হারানো শৈশব

সে ছিল এক আজব সময়। ছিল ঘুম থেকে না উঠতে চাওয়া সকাল, দুরন্ত দুপুর, অবাধ বিকেল, ঘরে ফেরা সন্ধ্যা, ঘুমানোর রাত। সবকিছুর জন্য, মনে হয় ছিল আলাদা আলাদা সময়। বাবা-মার ডাকে, আদরে-বকাতে “আজ স্কুলে যাব না, আজ স্কুলে যাব না” অনুরোধ, শেষমেশ পাষাণ বাবা-মার দয়া-হীনতায় মুদিত চক্ষু ডলতে ডলতে কলপাড়ে দাঁড়ানো, হিম শীতল পানিতে গোসল করে মাঘ মাসের কাপাকাপি করতে করতে বাবা-মাকে মনে মনে গালমন্দ। স্কুলের কাপড় পরে, চুল আঁচড়িয়ে ফিট বাবুটা হয়ে সুজি-রুটি, কোনদিন আলুভাজি-রুটি। তারপর! তারপর কাঁধে ব্যাগ, হাতে ওয়াটার-পট নিয়ে, বাবা-মার কোলে বসে রিকশায় চেপে রওনা। এই হত দিনের শুরু। আমাদের সময়কার শৈশবের, দিনের সূচনা।

এখনকার মত পাউরুটি, মাখন, জেলির প্রচলন তখনও আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারে হয়নি। ওগুলো কেবল নাটক-সিনেমার কুশীলবদের জন্য। আবাস ছিল ঢাকার উত্তর প্রান্তে। তখনও এ প্রান্তে স্কুল ছিল হাতে গোনা, তাও নাকি ভদ্র সমাজে কিঞ্চিৎ অপরিচিত। তাই বাবা-মার হাত ধরে, বড় ভাই আর আমার স্কুল জীবন কেটেছে ফার্মগেটে। তখন ছিল না এত জ্যাম, এত বাস, এত লোক। বড় রাস্তায় দাঁড়ালে ডেকে ডেকে বাসে তুলে নিত হেলপার। অফিস সময় ভিড় হত বেশ। তাও হাওয়া চলত বাসের ভেতরে। ভিড়ের মাঝে মায়ের কোলে বসে দেখতাম হেলপার ব্যাটা, কি সুন্দর দরজায় দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছে, দেখে ছোটবেলায় খুব শখ হয়েছিল বড় হলে বাসের হেলপার হব। ভিড়ের মাঝের লোকজনকে দেখিয়ে হাওয়া খাব।

যদিও ঘুম থেকে না উঠতে চাওয়া, স্কুলে না যাওয়ার বায়না ছিল নিত্য দিনের অজুহাত। কিন্তু স্কুলে গেলে কিন্তু সব অন্যরকম। সকালবেলা ব্যাগটা ক্লাসরুমে রেখেই ছুট দিয়ে ধরতে হত মর্নিং এসেম্বলি। সকালের মিষ্টি রোদে দাঁড়িয়ে “আরামে দাড়াও”, “সোজা হও”; ভাল মানুষ হওয়ার শপথ। শেষে হত জাতীয় সংগীত। এভাবেই শুরু হত স্কুল। চার পিরিয়ড ক্লাস করে টিফিন পিরিয়ড। কোনদিন বুন্দিয়া, কোনদিন প্যাটিস, কোনদিন মিষ্টি। সেসব নিয়েও কাড়াকাড়ি। টিফিন পিরিয়ডে শুরু হত ক্রিকেট, ফুটবল, দৌড়াদৌড়ি, আমাদের স্কুলটা ছিল বেশ বড়। সামনে মাঠ, পেছনে মাঠ, অনেক গাছপালা, স্কুলের মাঝে বিশাল ফুলের বাগান, পিছনে পুকুর, সাথে বিশাল এক নীল আকাশ। যার যেখানে খুশি, চড়ে বেড়াত। বাঁধা দেওয়ার কেউ নেই। উদ্দাম শৈশবকে রোখে সাধ্যি কার?

আমি বোধহয় ছিলাম একটু আজব কিসিমের। খেলতে একেবারেই পারতাম না, তা বলব না। কিন্তু খেলার চেয়ে আমায় টানত ঘোরাঘুরির নেশা। টিফিন টাইমে ফাকা জীববিদ্যা ল্যাবের কংকালটার সাথে কুশল বিনিময় করাটার প্রতি, ছিল আমার এক অমোঘ টান। সেই কংকালটাকে নিয়ে কত আজগুবি কাহিনী। সে জন্যই বোধ হয় ভয়-মাখা রোমাঞ্চ কাজ করত। এছাড়া ছিল স্কুলের পেছনে বিশাল মাঠ, যেখান থেকে দেখা যেত পেছনের গির্জার ক্রুশটা; ছিল পুকুরটা, যেটাতে নাকি প্রতি বছর একটা করে ছেলে ডুবে মরত। আর ছিল জংলা, নির্জন জায়গা। সবই আমাকে খুব টানত। এক-দুজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম প্রতিদিনের রোমাঞ্চে। রহস্যের গন্ধে ছুটে বেড়াতাম রহস্য উন্মোচনে। এভাবেই পার হত টিফিন টাইম।

ক্লাস ওয়ান-টুতে ছিল ক্লাস চার পিরিয়ড। টিফিন টাইমেই শেষ। একটু বড় হলে পাঁচ পিরিয়ড, আরও বড় হলে সাত। ছিল বন্ধুদের সাথে মারামারি, ছিল ঘুসি, লাথি, চড়, থাপ্পড়। সবই বন্ধুত্বের বহিঃপ্রকাশ। ঝগড়া-মারামারি করেই না আপন হলাম আমরা, একে অপরকে চিনলাম, জানলাম। ছিল সারের বকা, কানমলা, বেতের বাড়ি। ম্যাডামদের স্নেহ-মমতা মাখা স্কেলের দাগ, হাতে-পিঠে। সবই যেন বয়ে বেড়াত শৈশব। ছিল চিল্লাচিল্লি করার জন্য, সবার একসাথে বেঞ্চের উপর কানধরে দাঁড়িয়ে থাকা হাস্যমুখর সময়। এর মাঝেও ছিল দলাদলি, ক্লাস ক্যাপ্টেনের হম্বিতম্বি। সব মিলিয়ে কম পড়াশোনা, বেশি বিনোদন।

পাওয়া যেত কত রঙ বেরঙের আইসক্রিম, খাবার। স্কুলের সামনেই বিক্রি হত দুটাকার কোন আইসক্রিম। যে স্বাদ আর পাইনা খুঁজে। পাওয়া যেত লম্বা পলিথিনে রঙিন আইসবার। লাল, হলুদ, কমলা, কত তার রং-রূপ। ছিল কত পদের আচার। আর ছিল চকলেট-লজেন্স। চার আনার লজেন্স, আট আনার লজেন্স, এক টাকার লজেন্স, কাঠি লজেন্স, আর ঝাল-টক-মিষ্টি। এক টাকার ভুনভুনি, লোকে বলত ভূতের ডিম। ছিল সাত টাকার মিমি। ছিল না খুব বেশি রকমফের। ঐকটা নিয়েই পার হয়েছে শৈশব। এখন এত পদের চকলেট-লজেন্সের ভিড়েও কেন যেন মনে পড়ে সেই চার আনা, আট আনার লজেন্সগুলোকে। তাই হঠাৎ কোথাও খুঁজে পেলে কিনে ফেলি অনেককটা করে। ফিরে যায় সেই শৈশবে। মেটাতে চাই মধ্যবিত্ত ঘরের সেই ছোট-ছেলেটির না মেটা আশা। ফিরে আসে সে। মুঠো করে ধরে রাখে তার লজেন্সগুলোকে। হারিয়ে যেতে দেবে না। দেবে না ফুরিয়ে যেতে। দেবে না হারাতে তার শৈশবকে।

সভ্যতার কল্যাণে আজ চারদিকে কেবল ইট কাঠের সুউচ্চ অট্টালিকা। দম আটকে আসা বাতাস, গরমের হল্কা। আমাদের ছিল টিনের আধপাকা এক বাসা। দুপুরের গরমে খালি গায়ে বারান্দায় পাটি পেতে শোওয়া, বিদ্যুতের অনুপস্থিতিতে ছিল তালপাখা। ছিল বাসার সামনের উঠান, তাতে কত গাছ; আম, জাম, নারকেল, বাতাবি, পেয়ারা। আর ছিল টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ। ঝড়ো হাওয়ায় উড়ে বেড়ানো পাতারা, নুয়ে পড়া গাছ। আর এখন? ইট-কাঠের খাঁচার গবাক্ষে চোখ রেখে দেখি বারিপাত। হালকা শো-শা করেই ঝরে পড়ে। পাই না খুঁজে টুপ-টাপ-টিপ-টিপ-ঝুম-ঝুম। শব্দগুলো যেন হারিয়ে ফেলেছে তাদের অস্তিত্ব। নেই তার অলঙ্কার।

বিকেল যেন আমাদের সবার আকাঙ্ক্ষিত এক সময়। বিকেল হলেই ছুটে যেতাম মাঠে। হত ফুটবল, ক্রিকেট। ছিল কাদা-মেখে মার হাতের মার, বকুনি। তাও থেমে থাকত না কিছু। প্রতি বিকেলই চলে আসত নতুন নতুন পসরা নিয়ে। বল যেয়ে পড়ত পাশের পুকুরে, কারও বাড়িতে নয়ত ঝোপে। খেলা হত একেক দিন একেক মাঠে। কখনও বা ধানক্ষেতে। পাশেই রেল লাইন। খেলতে খেলতে দেখতাম ট্রেনের ছুটে চলা। পুকুরে ছিল মাছ। ঘাই দিত। দেখতাম পানির আন্দোলন। থাকত খুটে বাঁধা গরু। বাঁশ বাগান। খড়ের গাদা।

থাকি সেই একি জায়গায়। হেটে যায় সেই একি রাস্তা দিয়ে। আছে মোটামুটি সবাই, আরও বেড়েছে লোক। নেই কেবল সেই মাঠ,নেই সেই পুকুর, ঝোপঝাড়, বাঁশ বাগান, গরুর গোয়াল। নেই সেই গাছ। জায়গার নামই রয়ে গেছে কেবল আমতলা, আমও নেই, গাছও নেই। কেবল টিকে আছে তার স্মৃতি। চেয়ে দেখি আমাদের পরের প্রজন্মকে। খেলতে চায়। জায়গা নেই। বাসার গ্যারেজের অল্প পরিসরে চলে ব্যাট-বলের ঠুকোঠুকি। তাও পায় না সুযোগ সবসময়। যেয়ে বসে কম্পিউটারে। বাস্তবকে হারিয়ে ডুবে যায় কৃত্রিমতায়। জানালার গ্রিল দিয়ে আসা ডোরাকাটা আলো এসে পরে ওদের উপর। আমার ভ্রম হয়, কারাগার নয়ত?

ছোটবেলার সন্ধ্যাগুলো ছিল আরেক জ্বালাতন। সারাদিন যাই কর, বসতে হবে পড়তে। ভদ্র ছেলেটি হয়ে বসতাম বইটি নিয়ে। একেবারে ছোট্টকালে ছিল স্লেট, চক। ছিল “অ তে অজগর আসছে তেড়ে”, “আ তে আমটি আমি খাব পেড়ে” কথা-ছবির মেলবন্ধন। এভাবেই হত আমাদের বর্ণ পরিচয়। আর ছিল আদর্শলিপি। ছিল নীতি কবিতা “সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি”। এই করেই না হলাম বড়। সে আমলে বিদ্যুৎ ছিল বড়ই অভিমানী। একটুতেই রাগ করে নাই হয়ে যেত। বিদ্যুৎ নেই, তো পড়াও নেই। মাঝে মাঝে অবশ্য হারিকেনের আলোয়ও চলত বিদ্যাপাঠ। আলো কমে গেলে সলতে বাড়িয়ে দিতে হত। ভরতে হত কেরোসিন।

আমাদের শৈশবে ছিল কত ভয়-ডর। ছিল কত রাক্ষস-খোক্কস-জীন-পরী। ছিল গাছের পাতার কেমন করে কেপে ওঠা। আবোল তাবোল শব্দ। ছিল সব বিশ্বাসের যুগ। আজ বিজ্ঞানের নিক্তিতে, যুক্তির হুমকিতে ভূতরা সব পালিয়ে বেঁচেছে। নেই আর শাঁকচুন্নি। নেই আর তেলের পিঠে খেয়ে সন্ধ্যাকালে বাইরে না যাওয়ার আদেশ। সব যেন মার-মার-কাট-কাট। নেই সেই রহস্যময়তা, নেই সেই ভয়, রোমাঞ্চ। বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানিতে সব যেন ফকফকা। রাত এখন আর ঘুমানোর জন্য না। রাত এখন ফেসবুকের, রাত এখন তারহীন দুরালাপনের।

ওসময় মধ্যবিত্তের খাওয়া ছিল ভাত, ডাল আর একপদ তরকারি। কোনদিন মাছ, কোনদিন ডিম, কোনদিন মাংস। সপ্তাহে একদিন ভাল খাওয়া। মানে পোলাও। ঈদ বা পালা-পর্বনে হত জর্দা-সেমাই। দোকানে ছিল দুই টাকার সমুচা, তিন টাকার প্যাটিস, ছয় টাকার বার্গার। এর নামই তখন ফাস্টফুড। ছিল না মুরগী পোড়া। ছিল না আফগান বিরিয়ানি। চাইনিজ ছিল হাতেগোনা। সে ছিল বড়লোকদের আভিজাত্য। মধ্যবিত্তের এত বিলাসিতা কোথায়!

সে দশকে টিভি ছিল হাতে গোনা। ফুফুর বাসার সাদা কালো টিভিতে দেখতাম ম্যাগ-গাইভার। টিভি এলো আমাদের বাসায়। চৌদ্দ ইঞ্চির সনি। রঙিন। সে কি দম্ভ আমাদের, আমার আর বড় ভাইয়ের। আমাদের জানালায় ভিড় হত রাতে। আশেপাশের তিন-চার বাড়ির মানুষ। একসাথেই দেখতাম সংশপ্তক, অ্যারাবিয়ান নাইটস আর, কোথাও কেউ নেই। টিভিতে চ্যানেল ছিল একটাই। বিটিভি। রাত নটার এক ঘণ্টার নাটক, ইংরেজি সিরিয়ালই ধরে রাখত আমাদের। আমাদের সাথে পুরো দেশকে। পুরো দেশ হাসত একসাথে, একসাথে কাঁদত, মুছত চোখ, বাকের ভাইকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ত। সে এক আজব দিন ছিল। আজ দেশেই কত চ্যানেল। ডিশের কল্যাণে দেখি বাইরের দেশেরও কত কি। কিন্তু তাও আঁশ মেটে না। দেখেও দেখা হয় না। এত অনুষ্ঠান, এত সময়। মনে রাখা বড্ড কঠিন। বড্ড পরিশ্রম।

সে আমলে সবারই বাসার সামনে ছিল কিছু জায়গা। কত কিছু করত মানুষ। কত কি পালত সে জায়গায়। হাস-মুরগী-গরু। নিজেই পুষেছি কত। পেলেছি খরগোশ, বিড়াল। খেয়ে গেছে বাগডাশে, সাধের মুরগীটাকে, বাচ্চা থেকে বড় করা পাখিটাকে। কেঁদেছি কত। উঠোনে কুপিয়ে বানিয়েছি ছোট্ট গর্ত, আমার পুকুর। ছেড়েছি মাছ। দেখেছি তাদের খেলতে। খেয়েছি নিজেদের গাছের পেয়ারা, আম, জাম, বাতাবি। সবই এই ঢাকায়। করছি না গল্প অন্য কোন দেশের, অন্য কোন শহরের, শুধু কেবল অন্য এক সময়ের।

ছিল এলাকার কত বড় ভাই, চাচা, মামা, কাকা। ছিল পরিবারের বন্ধন। অধীর আগ্রহে বসে থাকা, অফিস-ফেরত বাবার, বাবার থেকেও বেশি, বাবার হাতের ফলের প্যাকেটের দিকে। কলা, কমলা, আপেল। সে আমলে আপেল রেখে দিলে পচে যেত, কমলা নরম হয়ে যেত, ব্যাকটেরিয়ারা তখন রাজত্ব করত। রাসায়নিকের কাছে হেরে যায়নি। ছিল বাবা-মা-ভাই-বোন সবার একসাথে খাওয়া। ছিল মায়ের হাতে মুখে তুলে দেওয়া ভাত। ছিল মায়ের কোলে শুয়ে কাটানো দুপুর। ছিল দুষ্টামো-খুনসুটি। পরিবারের কেউ বেড়াতে এলে পড়া থেকে ছুটি। সব ভাইবোন মিলে পলাপলি, কুমির-কুমির, রেলগাড়ি, রান্নাবাটি, ভূতের গল্প। ছিল চিঠি। ছিল টেলিগ্রাম। মাসে একদিন শিশুপার্ক, বছরে এক-দুইবার চিড়িয়াখানা। বাদর-কুমির-বাঘের খাঁচা।

সব যেন কিভাবে হারিয়ে গেল। মনে হয় এইতো সেদিন। মাঝে মাঝে মনে হয়, খুব কি বড় হয়ে গেছি আমরা? বুড়িয়ে কি গেলাম ত্রিশের আগেই। সব তাহলে কেন এমন মনে হয়। মনে হয় অল্প সময়ে যেন খুব বদলে গেল সব কিছু। বদলে গেল খাবার-পোশাক-আড্ডা-বিনোদন। আগের কিছুই যেন খুঁজে পাই না আর। আধুনিকতার আবরণে সব পাল্টেছে ভোল। জাদুর কাঠির পরশে যেন চলে এসেছি অন্য কোন জগতে। যে জগতে ঠাঁই নেই ঘুমন্ত রাজ কন্যার, ঠাঁই নেই কোটাল পুত্রের, নেই পাতালপুরী। নেই জিয়ন কাঠি, মরণ কাঠি। চলে এসেছে সায়েন্স ফিকশন।

ইচ্ছে করে বড় না হতে। ইচ্ছে করে কাশের বনে হতে লুটোপুটি। গাছের মগডালে বসে দেখতে চারপাশ। পেড়ে আনতে পেয়ারা-আম। একে অপরের কাঁধে হাত রেখে গড়ব রেলগাড়ি। কু-ঝিক-ঝিক করতে করতে চলে যাব শৈশবে। হারাব আবার উদাস দুপুরে। থাকব তাকিয়ে টলমলে জলের পুকুরপানে। বৃষ্টি হলে বন্ধ স্কুল। পড়াশোনাকে পাঠিয়ে দেব ছুটির দেশে। বারান্দায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ব টারজান কিংবা মোগলি, কিংবা সোনার হরিণ, রূপকথা, ঈশপ, ঠাকুমার ঝুলি, চাচা চৌধুরী। থাকবে মুখে কাঠি লজেন্স। বিকেল হলে চলে যাব খেলতে। হালকা পাম দেওয়া বলটাকে ঘিরে দৌড়াদৌড়ি। লাথালাথি। কাদায় পড়ব পা পিছলে। হব মাখামাখি। রাতে মায়ের কোলে শুয়ে শুনব কাজলা দিদি।

প্রাণহীন-ঘিঞ্জি-দুষিত ঢাকা শহরটাকে দেখলে খুব মায়া হয়। মনে হয় শহরটা তার সব কিছু দিতে দিতে আজ বড় রিক্ত-দৈন-শ্রীহীন। হারিয়ে ফেলেছে তার বর্ণ-রং-রূপ-গন্ধ। সাথে আমার শৈশব। আধুনিক এই কারাগারের কামরায় বসে তাই গবাক্ষে চোখ রেখে উদাস হয়ে পড়ি। সূর্য ডোবে, রাত আসে। ভোর হয়। সূর্য ওঠে। বৃষ্টিরা আসে, যায়, হয়ে যায় কেমন কাদাকাদা। পাইনা মাটির সোঁদা গন্ধ। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই সময়টাতে, ঢাকার যৌবনে। যে যৌবন লুকিয়ে আছে লাল-কমলা আইসক্রিমে, চার আনার লজেন্সে, ট্রেনের হুইসেলে, বিদ্যুতহীন অন্ধকারে, টিনের চালের বৃষ্টিতে, চিড়িয়াখানার বাঁদরের খাঁচায়। ঢাকার সে যৌবনে যে লুকিয়ে আছে আমার, আমাদের ছোট্ট শৈশব। হারানো শৈশব।

০৪.০৯.২০১৩

১,০৬৫ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “হারানো শৈশব”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আমার স্কুলে যাইতে খারাপ লাগতো না।
    জীবনে তিনদিন স্কুল পালাইছি।
    একেবারে প্রথমদিন, নানাবাড়িতে। টাংগাইলের কালিহাতি থানার দূর্গাপুর ইউনিয়নের পটল গ্রামে নানাবাড়ির সামনের বিসাল মাঠের একপাশে স্কুল ছিলো। স্কুলের পিছনে আবার আরেক (হেনা) মামার বাড়ি। খুব সম্ভবত হেনা মামার ছোট ছেলে রাসেল ভাই (পিঠাপিঠি, কিন্তু বয়সে আমার চাইতে কিছু বড়) এর সাথে আমি আর ছোট ভাই সজীব স্কুলে গেলাম নতুন বৈ খাতা নিয়ে। যে স্যারের ক্লাস ছিলো সে আবার পিটানোতে ওস্তাদ ছিলো।
    রাসেল ভাই আমাদের দুই ভাইকে জানালো সেই কথা। ক্লাসের সবাই কিচিরমিচির করছে। এরপরো কয়েক্জন রাসেল ভাইএর সাথে সহমত জ্ঞাপন করলো। সাথে সাথে দুই ভাই মিলে ক্লাসরুমের পিছনের ভাংাগা অংশ দিয়ে পগার পার। আর পিছনে রাসেল ভাই। এরপর পুরাটআ সময় মামাবাড়ি গিয়ে লোটাস আপার পিছনে পিছনে ঘুরলাম। আপা কি কি জানি খেতে দিয়েছিলেন মনে নেই।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    এরপরের দুইবার পালাইছি গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার লতিফ্পুর স্কুলে স্বাস্থ্যকর্মী টীকা দিতে আসছে এই রব শুইনা।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    যারা মটর সাইকেল চালাতো তাদের আমার দেবদূত মনে হতো।
    হেলপারদের লুংগি উড়িয়ে এক পা ভাসিয়ে যাওয়া মনে হতো আহ! জীবন!


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।