বিরহগাথা

মানুষের জীবনটা এমন কেন? কেন এমন তার চাওয়া-পাওয়া, তার ভালোলাগা-খারাপ লাগা, হাসি-কান্না, বেদনা-সুখগুলো, কেন তারা কোন নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ছুটে চলে লাগামহীন ঘোড়ার মত, আপন খেয়ালে, অর্থহীনভাবে। কেন চেনা মানুষগুলো হঠাৎ করে অচেনা হয়ে যায়, কাছের মানুষগুলো পথ হারিয়ে দূরের অচিন পথিকে পরিণত হয়! কিছুকাল আগের সুখস্মৃতিগুলো ব্যথার তীর হয়ে হৃদয় খুঁড়ে অশ্রু জাগায়। একি মানুষের যে কথাগুলো, স্পর্শগুলো, ভাবের আদান প্রদানের তরঙ্গগুলো খুবই আকাঙ্ক্ষিত, বহুল প্রতীক্ষিত ছিল, হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটাতে যাদের জুড়ি ছিল না, তারাই কিভাবে পরক্ষণেই বিতৃষ্ণার জন্ম দেয়। তারাই কিভাবে সহ্যসীমার বাইরে গিয়ে ভ্রুকুটি করে। তবে কি চাওয়াটা ভুল ছিল, না পাওয়াটা! তবে “যা চাই, তা ভুল করে চাই, আর যা পাই, তা চাই না”-চিরন্তন এই কথা কি সবার জীবনেই বারংবার প্রতিফলিত হয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। সমস্যাটা কোথায়, সমস্যা কি আমাতে, না তোমাতে? না দুজনেই দোষী হয়ে শাস্তিভোগী! এর উত্তর কি কেউ দিতে পারে, সব প্রশ্নের উত্তর কি দেওয়া যায়, পাওয়া যায়! সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার, অনুভব করার সামর্থ্য কি বিধাতা আমাদের দিয়েছেন!

আমরা কি অনুভূতির দাস! না অনুভূতি আমাদের! আমাদের অনুভূতির উপর কি আমাদের নিয়ন্ত্রণ আছে, না অনুভূতি আমায় নিয়ন্ত্রণ করে, আমাদের সব অনুভূতির কি যৌক্তিক ব্যখ্যা আছে? তাকে কি যুক্তির খাঁচায় আবদ্ধ অচিন পাখিতে পরিণত করা সম্ভব। মন কি আমার কথা শোনে, তাতে শত বাধ দিয়েও কি তার স্রোতধারাকে রুদ্ধ করে রাখা যায়। কোন ফাঁক গলে ইতস্তত জলধারা, প্রাণবন্ত ঝর্ণাধারায় পরিণত হয়ে, তার খেয়াল কি থাকে, না মন বুঝতে দেয়। বাধ ভেঙে স্রোত যখন সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়, যখন কূল কিনারাহীন নিঃস্ব, আশ্রয়হীনতার দশা গ্রস্ত হয়, তখনই নিজের দৈন্যতা প্রকট রূপে প্রস্ফুটিত হয়। সে কি আমার দোষ? নিয়ন্ত্রণহীনতার ব্যর্থতার দায়ভার নিয়েই কি তবে প্রস্থান করতে হবে, চলে যেতে হবে বিস্মৃতির চিলেকোঠায়।

তবে কি এই ছিল ভাগ্যে। নিয়তির পরিহাস স্বীকার করে কি তবে এই মেনে নিতে হবে। তোমার জীবননাট্যের রঙ্গমঞ্চ থেকে কি তবে পাট গুছিয়ে বিদায় নিতে হবে। তোমার জীবনে আমার অবস্থান যে পদে পদে আমায় হেয় করছে। ভ্রুকুটি করছে, আমাকে ফেলনা করে ফেলছে, আমার অস্তিত্বকে নাকচ করছে প্রতি মুহূর্তে। তোমাকে দেওয়ার মত কিছুই কি আমার অবশিষ্ট আছে, না নূতন করে পুতুল নাচের আসর সাজানোর ধৈর্য-আগ্রহ সবই ফুরিয়ে গেছে। তোমার কাছে কি আমার কিছু চাওয়ার আছে, আমাকে কিছু দেওয়ার সামর্থ্য কি তোমার আছে। তুমি যে দিন দিন দীনহীন দরিদ্র ভিক্ষুকে পরিণত হচ্ছ, তা কি তুমি বুঝতে পার, কেন এখন তোমায় এত অসহ্য লাগে, কেন তোমার কথা, তোমার হাসি, তোমার ঠাট্টা, তোমার সবকিছুই কেন এত ভ্রান্ত, এত মেকি মনে হয়। সবকিছুকেই কেন রঙিন ফানুসে পরিণত হতে দেখি। সবকিছুর মাঝে কেন এক আশ্চর্য অন্তঃসারশূন্যতা বেশি করে চোখে লাগে। তবে কি তোমার চাহিদা আমার জীবনে ফুরিয়ে গেছে, নাকি তোমার মানস পটে অনুভূতির অনুপস্থিতি তোমাকে আমার জীবনে অপ্রয়োজনীয় কদর্যতে পরিণত করছে। তবে কি তোমা প্রতি আমার আকর্ষণ ক্ষণিকের ছিল, ছিল কি ক্ষণস্থায়ী, পাড়ে ঢেউয়ের আঘাতে বুদবুদের ন্যায়। নাকি স্বীকার করতে চাই না, তাই গড়ে নিয়েছি আপন প্রতিমা, তোমায় না পাওয়ার বেদনাকে লুকিয়েছি তোমা প্রতি বিতৃষ্ণা, ঘৃণার আড়ালে। সত্য কোনটা, জানি হয়ত, তবু জানতে চাই না, চিনি হয়ত, তবু চিনতে চাই না!

এমন কি হতে পারত না, তুমি আমি দুই অর্বাচীন পথিক অর্বাচীনই রয়ে যেতাম, কেন খামাখা মানব-মানবীর অনুভূতির মিথস্ক্রিয়ায় এই বিরহগাথার জন্ম। তোমার আগে তো আমি ভালই ছিলাম, আপন ভুবনে, আপন মনে, কি দরকার ছিল এই ক্ষণিকের সাক্ষাতের, ক্ষণিকের পরিচয়ের, ক্ষণিকের অন্তরঙ্গতার, এই ক্ষণিকই তো আমার জীবনটাকে অনলে দঃশিত করে গেল। না, আমাকে পারতেই হবে তোমাকে ভুলে থাকতে, আমার জীবনকে চলতেই হবে আপন গতিতে, কারও জন্যই থেমে থাকবে না, তোমায় আমার জীবন থেকে মুছে ফেলে, শূন্য স্লেটে নতুন করে শুরু করব, নতুন করে গড়ব আমার পুতুল নাচের আসর, যেখানে কেউ আমায় আঘাত দিতে পারবে না, যেখানে আমিই সর্বেসর্বা, কারও কথায়, কারও আচরণে আমার কিছু যাবে আসবে না। আমার রাজ্যের রাজা আমিই হব, নিজের রাজ্যে প্রজা হয়ে আর না। আমার অনুভূতি, আমার দুঃখ-সুখ আমিই নিয়ন্ত্রণ করব। কেউ আমাকে আঘাত দিতে পারবে না, আমার অনুভূতিকে আস্তা কুড়ে ছুড়ে ফেলে দিতে পারবে না। আমার একাকীত্বের সঙ্গী আমি হব। আমিই হব আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। একমাত্র বন্ধু।

কিন্তু, কিন্তু তুমি কি আমায় ভুলে যাবে। যদি জীবনের পথ চলতে চলতে কোন জীবন-রাস্তার বাঁকে তোমাতে আমাতে দর্শনলাভ হয়, তুমি কি আমায় চিনতে পারবে, তুমি কি আমার পরিবর্তনটুকু ধরতে পারবে! নাকি আমি তোমার অবচেতন মনের কৃষ্ণগহ্বরে বিলীন হয়ে যাব! নাকি সেদিন তুমি তোমার ভুল অনুভব করবে। নিজের কৃতকর্মের জন্য নিজেকে দোষারোপ করবে; কে জানে। হয়ত তোমাতে আমাতে কোনদিন দেখায় হবে না। হয়ত দেখা হলেও অচেনা পথিকের মত একে অপরকে অতিক্রম করবে; জানি না, জানতে চাই না। বুঝি না, বুঝতে চাই না। চাই না আর তোমায় নিয়ে অলীক কল্পনার জাল বুনতে, চাই না আর মেঘের কোলে ছিমছাম বাসর পাতার। কল্পনার জগত থেকে মুক্তি চাই। রূপকথার রাজারানী থেকে বাস্তবতায় মিশে যেতে চাই। কালের বিবর্তনে স্রোতের জোয়ারে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চাই। গঙ্গাস্নানে নতুন করে জন্মাতে চাই। সবকিছু নতুন করে গড়তে চাই, বুঝতে চাই। জানি না, পারব কিনা, এতসব জানি না, জানতে চাই না। এতসব বুঝি না, বুঝতে চাই না। জীবনের সব সত্যকে মেনে নেওয়ার মত পরিণত যে আমি এখনও হয়ে উঠি নি!!!

০৬.১২.২০১১

১,৩৯০ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “বিরহগাথা”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    আহা রে!
    কোন পাষাণী এই কচি 'বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক' হৃদয়ে দাগা দিয়ে গেল!?

    সন্ধির প্রতি এহেন অমানবিক আচরণহেতু এআইইউবি'র সুন্দরী ছাত্রীকূলের ব্যান চাই :grr:


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : Humayra

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।