কালো টাকা কিংবা ফ্ল্যাট

ডিসক্লেইমার কেমনে দেয়: ২৫ বছর আগে গল্প লেখে একটা পুরস্কার পেয়েছিলাম। তখন আমি ক্যাডেট কলেজে পড়ি। খুলনা বিভাগে প্রথম হয়েছিলাম। সেইটাই ছিল আমার লেখা শেষ গল্প।সামু ব্লগে অনেকেই উসকাচ্ছিল গল্প লিখতে। আমিও ফাঁদে পা দিলাম। কেন যেন আগ্রহ হল রম্য গল্প লেখার। তবে এই গল্পটা ঠিক রম্য গল্প না। আবার রম্য গল্পও বলা যায়। কিছু হইলো কিনা বুঝতাছি না……….ভয়ে আছি

আয়নালুল হকের উত্থান বিস্ময়কর। উত্তরের একটা জেলা শহর থেকে ঢাকায় আসার পর তাকে কিছুদিন একটা ৫০ সিসির মোটর সাইকেল চালাতে দেখা গিয়েছিল। অনেকের হৃদয় কাঁপিয়ে পুরান ঢাকার কবিতাকে সেই মোটর সাইকেলের পিছনে বসে থাকতে দেখা যেত কিছুদিন। কবিতার খবর এখন আর তেমন কেউ জানে না। কিন্তু আয়নালুল হকরে চেনে না এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। তবুও পাঠককে মনে রাখতে বলি যে, কবিতা এখন তার স্ত্রী। আর সেই সময়ে কবিতাকে দেখে যাদের চিত্তচাঞ্চল্য ঘটতো এখনকার কবিতাকে একবারের জন্য হলেও তাদের দেখা উচিৎ। চিত্তের আরাম ঘটবে।

একটা প্রভাবশালী চেম্বারের প্রেসিডেন্ট আয়নালুল হক। নিয়মিত খবর কাগজে ছবি ও মন্তব্য ছাপা হয়। টেলিভিশনেও টক শোতে আলো করে বসে থাকেন তিনি। তখন ব্যবসায়ী না বলে অনায়াসে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবেও চালানো যায়। মাঝে মধ্যে সুশীল সমাজের একজন হতে তার বড়ই ইচ্ছা হয়।
আয়নালুল হক দিনটি কিভাবে শুরু করেন সেটি নিয়েই কয়েক পৃষ্ঠা লেখা যায়। তবে পাঠকদের তাতে কি যায় আসবে সেই প্রশ্নের মীমাংশা করা সম্ভব না বলে সে দিকে যাওয়া হলো না। তবে আজকের দিনটির কথা না বললে গল্পটাই শুরু করা সম্ভব হবে না। অন্যান্য দিনের সাথে অবশ্য আজকের দিনটার পার্থক্য আছে। প্রতিদিন সকালে পাশে ঘুমিয়ে থাকা ১৫ বছরের পুরানা বউকে দেখলে তার প্রতিদিনই খানিকটা বিরক্তি লাগে। আজ তাও লাগলো না। অনেক দিন রুবিনাকে নিয়ে গাজিপুরের বাগান বাড়িতে যাওয়া হয়না। আজ সে এটাও মনে করলো না।

ব্যবসায় নতুন কিছু ঘটলে আয়নালুল হকের মেজাজটা ফুরফুরে থাকে। আজ মেজাজটা বেশি ফুরফুরে। ব্যবসা কিভাবে করতে হয় এইটা জানতে হয়। আয়নালুল হক জানে যে এইটা সে ভালই বোঝে। ব্রাজিল থেকে আসা চিনি ভর্তি জাহাজ যাচ্ছিল পাশ দিয়েই। নষ্ট হওয়ায় চট্টগ্রামে কুতুবদিয়ার কাছে আটকে ছিল কয়েকদিন। তথ্যটা পেয়ে আয়নালুল হককে বেশি কিছু করতে হয়নি। দুদিনের মাথায় পত্রিকায় ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের একটা টেন্ডার নোটিশ অনেকেই হয়তো দেখছে, কিন্তু আয়নালুল হক ছাড়া কেউ এই ব্যবসা ধরতে পারে নাই। জরুরী প্রয়োজনে ৫০ হাজার টন চিনি কেনার এই টেন্ডারের শর্ত ছিল একটাই। ৭ দিনের মধ্যে সরবরাহ করতে হবে। নষ্ট হওয়া জাহাজ থেকে চিনি নামাতে ৫ দিনের বেশি সময় লাগে নাই তার। তবে এ জন্য কিছু খরচও আছে। গতকাল বিকালে চিনি সরবরাহ করা হয়েছে টিসিবিকে। আয়নালুল হকের ধারণা সচিব মহাদয়ের ফোন কিছুক্ষণ পরেই পাবেন তিনি।

আয়নালুল হক আজ অনেক ভোরেই উঠেছেন। এখনো ঘুমে স্ত্রী কবিতা। চোখ সরিয়ে নিয়ে স্টাডি রুমে চলে আসলেন তিনি। পত্রিকা দিয়েছে। ৭টা পত্রিকা রাখা হয়। পত্রিকা না পড়লে ব্যবসা করা যায় না। এখনও বাজেট নিয়ে আলোচনা চলছে। এ নিয়ে টক শোতে যেতে হয়, পত্রিকায় মন্তব্য দিতে হয়। পত্রিকাগুলো দেখে কপালে খানিকটা ভাজ পড়লো তার। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে এবার বাজেটে। তিনটি পত্রিকা এর বিপক্ষে মূল শিরোনাম করেছে বা সম্পাদকীয় লিখেছে।

বাজেটে এই সুবিধা রাখতে কম কষ্ট করতে হয়নি আয়নালুল হকের। মন্ত্রীকে বুঝাতে হয়েছে। উপরেও যেতে হয়েছে। এ জন্য উপরে প্রভাব আছে এমন একজন রাজনীতিবিদরে ধরতে হয়েছে। অন্তত তিনজন সচিব, দুইজন যুগ্ম সচিবকে তোষামেদ করতে হয়েছে। তবে আয়নালুল হকের আগ্রহ ছিল একটাই। যাতে পুরানা কারখানা সংস্কার বা আধুনিকীকরণ করলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকে। ব্যাক-টু-বাক এলসিতে নিয়ে আসা কাপড় ইসলামপুরে বিক্রি করে এক সময় প্রচুর টাকা আয় করেছেন তিনি। গার্মেন্টস-এ কোটা বিক্রি করেও আয় কম হয়নি। আরও নানা রকম ব্যবসা আছে আয়নালুল হকের। কিন্তু টাকার পরিমাণটা এতো বেশি বেড়ে গেছে যে কিছু সাদা না করলেই আর নয়।

টেক্সটাইল মিলটার কিছু মেশিন বদলাতে হবে। তাতে ১০ কোটি টাকার মতো লাগবে। আরও কিছু সংস্কার করতে হবে। সব মিলিয়ে ১৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ। এই ১৫ কোটি টাকা খরচ করে অন্তত ১১৫ কোটি টাকা দেখাতে হবে। এই সুযোগটা এবার নিতে হবে। এবার ফ্ল্যাট কিনলেও টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এই পথেও কিছু টাকা সাদা করা যাবে। রেজিষ্ট্রেশনের সময় দেখাতে হবে ২৫ লাখ কিন্তু আয়কর নথিতে লেখা থাকবে ১ কোটি ২৫ লাখ। রুবিনাকে একটা ফ্ল্যাট কিনে দেয়া হবে বলে কথা দিয়েছেন আয়নালুল হক।

ঠিক সাড়ে নটায় প্রথম ফোনটা পেলেন তিনি। এই ফোনটা আসবে জানতেন তিনি। চিনি সরবরাহের সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি। বেশ ভালই লাভ হয়েছে। ফোনে শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ করে গেলেন আয়নালুল হক। সবশেষ হ্যাঁ টা বলে রেখে দিলেন ফোন। দ্বিতীয় ফোনটা তার চট্টগ্রাম অফিসের ম্যানেজারের। বন্দর থেকে ৫০ হাজার টন চিনি দ্রুত খালাস করার দায়িত্ব ছিল তার। ম্যানেজারের কথাগুলো কেবল শুনলেন তিনি। উত্তরে কিছু একটা বলতে ইচ্ছা হলো না। মুখের মধ্যে কেমন তিতা স্বাদ পেলেন তিনি। আবার ফোন বাজছে। মোবাইলটার দিকে তাকালেন। চেনা নাম্বার। সেই রাজনীতিবিদের। যাকে দিয়ে উপরে গিয়েছিলেন তিনি। ফলে কালো টাকা সাদা করা সুযোগ বাজেটে রাখা গেছে। ইচ্ছা করছে লাইনটা কেটে দিতে। কিন্তু আয়নালুল হক জানেন সেটা সম্ভব না। কেন জানি মনে হচ্ছে ফোনে কি শুনতে হবে তা জানেন তিনি।
-আপনার কাজটা তো হলো।
-আপনার দোয়া ভাইজান। আপনরা আছেন বলেই তো কিছু একটা করতে পারছি।
-আমার জন্য কি ভাবলেন?
-আপনার জন্য তো আমিই আছি। ভাবছি এবার নতুন কিছু দেওয়া যায় কীনা।
-তাই নাকি। কি সেইটা
-ভাবছি, গুলশানে আপনার জন্য একটা ফ্ল্যাট রেখে দেই। এবার তো বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া হবে। তাই আপনার নামেই ফ্ল্যাটটা বুকিং দেই। পছন্দ হয়েছে ভাইজান?
-এই জন্যই আপনার সাথে কাজ করতে সুবিধা। আপনি ঠিকই বুঝে ফেলেন কি চাই। আমি তো এই কথাটাই বলতে চেয়েছিলাম।

আয়নালুল হক একদিন আগেও কিন্তু বিষয়টা বোঝেন নাই। বুঝেলেন একটু আগে। সকালে ফোন দুটা পেয়ে। প্রথম ফোনে সচিব মহাদয় অন্য কিছু না, একটা ফ্ল্যাটের আবদার করেছেন। এবার এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সুযোগটা হাতছাড়া করতে চান না তিনি। চট্টগ্রাম অফিসের ম্যানেজারেরও এক কথা। বন্দরের উপরের পদে যে ব্যক্তি নষ্ট হওয়া জাহাজের তথ্যসহ চিনি খালাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তারও চাহিদা এই ফ্ল্যাট। কেউই এই সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি না। রাজনীতিবিদ ভাইজানরে তাই কথা বলার সুযোগ না দিয়ে প্রথমেই জানিয়ে দিলেন একটা ফ্ল্যাট কিনে দেওয়া কথা। তিনি জানতেন এটাই শুনতে চাচ্ছিলেন তিনি।

মুখের মধ্যে আবারও তিতা স্বাদটা ফিরে এলো আয়নালুল হকের।

(আবারো ডিসক্লেইমার: জীবিত বা মৃত কারো সাথেই এই গল্পের কোনো মিল নাই।)

৪,৫৯০ বার দেখা হয়েছে

৫৬ টি মন্তব্য : “কালো টাকা কিংবা ফ্ল্যাট”

  1. সাব্বির (৯৫-০১)

    আপনার লেখা পইড়া ফ্ল্যাট পাইতে মঞ্চায় :dreamy:

    মাসুম ভাই আপনি শুধু গল্প কেন, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, নাটক যা লিখবেন সবই :gulli: হবে।
    অ ট ১ আমি কিন্তু তেল দেই না :-B
    অ ট ২ ভাইয়া আপনি কি আগে ইত্তেফাকে বসতেন? তাহলে আমি মনে হয় আপনার অফিসে গেসিলাম। আপনার মনে নাও থাকতে পারে, আমার মনে আছে। আপনে কিছু খাওয়ান নাই :((

    জবাব দিন
  2. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    মাসুম ভাই,
    লেখা জটিল হইছে (অবশ্য আপনার লেখা কবেই বা খারাপ হইছে?)...
    দেইখেনতো ভাইয়া ফ্ল্যাট আমার লইগাও একটা জোগাড় করতে পারেন কিনা... আমিতো ভাই মফস্বলের লোক...ঢাকায় থাকার জায়গা নাই...একটা ফ্ল্যাট পাইলে ব্যাপক উপকার হইত...

    আর সাব্বিরের মত আজাইরা পোলারে খাওয়াইয়া লাভ নাই...ওর কিন্তু পল্টি মারার অভ্যাস আছে... আজকে খাওয়াইবেন তো কালকেই ভুইলা যাইবো... এরচেয়ে বরং আমাদের মত যারা ভদ্র ছেলে আছে তাদেরকে খাওয়াইয়েন...আখেরাতে ফ্ল্যাট পাইলেও পাইতে পারেন...

    জবাব দিন
  3. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    ইদানিং মাল মুহিতরে টিভি পর্দায় বা খবরের কাগজে দেখলে আমি চোখ সরিয়ে নেই, তাকাতে ইচ্ছে করে না।

    আয়নালুল হক আর রুবিনা'র গল্প পড়ার সময় বারবার কিছুদিন আগে দেখা একটা স্টিল ছবি ভাসছিলো চোখে, এখানে দেয়া ঠিক হবে না ভেবে আপনার মেইলে দিলাম। মজা পাবেন।

    রম্য গল্প পড়েও কেন জানি খুব কষ্ট লাগলো।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  4. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। ফার্স্ট অফ অল ক্রেডিট গোস টু শওকত ভাই, হু রাইট সো নাইস গল্প। সামু ব্লগার ওয়ার্কস হার্ড টু মেক হিম রাজি।

    আর কিছু কওয়ার নাই। :just: :hatsoff:

    জবাব দিন
  5. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    শওকত ভাইয়ের আরো গল্প পরতে মঞ্চায় :dreamy: :dreamy: :dreamy:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহসান আকাশ (৯৬ - ০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।