দোজোর মেলায়

আবাস আমাদের কোত দিভোয়ার (Côte D’Ivoire) পশ্চিমের শহর মাঁ (Man) এর অদূরে। সাধের আফ্রিকা জীবন শুরু করার কিছুদিনের মাঝেই সু্যোগ আসল আফ্রিকার আদি এক শিকারী জাতি, দোজো(Dozo)দের সম্মেলনে অংশ নেয়ার। সম্মেলনস্থল এই দেশের উত্তর-পশ্চিমের এক গ্রাম সেগুয়েলো (Séguélo) তে। যাত্রা শুরু করলাম ৫ই ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষা মিশনের দুজন পদস্থ কর্মকর্তা, জনাবিশেক সৈনিক আর স্থানীয় দোভাষী আপুলিনাকে সঙ্গে করে। এমনিতে আফ্রিকার আবাস জীবন সূচনালগ্ন, নূতন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম, তার মাঝেই চলে এল আফ্রিকার আদিমতার, রহস্যময়তার, ঐতিহ্যের সম্পৃক্ততা অর্জনের মাহেন্দ্রক্ষণ।
মাঁ থেকে উত্তরদিকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে বিয়াকুমা(Biankouma), তার আর ৬৫ কিলোমিটার উত্তরে তুবা (Touba), তারও পরে ওদিয়েনে (Odienné), সেখান থেকে মাটির রাস্তায় সেগুয়েলো। পুরো কোত-দিভোয়া দেশটাই পাহাড়ের আবাসভূমি। তবে পশ্চিমের এইদিকগুলো আরও বেশী পাহাড়ি, আমাদের বান্দরবনের মত। মাঁ থেকে বিয়াকুমার রাস্তাটাই আমার এখানে দেখা সবচেয়ে পাহাড়ি রাস্তা। রাস্তার আশেপাশের পাথুরে পাহাড়গুলো যেন চোখে আঙুল দিয়ে আমাদেরকে আমাদের ক্ষুদ্রতা জানান দেয়। এই পাথুরে পাহাড়েও যে কিভাবে সবুজ তার স্থান করে নিলো সেটা বেশ আশ্চর্যের বিষয়। এভাবে অনেক দূরে দূরে গুটিকতক গ্রাম পাশ কাটিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম বিয়াকুমা পার হয়ে পরের শহর তুবাতে। মাঝে ফেলে এসেছি বিস্তীর্ণ পাহাড়ি ভূমি, জনমানবশূন্য বনাঞ্চল, আর দুর্লভ দৃশ্য গরুর পাল, রাখাল, তাদের মাথার ওপরে আত্মমগ্ন সাদা বকের ওড়া উড়ি।

চিত্রঃ বিয়াকুমার পথে যেতে


আমাদের আবাস থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে যখন তুবাতে পৌঁছলাম, স্থানীয় দোভাষী আপুকে জিজ্ঞাসা করলাম ওদিয়েনে আর কত দূর, ওখানে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত। সে জানাল, সে নাকি বেশ ছোটবেলায় এদিকে এসেছিল, দূরত্বের সঠিক হিসেব মনে নেই, তবে প্রায় ৫০ কিলোমিটারের মত। তাও কিছুটা মানসিক স্বস্তি অনুভব করলাম, যাক আর ঘণ্টা খানিক পরে একটু বিশ্রাম নেওয়া যাবে। কিন্তু বিধাতা বোধহয় আড়ালে একটু মুচকি হাসলেন। পরের কিলোমিটার নির্দেশকে দেখলাম ওদিয়েনে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার। আপু বোধহয় মনের ভুলে সামনের ১ টাকে উহ্য রেখে গেছে। কোত-দিভোয়ার জনবসতি সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই, তাদের জন্য বলি, এই দেশে সর্বমোট লোকসংখ্যা ২.১ কোটি। তার বেশিরভাগেরই আবাসস্থল মূল উপকূলীয় বাণিজ্যিক শহর আবিদজান(Abidjan)। দেশের আয়তন বাংলাদেশের প্রায় আড়াইগুণ। সহজ করে বললে আমাদের ঢাকা শহরের সমান লোকজন আমাদের দেশের আড়াইগুণ জায়গা নিয়ে বাস করে। এজন্য ঢাকা শহরে তথা বাংলাদেশে যেখানে নির্জনতার সাক্ষাত দুর্লভ, এখানের শহরের বাইরের দিকে জনমানবের সাক্ষাত পাওয়াই দুষ্কর।

চিত্রঃ জনমানবশূন্য চরাচর

তো বিধাতার নির্মম পরিহাস মেনে আমরা যাত্রা শুরু করলাম তুবা থেকে ওদিয়েনের পথে। পাহাড়ি উঁচুনিচু পথগুলোকে সরিয়ে তার জায়গা করে নেওয়া শুরু করল রুক্ষ-সম মালভূমি, সবুজ রঙ আস্তে আস্তে বদলে যাওয়া শুরু করল মরু-সম গেরুয়া বসনে। শূন্য বনাঞ্চল,উইয়ের ঢিপি, কাজু বাদামের গাছের সারি, এর মাঝেই আমাদের ছুটে চলা। তুবা থেক ওদিয়েনে আসার ১৫০ কিলোমিটার পথ প্রায় জনশূন্য। মাঝে পার করেছি হাতেগোনা সাত-আটটা গ্রাম, আর আমাদের অপর দিক হতে আমাদের পার করেছে মাত্র নয়-দশটা মনুষ্যবাহন। এভাবেই প্রায় ঢাকা-যশোর দূরত্ব পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছলাম , দুপুরে, ওদিয়েনেতে। ক্ষণিকের বিশ্রাম। কিছু জনবলকে ওখানে রেখে আবার যাত্রাপথে, সেগুয়েলোর পানে।
যাত্রার ফাঁকে ওদিয়েনের সম্পর্কে একটু বলে নেই। কোত-দিভোয়াকে সর্বমোট ১৯টা রিজিয়নে(Region) ভাগ করা হয়। একেকটা রিজিয়ন আয়তনে এবং প্রশাসনিক দিকে থেকে আমাদের বিভাগের মত। দেশের সর্ব উত্তর-পশ্চিমের রিজিয়নের নাম ডেঙ্গুয়েলে (Denguélé) , তারই রাজধানী ওদিয়েনে। মালি সীমান্তের সাথে হওয়ায় এখানকার আবহাওয়া বেশ রুক্ষ। সাহারা মরুভূমির নিচের দিকের অংশ যা মালির ভিতর দিয়ে বিস্তৃত, তাকে বলে সাহেল (Sahel). মরুভূমির নিকটবর্তী হওয়ায় মুসলমান-সমৃদ্ধ এই এলাকাটা মরুভূমি থেকে উড়ে আসা ধূলিধূসরিত। গাছপালা কম। বর্ষাকাল বাদে বাতাস খুবই শুষ্ক, ধূলি সমৃদ্ধ।

চিত্রঃ ওদিয়েনের একটি মসজিদ (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)


ভৌগোলিক জ্ঞান জাহির করা বাদ দিয়ে আবার ঘটনাতে প্রত্যাবর্তন করি। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার অবিরাম যাত্রা শেষে ক্ষণিকের বিশ্রাম। আবার পথের শুরু। এবারে গন্তব্য এই রিজিয়নেরই একটি গ্রাম সেগুয়েলো। সেখানেই অনুষ্ঠিত হবে দোজো সম্মেলন। মাটির রাস্তায় আরও ৬০ কিলোমিটার। ফিলিপিন এবং চাদের দু’জন সামরিক পর্যবেক্ষক এবারে আমাদের পথ-প্রদর্শক। মাটির রাস্তার ঝাঁকুনি আর ধূলা খেতে খেতে যেন আর শেষই হয় না। তখনো আসলে দোজোদের ব্যাপারে আমার জানাশোনা শূন্যের কোঠায়। কেবল জানি এরা বহু পুরনো এক শিকারি জাতি গোষ্ঠী। আফ্রিকার এইদিকের ঐতিহ্য। তাদের কি এক সম্মেলন। তার জন্য এত কষ্ট সহ্য করে আসা। বিকালের দিক পৌঁছলাম গ্রামে। পার্শ্ববর্তী এক স্কুলের সামনে একে একে জড় হতে শুরু করেছে দোজোরা, আফ্রিকার ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক-বাহক, তাদের তথাকথিত বেশভূষায়। পরনে ঐতিহ্যবাহী গেরুয়া পোশাক, যা বহু ব্যবহারে জীর্ণ। ধূলি-ময়লা-রোদে পুড়ে যার প্রকৃত বর্ণ উদ্ধার করা দুষ্কর। কাপড়ের বিভিন্ন জায়গা, গলা, মাথা বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের দাঁত-নখ দ্বারা অলংকৃত। সবার কাছেই তাদের নিজস্ব প্রস্তুত গাদাবন্দুক। কোমরে গুলি-ভর্তি কোমরবন্ধ, কারও কাছে তীর-ধনুক। সাথে ঐতিহ্যবাহী ছুরি আর পশুর লেজের পশম দিয়ে তৈরি একটা ঝাড়ু-সদৃশ, তান্ত্রিক সাধনায় যার ব্যবহার বিভিন্ন চলচ্চিত্রে দেখি বা বইতে পড়ি, সেরকম। যখন আমরা পৌঁছেছি তখনই প্রায় শখানেক দোজো উপস্থিত হয়েছে। এত বন্দুক, ছুরি, তীর-ধনুকের ভীরে যেন মনে হল সময়ের পরিক্রমায়, সময়ের বাহন সামনে যাওয়ার পরিবর্তে পিছনে নিয়ে গিয়েছে আমাদের। গল্পের বইয়ের পাতায় যে আফ্রিকার ছবি কল্পনায় এঁকেছি, চলচ্চিত্রের পর্দায় আফ্রিকার যে রূপ আমার কাছে মূর্ত হয়ে ধরা দিয়েছে, আমি যেন সেই জগতে চলে এসেছি। ভোজবাজির মত যেন টেলিভিশনের দর্শক যদি কখনও হঠাৎ করে টিভির পর্দার পেছনে নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পায়, সেরকম। আফ্রিকার গহীনে এই আদিমযুগের বংশধরদের মাঝে নিজের নিরাপত্তার সংকট যে অনুভব করছিলাম না, বললে মিথ্যা বলা হবে। তবে কৌতূহল যেন সেইসব দুশ্চিন্তাকে ছুটি দিয়ে প্রাচীনকে জানার, প্রত্যক্ষ করার এক অবারিত-দ্বার আমার সামনে উন্মুক্ত করে দিল।

চিত্রঃ দোজো


সম্মেলনের বিস্তারিত বর্ণনার আগে দোজোদের সম্পর্কে এক কথা-দুকথা না বললেই নয়। আগেই বলেছি দোজোরা হল শিকারি জাতি। তীর-ধনুক-ছুরির পাশাপাশি নিজস্ব তৈরি গাদাবন্দুক এদের হাতিয়ার। মৃত পশুর বিভিন্ন অংশ, চামড়া, পশম, দাঁত, হাড় এরা নিজেদের অলংকরণসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে আসছে আদিকাল হতে। শিকারী স্বত্ত্বার পাশাপাশি তন্ত্র সাধনাও এদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাথায় গেরুয়া বর্ণের বহুধা অলঙ্কৃত টুপি, আর হাতে পশুর লেজের পশম দিয়ে তৈরি ঝাড়ু সদৃশ পোশাকেরই অংশবিশেষ। এই পোশাক নিয়ে দোজোদের কিছু বিশ্বাস প্রচলিত আছে। তারা মনে করে এই পোশাক তাদেরকে আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা করে, এমনকি তাদেরকে শত্রুর গুলির সামনে অদৃশ্য করে ফেলে। বহু আদিকালে এরা সবাই এক জাতি ছিল। বিভিন্ন সময়ে উপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে কোত-দিভোয়া, মালী, লাইবেরিয়া, বুরকিনা ফাসো সহ আরও পার্শ্ববর্তী কিছু দেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এদের ইতিহাস বহু পুরাতন হলেও ইতিহাসের পাতায় এদের অস্তিত্বকে ততটা গুরুত্ব সহকারে স্মরণ করা হয়নি আগে। শিকার করে, তন্ত্রসাধনা করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলো নিজেরা নিজেরাই টিকে থাকত। কিন্তু কোত-দিভোয়ার গৃহযুদ্ধই ইতিহাসের পাতায় এদের সরব অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে।

চিত্রঃ অপেক্ষারত


কোত-দিভোয়ার গৃহযুদ্ধ দেশটিকে উত্তর-দক্ষিণ দুটো অংশে ভাগ করে ফেলে। দক্ষিণ অংশের নিয়ন্ত্রণ থাকে তৎকালীন সরকারী দলের হাতে। উত্তর অংশ বিরোধী শক্তির অধীনে। দোজোরা মূলত মালি, বুরকিনা সংলগ্ন উত্তর অংশে বাস করত। তাদের শিকারি দক্ষতাকে তৎকালীন বিরোধী শক্তি নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার শুরু করে। যদিও ১৯৯০ সালের দিক থেকেই দেশের শান্ত পরিস্থিতি থেকেই দোজোরা ধীরে ধীরে আলোচনায় আসতে শুরু করে, তবে ২০০০ সালের পরবর্তী গৃহযুদ্ধের মাঝে তাদের সরাসরি এবং অধিক সংখ্যায় অংশগ্রহণ দেখা যায়। তাদেরকে পথপ্রদর্শক, আধ্যাত্মিক গুরু, তথা নিরাপত্তা দায়িত্বসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। দোজোদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোও ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে শুরু করে। এদের সংখ্যাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। অবশেষে ২০১১তে আন্তর্জাতিক সহায়তার পাশাপাশি সশস্ত্র যুদ্ধে বিরোধী শক্তি ক্ষমতা-দখল নিতে সক্ষম হয়। আস্তে আস্তে দেশের যুদ্ধ-বিধ্বস্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। এবং পাশাপাশি যুদ্ধ-সময়ের অন্যতম সহযোদ্ধা দোজোদের ভূমিকা অপ্রয়োজনীয় হতে শুরু করে, দোজোরাও অস্তিত্বের সংকটে ভোগা শুরু করে। যে দেশ গড়তে তারা সম্যক ভূমিকা রেখেছিল, সেই দেশে তাদের অস্তিত্বই প্রশ্নের সম্মুখীন। ফলশ্রুতিতে দোজোরা অনেক জায়গায় আইন-বহির্ভূত কার্যকলাপ আরম্ভ করে। চাঁদা তোলা, ছিনতায়ের মত ঘটনা ঘটতে থাকে। অন্যান্য জাতির সাথে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বও ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয়। এরকম এক সময়ে এই বহু-বিভক্ত সম্প্রদায়কে একত্রিত করতে দোজোদের কোত-দিভোয়ার এক নেতা জাকারিয়া কোনে তার গ্রাম সেগুয়েলো সব দোজোদের একত্র হওয়ার আহবান জানান। এই সম্মেলনেই আমাদের আগমন। জাকারিয়া কোনে তৎকালীন বিরোধী সশস্ত্র বাহিনীর একজন নেতা হিসেবে যুদ্ধ করেন। বর্তমানে দেশের সামরিক পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত। তারই আহবানে সাড়া দিয়ে আশেপাশের বিভিন্ন দেশ থেকে, দেশের অভ্যন্তরের আনাচে-কানাচে থেকে প্রায় চার-পাঁচ হাজার দোজো এই সম্মেলনে একত্রিত হয়।

চিত্রঃ স্থানীয় প্রশাসন প্রতিনিধিদের সাথে জাকারিয়া কোনে(সাদা ট্রাকস্যুট পরিহিত)


চিত্রঃ যুদ্ধকালীন সামরিক সাঁজে জাকারিয়া কোনে


সাক্ষাতেই জাকারিয়া কোনে আমাদের তার বাসায় দাওয়াত দেন। শিকারি জাতির নেতা শুনে যা মনে হয় সেরকম না। গ্রামে তার একটি দ্বিতল বাসভবন আছে। যার নিচতলায় অতিথিদের বসার জন্য অন্দরখানা আর উপরতলায় তার বাসস্থান। আমাদের দেশের নেতাদের বাড়ির মতনই প্রচুর লোকসমাগম। সবাই নিচতলায় টিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখছে। পাশেই খাওয়ার টেবিল। বাইরে আরও দর্শনার্থী অপেক্ষারত। রাতের খাবারে কি না কি থাকে, তা নিয়ে আমরা ভালই সংশয়ে ছিলাম। কিন্তু খাওয়ার সময় মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস এগুলোই চোখে পড়ল। যদিও রসনা বিলাস আমাদের থেকে অন্যরকম; আমরা অল্পকিছু খাবার আর ফলের রস দিয়েই আতিথেয়তা গ্রহণ করলাম, পাছে বদহজম হয়ে যায় সেই ভয়ে।

চিত্রঃ জাকারিয়া কোনের দ্বিতল বাসভবন


চিত্রঃ বাসভবনের অন্দরমহল


রাত্রিকালীন খাবারের পর শুরু হল অনুষ্ঠান। গ্রামের অদূরেই ফাকা মাঠে সামিয়ানা টাঙিয়ে, চেয়ার-টেবিল সহকারে বিশাল আয়োজন। আমরা যখন সম্মেলন স্থলে পৌঁছলাম তখন প্রায় আড়াই-তিন হাজার দোজো উপস্থিত হয়েছে। আরও পথিমধ্যে। সবাই এই বিরাট জনসমাবেশে আপন স্থান করে নিয়েছে। আমরাও একপাশে আসনগ্রহণ করলাম। এত বিচিত্র পোশাক পরিহিত জনসমাগমে আমরা কয়েকজনই ব্যতিক্রম। সাথে অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থা, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরাও উপস্থিত। সশস্ত্র দোজোদের এই সম্মেলন তখন সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু।

চিত্রঃ দোজোদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক


চিত্রঃ জনসমাগম


রাত দশটার দিকে গানবাজনা শুরু হল। গীটারের দোজো সংস্করণ, কোরা। আরও অন্যান্য নিজস্ব প্রস্তুত বাদ্যযন্ত্র সহযোগে একদল বাদক পুরো ময়দানটাকেই সরগরম করে তুলল। তাদের নিজস্ব ভাষায় সাদর আমন্ত্রণ, সংগীত পরিবেশন, তাদের সংস্কৃতির প্রদর্শন চলতে থাকল। এদের মাঝে আতশবাজি-পটকার অভাব থাকতে পারে। তবে গাদা বন্দুকের অভাব নেই। আনন্দপ্রকাশার্থে কিছুক্ষণ পরপরই কেউ না কেউ আকাশপানে ফাকা গুলি ছুড়ে হর্ষধ্বনি সৃষ্টি করল। মুহুর্মুহু গুলি, বাদ্যযন্তের অবিশ্রাম ব্যবহার পুরো মাঠটাকেই যেন জীবন্ত করে তুলল।

চিত্রঃ সাদা ধোয়া না, গাদাবন্দুকের গুলির স্মৃতিচিহ্ন


চিত্রঃ নিজস্বপ্রস্তুত বাদ্যযন্ত্র (কোরা) হাতে একজন বাদক


তারপর দোজোরা একে একে সবাই মাঠ প্রদক্ষিণ করা শুরু করল। তাদের বেশভূষার বাহার, আগ্নেয়াস্ত্রের বিভিন্নতা, গায়ে-ঝোলানো পশুর হাড়-দাঁত-পশমের রকমারিতা আমাদের সামনে এক বিচিত্রতার মেলবন্ধন রচনা করল। সবার শেষে মাঠে প্রবেশ করল জাকারিয়া কোনের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন দেশের দোজো গোষ্ঠীর নেতারা। বিকালে দেখা সাধারণ বেশভূষার জাকারিয়াকে তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে খুঁজে পেতে আমাদের ভাল বেগ পেতে হল।

চিত্রঃ মাঠ-প্রদক্ষিণরত দোজোরা


চিত্রঃ বিভিন্ন দেশের দোজো নেতৃবৃন্দ, সর্ববামে অধিষ্ঠ জাকারিয়া


নেতারা আসনগ্রহণ শেষে শুরু হল স্তুতি-পর্ব। বয়স্ক এক দোজো গাতক, র‍্যাপ সংগীতের দোজো সংস্করণই বলা যায়, স্থানীয় ভাষায় দোজোদের ইতিহাস, ইতিহাসের পরিক্রমায় তাদের অবদান, কোত-দিভোয়ার যুদ্ধে তাদের অবদান এবং সবশেষে জাকারিয়া কোনের স্তুতি বর্ণন চলতেই থাকল।

চিত্রঃ বয়স্ক এই গায়কের সামর্থ্যের সীমা পাওয়া ভার, প্রায় ঘণ্টা দুয়েক চলে তার একক স্তুতি পর্ব


চিত্রঃ স্তুতি পর্ব চলছে...


ইতোমধ্যে জাকারিয়া এই গাথক দলটির সাথে মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে উপস্থিত হয়ে দোজোদের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে লাগল। গাছের পাতা মুখে চিবিয়ে গলাধঃকরণ, মুখ থেকে সুতা বের করা, মাটির শূন্য হাড়ি থেকে পানি উপচে পড়া, এইরকম কিছু লৌকিক-অলৌকিক সাংস্কৃতিক আচার ঘটতে থাকল। এভাবেই রাত চারটা পর্যন্ত চলল দোজোদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পরদিন সকালে প্রধান সম্মেলন।

চিত্রঃ চলছেই...


চিত্রঃ কিছু অলৌকিকতার ছোঁয়া আনার প্রয়াস


আমরা রাতে একটু বিশ্রাম নিতে ফিরে এলাম ওদিয়েনে। হালকা গড়াগড়ি করে সকাল সকাল আবার সেগুয়েলোর পথে। সকাল এগারটায় শুরু হল সম্মেলন। একইভাবে সবাই আসনগ্রহণ করার পর বিভিন্ন দেশের দোজো গোষ্ঠীর নেতারা একে একে মাঠে প্রবেশ করলেন। তারা স্থানীয় ভাষায় হালকা করে এই সম্মেলন আহবানের জন্য জাকারিয়াকে এবং অংশগ্রহণের জন্য বাকিদের ধন্যবাদজ্ঞাপন করলেন। তারপরে আসল মূল বক্তা, জাকারিয়া কোনে। তার বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল কোতদিভোয়ার বর্তমান শান্তি অবস্থায় দোজোদের ভূমিকা। তাদেরকে সংগঠিত হওয়ার আহবান, আইন শৃঙ্খলা মেনে চলার আহবান, স্থানীয় নিরাপত্তা সংস্থা ও সরকারের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সরকারের কাছে কোত-দিভোয়ার স্বাধীনতায় দোজোদের অবদানের স্বীকৃতির আবেদন। আগামীতে উত্তরের আরেক শহর করোগো (Korhogo)তে সম্মেলন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহবান, যাতে বিভক্ত দোজোদের এক নেতৃত্বের অধীনে আনয়ন করা যায়। এরকম কিছু গঠনমূলক পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়ে জাকারিয়া অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

চিত্রঃ নেতৃবর্গের সম্মেলনে প্রবেশ


চিত্রঃ সব দেশের নেতাদের একত্র অবস্থান, একাত্মতার আহবান


ক্লান্ত-শ্রান্ত, অবসাদগ্রস্ত দেহে আমরা ঐদিনই আবার ওদিয়েনের ফিরে আসি। পরের দিন আবার সেই জনবিরল বনের মাঝ দিয়ে, উইয়ের ঢিপি, কাজুবাদামের বাগান, হঠাৎ দেখা গরুর পাল, বকের ওড়া উড়ি, দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়-পর্বতের নির্জনতার মধ্য দিয়ে ফিরে আসি আমাদের আবাস মাঁ তে। পিছনে ফেলে আসি আফ্রিকার আদিমতার আকর্ষণকে। পেছনে ফিরে দেখতে গেলে যেন বিশ্বাসই হয়না দুটো দিন কোথায় পার করে এসেছি। কাদের মাঝে পার করে এসেছি। ছোটবেলার গল্পের বইয়ের আফ্রিকার গল্পে যেন দুটো দিন থেকে এসেছি, তাই মনে হয়। বাস্তবের তথাকথিত সভ্যজগৎ থেকে যেন ক্ষণিকের ছুটি নিয়ে কল্পনার রেলগাড়িতে অতীতের পাতায় ভ্রমণ করে এসেছি। এদেশে এসে যেই আফ্রিকা দেখব বলে মানস পটে চিত্র অংকন করেছিলাম তাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। দোজোর মেলায় যেয়ে আমার মানস পটের অস্পষ্ট অলস কল্পনাগুলো যেন রক্ত-মাংসের অবয়ব পেল। আফ্রিকার আদিম রূপ দেখার আমার ক্ষুধার বেশ কিছুটা যেন নিবৃত্ত হল। সাধারণ জীবন স্রোতে ওই দুটো দিন যেন স্রোতহীন নদীতে জোয়ার-ভাটার অনুপস্থিতিকে জানান দিয়ে গেল। আমার ক্ষুদ্র জীবনের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে একটি অনন্য ভ্রমণকাহিনীর পদাঙ্ক রেখে গেল।

০৮.০৪.২০১২

২,৫৪৮ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “দোজোর মেলায়”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    হুম, ভালই ঘোরা ফেরা হচ্ছে, দোজো পার্টি, আবিদজান, এখন আবার মালি বর্ডার। ভাল, ভাল... 😉

    লেখা ভাল লেগেছে :thumbup:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. তানভীর (২০০১-২০০৭)

    হাসান ভাই, দোজোদের জীবনে জীবন্ত পদার্পণ ঘটল যেন আমার। খুবই চমৎকার বর্ণনা। আর আপনি যে কখন আফ্রিকা তে গেলেন জানতে পারলাম না। তার চেয়ে বেশী অবাক হলাম আপনার বর্তমান পেশা নিয়ে। খুব ভাল লাগল জেনে। মেইল করবো আপনাকে। ভাল থাকেন।


    তানভীর আহমেদ

    জবাব দিন
  3. অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা। অনেক কিছুই জানা গেল এই শিকারি গোষ্ঠীর রীতি-নীতি, সংস্কৃতি সম্পর্কে। এরা কী শিকার করে? নরমাংশভোজী নাকি? এই নেতাও দেখি আমাদের দেশের নেতাদের মতই। শান-শওকত তো কম না তার।

    জবাব দিন
  4. সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

    মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। 🙂 দোজো শিকারী শব্দেরই সমার্থক। যেহেতু সময়ের ব্যবধানে এরা বেশ কিছু দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে, এদের আঞ্চলিক ভাষাও বিভিন্ন, গুটি কয়েক ফরাসী ভাষাও জানে। এরা মূলত অ্যানিমিস্ট এবং মুসলমান। উপরে দেয়া উইকির লিংকে গেলে হয়ত আরেকটু জানা যাবে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।