আই আই টি , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরু হয়েছিল আশির দশকে “কম্পিউটার সেন্টার” হিসেবে। তখন সারা বিশ্ববিদ্যাওলয়ের মধ্যে নেটয়ার্কিং এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হত। (কিছুদিন আগ পর্যন্তও তাই হত। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সার্ভারটিকে রেজিস্ট্রার অফিসে স্থানান্তর করা হয়েছে)। মজার ব্যাপার হল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কম্পিউটারটি কিন্তু এখানেই স্থাপন করা হয়েছিল। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের সুনাম জানি। এই বিভাগটির যাত্রাও শুরু হয়েছিল আই আই টির ভবন থেকেই। আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বতন্ত্র ইনিস্টিটিউট হিসেবে যাত্রা শুরু করে ২০০১ সালে। তখন থেকেই অত্র ইনিস্টিটিউটে Masters in Information Technology বা MIT এবং Post-Graduate Diploma in Information Technology বা PGDIT ডিগ্রী প্রদান করা হচ্ছে। পরবর্তীতে ২০০৯ এ ব্যাচেলর’স ডিগ্রী কে চালু করা হয় BIT হিসেবে। এখানে কিছু কথা বলে রাখা ভাল যে শুরু থেকেই BIT’র সিলেবাস ছিল একজন বিশ্বমানের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হবার জন্য উপযোগী। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অভ্যন্তরীণ জটিলতার (আমলাতান্ত্রিকতা) কারণে প্রথম থেকেই বিষয়টির নাম Software Engineering দেয়া সম্ভব হয় নি। যদিও BIT নামের আড়ালেই ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের মেজর করছিলেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিরারিং এ!!ইনস্টিটিউটের কিছু অন্তঃপ্রাণ শিক্ষকের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় পাঠক্রমটিকে পাঠানো হয় বিশ্বের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে। তারা এই পাঠক্রমকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিরারিং পড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বমানের বলে স্বীকৃতি দেয় এবং অধিকন্তু BIT থেকে ডিগ্রীর নাম হয়ে যায় Bachlor of Science in Software Engineering বা BSSE এবং MIT থেকে Masters of Science in Software Engineering বা MSSE আর বিষয়ের নাম হয়ে যায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিরারিং। এখন প্রশ্ন উঠবে যে তাহলে কেন সব যায়গায় বিষয়ের নাম তথ্য প্রযুক্তি বা আই টি লেখা থাকে বা বলা হয়? আভ্যন্তরীণ জটিলতার কথা আগেই বলেছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র নাম সফটওয়্যার ইঞ্জিনিরারিং লিখলেও মানুষ ( এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিষয়ের ছাত্র-ছাত্রী রাও) চিনবে কেন্দ্রীয় ভর্তি অফিস এটাকে যে নামে পরিচিত করবে। তো যাই হোক সেখানে নাম পরিবর্তন করতে আভ্যন্তরিন জটিলতা ও প্রশাসনিক শম্বুক গতির কথা বিবেচনা করে ধরে নেই আরো মোটামুটি পাঁচ বছর সময় লাগবে!!!

যখন থেকে ব্যাচেলরস স্টুডেন্ট নেয়া শুরু হয়েছে তখন থেকেই আই আই টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক ইউনিটে অনেক নামী-দামী বিষয় (কাউকে খাটো করছি না। সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখে বলেছি) এর উপরে অবস্থান করছে। বর্তমানে ভর্তির ক্ষেত্রে এর চাহিদা হল জেনেটিক্সের পরেই!!! এবং বিগত কয়েক বছর ধরেই এই অবস্থানে আছে।

বিষয় নিয়ে অনেক সুনাম করা হল এখন কাজের কথায় আসি। আসলে এখানে কি পড়ানো হয়।? এখানে একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিরারিং হতে যা যা পড়ানো দরকার তাই পড়ানো হয়। তুমি প্রোগ্রামিং শিখবে, অ্যাপ তৈরি করা শিখবে, নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট করবে একটা সফটওয়্যার ব্যাবসা কিভাবে চালাতে হয় সেট জানবে এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় তোমাদের কাছে যেটা সেটা হল সিকিউরিটি দেয়া শিখতে গিয়ে পরোক্ষভাবে হ্যাকিং শিখবে!!!!! এখন তাহলে সিএসই এর সাথে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিরারিং এর তফাৎ কোথায় হল? তফাৎ তো আছেই। সিএসই তে পড়ানো কম্পিটার সিস্টেম এর উপরে এবং হার্ডওয়্যার এর উপরে জোর দেয়া হয়। এমনটাই কথা কিন্তু আমাদের দেশে যেহেতু কোন কম্পিউটার হার্ডওয়ার তৈরির অথবা সিস্টেম ডেভলপিং ফার্ম নেই তাই এই বিষয় টি তেও চাকরির বাজারের কথা মাথায় রেখে সফটওয়্যার অংশে জোর দেয়া হয়। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিরারিং এও যদিও কম্পিউটার আর্কিটেকচার পড়ানো হয় কিন্তু সেটা মোটামুটি একটা ধারণা দেবার জন্যে। অনেকটা এরকম যে ডাক্তার দের কে ফার্মেসীর ধারণা রাখতে হয় তাদের কাজ করার জন্যে ফার্মাসিস্ট হবার জন্যে নয় সেরকম।

তাহলে আমরা আই আই টি থেকে পড়ে প্রোগ্রামার হতে পারবো? হ্যাঁ হতে পারব। কিন্তু আই আই টির লক্ষ্য তোমাকে প্রোগ্রামার বানানো নয়। তার লক্ষ্য হল তোমাকে সফটওয়্যার ডেভেলপার বানানো। এখন আস তাহলে কি প্রোগ্রামার আর ডেভেলপার এক জিনিস না? না কখনোই না। ধর একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার একটা বিল্ডিং তৈরি করবে। ঊনি ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেনে বলে এটা না যে ঊনি কভাবে ঢালাই করতে হয়, সিমেন্ট বালি কিভাবে মেশাতে হয়, ইট গাথুনি দিতে হয় কিভাবে এসব জানেন না। ঊনার ছাত্র জীবনে এইসব তাকে অনেক করতে হয়েছে এবং অধিকন্তু ল্যাবে ভাল মার্কস নিয়ে আসতে হয়েছে। অর্থাৎ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব একজন রাজমিস্ত্রী তাই না? কিন্তু যে জিনিসটা তাকে রাজমিস্ত্রী থেকে আলাদা করে সেটা হল যে উনি বিল্ডিংটা ডিজাইন করতে পারেন। কোন জায়াগায় কতটুকু বাঁক হবে কতটুকু উঁচু হবে তা জানেন। রাজমিস্ত্রী যদি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত সেও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যেত। দূর্ভাগ্য সে যেতে পারে নি। যাই হোক ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তার অধস্তনদের কাজ সম্পর্কেও এক্সপার্ট কারণ তাদের কাজ টা যদি তিনি নিজে না জানেন তাহলে তাদের কে নির্দেশনা কিভাবে দিবেন আর তাদের কাজ ঠিকমত হচ্ছে কিনা সেটা কিভাবে জানবেন তাই না? সে রকম সম্পর্ক হল সফটওয়্যার ইঞ্জিনিরার আর প্রোগ্রামার দের মাঝে। প্রতিজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিরার একজন ভাল মানের প্রোগ্রমার হন। তার অধীনে অনেক প্রোগ্রামার কাজ করেন। সকল প্রোগ্রামার এর কাজ একত্রিত করে তিনি তৈরি করেন একটি সফটওয়্যার । তিনি নির্দেশনা দেন। রাস্তা দেখিয়ে দেন কিভাবে কি করতে হবে। এজন্য কিন্তু তাকে প্রোগ্রামিং জানতে হবেই। কিন্তু প্রোগ্রামার হতে হবে না। আশা করি বুঝাতে পেরেছি।

এখন সবার কমন প্রশ্ন বেতন কত হয়? সেটা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। কারণ যে সর্বনিম্ন বেতনটাও যদি পাও তা দিয়ে অন্তত সপ্তাহে প্রতিদিন কে এফ সিতে লাঞ্চ ডিনার করা যাবে। সাথে ফ্যামিলিও মোটামুটি ভালভাবেই চালানো যাবে। এখন সবচেয়ে বড় সুবিধায় আসি চতুর্থ বর্ষ প্রথম সেমিস্টার চলা কালীন সময়ে আই আই টি থেকে তোমাকে পাঠানো হবে কোন একটা সফটওয়্যার ফার্মে ( সবগুলোই পৃথিবীতে এবং দেশে নামী এবং একই সাথে দামী) ইন্টার্ন করতে। মজার ব্যাপার হল বেতন ও দিবে। আর ভাবের ব্যাপার হল বাংলাদেশে আর কোথাও কোন ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি থেকে পুরো এক সেমিস্টার ইন্টার্ন করতে পাঠানো হয় না। যেটা করা হয় সেটা হল সর্বোচ্চ তিন মাসের ট্যুর (লক্ষ্য কর ইন্টার্ন না ট্যুর) এবং সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়কেই আবার সেইসব কোম্পানিকে টাকা পয়সা দেয়া লাগে। যাই হোক ইন্টার্ন করতে গিয়েই বেশিরভাগ তাদের জব সিউর করে আসে। সুতরাং চাকরী নিয়ে নো চিন্তা।

এখন আসো আই আই টি তে যাদের কাছে পড়বে তাদের কথায় আসি। বর্তমান যিনি পরিচালক তিনি বাংলাদেশে মাইক্রোসফটের উপদেষ্টা। এখানে একজন শিক্ষক আছেন যাকে অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতে মাঝে মাঝেই আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া কতগুলো বিশেষ টপিক পড়ানোর জন্যে। একজন আছেন যিনি যুক্ত ছিলেন প্রথম বাংলা ফন্ট মাইনুল লিপির সাথে। এরকম হাই প্রোফাইলদের কাছে পড়াশুনা বুঝতেই পারছ ব্যাপার খানা কি?? আর স্যারদের হাজার হাজার থিসিস পেপার তো আছেই। এগুলো খুব ভাল হয়ত না তারপরো মোটামুটি মানের যে আন্তর্জাতিক ভাবে রেফারেন্স হিসবে ব্যাবহার করা হয়। আর ছাত্র-ছাত্রীদের কথায় আসি। উনারা তো ইতিমধ্যেই থিসিস পেপার নিয়ে সফলতা দেখিয়ে দিয়েছেন। আর কমার্শিয়ালি যদি ভাব তাহলে উনাদের অনেকেই আছেন যারা বিভিন্ন সফটওয়্যার কোম্পানির স্টুডেন্ট পার্টনার।

অনেকেই হয়ত বিষয়টাকে আইটি বলে তুচ্ছ করবে। কিন্তু কথায় আর কি আসে যায়? তুমি জানবে তোমার সার্টিফিকেট জানবে আর তোমার রিক্রুটিং অফিসার জানবে তুমি পড়েছো সফটওয়্যার ইঞ্জিনিরারিং। মজার ব্যাপার হল বাংলাদেশে আর কোথাও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিরারিং পড়ানো হয় না। রাজশাহী ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের IT/ICT নামে যে বিষয়টি চালু আছে সেটি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিরারিং নয় যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আই আই টি থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে এবং সহায়তা দেয়া হচ্ছে অচিরেই সেখানেও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিরারিং কোর্স চালু করার জন্য। ইনস্টিটিউটের নামের কারণে অনেকে আইটি বলবে ক্ষতি কি ভুল টা শুধরে দিলেই হবে। আশা করি অনেক অনেক ক্যাডেট ভাই বোনের আনাগোনায় আই আই টি মুখরিত হয়ে উঠবে।

যাদের বিষয়ক্রম আর পাঠ্যক্রম জানার আরো আগ্রহ আছে ঘুরে আসতে পার আই আই টি’র ওয়েবসাইট থেকেঃ http://iit.univdhaka.edu/

শাফি (রকক/২০০৬-১২)
আই আই টি ৬ষ্ঠ ব্যাচ

২,২১২ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “আই আই টি , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়”

মওন্তব্য করুন : keya

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।