গল্প: জয়-পরাজয়

জহির একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাঝারি মাপের কর্মকর্তা। তার আলাদা কোনো বিশেষত্ব নেই। এরকম একজন মানুষ পথেঘাটে দেখতে পাওয়া যায় এবং কেউ মনেও রাখে না। সেই তুলনায় রাজিয়া বানু একদমই অন্যরকম। মুখে একটা আলগা লাবন্য আছে, মানুষ বার বার চোখ ফিরায়। রাজিয়া বানুরে রূপসী বলা যায় যে কোনো অর্থেই। তাদের তিন বছর হলো বিয়ে হয়েছে।
কেবল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গল্প কমই থাকে। তাই তৃতীয় একটা চরিত্র আনতেই হয়। তার নাম শফিক। সে জহিরের বন্ধু। শফিকও চাকরি করে। রাজিয়া বানুর ভাই যথেষ্ট অবস্থাপন্ন, তারই একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে শফিক। জহির ও রাজিয়া বানুর সংসারে শফিকের যাতায়াত ও সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে এই যোগসূত্রটি বাড়তি সহায়তা হিসেবে কাজ করেছে।
ওদের বসবার আসবাবপত্র বেশি নেই, কিন্তু কম আসবাবপত্র দিয়েও যে ঘর সুন্দর করে সাজানো যায় তা রাজিয়া বানুর জানা আছে। অর্থের প্রাচুর্য না থাকলেও রুচির প্রাচুর্য আছে রাজিয়া বানুর। সেই ঘরের কোনার সোফায় এখন বসা জহির আর শফিক। রাজিয়া বানু চা আর মুড়ি মাখা নিয়ে আসে। অতি সচেতন না হলে চায়ে কাপ হাতে দেয়ার সময় ছোঁয়া লাগবেই। শফিকের হাতের সঙ্গে রাজিয়া বানুরও লাগলো। শফিকই ছোঁয়া লাগাতে হাতটা একটি বেশি বাড়িয়ে দিয়েছিল। ছোঁয়া লাগালেও চোখে চোখ রাখার সাহস তার হয় না। আর তাই রাজিয়া বানুর হাসিটাও তার দেখা হয় না।

শফিককে এই বাসায় প্রায়ই আসতে দেখা যায়। ছোঁয়াছুয়ির এই ঘটনাও সুযোগ পেলেই ঘটে। তবে বিষয়টি জহির বুঝতে পারে কিনা তা কারো কাছেই স্পষ্ট হয় না। তবে জহিরকে দেখা যায় নতুন এক ভূমিকায়। জহির একদিন একটা শাড়ি নিয়ে বাসায় ফিরে। বউয়ের জন্য শাড়ি কেনা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা হতে পারে না। তবে রাজিয়া বানু এতে অনেকটাই বিষ্মিত হয়। জহির একা একা শাড়ি কিনতে পারে এই ধারণা রাজিয়া বানুর কখনোই ছিল না। রাজিয়া বানু যে বিষ্মিত, এটা জহির বেশ বুঝতে পারে। তাই একটা অজুহার দাঁড় করায়। জহির অবশ্য আগেই ভেবে এসেছে কি বলবে। ফলে অজুহাত দিতে তার কোনো সমস্যা হয় না।
-আসার পথে দোকানে দেখলাম, শাড়িটা সাজানো, পছন্দ হইল, কিনা আনলাম। কখনো তো কিনি না, ভাবলাম আসলে এটা ঠিক না। কেনা উচিৎ।
রাজিয়া বানু কোনো কথা বলে না। জহির আসার পথে ঝোঁকের মাথায় শাড়ি কিনেছে এটা ঠিক তার বিশ্বাস হয় না। রাজিয়া বানুর ভাবনাকে সত্যি প্রমান করতেই যেন জহির বাকিটুকু বলে।
-জানো, সাথে শফিকও ছিল। ওকেও বললাম একটা শাড়ি কিনতে। কিনলোই না। শফিক একজনকে পছন্দ করে। বলছিলাম তার জন্য কিনতে। কিন্তু কিনলো না।’
কথাটা বলেই জহির আড়চোখে রাজিয়া বানুকে দেখে। জহির বুঝতে পারে না রাজিয়া বানু তার এই মিথ্যা কথাটা ধরতে পারলো কিনা। বুঝতে পারে না বলেই জহির এ কাজটি চালিয়ে যেতে থাকে। কোনো দিন গোলাপ ফুল আনে, কোনোদিন পুঁতি বসানো মালা, একদিন আনলো চুলের কাটা। এসব কেনার সময় প্রতিবারই যে সাথে শফিক থাকে এবং শত অনুরোধেও সে তার পছন্দের মেয়েটির জন্য কিছুই কেনে না একথা প্রতিবারই জহির রাজিয়া বানুকে জানান।

জহির যখন বাসায় থাকে না সেই সময়টা একান্তই রাজিয়া বানু। সে ঘর গুছায়, বিছানায় গড়াগড়ি দেয়, গুনগুন করে গান গায়, বই পড়ে, কখনোবা জানালা ধরে তাকিয়ে থাকে। ওদের বাসা বড় রাস্তা পার হয়ে ডানদিকের গলির প্রায় শেষ মাথায়। কানা গলি না, ফলে সামনের রাস্তায় নানা ধরণের মানুষ থাকে। রাজিয়া বানু মানুষ দেখতে প্রায়ই জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক মানুষের ভিড়ে রাজিয়া বানুর চোখ আটকে যায় একটা মানুষের দিকে। সেই মানুষটি শফিক। সে রাজিয়া বানুর বাড়ির সামনে রাস্তা ধরে চলে যায়। রাজিয়া মাঝে মধ্যেই শফিককে দেখে। ঠিক দুপুরে রাজিয়া বানুর শফিককে দেখা প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
দূর থেকে শফিককে আসতে দেখলেই জানালার আড়ালে চলে যায় রাজিয়া বানু। তবে চোখের আড়াল করে না। শফিক এই বাড়ির সামনে এসে খানিকটা শ্লথ হয়, এক ধরণের ইতস্ততা দেখা যায়। রাজিয়া বানুর সন্দেহ দরজার কলিং বেলে আঙুল রাখবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত আর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। রাস্তা ধরে চলে যায় শফিক, রাজিয়া বানু তখন আবার জানালার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। রাজিয়া বানুর মুখে একটা হাসি খেলে যায়।

শফিকের অজান্তে রাজিয়া বানু আর জহির এক খেলা খেলে। জহির উপহার এনে রাজিয়া বানুকে দেয়, শফিকের ভালবাসাহীনতার প্রমান দেয়। আবার শফিক জহিরের অজান্তে রাজিয়া বানুর দরজা পর্যন্ত এসেও ফিরে যায়। রাজিয়া বানুকে কেন্দ্র করে এই গোপন খেলা চলতেই থাকে।

দুপুর বেলা অফিস থেকে বের হওয়া সহজ হয় না শফিকের জন্য। নানা ছুতোয় বের হতে হয়। এখন আবার অফিসে নানা সমস্যা চলছে। প্রমোশনের সময় এটা। কাকে দেবে কাকে দেবে না সেসসব নিয়ে একধরনের ঘোট পাকাচ্ছে অফিসে। শোনা যাচ্ছে কারো কারো চাকরিও থাকবে না। তারপরেও কি এক আকর্ষণে দুপুর বেলা বের হয় শফিক। দুপুরের তপ্ত রোদে শফিক যখন রাজিয়া বানুর বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটে তখন তাকে খানিকটা উদভ্রান্ত দেখায়। মনের অস্থিরতা কিছুতেই ঢেকে রাখা সম্ভব হয় না তার। রাজিয়া বানুর দরজার সামনে এসে আরও শ্লথ হয় শফিকের পথ চলা। তীব্র ইচ্ছা জাগে দরজায় কড়া নাড়তে। ইচ্ছা আর সাহসের সমন্বয় হয় না তার।
জীবন প্রতিদিন একরকম যায় না। রাজিয়া বানুর দরজার সামনে এসে এবার থেমেই যেতে হলো শফিকের। জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাজিয়া বানু। দুজনের চোখ এক হয়। শফিক ভেবে পায় না এখন তার কি করা উচিৎ। সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বলেই চোখ নামিয়ে আবার তাকায় শফিক। তারপর শফিক একসময় নিজেকে রাজিয়া বানুর দরজার সামনে আবিস্কার করে। একসময় দরজাটাও খুলে যায়। অমোঘ নিয়তির মতোই দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ে শফিক।
এরপর কাহিনী একদিকে চলে যাওয়াই স্বাভাবিক। এরকম যে আকছার ঘটে সেটিও সবার জানা। কিন্তু শফিক এর পর যে কাজটি করে তাতে তাতে রাজিয়া বানুর হিসাব মেলে না।
শফিক সোফায় গিয়ে বসে। সামনের সোফায় রাজিয়া বানু। শফিকের মনে তখন মিছিল করে কথা আসছে। এরকম একদিনের জন্য অনেক কল্পনা করেছে শফিক। অনেক কথা সাজানোও আছে। কিন্তু কথার মিছিলের তোড়ে শেষ পর্যন্ত শফিক যা বললো তাতে রাজিয়া বানুর মুখে সেই হাসিটিই কেবল দেখা গেল। শফিক কখনোই ভাবেনি এসব বলবে। কেন বললো সেও এক বিষ্ময়।
কথা হলো চা দেওয়ার সময়। চা দিতে গিয়ে সেই ছোয়াছুয়ির অভিনয় হলো খানিকটা। এবার আর জহির নেই। তাই শফিক চায়ের কাপটা সহই দুহাত দিয়ে রাজিয়া বানুর হাত জড়িয়ে ধরে বললো-
-‘অফিসে খুব ঝামেলা। তুমি কি তোমার ভাইকে আমার জন্য একটু বলবা?’
চায়ের কাপ উল্টে টেবিলে পড়া। ছিটকে কিছুটা শরীরেও আসে। সেসব গ্রাহ্য না করে আস্তে করে হাতটা ছেড়ে দেয় রাজিয়া বানু। নিঃশ্বাসের দূরত্বে থাকা নিজের মুখটা নামিয়ে আনে। এই মুখটাই খানিকটা উচিয়ে ধরা ছিল কিছু আগেও।
শফিকের একবার মনে হলো আবার হাতটা জড়িয়ে ধরে। চিৎকার করে বলে এটা তার কথা না। অন্য কোনো এক শফিক তাকে দিয়ে বলাচ্ছে। কিন্তু রাজিয়া বানুর চোখ আর আগে কখনোই না দেখা হাসিটি দেখে দরজা খুলে ছিটকে বেরিয়ে যায় শফিক।

সে রাতে রাজিয়া বানু যেন অন্য এক নারী, অন্তত জহিরের কাছে তাই মনে হল। গভীর রাতে রাজিয়া বানুর মধ্যে মিশে যেতে যেতে জহিরের আবারো মনে হল এই কি সেই রাজিয়া? চরম মুহূর্তে রাজিয়া বানু জহিররে আকড়ে ধরে বললো-
‘তোমার বন্ধু শফিককে আসতে মানা করবা। তাকে আমার ঠিক পছন্দ হয় না।’
এরকম এক পরম মুহূর্তে রাজিয়া বানুর মনে কেন শফিক আসলো সে ভাবনা জহিরের মাথায় এলো না। বরং রাজিয়া বানুর উপর এলিয়ে পড়ে ভাবলো, ‘আমারই জয় হলো’।

(লাবলু ভাইয়ের মতো আমারো হাম নিশপিশ করছিল পোস্ট দেওয়ার জন্য। তাই গত মাসে অন্য এক জায়গায় দেয়া এই গল্পটা ভয়ে ভয়ে দিলাম। আমি গল্পকার না। তাও সখ কইরা লিখে ফেললাম। )

২,২৬৫ বার দেখা হয়েছে

৩৪ টি মন্তব্য : “গল্প: জয়-পরাজয়”

  1. তাইফুর (৯২-৯৮)

    রূপসী'র নাম রাজিয়া বানু ... :-/
    ক্ষুরসিধা বানু হইলে বিয়াপওক হইত :khekz:
    (শফিক আর রাজিয়া বানু'র মধ্যে লুইস হিসেবে বানু'ই এগিয়ে রইল )

    তাই গত মাসে অন্য এক জায়গায় দেয়া এই গল্পটা ভয়ে ভয়ে দিলাম

    ভয়ে ভয়ে তো ভালই দিলেন বস


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  2. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    ইয়াল্লা! আমি ভাবছিলাম এইটা এট্টু ইয়ে গল্প হবে।
    পইড়া দেখি ঐসব কিছু নাই। 😛


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  3. রাব্বি (১৯৯৮-২০০৪)

    এরকম এক পরম মুহূর্তে রাজিয়া বানুর মনে কেন শফিক আসলো সে ভাবনা জহিরের মাথায় এলো না। বরং রাজিয়া বানুর উপর এলিয়ে পড়ে ভাবলো, ‘আমারই জয় হলো’
    বসস :boss:

    জবাব দিন
  4. শাওন (৯৫-০১)

    আবারো অসাধারণ এক লেখা...


    ধন্যবাদান্তে,
    মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান শাওন
    প্রাক্তন ক্যাডেট , সিলেট ক্যাডেট কলেজ, ১৯৯৫-২০০১

    ["যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি"]

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফখরুল (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।