ওদিয়েনেতে বসবাস

ছোটবেলার গল্পের বই বা ভূগোল পড়তে গিয়ে আফ্রিকা সম্পর্কে শুধুই ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ’, এই শব্দ-গুচ্ছই মনে পড়ে। পরে আরেকটু বড় হয়ে যখন বিভূতির চাঁদের পাহাড় পড়লাম, তখন যেন শংকরের সাথে আফ্রিকার গহীন বনাঞ্চলে আমিও ছুটে চললাম, রত্নের সন্ধানে। তখন থেকেই আফ্রিকার প্রতি এক অজানা-অচেনা রোমাঞ্চ অনুভব করতাম। না জানি কেমন সে? কত না জানি নাম না জানা গাছপালা, জন্তু জানোয়ার, কেমন তারা মানুষজন। মনের কোনা-কাঞ্চিতে আকুলি-বিকুলি করত। কিন্তু যখন সশরীরে আফ্রিকায় এসে পৌঁছলাম, তখন কেন যেন এদের প্রকৃতির মাঝে নিজেকে, নিজের দেশকে খুঁজে পেলাম নতুনভাবে, নতুন রূপে। কেমন যেন অচেনা পরিবেশে চেনা মানুষ দেখলে যেরকম আনন্দ-অনুভূতির সৃষ্টি হয় সেরকম। হয়ত এখানকার মানুষের জীবনচরিত, চলাফেরা আমাদের থেকে ভিন্ন, হয়ত অনেক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও পাশ্চাত্যের আগ্রাসনে এরা দরিদ্র, কিন্তু প্রকৃতি এদেরকে কোন দিক দিয়েই কমতি রাখেনি। ভরিয়ে দিয়েছে আঁজলা ভরে। তাই প্রকৃতির এই ঐশ্বর্যকে চাক্ষুষ করে যেন আমার হল নবজন্ম। পৃথিবীটাকে নতুন করে দেখে, ঐশ্বর্যময়ীর রূপ উপভোগ করি।
শেষ কয়েকদিন আছি কোত-দিভোয়ার উত্তর-পশ্চিমের শহর ওদিয়েনেতে। এর আগে শেষ ফেব্রুয়ারিতেও একবার আসা হয়েছিল এদিকে। তখন এখানকার রুক্ষ প্রকৃতি যেন আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু এখন বর্ষার শুরুর দিক। অল্প অল্প করে বৃষ্টির দেখা মেলে। কয়েকদিনের ব্যবধানে বরষা তার পূর্ণ যৌবনের হাতছানি দিয়ে যেন মুষলধারা বারিপাতে ছলনা করে যায়। কিন্তু এ অল্প বৃষ্টিতেই ওদিয়েনে যেন নবরূপে প্রস্ফুটিত। নানা রঙে বর্ণিল। যার দিকে দিকে যেন রঙের মেলা। যদিও সবুজই তার ব্রক্ষ্মাস্ত্র, সাথে অলংকার স্বরূপ লাল, হলুদ আরও কত কি! বৃষ্টির ছোঁয়ায় প্রকৃতিকে এতটা বদলাতে আমি আগে কখনও দেখি নি। কিছুদিন আগেই দেখে যাওয়া রুক্ষ মরু চরাচর যেন নবযৌবন-প্রাপ্ত, চারদিকে তার যৌবনের জয়গান। মরুময় গেরুয়া বরণকে ঝেড়ে ফেলে প্রকৃতি আজ সবুজ বসনে উদ্ভাসিত। প্রকৃতি যেন তার রূপের পসরা সাজিয়ে বসেছে। তার দিকে তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যায়। বৃষ্টির ছোঁয়ায় গাছে জমে থাকা ধূলোরা যেন মুখ লুকিয়েছে। শুকনো মাঠগুলো কচি সবুজ ঘাসে পরিপূর্ণ। গাছগুলো তাদের ধূলিধূসরিত অবয়ব পাল্টে নতুন পাতায়, নব আঙ্গিকে সজ্জিত। নব কিশলয়গুলো যেন তারুণ্যের জয়গান ঘোষণা করছে। কাজু বাদাম, সেগুন, আম, নিম আরও কত নাম না জানা শত শত হাজার কোটি বৃক্ষরাজি তাদের ডালপালা মেলে সগর্বে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবুজে সবুজে সয়লাব। তার যেন আদি নেই, অন্ত নেই, বিরামহীন বিস্তৃতি। গাছগুলোতেও ফুলফলের সমারোহ। সবুজের মাঝে অলংকারে যেন লাল হলুদের খেলা। এদিকের গাছে এত আম ধরে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। কাচা আম এরা খায় না। আর এত আম খেয়েও শেষ করতে পারবে না। আমগুলো পরিপক্ব হয়ে তার সবুজ বরণ ত্যাগ করে কেউ লাল, কেউ বা হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় আমগাছে যেন লাল হলুদ ফুল ফুটেছে। কাছে আসলে ভুল ভাঙে। ফুল না, এ যে আমের সম্ভার। গাছের নিচেই যে কত আম ঝরে পড়ে শুকিয়ে যায়, ইয়ত্তা নেই। কাজুবাদামের গাছেও লাল-হলুদের গহনা। কোনটায় লাল ফল, কোনটায় হলুদ। সবুজের সমারোহে তাদের লুকোচুরি। নিম গাছের সংখ্যাও অগণিত। সবুজ পাতা আর সবুজাভ হলুদ ফলে ফুলে তার নিঃশব্দ উপস্থিতি। আর সেগুন গাছ তার বড় বড় পাতা মেলে এক অপূর্ব সবুজ ছায়াবীথি রচনা করেছে।
এত গাছের ভিড়ে আমার দৃষ্টি কাড়ে কৃষ্ণচূড়া। বরষার আগমনে তারা যেন সবদিকে তাদের দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সাহিত্যের পাতায় পড়া ‘গাছে যেন মনে হয় আগুন লেগেছে, লাল আগুন’…আগুনটাকে উপলব্ধি করলাম। কি বলিষ্ঠ তাদের সরব উপস্থিতি। সবুজের যে কত রূপ চারদিকে, তার যেন কোন শেষ নেই। ছোটবেলায় যখন জলরঙ নিয়ে বিভিন্ন রং মিশিয়ে নতুন নতুন রঙের শেড আনার চেষ্টা করতাম, এখানেও তেমনি সবুজের যে কত রূপ, কত বিভিন্ন তার অবয়ব। একত্রে থেকেও যেন প্রতিটি সবুজ আপনাকে চিনিয়ে দেয় আপন আঙ্গিকে, আপন উপস্থিতির জানান দেয় আত্মগরিমায়। তার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ কৃষ্ণচূড়ার লালের প্রলেপ, বিন্দু-প্রায় আম, কাজু বাদামের ফলের তিলক-ফোঁটা, কারিগর যেন পরম মায়ায় সুন্দরের প্রতিমা গড়েছেন। সবুজের মাঝেই যেন নিজেই বিলীন হয়ে গেছেন, মিশে আছেন আপন স্বত্বায়।
এ তো গেল কেবল মাঠঘাট, গাছপালা আর সবুজের বর্ণনা। আকাশ কি তারচেয়ে কোন অংশে কম! ওদিয়েনে শহরটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশ উঁচুতে, মালভূমির মত। আকাশটাকে যেন এখানে অনেক কাছে মনে হয়। মেঘগুলোকে মনে হয় গাছের মাথায় উঠলে হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে। গল্পের বইতে পড়া ‘পেঁজা তুলো’র মত মেঘ যেন এখানেই প্রথম অনুভব করলাম। সবুজের উপরে আকাশেও যে নীল-সাদার কত খেলা। তা শব্দ চয়নে বোঝানো যায় না, চাক্ষুষ দেখে নির্বাক শ্রোতা হয়ে অনুভব করতে হয়। যখন ঈশান কোনে মেঘ জমে, আকাশটা ধূসর হতে হতে কাল হয়ে যায়, তার বুকে সাদা বক ওড়া উড়ি করে। কাল-ধূসর পটভূমিতে সাদা বকের পাখা মেলে উড়ে যাওয়া, কখনও সঙ্গীহীন, কখনও দল বেঁধে, মনটাকে উদাস করে দেয়। উদাস মনটাকে সিক্ত করতে ছুটে আসে বৃষ্টি। ধূসর-কাল মেঘগুলো যেন আকাশের সাথে আড়ি নিয়ে ধরার বুকে নেমে আসে। সবুজ শান্ত প্রকৃতি বরষায় অবগাহন করে। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ অবিশ্রাম সংগীত রচনা করে। তারমাঝে কখনও হয়ত কোন পছন্দের রবীন্দ্র সংগীত ছেড়ে দেই। নিকট আকাশের পটভূমিতে, সবুজের কোলে, বর্ষণমন্দ্রিত গানের কলিতে দেশ থেকে অনেক দুরে থাকার, আপন প্রিয়জনদের থেকে বিচ্ছেদের দুঃখগুলো সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। সুদূর আফ্রিকার বান্ধবহীন আবাসটাই যেন আমার, আমাদের বাংলাদেশ হয়ে যায়, পার্থক্য করতে পারি না। প্রকৃতির মাঝে বিলীন হয়ে যাই, আত্মার একাত্মতায়…

২৬.০৪.২০১২

১,৯৮২ বার দেখা হয়েছে

২৪ টি মন্তব্য : “ওদিয়েনেতে বসবাস”

  1. শব্দচয়ন ও প্রতিটি বাক্য লাজাওয়াব। ভালো লাগছে তমার লেখা পড়ে। এত সাহিত্য যে তোমার লুকিয়ে আছে তা ক্রমেই জানছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। খুব ভাল লেগেছে। keep it up...........

    জবাব দিন
  2. তানভীর (২০০১-২০০৭)

    হাসান ভাই, দিনদিন আপনার লেখার ভক্ত হয়ে উঠছি 😛
    সত্যই ভ্রমণ কাহিনী দুটো লাজবাব। তবে ছবি থাকলে আরও ভাল লাগত যদিও আপনার বর্ণনা চমৎকার তার পরও বুঝেনতো কষ্ট করতে মন চায় না। হাতের সামনে ছবিগুলো থাকলে আর কে কষ্ট করে ভাবে :))
    খুব ভাল লেখা। একটি সিরিজ বানায়ে ফেলেন। আপনি লিখেবন দেশেদেশে শিরোনামে আর আমি লিখবো ঘাটেঘাটে শিরোনামে। ভাল থাকিয়েন।


    তানভীর আহমেদ

    জবাব দিন
    • সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

      তানভীর, আমি কেন যেন এখনও বাস্তবের ছবির থেকে আমার কল্পনার ছবিগুলোকেই বেশি প্রাধান্য দেই। তাই চেষ্টা থাকে আমার কল্পনাগুলোকে মানুষের কল্পনায় স্থান দিতে পারি কিনা। তোর মন্তব্য দেখে খুব ভাল লাগল। তোর বন্দরে বন্দরে পদচারনার কথা জানার অপেক্ষায় থাকলাম। 🙂

      জবাব দিন
  3. "উদাস মনটাকে সিক্ত করতে ছুটে আসে বৃষ্টি" মারহাবা মারহাবা!!! পড়ে আমার মনটাও সিক্ত হয়ে গেল। প্রকৌশলীর মনে এত কাব্য !!! পরবর্তী পোষ্ট এর অপেক্ষায় রইলাম।

    জবাব দিন
    • সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

      কেন মামুন ভাই, প্রকৌশলবিদ্যায় হাতে খড়ি নিয়েছি বলে কি অনুভূতি সব জলাঞ্জলি দিতে হবে নাকি। 🙁 না ওটা আপনাদের মত সাহিত্যের ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত 😛

      মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ... 😀

      জবাব দিন
        • সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

          কিযে বলেন মামুন ভাই, আমি তো ছুডু ভাই হয়ে বড় ভাইয়ের সাথে একটু ঠাট্টা মসকরা করলাম 😛 আর আপনার হয়লেন আবিদজান সরকার, আর আমরা হলাম প্রত্যন্ত মঁ গ্রামবাসী; আপনাদের উপর রাগ করব, আমার ঘাড়ে কইটা মাথা 😀

          আর অনুভূতির বরফ গলে বয়ে যেতে দিন, দেখবেন আপনা আপনি কাব্য হয়ে স্রোতস্বিনী নদী হয়ে যাবে 🙂

          জবাব দিন
  4. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    একটা পরামর্শ: উপন্যাস লেখার কোন আকাঙ্খা/পরিকল্পনা থাকলে শুরু করে দিতে পারো। লোহা গরম আছে, হাতুড়ি চালাবার উপযুক্ত সময় এখনি।
    তোমার এ লেখাটা কতটা ভালো হয়েছে সেটা না বলে আমি বলবো, আরো কয়েকদিন ফেলে রেখে দিলে আরো ভালো হতো হয়তো। কতগুলো বাক্য ফিরে লিখতে হয়তো।
    প্যারা ভেঙে দিলে ভালো করতে কোথাও কোথাও।
    প্রকৃতিকে এখানে পেলাম বিভূতিভূষণের মতো (বাড়িয়ে বলিনি একটুও)!
    তবু কোথাও কোথাও পরীক্ষার বাংলা রচনার মতো লাগলো। ঘষামাজা করলে ঠিকরে ঠিকরে আরো আলো বেরুতো নিঃসন্দেহে।

    প্রচুর, প্রচুর লেখো। যা ইচ্ছে তাই নিয়ে।
    বহূদূর যাবার ইংগিত আছে তোমার লেখায়, দমটা অর্জন করতে হবে তার জন্যে।

    জবাব দিন
    • সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

      ভাইয়া, আপনার গঠনমূলক এত সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ 🙂 আর বিভূতির নামে তো লজ্জায় পড়ে গেলাম :shy:

      চেষ্টা করব আপনার পরামর্শগুলোকে উপলব্ধি করে ব্যবহার করতে। আবারও আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। 😀

      জবাব দিন
    • সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

      কবির ব্যাপারে বলতে পারি না। তবে ঢাকা শহরের যান্ত্রিক জীবন থেকে যখন প্রকৃতির সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়, তার মাঝে হারিয়ে যাওয়ার জন্য মনটা কেমন যেন করে ওঠে। :dreamy:
      আর তথাকথিত মিডিয়ায় দেখানো বা বইয়ে পড়া আফ্রিকা থেকে আসল আফ্রিকা অনেকাংশেই ভিন্ন।

      জবাব দিন
  5. রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

    ওদিয়েনেতে ৬ মাসের স্মৃতি । খুব ভাল ছিল দিনগুলি


    আমার কি সমস্ত কিছুই হলো ভুল
    ভুল কথা, ভুল সম্মোধন
    ভুল পথ, ভুল বাড়ি, ভুল ঘোরাফেরা
    সারাটা জীবন ভুল চিঠি লেখা হলো শুধু,
    ভুল দরজায় হলো ব্যর্থ করাঘাত
    আমার কেবল হলো সমস্ত জীবন শুধু ভুল বই পড়া ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।