মা তোমাকে খুব মিস করি

মা এর সাথে খুব বেশী সময় কাটাতে পারি নি। এক কি দেড় বছর। এ সময়ের মাঝেই মা আমার মা হয়ে উঠেন। আমার মা আমাদের তাহমিদের আম্মু আমাদের রকিমুন্নেসা ম্যাডাম।

ক্লাস ইলেভেনে হঠাৎই একদিন শুনলাম মা আসছেন আমাদের কলেজে। মা ভূগোলের শিক্ষিকা। আমিও ছিলাম হিউম্যানিটিজ গ্রুপে সেই সুবাদে কলেজে মার প্রথম দিনেই তার সাথে আমার সাক্ষাৎ। ডিপার্টমেন্টে গিয়ে মা কে সালাম দিলাম। বললাম “এতোদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম। আপনি তবে আসলেন।” মা তার স্বভাবসুলভ স্মিত হাসিটা দিলেন। বললেন, “কত ঝামেলা করে যে আসলাম তোদের কাছে বাবা”

মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করা ব্যাপারটা আমার কাছে বরাবরই ফার্স্টবয়দের সম্পত্তিই মনে হতো। আর অন্যের সম্পত্তিতে হাত দিবো এমন টেটন আমি ছিলাম না। কিন্তু মার প্রথম ক্লাসের পর মনে হলো এই মনোযোগ কারো একার সম্পত্তি হতে পারে না। ভূগোলের চেয়ে ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট আর কিছু হতে পারে সেটাও মনে হতো না। মনে আছে একবার ক্লাসে মাকে থামিয়ে বলছিলাম “ম্যাডাম আপনি কি পৌরনীতির কয়েকটা ক্লাস নিতে পারবেন আমার?” মা তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন “হ্যা আর কি কি পড়তে চাস সব গাট্টি বেধে আন”

প্রথমবছর মা ছিলেন গোমতী হাউজে। লাল হাউজ, আমাদের রাইভাল হাউজ। মাকে বলতাম আপনি কি শুরু করলেন বলেন তো স্টেজ কখনো মেঘনার (আমার হাউজ) কাছ থেকে নিতে পারবেন না। মা আমার দিকে তাকায়ে শুধু হাসতেন। আমি ভুল কিছু বলি নাই। মা পারে নাই আমাদের কাছ থেকে স্টেজ নিতে, কিন্তু মা আমাকে ডেকে বলছিলেন “এবার?”। হ্যা, মার হাউজ আমাদের সাথে পয়েন্ট ভাগ করছিলো কম্বাইন্ডলি ফার্স্ট হয়ে। মার হাউজ সেবার তিতাস হাউজের টানা নয় বছর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমাচুর করেছিল। আমি খুশীই হয়েছিলাম একদিক দিয়ে। কারন রেকর্ডটা যে না হয় হাত ছাড়া হয়ে যেত আমাদের হাত থেকে। তার পরের বছর মা আমাদের হাউজে আসলেন। দেখলাম কী জাদু ছিল তার হাতে, কি মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গোমতীর ক্যাডেটরা আমাদের সাথে স্টেজের পয়েন্ট ভাগ করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল। মা আপনার দেখান পথেই আমরা অনেকটুকু হাঁটছিলাম। সেকেন্ড টার্মেই নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম আমাদের চ্যাম্পিয়নশিপ। পারি নি। আপনি তো ছিলেন না মা। হঠাৎ করেই চলে গেলেন সিএমএইচে। পারি নি বলবো না মা। স্টেজে আমাদের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকাতে পারে নি। সেকেন্ড টার্মেই হয়ত হাউজকে চ্যাম্পিয়ন করতে পারি নি কিন্তু এথল্যাটিক্স শেষে আমরাই ট্রফি নিয়ে ঘরে ফিরেছি। কিন্তু মা আপনি তো দেখে গেলেন না। আপনার জন্যে যে কেকের ছোট্ট একটা টুকরো রেখেছিলাম সেটা খেতে তো একবার আসতেন।

আসতে পারতেন আমাকে ভূগোল প্র্যাক্টিক্যাল খাতা করার তাগাদা দিতে। তাও তো আসলেন না। জানেন আমি যে প্র্যাক্টিকেল পরীক্ষার দিন শেষ করেছি আমার খাতা। কি করবো বলেন, আপনার টিপস ছাড়া খাতা যে করতে পারতাম না। মনে আছে মা, একবার গার্লস কলেজ থেকে একটা চিঠি আসলো, আপনি আপনার কাছে একদিন রেখে দিলেন চিঠিটা। বললেন শুধু কেমন আছি জিজ্ঞাসা করার চিঠি নেয়ার জন্যে এত্তো লাফালাম কেন। আপনাকে বলা হয় নি মা, আসল চিঠিটা আমার কাছেই ছিলো। আপনি যেটা পড়েছিলেন সেটা আমারই লেখা ছিল। আরো অনেক কিছু বলার ছিল জিজ্ঞেস করার ছিল। আচ্ছা বলেন তো আপনার কেন মনে হলো আমার কাছে মোবাইল আছে। আপনার সাথে মিথ্যা বলতে ভাল লাগতো না। তাই তখন কিছু বলি নি। হ্যা মা, আমার কাছে মোবাইল ছিলো।

ভ্যাকেশনে আপনাকে দেখতে আসলাম সিএমএইচে একবার। তারপর আর আসি নি। মার এমন অবস্থা সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিলো না। কাঁদা আমার স্বভাবে নেই। নাহলে হয়তো কাঁদতাম। কাঁদবই না বা কেন? আমার মা আমাকে চিনতে পারছিল না……
কলেজে গেলাম। আপনার ক্লাস গুলা সালাম স্যার নিত। আর আমি বসে বসে ঝিমাতাম। একদিন তাহমিদকে ডেকে নিয়ে গেলো। কিছুক্ষন পর দেখলাম হাউজ থেকে প্রেপ ড্রেস পরে কোথায় যেন যাচ্ছে। আপনাকে দেখতে যাচ্ছিল জানতাম। সাহস করে বলতে পারি নি। সাহস থাকলে হয়ত ভিপি স্যারের কাছে যেতাম। বলতাম আমার মা কে দেখতে যাব। আরেক বার দেখবো।

রকিমুন্নেসা ম্যাডাম, আপনাকে খুব মিস করি।

মা তোমাকে খুব মিস করি।

২,৫৯৭ বার দেখা হয়েছে

২৫ টি মন্তব্য : “মা তোমাকে খুব মিস করি”

  1. তাওসীফ হামীম (০২-০৬)

    একবারে একটানে পড়লাম। লেখা ভালো হইসে, ব্লগে স্বাগতম। ফ্রন্ট্রল দিয়া শুরু করো


    চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।

    জবাব দিন
  2. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    লেখাটা দেখে কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। ইদানিং চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। লিক করে! পড়লাম আবারো লিক করলো। ব্লগে স্বাগতম কিন্তু ফ্রন্টরোল শুরু কর।

    লেখা ভালো ছিল। :thumbup:


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  3. মুন্তাসীর আর রাহী (২০০৪-২০১০)

    শেষঅংশটুকু হৃদয়বিদারক। সুন্দর হয়েছে। ব্লগে স্বাগতম। তবে সবার আগে :frontroll: :frontroll: :frontroll: লাগাও ১০ টা।


    রক্তিম প্রসাদ প্রাচীরে বন্দি সবুজ মায়া
    এরি মাঝে খুজে ফিরি নিজের অচেনা ছায়া..

    জবাব দিন
  4. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ছুঁইয়ে গেল তোমার লেখাটা। ব্লগে স্বাগতম, দারুন একটা লেখা দিয়ে শুরু করলে, আশা করি নিয়মিত তোমার লেখা পাব। :thumbup:

    এবার তাড়াতাড়ি ১০টা ফ্রন্ট্রোল দিয়ে দাও তো বাছা :grr:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  5. দিবস (২০০২-২০০৮)

    লেখাটা খুব সুন্দর, সাবলীল ছিল। লেখা চালিয়ে যাও। আমার চোখ মাঝে মাঝেই ভিজে উঠে। বিদেশে আসার পর এটা আরো বেশী হয়। লেখার শেষ অংশে এসেও আবার এমনই হল।

    যাই হোক এখন হেই কাম শুরু কর। হ্যাপী ব্লগিং 🙂


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন
  6. ফেরদৌস জামান রিফাত (ঝকক/২০০৪-২০১০)

    প্রথম লেখাই এতো অসাধারণ!! তুমি রেগুলার লিখবা। তোমার লেখা ঝরঝরে। কোথাও আটকাই নি। ম্যাডামকে আমরাও কিছুদিন পেয়েছি। সিএমএইচের কাছাকাছি থাকার কারণে মাঝে মাঝেই তাকে দেখতে যেতাম। তখন খুব বেশি খারাপ লাগতো। কী মানুষটা কী হয়ে গেছিলেন! আল্লাহ্‌ তাঁকে জান্নাতে নসীব করুন, আমিন।


    যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা

    জবাব দিন
  7. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    লেখা ভালো হইছে।

    হাউস চ্যাম্পিয়ন করার জন্য পোলাপান কতো কিছুই না করতো!


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  8. এই ভোর বেলায় কান্দায় দিলি।
    আমরা অনেক দিন পাইসি ম্যাডাম কে
    ম্যাডামকে দেখতে সি এম এইচ যাওয়া হইসিল একবার ... হিসাব মিলাইতে পারতেসিলাম না । কি মানুষ টা কি হয়ে গেসিলেন । আল্লাহ ম্যাডামকে জান্নাত নসিব করুক।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।