অবাক জিজ্ঞাসা…

(প্রারম্ভিকাঃ ক্যাডেট কলেজ ব্লগ এর নীরব পাঠক প্রায় এর জন্মলগ্ন থেকেই। কিন্তু কখনও মাঠে নামার সাহস অর্জন করতে পারিনি। কলেজে যাদের বাংলা লেখার প্রশংসা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, তাদেরকে এই ব্লগে লিখতে দেখে নিজেকে পাঠক হিসেবেই শ্রেয় ভাবতাম, কিন্তু যখন দেখলাম, দুলাভাই এর প্রশয়ে আমার নন-ক্যাডেট বোনও পুরোদস্তুর লেখক, তখন আর আত্মসংবরণ করতে পারলাম না। কলেজের শেষের দিকের লেখা কিছু বাক্যসম্ভার দিয়েই যাত্রা শুরু করলাম। জীবনে প্রথম ব্লগ লেখা, তাই ভুলত্রুটিগুলো সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে বাধিত হতাম )

দশ মাস দশ দিন গর্ভে অবস্থানের পর মাতৃজঠরের কুসুম কোমল স্থান হতে বিমুক্তিই হয়তবা মানবের সবচেয়ে দুঃখজনক স্মৃতি, তাই হয়তবা বিধাতা মানব মস্তিষ্কের নিউরোন সেলে এই রুক্ষ স্মৃতির স্থান সঙ্কুলান করেন না। দশ মাস দশ দিন গর্ভে রেখে তীব্র কষ্ট সহ্য করে যে জননী আমাকে এই বর্ণিল পৃথিবীর আলোয় আসার সুযোগ দিয়েছেন তিনি হলেনা আমার প্রাণপ্রিয় মা, যাকে আমি আহ্লাদ করে ডাকতাম মাবুলু। মা শব্দটিই হয়ত দুনিয়ার সবচেয়ে মধুর ও ব্যঞ্জনাময় শব্দ ঝংকার, যার উচ্চারণে মনের পাতায় পাতায় স্নেহার্দ্র এক আনন্দের পরশ বয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই অনেক মহৎ লোকের জীবনী পড়েছি, অনেক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে; কিন্তু আমার এই ক্ষুদ্র অকিঞ্চিতকর জীবনের পদযাত্রায় আমার মাবুলুর প্রভাব এত বিস্তৃত যে অন্যকারও অনুভূতি আমার জীবনে এমন পুস্পিত হওয়ার অবকাশ পায়নি।
জন্মের পর হতে বাবা নামক অচিন বৃক্ষটির দেখা আমি পাইনি। বাবা নামক জীবটি কেমন হয় তা কেবল আমার মায়ের বর্ণনায় আর সহপাঠীদের বাবার ছোয়ায় অন্বেষণের চেষ্টা চালিয়েছি। আমি যখন মায়ের পেটে, আমাকে এবং আমার মাকে ফাঁকি দিয়ে আমার বাবা এই ধরাধাম ত্যাগ করে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। ছোটবেলায় শুনেছিলাম মানুষ নাকি মৃত্যুর পর আকাশের তারা হয়ে যায়। অনেক রাত আকাশের দিকে তাকিয়ে কেদেছি, আকাশে খুজে বেরিয়েছি। কিন্তু কোন তারাকেই আপন মনে হয়নি। বন্ধুদের বাবাদের দেখতাম পরীক্ষার ফলাফলের দিন উৎকণ্ঠিত মুখে দাড়িয়ে আছেন। ছোটবেলাই নানা বন্ধুকে তাদের বাবার কোলে ঘুরে বেড়াতে দেখতাম। কিন্তু সেসবের অনুভূতি পাওয়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য আমার হয়ে ওঠেনি।
তখন থেকেই দেখতাম আমার মা কি তীব্র কষ্ট সহ্য করে আমাকে মানুষ করছেন। আমার মা ছিলেন বিএ পাশ। আমার বাবা রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যাবার পর বাবার অফিসের কর্মকর্তারা অফিসে মার জন্য একটা স্থান ছেড়ে দেন। টাকায় সঙ্কুলান করতে না পারায় মা আমাদের বিলাসবহুল ভাড়া বাসা থেকে এক রুমের এক ক্ষুদ্র বাসাতে আমাকে নিয়ে ওঠেন। তারপরেও তাকে ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি। বরং আমাকে উৎসাহ দিতেন। স্বপ্ন দেখতে শেখাতেন, কল্পনা করতে শেখাতেন। তিনি বলতেন আমি বড় হলে আমার সব হবে, গাড়ি হবে, বাড়ি হবে, আর একটা লাল টুকটুকে একটা বউ হবে; তখন তিনি পায়ের উপর পা তুলে অবসর জীবন যাপন করবেন। এসব কল্পনায় আমাদের গরীব কুঠুরিতে রক্তিম সূর্যের অমানিশা বিদীরণ ঘটত।
ছোটবেলাতে তাও মার কষ্ট এত বুঝতাম না। আমাকে পাশের বাসার এক নানুর কাছে রেখে তিনি অফিসে যেতেন। আমার বাবা-মার ছিল ভালবাসার বিয়ে। আমার দাদা-দাদী, নানা-নানী কেউ তাদের বিয়ে মেনে নেননি। তাই আত্মসম্মানবোধে দীপ্ত আমার মা, বাবার মৃত্যুর পরও নিজের সাহস বজায় রাখেন এবং কারও মুখাপেক্ষী হন নি। তিনি আমাকে বলতেন, কারও করুণা নিয়ে জীবনে বড় হওয়া যায় না। তিনিও সকলের করুণাকে অগ্রাহ্য করে, আমাকে অবলম্বন করে কঠোর সময় পাড়ি দিয়েছেন।
আমাদের বাসায় আমার বাবার একটা সুন্দর ফটো ছিল। মায়ের সাথে কক্সবাজারে সাগর সৈকতে স্নানরত অবস্থায়। মা মাঝে মাঝে আমাকে সেসব স্বপ্নিল দিনগুলোর কথা বলতেন আর আমাকে সাহস যোগাতেন। কিন্তু মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখতাম মা আমার, নির্বাক দৃষ্টিতে সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে; সে দৃষ্টিতে কোন বেদনা নেই, ভালবাসা নেই, কেবল জিজ্ঞাসা! হয়ত তিনি আমার স্বর্গীয় পিতার আত্মাকে প্রশ্ন করতেন তার এই আকস্মিক মহাপ্রস্থানের তথ্য অনুসন্ধানে। আমার মায়ের ট্রাঙ্কে মার কিছু পুরনো কাপড় চোপড় ছিল। সেসবের বিলাসিতা আমাকে স্পর্শ করত এবং একই সঙ্গে আনন্দিত ও ব্যথিত করত। মা যে কি পরিমান বিরূপ পরিবেশে মাথা তুলে দাড়িয়েছিলেন তা আমি এখন উপলব্ধি করি। একজন স্বামীহারা মহিলার পক্ষে এ অবস্থায় সমাজে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যে কত দুঃসাধ্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মার জগত ছিল আমাকে ঘিরে। তার কাছেই আমার পড়াশোনার হাতে খড়ি। অফিস শেষে তিনি ঘর পরিষ্কার করতেন, রান্না করতেন, আমাকে পড়া দেখিয়ে দিতেন। একদিন ক্লাস পরীক্ষায় দশে শূণ্য পেয়েছিলাম। আমার সেকি কান্না! মা আমাকে কোলে তুলে সান্তনা দিয়েছিলেন। এরপর তিনি পরিশ্রম আরও বাড়িয়ে দেন। আমার লেখাপড়ায় আরও মনোযোগ দেন। মাকে আমি কখনও কাদতে দেখতাম না। কখনও ভেঙ্গে পড়তেন না। কেবল ১২ই এপ্রিল, নিজের বিয়ের শাড়িটা একবার স্পর্শ করতেন, আমার বাবার প্রিয় খাবারটা রান্না করে আমায় খাওয়াতেন। সে দিনটি ছিল আমার বাবা-মার বিবাহ বার্ষিকী। আমি ক্লাস ফাইভে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় আমাদের এলাকায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম। আমাকে জড়িয়ে মা কেঁদে ফেলেছিলেন। সেদিন আমার মনে হয়েছিল মার সেই চোখের অশ্রু দেখার জন্য আমি হাজার বার মরতেও দ্বিধা করব না। মাকে না জড়িয়ে ধরলে আমি ঘুমাতে পারতাম না। তার গায়ের মিষ্টি মা-মা গন্ধটা আমার অনুভূতির জগতে এক নিবিড় প্রশান্তির জন্ম দিত।
মার স্বপ্ন ছিল আমি এস এস সি পরীক্ষায় ভাল ফল করব। আমি ভালই করেছিলাম। সর্বোচ্চ যে গ্রেড A+, তাও পেয়েছিলাম। স্কুলের সব শিক্ষক আমাকে অভিনন্দন জানান। সবাই বাহবা দেন। কিন্তু যার চোখের দৃষ্টিতে আমার দৃষ্টি প্রসারিত, সেই দৃষ্টি আজ নেই। যে স্পর্শে আমার সারা দেহ প্রশান্তির পরশে অবশ হয়ে যেত সেই স্পর্শ আজ নেই। বিধাতা যে কেন আমাকে নিয়েই এই নিষ্ঠুর খেলা খেললেন তা আমার অজানা। মার বুকের ভেতর যে তার লুপ্ত নিঃসঙ্গতা ক্যান্সারের জন্ম দিয়েছে তা কেউ বুঝে উঠতে পারিনি। আমি ক্লাস নাইনে পড়ার সময় হঠাৎ মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তার সুন্দর মুখশ্রী হাসপাতালের অসুস্থ পরিবেশে ম্লান হয়ে যায়। হঠাৎ বুড়িয়ে যান তিনি। নানা অনিয়ম-অবহেলার শরীর আর এত কষ্ট সহ্য করতে পারেনি। তার সাময়িক প্রস্থানই তার অন্তিম প্রস্থান হয়ে যায়।
আমার মুখে দুঃখের কোন ভাষা ফোটে না। বিধাতার নিষ্ঠুরতায় আমার চোখও বোধহয় শুষ্ক মরুচর হয়ে গেছে। তাও মায়ের শাড়ি জড়িয়ে ধরে তাকে স্পর্শ করার ব্যর্থ প্রয়াস চালাই। শাড়ি থেকে সেই অতি চেনা মা-মা গন্ধটা খুজে বের করার চেষ্টা করি। এখনও রাত জেগে পড়ার মাঝে, মধ্যরাতের রহস্যময় আলোতে আমি বাবা-মায়ের সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার চোখ থেকেও কোন অশ্রু বর্ষিত হয় না। আমার চোখেও কোন বেদনা থাকে না, থাকে না কোন ভালবাসা; থাকে কেবল অবাক জিজ্ঞাসা…….

(কল্পনাপ্রসূত…)
২২.০৩.২০০৫

৪,১৪১ বার দেখা হয়েছে

৪৬ টি মন্তব্য : “অবাক জিজ্ঞাসা…”

  1. গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

    ওয়েলকাম দোস্ত। ঝিনাইদহের আমাদের ইনটেকের আরও একজন পেলাম। অনেক ভাল লাগছে তোকে দেখে। আমাদের আরও কয়েকটা পোলাপাইন আছে কিন্তু লেখে খুব কম। পারলে নিয়মিত লিখিস।

    আর এই পোস্টের শেষে একটা ডিসক্লেইমার দিয়ে দিস। নাহলে সবাই মন খারাপ করে বসে থাকবে। আর প্রথম ব্লগে আসলে প্রিন্সিপাল স্যারের সম্মানে কিছু ফর্মালিটিজ পালন করতে হয়। ওসব শেষ করে আমাদের চা-ওয়ালা রকিবের কাছ থেকে এক কাপ চা খেয়ে নিস। হ্যাপি ব্লগিং।

    জবাব দিন
  2. পড়তে পড়তে যখন চোখ ভিজে উঠছিল এবং আমার দেখা সন্ধি ভাইয়া কে গল্পের ছেলেটির সাথে মেলাতে চেষ্টা করছিলাম..... তখন অবশেষে "( কল্পনাপ্রসূত )" দেখে নিশ্চিন্ত হলাম ..... সহজ, বাস্তববাদী এবং হৃদয়স্পর্শী লেখনী....চালিয়ে যান ... 🙂

    জবাব দিন
    • সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

      তোমার মন্তব্য এখানে দেখে খুব অবাক এবং আনন্দিত হলাম। ধন্যবাদ তোমার এই সুন্দর মন্তব্যের জন্য। যদিও গল্প, তারপরেও আমার মায়ের প্রতি আমার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ কিছুটা হলেও এখানে আনার প্রয়াস চালিয়েছি। ভাল থেকো।

      জবাব দিন
  3. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    😀 :guitar:

    জন্মের পর হতে বাবা নামক অচিন বৃক্ষটির দেখা আমি পাইনি।

    - এই লাইনই বলে দেয় যে, এটা বানানো কাহিনী 😛


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  4. রাশেদ (৯৯-০৫)

    হ্যাপি ব্লগিং দোস্ত 🙂
    আমিও লেখাটা পড়ে ডজ খাইছিলাম আরেকটু হলে তবে শেষ লাইন আর উপরের ট্যাগ দেখে নিশ্চিত হলাম এইটা গল্প 🙂
    যাই হোন ৯৯ এর লোকসংখ্যা আরেক জন বাড়ল। আফসোস একসময় লগিন করলেই ৯৯ এর কত পোলাপাইন দেখা যেত আর আজকাল সারাদিন খুজলেও দুয়েকজন পাওয়া যায় না 🙁
    আর নতুন লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম 🙂


    মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

    জবাব দিন
  5. রাফি (৯৯-০৫)

    গালি-গালাজ তো মেসেঞ্জারেই করলাম, সিরিয়াস ইমোশনাল হয়ে গেছিলাম, যেহেতু নিয়মিত পাঠক না তাই উপরে গল্প ট্যাগ দেখে বুঝতে পারিনি। তাহলেই বুঝ লেখা কেমন হইছে...সত্যি হইলে আমি হান্ড্রেড ফ্রন্ট্রোল দিতাম না জানার জন্য। এখন দুইটা দিচ্ছি... :frontroll: :frontroll:

    জবাব দিন
    • সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

      ধন্যবাদ ভাইয়া। এই লেখাটার একটা মজার কাহিনী আছে। আমাদের কলেজ জীবনের শেষ পরীক্ষা, কলেজ ফাইনাল। ওটার বাংলা পরীক্ষায় একটা রচনা ছিল, তোমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব। ওটাতে নিজের মাকে প্রিয় হিসেবে লিখছিলাম। পরে লেখাটা নিজেরই পছন্দ হওয়াতে খাতা দেয়ার পর ডায়রীতে তুলে রাখছিলাম।
      আশা করি, আরো লেখা চালায় যেতে পারব। 🙂

      জবাব দিন
  6. মুহিব (৯৬-০২)

    ভাগ্যিস এইটা কল্পনা। সন্ধি তোমার জন্য খুব কষ্ট হইতাছিল। ভাই আমার শ্ত্রুরও যেন এরকম পরিণতি না হয়। লিখাটা খুব ভালো হইছে তবে কল্পনাটা খুব খারাপ। যাই হোক ব্লগে স্বাগতম। কনফিউজড করার জন্য ১০০ আর স্বাগতম মিলে ২০০ :frontroll: :frontroll: দিয়া ফেলাও দেখি ভাইডি।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সন্ধি (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।