২০০২, জুন… মনে আশ, খেলাম বাশ

সিরিয়াল ৯
২০০২, জুন… মনে আশ, খেলাম বাশ

সবাই ঘুমিয়ে গেছে। মন হঠাত খারাপ লাগছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি একা অন্ধকারে। এভাবে জোর করে মানুষটাকে হারানো ঠিক হয়নি। বেচারা পরে জিদ করে নিজেই বারবার হারলো।
আজকে খুব জ্যকেটওয়ালার কথা মনে পড়ছে। ইস, চেহারাটা দেখা হয়নি। আর কোনদিন দেখাও হবে না মনে হয়। আচ্ছা জ্যকেটওয়ালার নাম যদি রায়হান হত! আমার প্রিয় নাম। আমার হাতে এক টা মজার জিনিস আছে। বিরাট একটা ” A” আছে দুই হাতের তালুতে। তার মানে কি আমার ভাগ্যে ” A” নামক ব্যক্তি আছে?আবোল তাবোল ভাবছি সব। আমার ইচ্ছা গোপনে গোপনে কিন্তু ফাইনাল। কিন্তু কেউ জানে না। কেবল আমার ডায়রি জানে। নাম হবে রায়হান। আর…অবশ্যই আমার পণ পূরণ করতে হবে। পুরণিমার রাতে আমাকে গলায় শিউলি ফুলের মালা পড়াতে হবে। নাহলে নো বিবাহ।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাত মনে পড়ল ২ দিন পর ঢাকা যেতে হবে,নাটোর ছেড়ে। তারপর একদিন অস্ট্রেলিয়া যাব। সবাইকে ছেড়ে একা। কান্না লাগছে। কখন যেন, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। হঠাত মাথায় বাজ পড়ল যেন কথা শুনে
আরিফঃ একা একা কাদছো কেন?
আমিঃ আপনি এখানে এত রাতে? কেউ দেখলে আমি মরে যাব
আরিফঃ আগে বল কাদো কেন?
আমিঃ কে বলে আমি কাদি?
আরিফঃ বললে, এখনি বিয়ে করে নিজের কাছে নিয়ে যাই। একদম কাদতে হবে না, প্রমিজ
রাত দুপুরে এইরকম ভয়াবহ প্রপোজ! আমি ভয়ে ঘরে গিয়ে খালামনির পাশে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে পাত্রমিয়াকে দেখে আমি লজ্জায় আর তাকাতে পারছি না। আব্বু বলল সবাই উত্তরা গনভবন যাবে।
এত সুন্দর এই জায়গাটা! যত দেখি তত ভালো লাগে। পাত্র আজকে আর আমাকে দেখে ভেংচি কাটে না। মিটিমিটি হাসে। তাই দেখে আমি লজ্জায় আধা হয়ে যাচ্ছি। পুকুরপাড়ে জোড়ায় জোড়ায় সব কপোত কপতি বসে আছে। তাই দেখে আরিফ সাহেব ফিসফিসিয়ে বলে…” দ্যাখো কিভাবে প্রেম করে?”
আমিঃ জামাই বউও তো হতে পারে।
আরিফঃ দেখি এরা কি!
কিছু বোঝার আগেই তিনি মেহগনি গাছের পড়ে থাকা ফল নিয়ে কপোতের গায়ে ছুড়ে মারলেন। লোকটা খেকিয়ে গালি দেয়া শুরু করল। আমি দেখি, আরিফ সাহেব গায়েব। আমি একা দাঁড়িয়ে গালি খাচ্ছি। ভয়ে আমি সরে সবার মাঝে গেলাম। সবাই রাজার ঘর, দীঘি দেখছিল। আবারো আরিফ সাহেব ফিসফিসিয়ে বলে…” কালকের শোধ”
আমি এভাবে বাশ খেলাম! এই লোকটা আসলেই খারাপ! অথচ কাল রাতে…

সিরিয়াল ১০
২০০২ জুন, মাথা টাক করব

উত্তরা গনভবন দেখব কি! কপোতের মাথায় আরিফ সাহেব মেহগনি ফল মেরে যে গালি শুনিয়েছে, তা আমাকে দুনিয়ার সকল ভবন দেখেও অবাক করবে না। বেচারা আবার টাক ছিল। ফল মাথায় পড়ে তার উইগ খুলে গিয়েছিল। বেইজ্জত হয়েছে বেচারা কপোত তার কপোতির সামনে।
আমি ভাবছি কিভাবে প্রতিশোধ নেয়া যায়। বাসায় ফিরে শুনলাম আব্বু আর পাত্রমিয়া আমাদেরকে রেখে আগেই ঢাকা যাবে। আমরা আরো ২ দিন থাকব।মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আব্বু গেলে মজা হবে কিভাবে? আর পাত্রমিয়া গেলে প্রতিশোধ নেয়া হবে কিভাবে? আমি মুখটা ভার করে গেলাম তার কাছে। সিলিং ফ্যানের সাথে টেবিল ফ্যানেরও বাতাস খাচ্ছে মহারাজ খাটে বসে বসে। আমি সামনে দাড়ালাম।
আমিঃ চলে যাবেন কেন? বিয়ের আশা মিটে গেছে?
আরিফঃ হাহাহা তা কি আর মিটে? না বললেও রাজী। হ্যা বললেও রাজী
আমিঃ সবাই যে জামাই আদর করছে! আপনার পাত্রীরাও তো মহাখুশি। কেউ তো না বলে নাই।
আরিফঃ ও তার মানে আর ডোজ দেয়া লাগবে না? তোমার কি রঙ পছন্দ?
আমিঃ কিসের ডোজ?
আরিফঃ সকালে দিলাম, গণভবনে! আচ্ছা, তোমার কি রঙ পছন্দ?
আমিঃ নীল। কেন?
আরিফঃ বিয়ের শাড়ি কেনা লাগবে না? নীল শাড়ি বিয়েতে পড়া যায়?
আমিঃ দাড়ান, দাড়ান, আমি কি আপনাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি?
আরিফঃ তুমিই তো বললে ” কেউ তো না বলে নাই।”
আমিঃ উফ! আমি কিছুতেই বুঝি না, সব কথা বারবার এই বিয়েতে কেন যায়?
আরিফঃ সিধা কথায় একবারে মেনে নিলে তো আর বারবার বলতে হয় না
আমিঃ ধুর আমি বলতে আসলাম আপনার যাওয়ার দরকার নেই। আর আপনি? থাক, চলে যান।
আরিফঃ ভেবে দ্যাখো, গেলে কিন্তু গেলামই। ( হাত টেনে ধরে বলল)
আমিঃ যান, তাতে আমার কি? ( হাত ছাড়িয়ে নিলাম)
উলটা ঘুরে হাটা ধরব হঠাত মাথার চুলে টান লাগল। আমার তখন কোমর সমান লম্বা চুল।
আমিঃ চুল ছাড়েন (উলটা ঘুরেই আছি)
আরিফঃ আমিতো ধরে রাখিনি
আস্তে আস্তে সোজা ঘুরে দেখি আমার চুল দাড়ানো আরিফ সাহেব এর মুখের ওপর জট পেকে আছে। সরাতে গিয়ে দেখি আসলে তার শারট এর বোতামে কিছু আটকে আছে, আর কিছু টেবিল ফ্যানে আটকে আছে। সব শেষ। টাক ছাড়া আর উপায় নেই।
আমিঃ এখন কি টাক হতে হবে! আমার এত সাধের চুল! (ভয়ে আমার কান্না চলে এল)
আরিফঃ একটা চুলও কমবে না, চুপ করে দাঁড়াও
একটা একটা করে চুল ছাড়াচ্ছেন তিনি। সারাজীবন পার হয়ে যাবে। আমি ভয় পাচ্ছি কেউ যদি দেখে আমি এভাবে পাত্রের এত কাছে দাঁড়িয়ে আছি! সব চুলই প্রায় ছাড়ানো শেষ। আর একটু বাকী। হঠাত শুনি আব্বু ডাকছে। এখন কি হবে! যদি দেখে! অপেক্ষা না করে খানিক চুল ছিড়ে নিয়েই দৌড়ালাম।মাথাটা ঝিমঝিম করছে ব্যাথায়।
আব্বু ক্যারাম খেলতে ডাকছে সবাইকে। আমি ঠিক করলাম আজকে আব্বুর জোড়া হব, পাত্রের না। পাত্র দেখি আমার দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইল। কেন যেন মনে হল, তার মন খারাপ। একটু পর বাথরুমে যাবার কথা বলে তিনি গেলেন। একটু পর এলেন। এসেই লুকিয়ে ক্যারাম বোরডের নিচ দিয়ে রাগ করে জোরে আমার হাত চেপে ধরলেন। একে তো ব্যাথা লাগল, তার ওপর মনে হল কাটা ফুটছে আমার হাতে।
আমি ব্যাথায় উফ করে উঠলাম।
আব্বুঃ কি হল?
আমিঃ আব্বু বোরডের পেরেক লাগল হাতে
হাত সরিয়ে দেখি আমার তালুতে দুই তিনটা ক্যাক্টাস গাছের কাটা। তাতেই এত ব্যাথা! পাত্র তখন দেখাল পাত্রের বাম হাতের তালুতে শ খানেক কাটা। দেখলাম কেবল আমি সবার অলক্ষ্যে। ব্যাথায় তার চোখ মুখ লাল। আমি একই সাথে অবাক হলাম আর ভয়ও পেলাম। আজ পাত্র একদম ভালো খেলছে না
আরিফঃ এখন কি আমার সাথে জোড়া হয়ে খেলবে? আজকে তো আমি পারছি না
আব্বুঃ দাও একটু খেলে, যদি জিতাতে পার! হাহাহা( আমার দিকে তাকিয়ে)
আমিঃ এই গেমটা শেষ করে নেই
আরিফঃ আচ্ছা আমি বাথরুম থেকে এসে খেলছি
আব্বুঃ ওর কি পেটে সমস্যা নাকি জিজ্ঞাসা করে আসোতো!
পাত্র আর আসে না। দেখি গিয়ে ঘরে চুপ করে শুয়ে আছে। আমি গিয়ে বললাম আব্বু ডাকে। তাও কথা বলে না। উকি মেরে দেখি চুপ করে তাকিয়ে আছে।
আমিঃ কি হল যাবেন না?
আরিফঃ আমার জোড়া না হলে খেলব না
আমিঃ আপনি হাতে কাটা ফুটিয়েছেন কেন? খেলব না জোড়া হয়ে।
কিছু বোঝার আগেই তিনি জানালায় রাখা ভয়ংকর ক্যাক্টাস এর ভিতর তার দুইটা হাত ঢুকিয়ে দিলেন। এবার তার দুইহাত ভরে গেল জমা জমা রক্তে। তার চোখে স্পষ্ট পানি জমে আছে। আমি এরকম কোন দিন দেখিনি। কি করব! কি বলব! আমি ভয়ে কেদে ফেললাম।
আরিফঃ কাদছ কেন?
আমিঃ সবাই যদি দেখে তার হাত ভরা কাটা আর রক্ত। কি বলবে!
আরিফঃ ও তাহলে আমার জন্য না!
এবার পাজী লোক টা জিদে কেদে ফেলল ঝরঝর করে। আর ঘাপ্টি মেরে মাথায় কাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি প্রথমেই আব্বুকে বললাম আরিফ সাহেবের মাথা ব্যাথা। আমি মাথা টিপে দিচ্ছি। তারপর চুরি করে খালামনির ভ্রু প্লাক করা শৌন এনে এক এক করে কাটা তুলছি। রাগ আছে বান্দার। হাত ধরতেই দেয় না। একটু পর পর নানারকম মাথা মালিশের বাম আসছে নানাজনের কাছে থেকে আর আমি সবাইকে দেখিয়ে সবই তার মাথায় মালিশ করছি। কি অত্যাচার! তার চোখে কান্না, মুখে হাসি। কারণ, বাম এর ঝাজে তার চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে।
আমিঃ কিন্তু মামার দেয়া ট্যাব্লেট যে খেয়ে ফেললেন?
আরিফঃ খাইনি( জিভের নিচে লুকান ট্যাব্লেট)
আমিঃ নেন সব কাটা তোলা শেষ
আরিফঃ তাহলে কি আরেকবার কাটা ফুটাব?
আমিঃ আবার কেন?( ভয়ে আরতনাদ)
আরিফঃ আর বেশিক্ষণ পাশে থাকা যাবে
টেবিলে রাখা পানির গ্লাস এর পানি পাত্রের মাথায় ঢেলে আমি দৌড়!
আরিফঃ তোমার চুলগুলো কি আমি ঢাকায় নিয়ে যাবো নাকি দিয়ে যাবো?
কে শুনে কার কথা। আমি আর সীমানায় নাই…।

১,০২৬ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “২০০২, জুন… মনে আশ, খেলাম বাশ”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    একেক পর্বে ট্যাগ পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে দেখি। আজকে দেখি আত্মজীবনী বলা হচ্ছে। বেশ!
    লেখা যথারীতি সুস্বাদু।
    ফেসবুকে গল্প অনেকদূর এগিয়ে গেছে দেখেও ওখানে পড়ছিনা। সাস্পেন্সটা এখানেই ধরে রাখতে চাই।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।