আমার দ্বিচক্রযান

কিছু কিছু শব্দের প্রতি কেন যেন আমার এক অযৌক্তিক ভালবাসা তথা পক্ষপাত। তন্মধ্যে অন্যতম ‘দ্বিচক্রযান’। প্রথম এই শব্দটা কোন এক ঈদের নাটকের, জাহিদ হাসান এবং বন্যা মির্জা অভিনীত, শিরোনাম থেকে মাথায় ঢুকে যায়। কেন যেন তখন থেকেই এই শব্দটির প্রতি ভালোলাগা সৃষ্টি হল। সবাই যেখানে সাইকেল বলেই সহজভাবে কার্য সমাধানের পথ খোঁজে, আমি সেখানে এরকম এক কিম্ভূত কিমাকার শব্দের প্রেমে পড়ে যাই। না, শুধু শব্দের প্রেমেই না বস্তুটার প্রতিও আমার তীব্র আকর্ষণ। তবে ছোট থেকেই ঢাকার বস্তি-জীবনে অভ্যস্ত হওয়ায়, রাস্তায় চালানোর নিরাপত্তা হীনতার কথা চিন্তা করে মায়ের ছিল বেশ কড়া নিষেধ। তাই কয়েকদিনের জন্য বাসায় একখানা সাইকেল থাকলেও চালানো আর হয়ে ওঠেনি। যখন যশোরে নানুবাড়িতে যেতাম, ছোট মামা সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতেন। অন্যান্য খালাত ভাইগুলোকেও দেখতাম সাইকেল নিয়ে। পরে যখন কলেজ ছুটিতেও যশোর যেতাম, সাইকেলে আমার অবস্থান তখনও অপরিবর্তিত। ক্যারিয়ারে পশ্চাদ অংশখানা কোনভাবে সংকুলান করে, দুটো পা দুদিকে মেলে ধরে বসে থাকতাম। চালকের স্থানে কলেজের বন্ধু কজন। যশোর আবার সাইকেলের স্বর্গরাজ্য। রাস্তায় বের হলেই অসংখ্য রকমফের চোখে পড়ে। ফনিক্স, হিরো, অ্যাভন আরও কত কি ছাপ মারা। সবাই কেমন স্বাধীনভাবে চলে ফিরে বেড়ায়। ক্যারিয়ারে বসে বসে বন্ধুদের পিছনে যেতে যেতে আমি কেবল দেখি। পা মেলে রাখতে রাখতে ব্যথা হয়ে যায়। তাও ক্ষণিকের অসতর্কতায় আবার চাকার স্পোকের ভেতরে ঢুকে না যায়, তার জন্য কষ্ট সহ্য করে মুখ বুজে থাকি, আর আফসোস করি। হায়! আমিও যদি সাইকেল চালাতে পারতাম! আমিও তবে পারতাম এদের মত স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে। আমার চোখে তখন সাইকেলই স্বাধীনতার নামান্তর। ঢাকা শহরে থাকলে ততটা অনুভব না করলেও, যশোরে বা ঢাকার বাইরে বের হলেই আফসোস, মনঃকষ্টটা দীর্ঘায়িত হত। চিকন চিকন দুটো চাকার উপর কি করে আস্ত একটা মানুষ ভারসাম্য বজায় রাখে, হিসেব মেলাতে পারতাম না। মনে হত যেন বিজ্ঞান মহাশয়কে বুড়ো আঙুল দেখাতেই সাইকেল ব্যাটার জন্ম।
কবে চালানো শেখা যায়, কোথায় চালানো শেখা যায় তারই ব্যর্থ জল্পনা কল্পনায় পার হয়ে যায় জীবনের প্রায় আঠার বছর। কলেজ পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি যুদ্ধে অবতীর্ণ। যুদ্ধের কিছু দিনের মাথায় এক দুর্গ পরাভূত। বিজয়োৎসব উদযাপনে চলে গেলাম আবার সেই একই জেলায়, যশোর। কলেজের বন্ধুরা বেশির ভাগই তখন ঢাকায় বিভিন্ন কোচিং নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। আছে কেবল দুই জন। তার মধ্যে রহমান আবার তখন জন্ডিস রোগী। সেনাবাহিনীতে হয়ে যাওয়ায় সে তখন অন্যান্য জায়গার চিন্তা বাদ দিয়ে বিশ্রামে। আর আসিফ মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। এসময়েই আমায় দীক্ষা দিতে এগিয়ে এলো রহমান। রোগের জ্বালায় নাকি বাসায় বসে থেকে সে বিরক্ত। তার এই অলস সময়ের সার্থক ব্যবহার হতে পারে নাকি আমার মত গণ্ডমূর্খকে দুই চাকার তালিম দেওয়া। আসিফের সাইকেল নিয়ে পাশের এক পার্কে চলে এলাম। আমাকে সিটে বসিয়ে পেছন থেকে ধরে রেখে বলল, প্যাডেল মার। এই বুড়ো বয়সে বাচ্চাদের মত সাইকেল চালানো শিখতে বেশ লজ্জায় ভুগছিলাম। পার্কে আসা অন্যান্য দর্শনার্থীরা আড়চোখে আমার মত এক কার্টুনকে থেকে ভাল মানের বিনোদনের খোরাক পেল। তাও লজ্জার মাথা খেয়েই শুরু হল। দু এক বারের চেষ্টার পর সাইকেল আগানো শুরু করল। একটু পর বন্ধু বলল, ভালই তো চালাচ্ছিস। দেখলাম ফাজিলটা সাইকেল ছেড়ে দূরে দাঁড়িয়ে। কখন যে আমায় সাইকেলসহ একা ছেড়ে দিল, টেরই পেলাম না। বুঝতে পেরেই ঢুপ!! মানে ভূপৃষ্ঠে পতন। সাইকেল সমেত। তবে একটু যেন আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেলাম। এভাবেই শুরু হল আমার সাইকেল চালানো। এরপরে যেই কয়েকদিন যশোরে ছিলাম, কখনও কোন নির্জন রাস্তায় বা গ্রামের দিকে, হলদে সরিষা, সবুজ ধান, ফসলের ক্ষেতের পাশ দিয়ে ছুটে বেড়িয়েছি। আমার আরাধ্য স্বাধীনতাকে যেন খুঁজে পেয়েছি।
কিন্তু যা হয় আর কি। আবার ঢাকায় ফেরা। গতিময় যান্ত্রিক জীবনে মিশে গেলাম। বাস, রিক্সা, মানুষের কোলাহলে গেলাম হারিয়ে। সাইকেলসহ আমার স্বাধীনতাখানা হারিয়ে গেল ইট-কাঠের জিঞ্জিরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে পদার্পণ করে নিজের সাথে নতুন এক বোঝাপড়া শুরু করলাম। চিন্তা করে দেখলাম ছাত্রজীবন অস্তপ্রায়। এরপর যখন চাকরজীবনে প্রবেশ করব, আমার ছোট ছোট সাধ-আহ্লাদগুলো তবে অপূর্ণই থেকে যাবে। হয়ত চাকর বৃত্তিতে কিছু পয়সাকড়িও জমবে। তবে জীবনান্তে যখন পেছন ফিরে তাকাব, এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বপ্নগুলো, সাধগুলো আমায় ব্যঙ্গ করবে। ছোট ছোট সুখদুঃখগুলোকে ঘিরেই যে আমাদের ছোট্ট জীবনটা আবর্তিত হয় তা অনুভব করলাম। তাই দেরিতে হলেও নিজের মনের অতৃপ্ত সামান্য বাসনাগুলোকে পূরণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তন্মধ্যে অন্যতম নিজের একখানা দ্বিচক্রযান।
পরের মাসের টিউশনির টাকা হাতে পেয়ে দুজন বন্ধুকে নিয়ে গেলাম বংশাল। অল্পবিস্তর খোঁজাখুঁজি করে নিয়ে এলাম লাল কালো মেশানো আমার দ্বিচক্রযান। শুরু হল আমার নিশাচর জীবনের নতুন অধ্যায়। আগে রাত বারটায় চা খেতে বের হয়ে কখনও হেটে হেটে চলে যেতাম ফুলার রোড, কখনও টিএসসি। এখন যে এসেছে আমার হেলিকপ্টার, আমার অ্যাভন। ঢাকা ভার্সিটির মাঝে রাতে চালিয়ে একটু হাত পাকিয়ে নিলাম। তারপর আস্তে আস্তে শুরু করলাম দিনের বেলায় বেরোনো।
ঢাকা শহরের অবস্থা দিন দিন যেদিকে এগুচ্ছে, বাসে বা রিক্সায় চলাফেরা করাটা যেমন কষ্টসাধ্য, তেমন ব্যয়বহুল। আর জ্যামে বসে থেকে তো নাভিশ্বাস উঠে যায় মানুষের। তার মাঝে আমার সাইকেলখানা যেন স্বর্গের বাহন রূপে দেখা দিল। হল থেকে ক্লাস, রাত-বিরাতে বাইরে খেতে যাওয়া, গৃহশিক্ষকতায় এত কম সময়ে, কম কষ্টে সহজে পৌঁছানোর এত সুন্দর উপায় খুঁজে পেয়ে আমার জীবনে যেন স্বস্তি নেমে আসল। জ্যামে বসে থাকতে হয় না। ইচ্ছামত রাস্তা থেকে ফুটপাথ, ফুটপাথ থেকে রাস্তা, রাস্তার একপাশে জ্যাম থাকলে সাইকেল হাতে নিয়ে আরেক পাশে। আর যারা জানেন না, ঢাকায় সাইকেল চালানোর জন্য কোন পথ সীমাবদ্ধ করা নেই। যে পথে ইচ্ছা যাওয়া যায়। ট্রাফিক পুলিশকে কখনও সাইকেল আরোহীকে হেনস্থা করতে দেখিনি। এভাবেই গাড়ি, রিক্সা, বাস, মানুষ, ঘোড়ার গাড়ি, ময়লা, আবর্জনা সব কিছুকে পার করে দুর্বার ছুটে চলা। আমার জন্য তখন সব জায়গায় সুগম, সব সময়ই সুসময়। বাস্তবিকই পরাধীনতার ঢাকা শহরে আমি যেন আমার স্বাধীনতাকে নতুনভাবে খুঁজে পেলাম। চলাফেরার করার এই সহজগম্যতা স্বাধীনতার এক নতুন সংজ্ঞা আমার সামনে উপস্থাপন করল।
এতক্ষণ তো হল প্রয়োজনের তাগিদে আমার দ্বিচক্রযানের ব্যবহার। সাইকেল কেনার পর থেকে তা আমার অবসরের, আমার বিনোদনের, আমার মানসিক শান্তির অন্যতম মাধ্যমে পরিণত হল। নিজেকে ঠিক পেটুক বলব না, তবে ভোজন-রসিক হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বস্তি-বোধ করি। যখন ইচ্ছা চলে যেতাম পুরনো ঢাকায়, ঠাটারিবাজার স্টার, নাজিরা বাজারের চাপ, বিউটির সরবত, ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নীলক্ষেতের গরম গরম জিলাপি। ছাত্রজীবনের শেষাংশ যেন নতুনভাবে উপভোগ করা শুরু করলাম। খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি শুরু হল সাইকেল নিয়ে নতুন ঢাকা, পুরনো ঢাকার অলিগলি চষে বেড়ানো। কখনও ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী হয়ে মিরপুর, কখনও বা আজিমপুর, হাজারীবাগ হয়ে বেড়িবাঁধ দিয়ে রায়েরবাজার বধ্যভূমি, কখনও বা কামরাঙ্গীর চর। আবার হয়ত নওয়াবপুর, নারিন্দা হয়ে সূত্রাপুর, গ্যাণ্ডারিয়া। এভাবেই আমার ছন্নছাড়া ইতস্তত ভ্রমণের সঙ্গী হল সাইকেল। অবশ্য এসব ছোট ছোট দূরত্বের পাশাপাশি গ্যাণ্ডারিয়া থেকে মতিঝিল, রামপুরা হয়ে উত্তরা। উত্তরা হতে ফার্মগেট হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, কতরকম সামর্থ্যের পরীক্ষা করে দেখেছি। কখনই আহামরি কষ্ট অনুভব করিনি। হয়ত মানসিক পরিতৃপ্তিটুকু দৈহিক কষ্টটাকে অতিক্রম করে বিজয়ী হয়েছে। ক্লেশটাকে আড়াল করে দিয়েছে আত্মার প্রশান্তিতে।
যদিও হেটে ঘুরে বেড়াতেও খুব ভাল লাগে, তবে সাইকেল থাকলে আরও সহজে অনেক জায়গায় যাওয়া যায়। চারপাশের মানুষের জীবনচরিত, জীবন স্রোত, সময়ের অবিরাম ছুটে চলার মাঝ দিয়ে শান্ত পর্যবেক্ষক রূপে। আমাদের বাসাটা ঢাকার উত্তর প্রান্তে, পৌরসভার আয়ত্তের বাইরে। স্বাভাবিক কিছু নাগরিক সুবিধা-বঞ্চিত হলেও আমার দিন খারাপ যায় না। আমাদের বাসার দিকের রাস্তা ধরে ভিতরে পাঁচ-সাত কিলোমিটার গেলে তুরাগ নদীর পাড়। ইচ্ছা হলেই চলে যায় সাইকেল নিয়ে। ভিতরের দিকটাতে এখনও কিছু মাটির বাড়ি সভ্যতার নাগপাশ থেকে মুক্ত অবস্থায় গ্রাম বাংলার আমেজ ফুটিয়ে তোলে। এইদিকের রাস্তাগুলোও আমার খুব পছন্দের। যখন এর ভিতর দিয়ে ছুটে চলি, ঢাকায় আছি বিশ্বাসই হয় না। তুরাগ নদীর কিছু খণ্ডিত অংশ এখনও খাল হিসেবে শ্বাস নিয়ে চলেছে। তারপাশে শরৎকালে কাশবনে শুভ্র কাশফুল বাতাসের প্রবাহের উপস্থিতি জানিয়ে যায় দুলে দুলে। মাটির ঘর, বালুর পাড়, কাশবন, নদীর মাঝে নৌকার চলাচল আমার দিনের ক্লান্তি, অবসাদকে শুষে নেয়। কখনও যখন আকাশ কাল করে মেঘ জমে, আমি সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। বৃষ্টির মাঝে চালিয়ে চলে যায় নদীর পাড়ে। সাইকেলটা পাশে রেখে আকাশের পানি আর নদীর পানির একাকার হয়ে যাওয়া দেখি। সূর্যতাপে যেসব অণু-পরমাণুগুলো তাদের বাসস্থান ছেড়ে দূর আকাশে পাড়ি জমিয়েছিল, তারা আবার নিজ দেশ, নিজ আবাসে ফিরে আসে। আমি নীরব দর্শক হয়ে এই আত্মীয়ের পুনর্মিলন দেখি। পানি দেখতে, নদী দেখতে আমার গাড়ি নিয়ে আশুলিয়া বা মাওয়া যেতে হয় না। আমার দুচাকার বন্ধুটাকে সঙ্গে করে মৃতপ্রায় ক্ষুদ্র তুরাগ নদীকে বরষায় অবগাহন করতে দেখি। বৃষ্টি যেন তুরাগের রিক্ততা, দৈন্যতা, কলুষতাকে আপন শুভ্রতায় পরিষ্কার করে দেয়। আমার ক্ষুদ্র নদীর বালুচরে বসে আমি তাই অবলোকন করি, নীরব সাক্ষী হয়ে।
হয়ত আমার মাঝে নিশাচর ভাবটা একটু প্রবল। তাই আমার অন্যতম পছন্দের অবসর রাতের বেলা সাইকেল নিয়ে বের হয়ে যাওয়া। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর যখন নগরী ঘুমের ঘোরে অচেতন হতে শুরু করে, ব্যস্ততাগুলো যখন আস্তে আস্তে বিলীন হওয়া শুরু করে, রাস্তাগুলো একটু একটু করে ফাকা হতে শুরু করে, রাতের ঢাকা তার সুপ্ত সৌন্দর্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। কৃত্রিম সোডিয়াম আলোয় আলো-আধারীর রহস্যময়তা সৃষ্টি হয়। অল্প কিছু রিক্সা, দূরান্তের ট্রাকগুলো ব্যতিরেকে রাস্তাটা শূন্যতার বসন বরণ করে নেয়। তার মাঝে আমি ঘুরে ফিরি। কখনও বা সংসদের সামনে চলে যায়। রাতের নীরবতায় আমাদের অনন্য এই ঐতিহ্যটাকে উপভোগ করি। কখনওবা পুরনো ঢাকার অলিগলির গোলকধাঁধায় চক্কর কাটি। না হয় বুড়িগঙ্গার বাবুবাজার ব্রিজের উপরে চলে যায়। শেষরাতের ঢাকা-ফেরত লঞ্চগুলো তখন ঘুমন্ত আরোহী নিয়ে ঘাটে এসে ভিড়ে। পূব আকাশ একটু একটু করে ফরসা হয়। লাল, হলুদ, নীল কত রঙ খেলা করে। নদীর থেকে আসা স্নিগ্ধ বাতাস আমাদের চুল এলোমেলো করে দেয়। কেন যেন সেই বাতাসে বুড়িগঙ্গার পচা পানির গন্ধ থাকে না। তাকে সুন্দর, শুভ্র, নির্মল মনে হয়।
রাতে হয়ত কখনও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনার পাশ দিয়ে চলে যায়। ফুটপাথে ঘুমন্ত কিছু আশ্রয়হীন মানুষ ঘুমের মাঝে নড়ে চড়ে আবার ঘুমায়। নিশি-কন্যারা তাদের নিশি-পর্ব শেষ করে আশ্রয়ের সন্ধান করে। রাতজাগা কোন পাখি ডানা ঝাপটে রমনার গাছের আড়ালে তাদের উপস্থিতি জানান দেয়। তার মাঝ দিয়ে আমি চলে যায় হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সামনের পরিচিত চায়ের দোকানে। আমার বাল্যকালের এক সুহৃদের বাসস্থান তারই অনতিদূরে। ধোয়া-ওঠা গরম চা নিয়ে ফুটপাথে বসে দুনিয়ার গল্প জুড়ে দেই। গল্পে গল্পে রাত হয়ে যায় ভোর। চাওয়ালা মামা কাপ ফেরত নিয়ে যান। আমাদের আড্ডা ভাঙে। আবার ফিরে আসি পলাশীর প্রান্তরের ছাত্রাবাসে, সূর্যোদয়ের স্নিগ্ধ আলোর মাঝ দিয়ে। শহর আবার ফিরে পায় তার ব্যস্ততা, তার চেনা পরিচিত অবয়ব। ব্যস্ততা থেকে বিদায় নিয়ে আমি আমার বিছানাটাকে আপন করে নেই, দিনের আলোটাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম চার বছর রাত্রিযাপন করতাম বন্ধুদের সাথে পদব্রজে ঢাকা শহর পরিভ্রমণ করে। আর শেষ এক বৎসর দ্বিচক্রযানে করে। চাঁদ-তারা-সোডিয়াম বাতির আলোছায়া মাখা… আধোঘুমন্ত স্বপ্নের আবরণে…রাতজাগা কিছু উদভ্রান্তের সংস্পর্শে…রহস্যের আড়ালে…রাতের গহীনে…অসংখ্য নির্ঘুম রাত…বন্ধুদের সাথে আবোলতাবোল প্রলাপ…সেই পুরনো ঢাকার শূন্য রাজপথ…বুড়িগঙ্গা পাড়ে সূর্যোদয় দর্শন, কল্পনার রং-তুলিতে ইতস্তত আঁকিবুঁকি। এভাবেই আমার সাধের দ্বিচক্রযানে করে, স্বাধীনতার পাখা মেলে উড়ে বেড়াই কল্পনার আকাশে বাতাসে, দুচাকায় ভর করে…

০৯.০৫.২০১২

৩,১৭৫ বার দেখা হয়েছে

২৮ টি মন্তব্য : “আমার দ্বিচক্রযান”

  1. আপনার সাথে সাথে অনেক চড়লাম হাসান ভাই, ঢাকা শহর পুরো ঘুরে ফেললাম। আমার কোন সাইকেল নেই, চালাতেও পারিনা। অন্যরা তাদের সাইকেলের পেছনদাবা করে আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। :((

    জবাব দিন
  2. সাইকেল চালাতে আমারো অনেক আনন্দ লাগে। কিন্তু চালক হিসেবে যে কোন কিছু চালাতেই আমার ভয় হয়। যদিও ভয় নিয়েই অনেক কিছু চালানো শিখে ফেলেছি।

    তো একবার হয়েছিল কি, তখন ক্লাস এইটে পড়ি, কোন এক ভেকেশনে ....... ব্রাহ্মনবাড়ীয়া শহরে যে উচূ ব্রিজ টা আছে, তার উপর থেকে প্রচন্ড জোড়ে সাইকেল চালিয়ে নামছি। কিন্তু এক আহাম্মক মাথায় জামের জাঁকা নিয়ে হঠাৎ করে আমার সামনে মোড় নিল। বেল দেয়ার সময় নেই, অগ্যতা সাইকেলের সাথে লেগে ব্যাটা জামের জাঁকা ফেলে দিয়ে পড়ে গেল। জাম চারদিকে ছিটকিয়ে পড়ল। আমি পড়ে গেলাম অন্য পাশে। আমার প্যান্ট ছিড়ে হাটু ছিলে গেল। কিন্তু পরক্ষনই মাথায় চিন্তা হল তাড়াতাড়ি সরে পড়তে হবে, না হয় জরিমানা গুনতে হতে পারে। ব্যস্‌ কোন রকমে উঠে সাইকেল নিয়ে ছুট। পিছন থেকে ব্যাটা চিৎকার করছে, “ঐ হেরে ধড়, পালাই যাইতাছে ”। কিন্তু, আমারে আর পায় কে। বাসা বেশী দূরে ছিল না। বাসা পৌছে দ্রুত প্যান্ট, টিশার্ট পরিবর্তন করে সাইকেল রেখে আবার ঘটনা স্থলে হাজির হলাম। দেখি ব্যাটা কষ্ট করে জাম কুড়াচ্ছে, আর গালাগালি করছে। বেশরি ভাগ জাম থেতলে গেছে। আরো কয়েকজনও কুড়াতে সাহায্য করছে। আমি কুড়াতে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলাম। ব্যাটা আমাকে চিনতে পারলো না। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম কিভাবে হল। সে ঘটনা বলছে আর গালি দিচ্ছে। আমিও সাইকেল চালককে গালি দিয়ে, অন্ধ, অসভ্য ডেকে তাকে স্বান্তনা দিলাম। (সম্পাদিত)

    জবাব দিন
    • সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

      মন্তব্যে মজা পেলাম ভাইয়া... 😀
      ঢাকা শহরে সাইকেল চালাতে গিয়ে আমিও বেশ কিছু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। এক নিউমার্কেটের মোড়েই যে কত বার মানুষের গায়ে লাগছে, বলার না। সবাই রাজা-বাদশাহের মত রাস্তা পার হয়, সে পার হলে সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে তাই মনে করে। তবে সাইকেল চালানো শুরু করার পর রিক্সা ভাড়া দিতে গেলে খুব গায়ে লাগত। মনে হত এইটুকু রাস্তা, সাইকেলে গেলে কতটুকু সময় লাগত। এইটা একটা সমস্যা। সাইকেল নিয়ে আপনার লেখা পড়ার প্রত্যাশায়...

      জবাব দিন
  3. মুহাম্মদ আবু ফাত্তাহ

    মনের দুঃখের কথা আর কী বলব স্যার !! আমি আমার স্কুল জীবন পুরটাই সাইকেল চালিয়েছি। ঢাকায় এসে বাসে ওঠার যুদ্ধ, বাসে ওঠার পর যানজটে জীবন অতিষ্ঠ তখন বাবা-মা কে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না যে একটা সাইকেল থাকলে কত সুবিধা। আপনার স্মৃতি চারন নিজের অতীত স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দিল।

    "আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম"

    জবাব দিন
  4. লুবজানা (২০০৫-২০১১)

    সাইকেলের প্রতি দূর্বলতা আমার সেই ছোট্টবেলা থেকেই। বাবাকে হারানর পর আমার সাইকেলের সাথে বাবার বাইকের ও পাল্লা দেয়া আর হয়নি, আমার একমাত্র সাথী হারানোর কারনে আর চালাইনি সাইকেল ঢাকার ব্যাস্ত কেন্দ্রে বড় হয়েও খিখেছিলাম সাইকেল চালানো, তাই আমারও খুব সাধ হয় আবার একটা সাইকেল কেনার...মা রাজি হয়না।

    খুব আবেগপ্রবন লেখা ভাইয়া। একদম গভীরে চলে গিয়েছিলাম!!!


    নিজে যেমন, নিজেকে তেমনি ভালবাসি!!!

    জবাব দিন
  5. সাইকেল চালাতে শিখতে গিয়েছিলাম। একজন বলল, " সাইকেল চালাতে হলে অবশ্যই নিজের রক্ত ঝরাতে হবে।" ঐ কথা শুনে ভয়ে আর কোনদিন সাইকেল শিখতে যাইনি। বরং অনেক রিকশা চালিয়েছি। রক্তও ঝরাতে হয়নি। লিখা ভালু লিগিছি লিবানুজ বাই :clap:

    জবাব দিন
  6. লেখা খুব ভাল লাগলো আসলে আমার সেই কলেজ জীবনে নিয়ে গেলো তোমার এই লেখাটি। আমি সেই প্রাইমারিতে থাকতেই সাইকেল চালাই। আমার একটা হিরো সাইকেল ছিল যেটা আমি আমার কলেজ জীবনও চালিয়ে এসেছি। আমার একমাত্র অতি প্রয়োজনীয় বন্ধু যাকে এখনও মিস করি যখন ঢাকার জ্যাম এ পড়ি। সেই বন্ধুটি বাসায় এখনও আছে শুধু চালকের পরিবর্তন হয়েছে। আজ আবার তার কথা মনে হল।
    পুরানো স্মৃতি আবার নাড়িয়ে দিয়ে গেলে। অনেক ভাল হয়েছে লেখা। :boss:

    জবাব দিন
  7. রেজা শাওন (০১-০৭)

    চমৎকারভাবে একান্ত কিছু অনুভূতির প্রকাশ...ভাল লাগলো।

    আমার এখন পর্যন্ত সাইকেল ৫টা। দুইটা ইউনিভার্সিটির গ্যারেজে রাখা, আসেপাশে যেতে হলে ওই দুইটা ইউজ হয়। একটা ইউটরেক্ট সেন্ট্রাল স্টেশনে রাখা। রাতে বাস মিস করলে ওইটা ইউজ হয়। আর বাসায় একটা। বাকী যে একটা ওইটার চাকায় হাওয়া নাই।

    হল্যান্ডে সবার মাথাপিছু ৩টা করে সাইকেল থাকে। আমি ১০ ইউরোতে একবার দুইটা কিনে ফেলায় আমার ভাগে এক্সট্রা দুইটা পড়ে গেছে। 😛 😛

    জবাব দিন
  8. সুষমা (১৯৯৯-২০০৫)

    আমি একটু ধপাস আছি, 😛 ,পইড়া যাই বেশি, তাও সাইকেল চালাতে খুবি ভাল্লাগত। এখন ঢাকায় বাসের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে গিয়ে সাইকেলটাকে খুবি মিসাই। একটা স্কুটি অন্তত কিনতে চাই কিন্তু কেও রাজি হয়না :((

    জবাব দিন
    • সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

      ঢাকায় জ্যামের মধ্যে যখন লোকজন গরমে সিদ্ধ হত, আর তার মাঝ দিয়ে আমি আমার হেলিকপ্টারটা নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম, নিজেকে বেশ লায়ক লায়ক মনে হত। 😛
      বাবা-মা রাজি হয় না জেনে, এখন শখের এই কাজগুলো আড়ালে করে ফেলি। তারপরে মাকে বলি। এখন তো বড় হয়ছি। খুব বেশি হলে ঝাড়ি দিবে, মাইর তো আর দিবে না 😀 মা রাগ করে। কিন্তু এই রাগটাও অনেক ভাল লাগে। 🙂

      জবাব দিন
  9. তপু (৯৯-০৫/ককক)

    আমরা ত কলেজেও সাইকেল চালাইসি।কলেযে এক গ্রউন্দস্মান এর সাইকেল চুরি কইরা হউসের সাম্নে কত্ত চালাইসি। তবে শব থেকে মজা লাগত সার বা সটাফদের সাইকেল এর পাম্প ছারতে। উফফ শরগিয় শুখ সার দের পাম্প ছারাতে। :)) 😀

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।