পাগলির প্রেমিক

দুটো বিড়ালের ঝগড়াঝাটির শব্দে মিথির ঘুম ভাঙে। হুট করে ঘুম ভেঙ্গে তার মনে হয়েছিল বাইরে বাড়ির সবাই হুলস্থুল কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে আর সে কিছুই জানে না। কিন্তু না!!! বাড়ির বিড়াল দুটো ঝগড়া করছে । অবিকল মানুষের সুর।
শুয়ে শুয়েই আড়মোড়া ভেঙ্গে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় মিথি।জানালার বাইরে শিউলি গাছটায় এখনো আধঝরা কিছু ফুল পাতার উপর বসে আছে। গাছের উপর তৈরি হওয়া মাকড়সার জালটা শিশির কনার ভারে নুইয়ে পড়েছে।
সূর্যটা যেন গত গোধূলি বেলার চুরি যাওয়া আলো গুলো ফেরত দিতে শুরু করেছে। শিউলি পাতা গুলোর কি অপরূপ(!) শক্তি । চুরি যাওয়া সেই আলোকে ফালি ফালি করে কেটে জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে পাঠিয়েছে।
সেই আলোর স্রোতে ধুলিকনার কি অবিরাম ছুটোছুটি ।
সেই ছুটোছুটি দেখতে দেখতে মিথির মন কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আজকের দিনটা তার কাছে অনেক দিনের আকাঙ্ক্ষিত। ওর প্রিয় কারো সাথে আজ দেখা হবার কথা ।
এই প্রিয় মানুষটিকে ওর কাছে আশেপাশের মানুষগুলোর চেয়ে আলাদা মনে হয়। একটু আলাদাই বটে, তা না হলে কোন মেয়ে সুন্দর করে সেজেগুজে সামনে গেলে কেও কি প্রথম কথা এটা বলতে পারে যে তোমাকে দেখতে ভালো লাগছে না।একেবারে যেন মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল।
আবার মিথির মনে হয় ঠিকই তো বলেছে। ওর যা মনে হয় সোজাসুজি বলে দিয়েছে। কোন ভনিতা করে নি। এই সোজাসুজি কথা বলার কারনেই ওকে এত বেশি ভালো লাগে মিথির।
কাওকে অতিরঞ্জিত কিছু করতে দেখলে ওর নাকি গায়ে জ্বালা করে।মেকাপ করা, লিপস্টিক দেয়া ওর একদমই পছন্দ না। ওর ভাষ্যমতে আমি নাকি জানিই না কিভাবে সাজলে আমাকে সুন্দর লাগবে।
আমি বলেছিলাম তাহলে বলে দাও কিভাবে সাজতে হবে??
ও বলেছিল আমাকে নাকি সবচেয়ে সুন্দর লাগবে ঝুপ ঝুপ বৃষ্টির পানিতে মুখ ধুয়ে খোপায় বেলি ফুলের মালা আর মাঝখানে একটা রক্তজবা গুজে দিলে।সাথে থাকবে আকাশী নীলরঙা শাড়ি।
আর!
এই যে শুরু হল তার ফাজলামি।উপরের পাটির সামনের দাতটায় নাকি পার্মানেন্ট মার্কার দিয়ে কালো রঙ করতে হবে। কপালের ঠিক মাঝখানে একটা বড়সড় মাছি বসাতে হবে টিপ হিসাবে।আরও কত কি!?!! বলা শুরু করলে আর থামতেই চাই না । কখন যে সিরিয়াস থাকে আর কখন যে ফাজলামি করে আজো ঠিকমতো বুঝতে পারল না।
তবুও এই মানুষটিকে মিথি খুব ভালবাসে।…ও কি আমাকে এতটা ভালবাসে???
আচানক প্রশ্নপত্রের আগমন……!!
উত্তরটা যেন একটা মুচকি হাসির ভাব সম্প্রসারণ।
নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দেয় মিথি। ‘ ও নিজেই হয়ত জানে না ও আমাকে ভালবাসে কিনা । ও যে কি ভালবাসে তাই ও জানে না।’
এসব আগডুম বাগডুম চিন্তা করতে করতে মিথির সকাল পার হচ্ছে আর অপেক্ষা করছে কখন সেই কাঙ্ক্ষিত ফোন আসবে।

অনেক দিন পর ছুটি পেয়েছে এবং ও নিজের থেকেই বলেছে যে আজ সারাদিন আমাকে নিয়ে ঘুরাঘুরি করবে।
মিথির মাথাই হঠাত চিন্তা শুরু হয়েছে যে আজকে ওকে চমকে দেবে। কিন্তু কিভাবে?
সত্যি সত্যি কি পার্মানেন্ট মার্কার দিয়ে দাতে রঙ করবে?
না!! না!!
এটা করতে গেলে ওর নিজেরই বেশি কষ্ট।
আর কি করা যায় ? ? কি করা যায়??

Arash এর pure love গানের শুরুটা কানে আসতেই ওর সব চিন্তা বাষ্পীভূত হয়। এই গানটা শুধু ওর নম্বরের জন্যই রিংটোন করে রাখা।
দৌড় দিয়ে গিয়ে ফোন রিসিভ করে মিথি।

– হ্যালো মিথি??
– আমি তোমার সাথে দেখা করার জন্যই এসেছিলাম
– কোন সতর্ক সংকেত ছাড়াই একটা সমস্যায় পড়ে গেলাম
– তুমি খুব তাড়াতাড়ি রিক্সা নিয়ে তোমাদের কলেজের মাঠে চলে এস!
– খুব তাড়াতাড়ি কিন্তু, আর্জেন্ট।
– বাই
ফোন কেটে গেল ।
মিথির নিজেকে মূর্তির মত মনে হল ।—অবয়ব আছে শক্তি নেই—
কি রেখে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। দ্রুত আটপৌরে কাপড় পালটে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রেডি হয়ে বের হয়ে গেল।
রিক্সাই উঠে মাথায় হাজারো ভাবনা। কি সমস্যা হতে পারে? খারাপ কোন খবর নয় তো ? আবার নতুন কোন ফাজলামি নয়তো!
নাহ! ওর কন্ঠে অভিনয়ের কোন রেষ ছিল না, পুরোপুরি সিরিয়াস। আল্লাহ ভরসা । এই মনোবল নিয়েই চলতে থাকল।
কলেজের মাঠে পৌঁছে দেখতে পেল অনেক গুলো টোকাই টাইপ ৮-৯ বছরের ছেলে ওকে ঘিরে রেখেছে।
মিথিকে দেখতেই দৌড়ে এল।রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘একটা পার্টির আয়োজন করেছি। তুমি পাশে না থাকলে অপূর্ণ মনে হচ্ছিল তাই তোমাকে ধরে নিয়ে এলাম।’
– কোথায় পার্টি ? কিসের পার্টি ?
বার্থডে পার্টি।
– কার?
রনকের
– কোন রনক ?
এই যে আজকের বার্থডে বয়
– ওর যে আজ বার্থডে তোমাকে কে বলল?

ওই বলেছে। ও বলেছে ও যেদিন জন্মগ্রহণ করেছিল সেদিন নাকি আমেরিকায় দুটো বড় বড় বিল্ডিং প্লেন ভেঙ্গে দিয়েছিল, ওর মা ওকে বলেছে। আজ ১১ সেপ্টেম্বর । টিভিতে নাকি দেখেছে আজকে সেই বিল্ডিং ভাঙ্গার খবর দেখাচ্ছে।

– তা নাই বুঝলাম, পার্টি করবা কিভাবে?

সব রেডি। স্পন্সর আছে না!!

– কিসের স্পন্সর ?

আজকের পার্টির

– মানে?

এই যে দেখো…১ জন ঝালমুড়িওয়ালা, ১ জন বাদাম ওয়ালা, ১ জন আইস্ক্রিম ওয়ালা
আর আমার পক্ষ থেকে সবার জন্য চকলেট।
রনকের ৯ জন ফ্রেন্ড জোগাড় করা হয়েছে। ওই যে সবাই বসে আছে।
সবকিছু রেডি আছে তুমি অনুমতি দিলেই ভোজনপর্ব শুরু হবে

– অনুমতি দেয়া হল

তুমি বসো, আমি আসছি।

আবারো মিথির মুচকি হাসির ভাবসম্প্রসারন করতে হবে ( কে করবে? – যে গল্প পড়ছে সেই করবে ;))

মিথি অবাক নয়নে চেয়ে আছে।সবার হাতে এক ঠোঙা ঝালমুড়ি, একটা আইসক্রিম আর বাদাম ওয়ালা বসে বসে বাদাম প্যাকেট করছে।

সবার চোখে মুখে অনাবিল তৃপ্তি।সবার মাঝখানে ও বসে আছে। যেন ওদেরই একজন। কে বলবে এই মানুষটি একটি মিলিটারি অফিসার।

আপু আপনার জন্য … ঝালমুড়ি
রনকের ডাকে মিথি যেন জেগে উঠল।
রনকের আরেক হাতে একটা মাউথ অর্গান
মাউথ অর্গান টা দেখে মিথি প্রশ্ন করল এটা কোথায় পেলে?
– উনি দিয়েছেন।
উনি তোমাদের উনার নাম বলে নি?
– আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম তখন বলেছে
কি বলেছে?
– বলেছে উনার নাম “পাগলির প্রেমিক”

১,২২০ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “পাগলির প্রেমিক”

  1. রিদওয়ান (২০০২-২০০৮)

    সকালের যে বর্ণনা দিয়েছ, বিশেষ করে গোধূলির আলো ফেরত দেয়া আর পাতাদের আলো ফালি ফালি করে কেটে জানালা দিয়ে পাঠানো, এক কথায় অসাধারন একটা চিত্রায়ন। :clap:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফজলে রাব্বি নোমান (৮৬-৯২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।