১.
আমার রুগ্ন, শীর্ণকায় দেহাংশ, আমার বা-পাখানা আজ পারিবারিক কবরস্থানে কবরস্থ করে এলেন বাবা। ফিরে এসে কেমন যেন অপরাধীর মত আমার দিকে তাকালেন। যেন দোষটা তারই। দোষ কি আর তার, দোষ তো আমার ভাগ্যের।
আমার বা-পায়ের ফুটবল কিক আমাদের এলাকা বিখ্যাত ছিল। সবাই বলত, অর্ণব, তোমার বা-পায়ের শটের জুড়ি নেই। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ছিল আমার তীব্র ঝোঁক। মায়ের নিষেধ, বাবার চোখ রাঙানো, সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে প্রতিদিন লুকিয়ে খেলতে যেতাম। খেলা শেষে মায়ের তীব্র বকুনি ছিল শিরোধার্য। তারপরেও উৎসাহে কখনও ভাটা পড়েনি। খেলতাম মিডফিল্ডে। চেষ্টা করতাম দারুণ গতির বাঁকানো ফ্রি-কিক নেওয়ার। ধীরে ধীরে অগ্রগতির সাথে সাথে সাফল্যও হস্তগত হচ্ছিল; কিন্তু ছোট এক ঘটনা আমার সাজানো স্বপ্নের জগতটাকে ডিমের খোসার মত চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল। আমার স্বপ্নিল স্বর্গ ক্ষীণকায় তাসের ঘর হিসেবে প্রতিভাত হল।
একদিন আমাদের ফুটবল ক্লাবের দলনেতা রকিব ভাইয়ের সাথে বল কাটাতে গিয়ে কাদায় পা পিছলে বেকায়দায় পড়ে গেলাম। পায়ে হালকা টান লেগেছিল। তখন অত পাত্তা দেইনি। পায়ে কিছুদিন হালকা চিনচিনে ব্যথা; আস্তে আস্তে তার অনুভূতিও বিলীন হয়ে গেল।
আমার পায়ের ক্যান্সারটা ধরা পড়ে দুবছর আগে। তাও বাবা-মা আমাকে জানান নি। ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এর আগে কখনও পায়ে ব্যথা পেয়েছি কিনা। কে জানত, কৈশোরের এক ক্ষুদ্র ব্যথাময় মুহূর্ত আমার আমার জীবনে এত বড় প্রভাব ফেলবে।
পায়ে ঠিকমত শক্তি পেতাম না। ব্যথা হওয়া শুরু করল। ব্যথা কমল না। বরং বাড়তেই থাকল। যথেষ্ট সেবাশুশ্রূষার পরও আমার বা-পা টা কেমন যেন বিদঘুটে আকার পেতে থাকল। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হাটাচলার ক্ষমতাও লুপ্ত হল। বাবা-মা তাদের সাধ্যমত ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। কিন্তু বিধাতার নির্ধারিত অদৃষ্ট তারা পরিবর্তন করতে পারলেন না। কয়েকদিন পর মায়ের আড়াল করা চোখের বন্যা আমার কাছে মূর্ত হয়ে ধরা দিল। জানলাম আমার পায়ে ক্যান্সার হয়েছে। আমার দেহের শ্বেত-রক্ত কণিকাগুলো যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিয়েছে; পায়ে পচন ধরেছে। এতদিনের নির্ভরতা অনিশ্চয়তার ভয়াল কালগ্রাসে হুমকির সম্মুখে।
বিধাতার বিধি অনুযায়ী আজ তাই আমার নিত্যদিনের সঙ্গী হুইলচেয়ার। উদ্যমশীল কিশোর আজ যৌবনে এসে হেরে গেল, নিয়তির নিষ্ঠুরতার কাছে। লাজুক এই যুবককে আজ তাই প্রাত্যহিক কাজকর্মের জন্যও অন্যের দ্বারস্থ হতে হয়। নিয়তির পরিহাসের কাছে আজ সে অসহায়, রিক্ত, শক্তিহীন।
কয়েকদিন আগে বা-পায়ের অবস্থা আরও শোচনীয় হতে শুরু করল। পায়ে তীব্র ব্যথা। জীবনের প্রতিটি স্পন্দন আমার জীবনে বেদনা নিয়ে হাজির হত। মনে হত অসংখ্য পোকা বুঝি আমার নিম্নাঙ্গ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এক অবর্ণনীয় কষ্ট। সারাদিন, সারারাত তার বিচরণ। কষ্ট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল।
ডাক্তার জানালেন পায়ের পচন সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়া শুরু করেছে। আমার জীবনদৈর্ঘ্য বৃদ্ধির জন্য আমার বা-পা কেটে ফেলতে হবে। এত কষ্ট সহ্য করে এ পৃথিবীতে আরও বেশিদিন স্থিতিলাভ করার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু তারপরেও বাবা-মার মুখ চেয়ে অপারেশনে রাজি হয়ে গেলাম।
আজ আমার জীবনে এসেছিল আমার অভিজ্ঞতালব্ধ সবচেয়ে ভয়ংকর মুহূর্ত। আজ ছিল আমার দেহ বিচ্ছিন্ন পা টার দাফনকার্য। হাসপাতালের বিছানায় আমি; বা উরুতে ব্যান্ডেজ বাধা। কেন যেন কল্পনায় কবর দেওয়ার ছবিটা বারবার ভেসে উঠছিল। ছোটবেলায় কলপাড়ে পড়ে গিয়ে পা কেটে গিয়েছিল। কবর দেয়ার সময়ও নিশ্চয় দাগটা পা টার অলংকার হয়েছিল। অভাব শুধু আমার বাকি দেহটার। তাও হয়তবা কিছুদিনের মধ্যে সহযাত্রী হবে। জীবনে নানা কষ্ট সহ্য করেছি। কিন্তু কখনও চোখের অশ্রু ঝরাইনি। কিন্তু আজ আর কান্না বাধ মানেনি। চোখের বর্ষণ বিদায় সম্ভাষণ রূপে আত্মপ্রকাশ করে।
২.
কি স্বার্থপর আমি! বাবা-মাকে আরও ভাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বলি। এক পা নিয়ে আছি দুমাস থেকে। বাবা-মা তাদের যথাসর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। তারপরেও তাদের কাছে কি করে আরও আবদার করি! যে ছেলে লজ্জায় কারও কাছে কিছু চাইতে পারত না, সে আজ লোভী, স্বার্থপর। ভিক্ষা চায়। জীবন ভিক্ষা। মানুষের জীবন তার নিজের কাছে এত প্রিয় কেন! সুস্থ অবস্থায় কি কখনও আমার মধ্যে এ ধরণের মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত! মৃত্যু নিশ্চিত জানি বলেই কি এই বেচে থাকার তীব্র ইচ্ছা! আর্তনাদ! হাহাকার!
৩.
কেমো দিতে দিতে মাথার চুল প্রায় সব পড়ে গেছে। সারাদেহে পচন ধরেছে। আয়না দেখা বন্ধ করে দিয়েছি। নিজেকে কেন যেন আর নিজেই চিনতে পারি না। দেহটাকে বড় বোঝা বলে মনে হয়। মাথার মধ্যে মনে হয় লক্ষ-কোটি ঝিঁঝিঁ পোকার ঘর-সংসার। নেশা না করেই সারাদিন ঘোরের মধ্যে থাকি, বুঝিনা। নিজের হৃৎস্পন্দনটাই যেন কালঘড়ির মত ঘরের মধ্যে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। আমায় জানান দেয়। আর খুব বেশি হলে হয়ত এক মাস। তারপর? জানিনা।
আমার চারদিকে সবাই কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরণ করছে। মা টা কেন যেন আর কাছেই আসে না, বাবা টা কেন যেন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনা। বদরাগী বড় চাচাও কেন যেন প্রতিদিন তিনবার করে খোজ নেন। আমার পোষা বিড়ালটাও কেমন করুণ চোখে তাকায়। ও কি কিছু বুঝতে পেরেছে! হয়তবা! জন্তু জানোয়ার নাকি সব আগে থেকেই বুঝতে পারে। উফ!!! কাকটা বড় জ্বালাতন করছে, সকালবেলা থেকে। সারাদিন কাঁ!!কাঁ!! অসহ্য!
৪.
পাঁচদিন পর অর্ণব মারা গেল। যে কবরে তার পা-টাকে দাফন করা হয়েছিল, সেই কবরেই তার অবশিষ্ট দেহও দাফন করা হল। সাথে দাফন করা হল তার ভবিষ্যৎ, তার বাচার ইচ্ছা, তার আশা, তার স্বপ্ন, তার শেষ চিহ্ন, স্মৃতি। সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। এটাই হয়তবা প্রকৃতির বিদায় সম্ভাষণ। এটাই হয়তবা প্রকৃতির তথা বিধাতার লীলাখেলা। তার খেয়ালেই হয়তবা এই সহকবরের সৃষ্টি। কে জানে? অবান্তর প্রশ্ন!!!
ভালো লাগলো হাসান ভাই। তবে গল্পটা কেমন যেন হঠাৎ করেই ফুরিয়ে গেলো, আরো খানিকটা চললে যে জমে উঠতো।
ভাইয়া, কয়েকটা বানান সম্ভবত টাইপিং মিস্টেকের কারণে ভুল এসেছে। একটু বদলে দিয়েনঃ
বাকানো = বাঁকানো
ব্যাথা = ব্যথা
যথেষ্ঠ = যথেষ্ট
উদ্যোমশীল = উদ্যমশীল
প্রাত্যাহিক = প্রাত্যহিক
শোচণীয় = শোচনীয়
ভয়ংকার = ভয়ংকর
রুপে = রূপে
মানষিকতার =মানসিকতার
হৃদস্পন্দনটাই = হৃৎস্পন্দনটাই
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
......অন্য গুলো ঠিক আছে, কিন্তু আমি "ব্যাথা" টাই সঠিক জানতাম।
......একটু দেখিস তো ভাই রকিইব্যা।
অভ্র স্পেল-চেকিং ব্যবহার করছ মনে হচ্ছে।
না ভাইয়া, "ব্যথা" বানানটাই ঠিক আছে (সূত্রঃ বাংলা একাডেমীর অভিধান)।
@গুলশান ভাই- অভ্র স্পেল চেকার + বাংলা একডেমীর (বাংলা টু ইংরেজি) অভিধান। 😀
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
......ধইন্যবাদ রকিব, শুধরে নিলাম। 🙂
নিজের ভুল দেখে নিজেরই লজ্জা লাগছে। তাড়াতাড়ি একখানা বাংলা অভিধান কিনতে হবে বলে মনে হচ্ছে। আসলে অনেকদিন বাংলা লেখার অভ্যাস নেই, আর কম্পিউটারে বাংলা লিখতে গিয়েই যত গ্যাঁড়াকল।
অভ্রের নতুন ভার্সনে কিন্তু একটা বাংলা স্পেল-চেকার আছে। ওটা ব্যবহার করলে আর বাংলা অভিধান না কিনলেও চলবে।
১ম নাকি 😉 😀 ।
যাই এইবার পড়ি 😛 ।
......ভালই তো পরথম হইলি রে। ;))
নাম থেকে গল্পের শেষটা একদম শুরুতেই বোঝা যায়। সাহিত্যমান ভাল। :-B
আরো লিখিস।
তাহলে তো নামকরণ সার্থক বলতে হয়। ধন্যবাদ দোস্ত। আরও লেখার ইচ্ছা আসে।
আজকাল সবাই শেষের দিকে এসে একটা 'টুইস্ট' দেয় তো। একদম শেষ না করা পর্যন্ত বোঝা যায় না কি হবে। নামটা এতই বিমূর্ত টাইপের হয় যে সেই নাম থেকে তেমন কিছু উদ্ধার করা যায় না। তবে শেষে এসে বোঝা যায়, আসলে এটা হল নামকরণের আসল রহস্য। ঐযে 'ছুটি' গল্পটার কথা মনে আছে?
......মর্মস্পর্শী লেখা হাসান। :thumbup:
ধন্যবাদ ভাইয়া।
নাহ, আগেরটার মত হয়নি। 🙂
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ভাইয়া, ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। আসলে মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ রাত নিয়ে লেখার ইচ্ছা আমার বহুদিনের। কিন্তু অনুভূতিগুলো কল্পনার জগত থেকে বাস্তবের পাতায় আনতে পারব কিনা, ভয় পাই। আশা করি এই বিষয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারব এবং আপনার সন্তুষ্টি অর্জনে সফল হব। 🙂
একটানে পুরোটা পড়ে ফেললাম। খুবই ভালো লেগেছে। তবে আপাতত টেনশনে আছি কারণ খয়েকদিন ধরে আমার ডানপায়ে চিনচিনে ব্যথা হইতেসে। 🙂
গল্পের আইডিয়াটা ভালো ছিলো তবে শেষের দিকে মনে হয় আরেকটু এলাবোরেট করা যেত। মৃত্যুপথযাত্রীদের শেষরাত্র নিয়ে আমার আগ্রহ গুতাগুতি অনেক আগে থেকেই। এমন থিমে গল্পও লিখেছিলাম। অবশ্য সেটা সম্পূর্ণই ভিন্ন থিমে।
তিন নম্বর প্যারাটা পড়তে খুবই ভালো লাগছিলো। হঠাৎ করেই থেমে গেছে। সেটা আরো ইলবোরেট হয়ে চতুর্থ প্যারাটা বাদ দিয়ে সেটাকে একটা ফুটনোট করা যেত কি??
গল্প লেখকের আপন অধিকারের জায়গা। সেটা নিয়ে একটু অনাধিকার চর্চাই করে ফেললাম ভালো লাগলো বলে। আরো লেখ ছোট ভাই।
:)) :)) , ডাক্তার দেখান, আর সিসিবি তে কেউ ডাক্তার থাকলে যোগাযোগ করেন। 😛
আপনার প্রস্তাবটা ভাল। কিন্তু নিজের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি বলেই এইখানেই ইতি টানছি। তবে আপনাদের মন্তব্যে উৎসাহ পাচ্ছি। আশা করি, পরবর্তীতে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অবকাশ পাব। 🙂 মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। 😀
:clap:
ধন্যবাদ দোস্ত। 🙂
চমৎকার! এক টানে পড়ে গেলাম। তুমি কি আমাদের বুয়েটের সন্ধি??
ধন্যবাদ। তোমার সাথে তো পরিচয় আরও আগে থেকে, তাহলে Scafe' র সন্ধি বলা যায়। 🙂
হাহাহাহা...ঠিক তাই। সেইটাই জিগাস করতে গেসিলাম, পরে মনে হলো তুমি যদি সেই সন্ধি না হও!
সবথেকে ভালো লেগেছে এই প্যারাটি।
ওয়েল ডান দাদা :clap:
:clap: :clap: েশষ হইয়্যাউ হইলো না েয েশষ ভালো ছিল ::salute:: ::salute:: :hatsoff: :hatsoff:
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, হাবীব... 🙂