তাহলে ওইটা নিয়ে ছবি করবো 😀

    জবাব দিন
  3. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    ১/১১ নিয়ে মইন উ'র লেখার জবাব দিয়েছে মোলখেছ। আজকের "আমার দেশ"-এ ছাপা হয়েছে। লিংক দিলাম। পিডিএফ ফরমেটেও দিতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু ডেস্কটপ থেকে দেয়ার কোনো পথ পাচ্ছি না।

    লিংক : মোলখেছ যা বলেছে : আমার দেশ

    পড়লেই সবাই বুঝবে, বঙ্গভবনে সেদিন যা ঘটেছিল তা কোনোমতেই শান্তিপূর্ণ ছিল না। মোলখেছ চড়-থাপ্পরের কথা স্বীকার করবে না।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  4. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    দেখতেই হবে। রন হাওয়ার্ডের "অ্যাপোলো ১৩" দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। আ বিউটিফুল মাইন্ডও খুব ভাল লেগেছিল। ভিঞ্চি কোড ভাল ভাবে করতে পারেননি। ফ্রস্ট/নিক্সন দিয়ে আবার ফর্ম ফিরে পেলেন বোধহয়।

    জবাব দিন
  5. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    ফ্রস্ট অনেক বিখ্যাত সাংবাদিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সে সময় এটা আলোচিত ছিল। বিবিসিতে দীর্ঘদিন একটা পপুলার টক শো ছিল : ব্রেকফাস্ট উইথ ফ্রস্ট। বেনজির মারা যাওয়ার আগে ফ্রস্ট তার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। কদিন আগে শেখ হাসিনারও সাক্ষাৎকার দেখলাম। তবে এসব সাক্ষাৎকার :just: আচার। আগের ঝাঁঝ নাই।

    এখন কাজ করেন আল-জাজিরায়।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  6. হাসান (১৯৯৬-২০০২)
    তসলিমা নাসরিনের বই পড়া আমি তো সিদ্ধান্ত নিছি যে গদ্য লিখতে পারে এমন কোনো মেয়ের সঙ্গে কখনোই সম্পর্ক করবো না। পড়ে কিইনা কি লেইখা দেয়।

    কবিতা লিখতে পারে এমন কারো সাথে করবেন? 😛

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : শওকত (৭৯-৮৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।