আমার প্রিয় দুই উপন্যাস

ছুটি হলেই আমাদের যেতে হতো নানা বাড়ী। মনে আছে আমার খালারা রোববার দুপুরের পর সবাই মিলে রেডিওর নাটক শুনতো। আমরাও শুনতাম। আমারা মা-খালা সবারই বই পড়ার অভ্যাস ছিল। তারা সদ্য পড়া বইটি নিয়ে আলোচনাও করতো। সে সময়ই আমি শুনি দৃষ্টিপাতের কথা। চারুদত্ত আধারকার নামটি সে সময়েই আমার মুখস্ত হয়ে যায়।
বইটি আমি হাতে পাই অনেক পড়ে। আমার মায়ের বেশ কিছু বই ছিল। আমার মা বই কিনতো। শুনেছি বই পড়তে গিয়ে অনেকদিনই ভাত বেশি নরম হয়ে গেছে, তরকারি গেছে পুড়ে। কিন্তু বই পড়া থামেনি। আমার মায়ের সংগ্রহশালা থেকে একদিন পাই দৃষ্টিপাত। লেখক যাযাবার। অবশ্যই ছদ্মনাম।

দৃষ্টিপাত: এইটা আমার প্রিয় বইয়ের একটি। দৃষ্টিপাততে উপন্যাস বলা চলে। আবার উপন্যাসের পুরো চরিত্রটা এই বইয়ে নেই। খানিকটা ইতিহাস, খানিকটা ঘঠনাপঞ্জি আর একজনের প্রেম কাহিনী ও বঞ্চনার দীর্ঘশ্বাস।
সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কাল। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস লন্ডনে ওয়ার কেবিনেটের সদস্য। ভারতে এসেছেন ভারতের ভাগ্য নির্ধারণে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার প্রস্তাব নিয়ে। বাঙ্গালী এক যুবক। লন্ডনে ব্যারিষ্টারি পড়েন। তিনি এসেছেন রিপোর্টার হিসেবে ঘটনাটি কাভার করতে। এই যুবকটির কোনো নাম বইতে পাওয়া যায় না। মিনি সাহেব বলে সবাই ডাকেন। এই মিনি সাহেবের চিঠিটাই এই বই।
dristipat
দৃষ্টিপাতকে একটি তথ্যবহুল উপন্যাসও বলা যায়। সে সময়ের দিল্লীর এতো ভাল বর্ণনা মনে হয় আর পাওয়া যাবে না। দিল্লী কিভাবে তৈরি হয়েছে সেটা জানার জন্য এই বই একটা ভাল মাধ্যম হতে পারে।
কোটেশন হিসেবেও এই বইয়ের তুলনা নেই। বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ-এই ভাবস্প্রসারণ আমরা স্কুলে করেছি। বিতর্কেও আমরা খুব ব্যবহার করতাম। এরকম আরও অনেক কথাই আছে বইটিতে। আর আছে চারুদত্ত আধারকার। মারাঠি এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ, পানীয়ের বিভিন্ন ককটেল তৈরিতে যার জুরি নেই। শিল্পপতি ছিলেন, সব বেচে দিয়ে হয়েছেন চাকরিজীবি। বৈরাগ্যের কারণ প্রেমে ব্যর্থতা। চারুদত্ত পেমে পড়েছিলেন সুনন্দার। সুনন্দা পরস্ত্রী। এক বিপদের সময় আশ্রয় দিয়েছিলেন চারুদত্ত। সেখান থেকে প্রেম। বইটির একদম শেষ ভাগে আছে এই কাহিনী। সুনন্দা কাছে এসেছিল, সুনন্দাই এক সময় দূরে সরে যায়।
‘সে নারী, প্রেম তার পক্ষে একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র। আবিস্কার নয়, যেমন পুরুষের কাছে। মেয়েরা স্বভাবত সাবধানী, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর বাঁধে। ছেলেরা স্বভাবতই বেপরোয়া, তাই প্রেমে পড়ে তারা ধর ভাঙ্গে।’
‘প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্ষ, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কী? তাকে দেয় দাহ।’………..এরকম অনেক কথা আছে বইটিতে।
কে দায়ী, চারুদত্ত নাকি সুনন্দা-এই বিতর্কও আমি অনেক শুনেছি।

জীবনে অনেক বই পড়েছি। কিন্তু দৃষ্টিপাত আমি পড়েছি বারবার। আমি জানি আমি আবারো পড়বো। আমার প্রিয় বই এর একটি দৃষ্টিপাত। বিনয়কৃঞ্চ ঘোষ এর মূল লেখক। ছদ্মনাম যাযাবর। বইটি নিয়ে আরও অনেক কিছু লেখা যেতো। যারা পড়েছেন তাতে তারা বিরক্ত হতেন, আর যারা পড়েননি, তাদের মজাটা নষ্ট করতে চাইলাম না।

ওদের জানিয়ে দাও: নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড় না পড়ে যারা বড় হয়েছেন তাদের প্রতি আমার খানিকটা করুণা হয়। কিশোরদের জন্য শাহরিয়ার কবির অবশ্য পাঠ্য। জাফর ইকবালের যুগ শাহরিয়ার কবিরের পরে। বড় হয়েছি শাহরিয়ার কবির পড়ে। বুড়ো হচ্ছি, এখনো পড়ছি। জাফর ইকবালেও এখন মজে আছি।
শাহরিয়ার কবির আমার প্রিয় লেখক। তবে তাঁর লেখা আমার প্রিয় বই আরেকটি-ওদের জানিয়ে দাও। এটি একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। নিষিদ্ধ রাজনীতির মানুষরা এর মূল সব চরিত্র।
সময়কাল ১৯৭৪। অস্থির এক সময়। দুর্ভিক্ষ তখন দেশের পথে-ঘাটে। রাজু, জাফর আর দীপু। এই তিনজনের উপর দায়িত্ব পড়েছে শ্রেনীশক্র খতমের। সাহেবালী একজন জোতদার, তাকে খতম করতে হবে। দীপুর প্রথম খতম। জাফরের অভিজ্ঞতা ৩শর বেশি খতমের। রাজু ওদের বড় নেতা। তিনজনই বেড়িয়ে যায় খতমের উদ্দেশ্যে।
oder-janiye-dao
তারপরেই বসে দলের গোপন বৈঠক। বিষয় রাজু আর জাফররা খতম লাইন মানতে চাচ্ছেন না। তারা ভাবতে শুরু করছে যে এতে বিপ্লব হবে না। যে কৃষকের জন্য খতম, সেই কৃষক কিন্তু সচেতন না। ফলে আগে ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। এই নিয়ে দলে শুরু হয়েছে দ্বন্দ্ব। রফিক দলের মূল নেতা। গোপন বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় বিপ্লবকে এগিয়ে নিতে হলে হঠকারী যারা তাদের সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। পার্টির মধ্যে আপোষের বীজ রাখলে পার্টিরই ক্ষতি। সিদ্ধান্ত হয় রাজু ও জাফরকে খতম করতে হবে। দায়িত্ব নেয় কেন্দ্রীয় কমিটির কমরেড মানু।
পুরবীর মধ্যেও খতম নিয়ে দ্বিধা দেখা দিয়েছে। পুরবী গিয়েছিল পাশের জেলায় সভা করতে। ফেরার কথা ছিল না, কিন্তু ফিরতে হলো। গোপনে শুনে ফেলে কেন্দ্রীয় কমিটির এই গোপন সিদ্ধান্ত।
সাহেবালীকে খতম করে ফিরছিল ওরা। পথে যোগ দেয় পুরবী। ওরা চারজন পালায়। সেই পালানোটাও সহজ হয় না। পুলিশের হাত থেকে বেঁচে যায় দুইবার। জঙ্গলে হেটে দীর্ঘ রাস্তা পার হতে হয়। ট্রেনে উঠে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। এভাবেই একদিন পৌছে যায় ঢাকায়। সেখান থেকে চট্টগ্রামের জেল পাড়ায়।
এখানেও আছে প্রেম ভালবাসা ও দ্বন্দ্ব। পুরবী বা রাজু। কিংবা পুরবী ও জাফর। বিয়েও করতে হয় পুরবীকে। কিন্তু সময়টা গোপন রাজনীতির জন্য সহজ সময় ছিল না। সিরাজ শিকদারকে মেরে ফেলা হয়। চরমপন্থীদের ধরতে জারি হয় জরুরী অবস্থা। তার আঘাত লাগে এই চারজনের জীবনেও।
এই হচ্ছে বইটির মূল কথা।

পশ্চিমবঙ্গের চারু মজুমদারের লাইন বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশে চিনাপন্থীরাই মূলত এই লাইন বেছে নেয়। ভুলও ছিল তাদের। এদের একটা স্বাধীনতা যুদ্ধেরও বিরোধীতা করেছিল। তারপরেও এই চরমপন্থীরা বঙ্গবন্ধু সরকারের ভিত কাপিয়ে দিয়েছিল।
বাংলাদেশে বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি হয়নি। অথচ আদর্শের জন্য তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ এই খতম লাইনের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৭১ সালে ও এর পরে কোলকাতার রাস্তায় অনেক যুবকের লাশ পড়ে থাকতো। এ নিয়ে পশ্চিম বঙ্গে অনেক লেখালেখি হলেও বাংলাদেশে তেমননি হয়নি।

শাহরিয়ার কবির বলেছেন, এটি কাল্পনিক উপন্যাস নয়। তার ভাষায়, ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে বসে লেখা। কেবল ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
উপন্যাসটি ছোট আকারে ১৯৭৪ সালে বিচিত্রায় ছাপা হয়েছিল। পড়ে এটিকে খানিকটা বড় করা হয়েছে।
শুরুতেই জানা থাকে যে ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক নয়। ফলে পড়তে গিয়ে ভিন্ন এক অনুভূতি হয়। আমাদের বয়সী তরুণরা দেশকে ভেঙ্গেচুরে নতুন করে গড়তে চেয়েছিলেন। লাইন ভুল বলে এখন আমরা জানি। তারা কিন্তু সঠিক মনে করেই ঝাপিয়ে পড়েছিলেন।

এটি আমার প্রিয় বই। আমি পড়েছি অসংখ্যবার। আমি জানি আমি আবারও পড়বো।

যারা সমরেশ মজুমদারের গর্ভধারিনি পড়েছেন তারা কিন্তু কাহিনীর মিল পাচ্ছেন? একই কাহিনী। শাহরিয়ার কবির এটি লিখেছিলেন ১৯৭৪ সালে। আর গর্ভধারিনী প্রকাশ পায় ১৯৮১ সালে। আমি প্রথম বইটি পড়ি ১৯৮৮ সালে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ঐবার বই মেলায় শাহরিয়ার কবিরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম গর্ভধারিনীর কথা। উনি বলেছিলেন, তিনি বইটি পড়েননি, তবে সমরেশ মজুমদার যে ওদের জানিয়ে দাও পড়েছেন সেটা তিনি জানেন।

শেষ কথা: দুটো লেখা এক করে এই পোস্ট। পুরানা লেখা, কিন্তু সিসিবিতে পোস্ট দিতে ইচ্ছা হল তাই দিলাম।

৩,৭০০ বার দেখা হয়েছে

৩৪ টি মন্তব্য : “আমার প্রিয় দুই উপন্যাস”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    যাক ভাইয়া, এতদিনে আমার লাইনের পোষ্ট দিলেন একটা। 😀

    সবুরে মেওয়া ফলে কি বলেন। আমি ভাবছিলাম আবার একটা গুতা দিব নাকি আপনারে। 🙂

    আপনার লেখায় অনেক টাইপো আছে, মোটেই সিরিয়াস মনে হল না বানান নিয়ে B-)


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    'দৃষ্টিপাত' মনে হয় সবারই প্রিয় উপন্যাসের তালিকায় থাকে। 😀
    কলেজে থাকতে পড়েছিলাম, ক্লাস টেনে। তারপর আরো অনেকবার পড়েছি এবং আরো অনেকবার পড়বো।

    যদিও সমরেশ এখন আর খুব একটা টানে না কিন্তু 'গর্ভধারিণী' খুব ভালো লেগেছিলো। 'ওদের জানিয়ে দাও' তাই পড়ার আগ্রহ বোধ করছি। কোন প্রকাশনী বের করেছে জানাতে পারবেন একটু! কিংবা কোথায় পেতে পারি!

    'নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়' বিষয়ে আপনার সাথে একমত। :thumbup:


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
    • শওকত (৭৯-৮৫)

      সমরেশে মুগ্ধ ছিলাম উত্তরাধিকার ও কালবেলা পড়ে। প্রেমিকা রূপে কল্পনা করতাম মাধবীকে। তারপর আর সহ্য হয়নি সমরেশকে।
      ওদের জানিয়ে দাও আমার আগে পড়া, তারপর গর্ভধারিনী। ফলে চরম বিরক্ত হইছিলাম।

      ওদের জানিয়ে দাও প্রথম প্রকাশ করে ডানা প্রকাশনী। সেইটাই আমার কাছে আছে। এরপর কারা বের করেছে আমার জানা নাই।

      জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    শাহরিয়ার কবিরের কিশোর উপন্যাস প্রায় সবগুলোই পড়েছি... "ওদের জানিয়ে দাও" পড়তে হবে, এই ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানতাম না, জানতে হবে।

    সমরেশের বইগুলো খুব আকর্ষন করত, ডুয়ার্সের চা বাগান, স্কটিশ চার্চ স্কুল জায়গাগুলো দেখার সখ এখনো রয়ে গেছে। আর মাধবী... :dreamy: :dreamy: :dreamy: তবে এইভাবে শাহরিয়ার কবিরের থিম মেরে দিয়েছে শুনে খারাপ লাগল।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  4. রাশেদ (৯৯-০৫)

    দৃষ্টিপাত ক্লাস নাইনে পড়েছিলাম কলেজে। এর পরে আর অনেকবার পড়েছি হয়ত আর পড়া হবে। এই বইটা নিয়ে কোন কিছু বলার নাই, আপনি অনেক কিছু বলেছেন হয়ত এই পোস্টের আলোচনায় আর অনেকে অনেক কিছু বলবে তাই থাক।

    আর যদিও আমার কৈশোর কাল কেটেছে জাফর ইকবালের সময় কিন্তু কি ভাবে কিভাবে যেন আমার হাতে আগে পড়েছিল শাহারিয়ার কবীর। তার প্রথম পড়া আমার বই ছিল পাথারিয়ার খনি রহস্য। এরপর তার আর কত কত ক্লাসিক যে আমার দুপুর গুলো আটকে রাখল তার শেষ নেই। আপনার সাথে একমত যারা বই পড়ে তারা যদি কৈশোরে শাহারিয়ার কবীর কে মিস করে তাইলে বেচারারা বুঝল না তার কি মিস করল।

    ওদের জানিয়ে দাও বইটা যেভাবেই হোক খুজে পড়ে ফেলতে হবে।


    মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

    জবাব দিন
  5. আদনান (১৯৯৪-২০০০)

    শাহরিয়ার কবীরের এই বইটা পড়া হয়নি এমনকি যাযাবরের বইটাও পড়া হয়নি । নেক্সট বি কেনার লিস্টে উপরের দিকে উনারা থাকবেন । মাসুম ভাই বইয়ের প্রিভিউ ভাল লেগেছে । আমার তো এখনি কিনে পড়তে ইচ্ছা করতেছে । কেমনে কিনি আর পড়ি :((

    জবাব দিন
  6. দিহান আহসান

    নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়
    ঈশ ভাইয়া!!! তখন শাহরিয়ার কবিরের বই পড়ে ইচ্ছে হত ওদের মত করে ঘুরে বেড়াতে। " ওদের জানিয়ে দাও " পড়া হয়নি। ঠিক বলেছেন ভাইয়া, কিশোরদের জন্য শাহরিয়ার কবির অবশ্য পাঠ্য
    দৃষ্টিপাত স্কুলে থাকতে পড়া হয়েছিলো। এখনতো বাংলা বই পড়া স্বপ্নের কাছাকাছি। 🙁

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মহিব (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।