২০০২, জুন…হারডিঞ্জ ব্রীজ

সিরিয়াল ৭
২০০২, জুন…হারডিঞ্জ ব্রীজ

ছোটবেলা থেকে আমার হাইট ফোবিয়া আছে। আমি ৩ তলার বেশি উচুতে উঠলেই মাথায় চক্কর। আমি অবশ্য এটা সবাইকে বলি না। যাই হোক, নানাবাড়ীর সবাই আর আমরা হারডিঞ্জ ব্রীজ এ পৌছে গেলাম মাইক্রোতে চড়ে। আমি শুধু প্লানে আছি ওই বদ লোক কে কিভাবে শায়েস্তা করা যায়।
আমিঃ আমিতো কানা তাই সানগ্লাস পড়ি না। আপনি সানগ্লাস পড়েন না কেন? রোদ থেকে চোখ না বাচালে এত মানুষের দিকে নজর দিবেন কিভাবে?
আরিফঃ আমার নজর এতো দূরবল না যে এইটুকু রোদে কমে যাবে। আমরা খেয়ে বড় হয়েছি…হেহেহে তোমার মত কাঠি না
আমিঃ আমি কাঠি, আপনি জানেন আমার ওজন ৫০ কেজি
আরিফঃ কোন মেশিন বলে? মেশিন নষ্ট শিওর
আমিঃ খালামনি, এদিকে আসো। আরিফ সাহেব কি বলেন জানো? বলেন, তিনি নাকি তার বউকে কোলে নিয়ে এই ব্রীজ পার হতে পারবেন। উনার নাকি এতই শক্তি। বউ এর ওজন ৮০ কেজি হলেও পারবে। তোমার ওজন কত খালামনি? ( আমি কিন্তু জানি যে, আমার মটু খালামনির ওজন ৮৮ কেজি)
এইবার আরিফ সাহেব বোকা বনে গেল। কোন কথা নাই, আর খালামনি লজ্জা। আমি মনের আনন্দে ইতিউতি তাকাচ্ছি
আরিফঃ কোলে উঠবা সিধা বলো। খালামনিকে সাক্ষী আনার দরকার কি? আমি ৫০+ ৮০ দুই ওজন ই টানতে পারব।
বদ লোকটার সাথে কথায় পারা মুশকিল। হই হই করে সবাই ব্রীজে যাওয়া শুরু করল। ব্রীজটা আর তার চারপাশের সবকিছু এতই সুন্দর যে, আমি কিছুক্ষণের জন্য প্রতিশোধ ভুলে গেলাম। পাত্র তার চারপাশে সকল নারী নিয়ে মনের আনন্দে ব্রীজে যাচ্ছে। আমি কিছুদূর যাবার পর হঠাত চোখ গেল পানিতে। আর আমার মনে হতে লাগলো আমি পানি থেকে প্রায় ১০০ তলা সমান উচুতে। চোখ আন্ধকার। কোনমতে সামলে নিয়ে বীজের রেলিং ধরলাম। কিন্তু চোখ বারে বারে পানিতে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে রেলিং ধরে আছি। আর সবাই ব্রীজের মাঝ বরাবর চলে গেছে।
আরিফঃ কি করো?
আমিঃ ঘাস কাটি। চোখে দেখেন না, ব্রীজ দেখি, পানি দেখি।
আরিফঃ চোখ বন্ধ করে এতো কিছু দেখ?
আমিঃ আপনার সমস্যা? আমি চোখ বন্ধ করেই সব দেখি
আরিফঃ চোখ বন্ধ করে তো আমি ছাড়া আর কাউকে দেখা সম্ভব না। পানি, ব্রীজ কিছুই না। ও হ্যা, ঘাসও কাটা সম্ভব না।
আমি রাগে মন হল খেয়ে ফেলব এই লোকটাকে।
আরিফঃ ঘাস কাটা হয়ে গেলে চল যাই। তোমার আব্বু বলেছে ব্রীজের মাঝখানে একসাথে সবাই ছবি তুলবে। চাইলে ৫০ কেজি ওজন উঠিয়ে ওখানে নিয়ে যেতে পারি।
আব্বু আম্মু সবাই ডাকছে, কিন্তু আমি এক পা ও নড়তে পারব না। এত উচুতে ভয়ে আমার গা থরথর করে কাপছে।
আরিফঃ তুমি ক্যাডেট ছিলা সত্যি? নাকি আমাকে ইম্প্রেস করার জন্য বানিয়ে বলেছে তোমার আব্বু?
আমিঃ আমার আব্বু বানিয়ে কথা বলে?
আরিফঃ বলতেই পারে। ভালো ছেলে দেখে ।
আমিঃ আমি কিন্তু আপনাকে একটা ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিব। আপনি এতো খারাপ কেন?
আরিফঃ খারাপ হলে কি আর তোমার আব্বু পটিয়ে নাটোর আনতো?
আমিঃ আমার আব্বু পটিয়ে এনেছে?
ঝগড়া চলতেই থাকলো। ৫ মিনিট পর দেখি আমি আব্বু আম্মুর পাশে। আর সবাই বলছে,” তোমরা কি নিয়ে এতো রাগারাগি করছিলে?” তার মানে আমি চোখ খুলে হেটে এই ব্রীজের মাঝখানে চলে এসেছি? এই লোক আমার সাথে ঝগড়া করে ব্রীজ পার করিয়েছে! আমি অবাক হয়ে ব্রীজ আর সবাইকে দেখছি। আম্মু বলে, ” কি হল কথা বল না কেন?”
আমি কি বল্ব, ভেবেই পাচ্ছি না।
আরিফঃ কি আর বলবে, বলে এই ব্রীজ নাকি ১৯২০ সালে বানানো। আমি বলি আরো আগে, ব্রীজের চেহারা দেখ না। ও শুনেই না
আমি এখনো অবাক হয়েই তাকিয়ে আছি। লোকটা আসলে কি?
সবাই অনেক ছবি তুলল। আমি আর ঝগড়া করিনি। ভাবছি লোকটা আসলে একটু ভালোই
আরিফঃ আচ্ছা আমরা হানিমুনে এখানেই আসব, কেমন? ( কানে কানে বলে)
আমিঃ আমি হানিমুনে? আর একটা বাজে কথা বললে আমি একটা ঝাপ দিব
আরিফঃ ঝাপ! হেহেহে, আগে ব্রীজে উঠতে তো হবে তার জন্য! ওইটা তো আমাকে ছাড়া হবেনা!
আমিঃ তাহলে আপনাকেই ফেলে দিব
আরিফঃ যেই হাত একবার ধরেছি, তাতো ছাড়ব না! ধাক্কা দিলে তুমি সহই পড়ব। তাছাড়া, আমি সাতার জানি
আমিঃ আপনি আমার হাত ধরেছেন কেন? কেউ যদি দেখে কি বলবে? ছাড়েন!
আরিফঃ এখন আবার পার করতে হবে তাই রেডী হয়ে আছি
আমিঃ আমি আপনার হাত ধরে পার হব? পাগল নাকি?
আরিফঃ আসার সময়তো তাই করেছ। ঝগড়ায় টের পাওনি
আমি এই লোকের হাত ধরে ব্রীজ পার হয়েছি! পাটক্ষেত পার হয়েছি! আল্লাহ আমার হাত কেন দিয়েছো! আমি সোজা গিয়ে আব্বুর হাত ধরে মনের আননে চোখ বন্ধ করে ব্রীজ পার হলাম।একবারে পার হয়ে চোখ খুলে দেখি বদ লোকটা আমার দিকে চেয়ে হাসছে ভিলেনের মত।

২০০২, জুন… বারি বরষণ

হারডিঞ্জ ব্রীজ দেখা শেষে পুরো রাস্তা আমি পাত্রের সাথে গাড়ির লুকিং গ্লাসে দাত মুখ খিচিয়ে ঝগড়া করলাম। পাত্রীরা দেখল না। আমি যেদিকেই মুখ ঘুড়াই, যা যা করি, তিনিও তাই করেন, talking tom এর মত। দুপুরে্র ভাত খাচ্ছে সবাই।
আরিফঃ গ্লাসের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমার মুখ দেখা যাচ্ছে নাকি পানিতে?
আমিঃ হুম আপনার মত একটা মাছি পানিতে পড়েছে, তাই দেখছি
আরিফঃ বাহ, আজকাল মাছির মধ্যেও আমাকে দ্যাখো, ভালই তো
নিজেকে নিরুপায় লাগছে। যুদ্ধে হেরে যাচ্ছি
মাইক্রো ড্রাইভারকে খেতে দিয়ে আমরা গিয়েছি পুঠিয়া রাজবাড়ীতে।
আমিঃ কি সুন্দর প্রাসাদ। কিন্তু সামনের দরজা এতো বড় আর পিছনে রাণীমহলের এতো ছোট দরজা কেন?
আরিফঃ যেন কেবল রাজা আসতে যেতে পারে
আমিঃ মানে কি?
আরিফঃ রাজা রাণী তোমার আমার মত সাইজ ছিল
আমিঃ আমি কি আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেছি? কোথা থেকে এসে জবাব দিচ্ছে!
আরিফঃ নাটোর ও গরম, নাটোরের মানুষের মেজাজ ও গরম
আমিঃ আপনার জন্য তো রাস্তায় এসি থাকবে না
আরিফঃ কিন্তু বৃষ্টি তো হতে পারে?
আমিঃ ঐটা ভালো মানুষের জন্য স্টক করা
আরিফঃ দেখি হয় কি না।
ড্রাইভার ভাত খেতে গিয়ে হারিয়ে গেছে বাজারে। আমরা তাই নসিমনে চড়ে আগাচ্ছি। খারাপ লোক্টার কথা মত হুডবিহীন এই যানের ওপর আকাশ ভেঙ্গে বারি বরষণ। তার সাথে বিজলীর চমক ফ্রি।
সবাই ভিজা কাক হয়ে মাইক্রোতে উঠলাম আর ঘরে ফিরলাম।
সবাই ক্যারাম খেলবে চা খেয়ে। টুরনামেণ্ট হবে। তার আগে আমার সাথে আরিফের খেলা হবে সিঙ্গেল। আমি হেরেছি
আরিফঃ তুমি না ৬ বারের টানা চ্যাম্পিয়ন! হেহেহে তোমার কলেজে কেউ কি খেলতেই পারে না?
আমি রেগে পরের বার নীল গেম দিলাম।
এবার জোড়ায় জোড়ায় খেলা টুরনামেণ্ট। টিকে আছি আমি, আরিফ, আব্বু আর ছোট মামা। ছোটমামা আব্বুর সাথে জোড়া হল জিতার আশায়। আমি আর আরিফ জোড়া। টাকা খসানোর জন্য আমি ইচ্ছা করে খারাপ খেললাম…প্রতিশোধ। কিন্তু পাত্র মিয়াতো রাগে না। হাসতে হাসতে হারছে। কি বিপদ! ১০০০ টাকা হারল। আমি তাই এবার ভালোমত খেলছি। কিন্তু এবার আরিফ সাহেব খারাপ খেলছেন। একটা হিটও ভালো করে না। আমার দিকে তাকিয়ে শুধু হাসে। আমি খেলব না। তাও খেলবেই।
আরিফঃ দেখি আমার জোড়া হয়ে কত হারো তুমি
৩২০০ টাকা হারল। আমার মন খারাপ।
আমিঃ এত হারলে খেলা যায়! আপনার জোড়া হব না
পাত্র এবার এক হিটে ১৪ করল, আর গেমও জিতল। ঘুমাতে যাবার আগে সবার অলক্ষ্যে কানে কানে বলে গেল, ” আমার হার বেশিক্ষণ দেখতে পারলে না?”
আবারো সারা রাত বারি বরষণ হল। এতো বৃষ্টি নাটোরে হয় না তো!

১,৩৮৮ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “২০০২, জুন…হারডিঞ্জ ব্রীজ”

মওন্তব্য করুন : শর্মিলী আনোয়ার (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।