লাইবেরিয়ার গান্তা ক্যাম্পে সোমবারে ঈদ…………সবার মনে মনে আনন্দ

আমার এই লেখাটি আমার ঈদ উদযাপন এবং ঈদের ভাবনা গুলো নিয়ে লেখা । সামরিক জীবেন চাকুরী তে প্রায় সবাইকে ই (ভাগ্যবান কয়েক জন ছাড়া ) রোজার ঈদ বা কোরবাণীর ঈদ দুটির যে কোন একটিকে পরিবার পরিজন ছাড়া উদযাপন করতে হয়। নিয়ম মোতাবেক রোজার ঈদে ছুটি গেলে কোরবাণীর ঈদে ছুটি যাওয়া যাবে না অথবা Vice Versa . বর্তমানে লাইবেরিয়া তে মিশনে অবস্থান করার ধরুন পরপর দুটি ঈদ ই আমাকে আমার পরিবার ছাড়া উদযাপন করতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে ভাবি ক্যাডেট কলেজে থাকলে ই ভাল ছিল আর যাই হোক দুটি ঈদ ই বাসায় করা যেত।
ঈদ যত ঘনিয়ে আসে আমার মনটা তত ই খারাপ হতে থাকে , নানা স্মৃতি মনে হতে থাকে স্মৃতি র যন্ত্রনা থেকে বাচার জন্য লম্বা ঘুম দেই না তাতে ও কাজ হয় না স্মৃতি গুলো স্বপ্ন আকারে ধরা দেয়।
ঈদের দিন সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গে মায়ের ডাকে
“এই মহিম উঠ, আজকে ঈদের দিন না আর কত ঘুমাবি …নামাজ পড়তে হবে না …
আমি বলি মা আর একটু ঘুমাই এখনো ত নামাজের অনেক দেরী
মা আবার রান্নার কাজে যায়, আবার আমাকে ডাকে শেষ পর্যন্ত আমার ঘুম ভেংগে গেলে মা হাসি মুখে বিজয়িনীর বেশে তার কাজে ফিরে যায়…
এখানে ঘুম ভাংগে আমার সহকর্মী কিংবা Runner এর ডাকে “ স্যার উঠেন জামাতে নামাজের আর বেশী বাকি নাই … আমি তাড়াতাড়ি গোসল শেভ শেষ করি নতুন পাঞ্জাবী পড়ব তখন শুনি মার গলা
“ মহিম পাঞ্জাবী টা আমার সামনে পড়… দেখি কেমন লাগে” ……… “ চলে যাবার সময় ……… “এই তোর টুপী কোথায় (আমি প্রায়ই টুপী নিতে ভুলে যাই) ?? মসজিদে নামাজের শেষে মোনাজাতের সময় হুজুর বলেন “ আল্লাহ আমাদের পরিবারের সবাই কে……… বলে উনি সময় নেন তত ক্ষণে উনি নিজে সহ আনেকের চোখে পানি চলে আসে ……… নিরাপদে রাখি ও”
নামাজ শেষ করে নাস্তা করার জন্য যাই হঠাত করে ই চোখ দিয়ে পানি চলে আসে চোখে কিছু একটা পড়েছে ভাণ করি ……সবার সামনে কাদা যাবে না …………
ঈদের দিন আমি সবার আগে বাসায় এসে মায়ের হাতের তৈরী লাচ্ছা সেমাই, ফিন্নী খাই তার পর সবকিছু আড্ডা , ঘোরঘুরি, কোরবাণী অন্যান্য সকল কার্যক্রম শুরু ।
আমি এবং আমার সহকর্মী অফিসার সবাই মিলে মেসে নাস্তা করতে যাই , লাইবেরিয়াতে সেমাই পাওয়া যায় না ……… কিন্তু সেমাই ছাড়া বাঙ্গালীর ঈদ পূরণ হয় না ……… তাই তো কার ও উর্বর মস্থিষ্কের বুদ্বি তে নুডুলস কে ভেংগে গুড়া করে সেমাই পাকানো হয় আমি এর নাম দেই সেলোলুজ ( সেমাই+নুডুলস )
কিছুক্ষন পর মায়ের ফোন পাই মা জিজ্ঞাশা করে “ মহিম সেমাই খাইছিস” আমি বলি “ হ্যা মা সেমাই খুব মজা হয়ছে”
হঠাত মা বলে “ বাবা চিনি দিছিল বেশী করে” মা জানে আমি সেমাই তে একটু বেশী মিষ্টি খাই
আমি বলি “ হ্যা মা” আমি আমার মায়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই । নিজের উপর রাগ হয় দূর মার কাছে মিথ্য কথা টা সাজিয়ে না বলতে পারার জন্য………… আসলে মা তো কিভাবে যেন সব টের পেয়ে যাই ……..
মিশনে ঈদের দিন ছুটির দিন……… রুমে আসি আমার একজন সহকর্মী বলে “ রুমে বসে থাকিস না খারাপ লাগবে” অলক্ষে স্যারের চোখের দিকে তাকাই স্যারের চোখ লাল……………আমি আর কিছু না বলে রুমে চলে আসি ।

সকাল গিয়ে দুপুর হয় ১২৪৫ ঘটিকায় আবার সবাই সমবেত হই “ বড়খানা “ (উন্নত মানের খাবার কে সেনাবাহিনী তে বড়খানা বলা হয়) খাবার জন্য………
আমি চলে যাই আমার বাসায়……… দুপুরে মায়ের হাতের খিচুরী আর গরুর মাংসের কথা মনে পড়ে যায়। বাসায় মা আমার পাশে না থাকলে খেতে ইচ্ছা করে না ………মা আমার প্লেটে সবকিছু তুলে দেয় …… আমি বলি “মা তুমি খাবা না”
আমার মা বলে “তুই খা আমি তোকে দেখি ……… আমার খাওয়া হয়ে যাবে” নিজের অজান্তে ই বুঝতে পারি চোখ যেন বাধ মানতে চাইছে না ………… আবার আমি ভাণ ধরি চোখে কিছু পড়ল না তো ………

“স্যার প্লেট তো একবারে খালি … কিছু ই তো নিলেন না …স্যার একটু পোলাও দেই……” মেসওয়েটারের কথায় আমি মুখ তুলে তাকাই বলি “ দাও”

দুপুর গড়িয়ে বিকাল নামে … আমি তৈরী হয় GBARNGA (ভাংগা G,R এর উচ্চারণ উহ্য ) যাওয়ার জন্য যা আমাদের GANTA গান্তা ক্যাম্প থেকে ৮৬ কিমি দূর । পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে সুন্দর এবং উপভোগ্য Journey এর জন্য এই রাস্তাটির নাম গিনেস রেকর্ড এ প্রস্তাব করা যেতে পারে…… এই রাস্তায় চললে বোধ হয় সবাই A JOURNEY BY ROAD করার নাম আর কখনো কেউ ভুলে ও মুখে উচ্চারণ করবে না ……… এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস

“যাই হোক সন্ধা ৬ টায় যাত্রা শুরু করিয়া মাঝে এক থেকে দেড় ঘন্টা রাতের খাবার এর বিরতি এর সময় টুকু হিসাব করিয়া রাত ১১-৪৫ ঘটকায় মোটামুটি বিধ্বস্ত অবস্থায় ক্যাম্পে প্রত্যাবর্তন করি…” মনে মনে খুশি হয় যাক আর মাত্র ১৫ মিনিট ঈদের দিন শেষ…………

এতক্ষণ আমি রোজার ঈদ কাটানোর কথা বললাম আর আসছে সোমবার কোরবাণীর ঈদ (লাইবেরিয়াতে ৮ ডিসে.-0৮ তারিখে ঈদ হবে ) কোরবাণীর ঈদ টা ও হয়ত আমার জন্য ব্যাতিক্রম কিছু হবে না ……… এখন পর্যন্ত সকল অনুষ্ঠান সূচী রোজার ঈদের মত ই মাঝখানে সকাল বেলা ADD হবে শুধু গরু কোরবাণী’র অংশটুকু ……আর বাকি সবকিছু যেমন ছিলে……… তাই আমি চাই কোরবাণী ঈদের দিন টা খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাক যেন স্মৃতি গুলো আমাকে কম নাড়া দেয় ………
সবাই কে অগ্রিম ঈদ মোবারক …
জানি না লেখাটা কারো কাছে ভাল লাগবে কি না ………তবু ও লিখলাম …যদি কারো খারাপ লাগে “ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হইয়া আমাকে ক্ষমা করিয়া দিবেন”

৩,১৪২ বার দেখা হয়েছে

৪৭ টি মন্তব্য : “লাইবেরিয়ার গান্তা ক্যাম্পে সোমবারে ঈদ…………সবার মনে মনে আনন্দ”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    সহল ভাই,প্রিয়জনের কাছ থেকে দূরে বিদেশ বিভূঁইয়ে ঈদ করতে গিয়ে যে মর্মজ্বালা তা অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে আপনার লেখায়।মন খারাপ করবেন না ভাইয়া!প্লিজ!ঈদের দিন এসে আবার এখানে আপনাকে উইশ করে যাব। 🙂

    জবাব দিন
  2. ইফতেখার (৯৫-০১)

    ভাই, তাও তো ঈদ এর নামাজ টা পড়তে পারসেন, সেলুলোজ ও খাইসেন, কোরবানি ও দিবেন ... আমাদের কথা চিন্তা করেন, নামায এর উপায় নাই, একা একা ঈদ করবো, কোনো ভালো মন্দ খাওয়া নাই ... ঈদ কবে তা আমার না জানাই ভালো।

    জবাব দিন
  3. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    যারা একা একা ঈদ করবেন সকলের জন্য সমবেদনা :salute:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  4. জিহাদ (৯৯-০৫)

    এখন পর্যন্ত এরকম একা একা ঈদ করতে হয়নি। তাই অনুভূতিগুলো পুরোপুরি বোঝা কষ্টকর। তবে সেটা যে মোটেও সুখকর নয় এতটুকু বুঝতে পারি।

    ভাল থাকবেন। ঈদ মোবারক।


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  5. সিরাজ (৯৪-০০)

    সহল অসাধারন লেখা। :thumbup: :thumbup:
    কিন্তু দোস্ত আমার কথা চিন্তা কর তুই তো তবুও অনেক লোকের মাঝে আছিস আর আমি আছি এক মরুভুমি তে.........।।আমি আর সায়েদ ভাই............কোথাও কেও নাই...... :(( :(( :(( .কি আর করা...।।

    জবাব দিন
  6. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    ঈদের সেই অনুভূতিটা এখন আর নাই। কিন্তু আপনার লেখা পড়ে মনে হলো আমরা ঈদের দিন অনেক কিছুই করি, অন্তত সবার সাথে দেখাটা তো করি।
    সীমাবদ্ধতার মধ্যেই সুন্দর হোক আপনার ঈদের দিনটা।

    জবাব দিন
  7. সামি হক (৯০-৯৬)

    এখানে ঈদে যে জিনিসটা সব চাইতে মিস করি তা হলো ঈদের নামাজ শেষে কোলাকোলি করা। বিশেষ করে নামাজ শেষে যখন বাপের সাথে কোলাকোলি করতাম সে এক অন্য অনুভূতি। আমাদের অ কালকে ঈদ নামাজ শেষে কাজে যাওয়া লাগবে কাজ থেকে ফিরে এসে বিশেষ কিছু যে রাধব তার জন্য আর এনারজী অবশিষ্ট থাকবে না। তবে কাজ এ যাওয়া একদিক দিয়ে ভালো ঈদের দিন কই দিয়ে চলে যাবে টের পাবো না।

    সহল, সায়েদ, মুরতাজা, কামরুল, তারেক আরো যারা আমার মতো দেশ থেকে দূরে ঈদ করছে তাদের ঈদের বেশি বেশি ক্রে শুভেচ্ছা।

    আর বাকীদের শুধু ঈদ মোবারক।

    মাসরুফ কি ঈদের দিন গরু নিয়ে ব্যস্ত থাকার চাইতে just friend কে নিয়ে ব্যস্ত থাকবা?

    কামরুল আশা করি ঈদের আনন্দে ও ব্লগ সচল থাকবে, তোমরা সবাই ব্লগ ত্যাগ করবা না।

    ঈদ মোবারাক সবাইকে

    জবাব দিন
  8. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)
    মাসরুফ কি ঈদের দিন গরু নিয়ে ব্যস্ত থাকার চাইতে just friend কে নিয়ে ব্যস্ত থাকবা

    আমার চোক্খে খালি এইডাই পড়ল?? নিজেরে ধিক্কার!! 😡 😡 😡


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  9. তাইফুর (৯২-৯৮)

    সহল, লেখাটা সুন্দর হইছে। বাসায় ঈদ vs বাইরে ঈদ ... তুলনা মূলক বর্ণনা জমছে ভাল। মন জিনিসটা ইদানিং আর খারাপ হয় না।

    (আমার এইখানেও কালকে (সোমবার) ঈদ। বাপ মা ছাড়া ঈদ করতে করতে অভ্যাস হই গেছে। আর বউ নিয়া ঈদ করার অভ্যাস'ই এখনো হয় নাই বইলা কারে কারে মিস করুম বুঝতে পারতেছিনা ... দেখা যাক কালকে কি হয় ... )


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  10. রকিব (০১-০৭)

    আমার ঈদটাও বড় বাজে হইব :(( :(( :(( ... ঈদ এর দিন সন্ধ্যায় আমার পরীক্ষা আছে :-B :-B x-( x-( x-( ... দোয়া কইরেন... আগাম ঈদ এর শুভেচ্ছা রইলো।
    ঈদ মো্বারাক :awesome: :awesome: :guitar: :guitar:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রবিন (৯৪/ককক)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।