অনুবাদঃ পাকিস্তান কিভাবে ১৯৭১ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেঃ কয়েকটি সাক্ষ্য

[কয়েকদিন আগে ই-লাইব্রেরি থেকে এই বইটি পড়ছিলাম। পড়ার পর মনে ভীষণ চাপ পড়ছিল, সেটাই আপনাদের সাথে ভাগ করে নিলাম। বইটি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর ওয়ার্ল্ড এফেয়ার্স কর্তৃক ১৯৭২ সালে প্রকাশিত। মোট ২৬ টি সাক্ষ্য এতে আছে। আমি শুধু প্রথমটাই অনুবাদ করার চেষ্টা করলাম। অনুবাদের দূর্বলতা হয়তো পুরো অনুভূতি তুলে ধরতে পারেনি, সেটার দায় আগে থেকেই মেনে নিচ্ছি। মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শহীদুল ইসলামের ছবিটা ওই স্ক্যান করা বই থেকে নেয়ার কারণে এত খারাপ অবস্থা। এই সাক্ষাৎকার প্রদানের সময় তাঁর বয়স ছিল ২৭ এবং ঠিকানা ছিল ১৩ ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, ধান মন্ডি, ঢাকা।]

আজ আমি মুক্ত, স্বাধীন। কিন্তু যদি ৭১’এর নভেম্বরের ২৪ তারিখ আমি মারা যেতাম তাহলে আমার মৃতদেহ মাটির সাথে মিশে যেত। পৃথিবীর কেউই, এমনকি আমার স্ত্রী-সন্তানরাও জানতে পারতোনা কবে এবং কখন আমার মৃত্যু ঘটেছে। কেউ জানতে পারতোনা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সেই নিরপরাধ বন্দীদের কথা যাদেরকে ভ্রাতৃসম শিকদার ইবু নুর (পিতা মৃত নুর বখশ, ৩৯৯ ফ্রি স্কুল স্ট্রীট, ধানমন্ডি, ঢাকা) ও আমার চোখের সামনেই গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। বন্দুকের নলের মুখে আমি গুলিতে হত ব্যক্তিদের মৃতদেহ সরিয়েছি। গুলি খাওয়া একজনের চিৎকারের শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই পাকি আর্মির গুলিতে আরো একজন লুটিয়ে পড়তো।আমি এবং আমার সঙ্গীদের শেষ ও হয়তো একই ভাবে হত আর আমাদের শেষ চিৎকারও হয়তো বাতাসে মিলিয়ে যেত।

১৯৭১ সালের ১০ই অক্টোবরের ঘটনা। আখাউড়ার তিন মাইল দক্ষিন পূর্বের স্বাধীন মনিয়ন্দি থেকে আমরা পাকিস্তানীদের দখলে থাকা আমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ভাঙ্গুরা হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে আমাদের নৌকা চলল। সাত জন মাঝি সহ সেই নৌকায় আরো আট জন লোক ছিল। তাদের মধ্যে পাঁচজন ছিল ভারত থেকে ফেরা শরনার্থী যারা ইয়াহিয়ার ক্ষমা ঘোষনার কথা শুনে ভারত থেকে দেশে ফেরত এসেছে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন শ্রীধরপুরের আসগর আলি নামে ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধ, ওমর, গৌরাঙ্গ, বাচ্চু, প্রমোদ, রফিক আর ঢাকার আরো তিন ভাই। আমার চোখের সামনেই [পরে] তাদেরকে নির্মম ভাবে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। রাত ১১টার দিকে আমরা ঘাটিয়ারা পৌছলাম। অন্ধকার থেকে নির্দেশ শোনা গেল, “নৌকা কাছে না আনলে সবাইকে গুলি করা হবে”। অসংখ্য রাইফেলের নলের সামনে নৌকা তীরে ভেড়ানো হল, নৌকার যাত্রীদেরকে লাইনে দাঁড় করানো হল। তাদের শরীর সার্চ করা হল এবং কোন কথা-বার্তা, প্রশ্ন ছাড়াই ঘড়ি, টাকা পয়সা সহ যা পাওয়া গেল সব লুটে নিয়ে দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে হাত বেঁধে দেয়া হল। জুলফিকার আলী নামে একজন ক্যাপ্টেন বন্দীদের সবার চেহারা দেখে তার সেনাদেরকে ফিসফিসিয়ে কিছু নির্দেশ দিল। আমাদের কে কোন কথা বলতে দেয়া হলনা, আমরা যখন জানতে চাইলাম আমাদেরকে কেন বন্দী করা হচ্ছে আমাদেরকে গালি-গালাজ করে চুপ করিয়ে দেয়া হল।

সারারাত আমাদেরকে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হল। সূর্য ওঠার কিছুক্ষন আগে, আমাদেরকে নৌকায় তোলা হল, সে সময়ে নারী-পুরুষ ও শিশু সহ প্রায় ১০০ জন যাত্রী নিয়ে আরো দুটি বড় নৌকা আমাদের দিকে আসছিল। নৌকা থামানোর জন্য কোন নির্দেশ শোনা গেলনা, ক্যাপ্টেনের হাতের ইশারায় তার সহযোগীরা বুলেট বৃষ্টি শুরু করল, আমাদের মাথার উপর দিয়ে, চুল ঘেঁসে ঠুস ঠাস করে বুলেট ছুটে গেল, মাত্র দশ সেকেন্ডের মধ্যে দুই নৌকার সমস্ত যাত্রী মারা গেল; আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। প্রতি মূহুর্তেই মনে হচ্ছিল এল এম জি’র গুলি এই বুঝি আমার গায়েও লাগলো।

না, তা হলনা। সেটা হলে এই জীবনটা শেষ হত, আর এই বর্ণনাও দিনের আলোর মুখ দেখতোনা, কাউকে বলা হতনা, এই নৃশংসতার কথা, কেউ জানতওনা! ক্যাপ্টেন আকাশের দিকে একটা গুলি ছুড়ল। মূহুর্তের মধ্যে আর্মির অনেকগুলি নৌকা চারদিক থেকে ধ্বংস হওয়া দুই নৌকার দিকে ছুটে আসল, তাদের মুখে ছিল শিকারের পর আহত পাখি ধরার পারার মত গর্ব ও উন্মত্ততা। কিছুক্ষন পরে মাত্র একজন জীবিত ব্যক্তিকে ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে আমাদের নৌকায় তুলে আনা হল। সামনে পিছনে সশস্ত্র আর্মির নৌকা পরিবেষ্টিত হয়ে আমরা কুমিল্লা জেলার আখাউড়া বাজারে আসলাম।

নৌকা থেকে নামিয়ে আমাদেরকে ইন্টারোগেশনের নামে দুই ভাগে ভাগ করা হল। এক দলে ছিল শরণার্থীরা আর অন্য দলে চোরাচালানকারীরা। আমাদের কে রাখা হল শরণার্থীদের দলে। বলা নিষ্প্রয়োজন যে আমরা আমাদের আসল নাম না বলে নতুন নাম নিয়েছিলাম তার আগের রাত থেকেই, কারণ আমরা শুনেছিলাম যে বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী ও শিক্ষিত বাঙ্গালীদের কে দলে দলে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। জান বাঁচানোর জন্যই আমরা নিজেদের নাম গোপন করে অন্য নাম বলি। আমাদের সবাইকে আখাউড়া রেল স্টেশনের ১ নং গুদামে নিয়ে যাওয়া হল। এই গুদামে সামনে ও পিছনে একটা করে বড় কলাপসিবল গেট আছে মাত্র, কোন জানালা বা আলো বাতাস আসা যাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। সে সময়ে খুব গরম ছিল, গুদামের ভেতর প্রচন্ড গরমে মনে হচ্ছিল শরীর ঝলসে যাচ্ছে। তার মধ্যে কবুতরের বিষ্ঠা জমে প্রায় আধা ইঞ্চি পুরু কার্পেট তৈরি হয়েছিল মেঝেতে। গুদামের দেয়ালে অসংখ্য ফুটা, কিছু কিছু জায়গায় মনে হল নতুন প্লাস্টার করা হয়েছে।

সেই ৬৫ বছরের বৃদ্ধকেও রিফিউজিদের দলে রাখা হল। ক্যাপ্টেন বলল রিফিউজিদের সবাইকে গুলি করে মারা হবে আর চোরাকারবারীদের কে ১৪ বছর সশ্রম সাজা ভোগ করতে হবে কারাগারে। তারপর ক্যাপ্টেন চলে গেলে বিকট শব্দ করে সামনের গেট বন্ধ হয়ে গেল। অজানা আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তার ভয়ে আমরা কাঁপছিলাম। সারাটা দিন কেটে গেল ঐ দোযখের মত ভীষণ গরম ও ভয়ানক দুর্গন্ধযুক্ত গুদামে। সারাদিনে কোন খাবার বা পানি দেয়া হয়নি। হঠাৎ রাত আটটারদিকে আবারো কর্কশ শব্দে গেট খুলে গেল আর আমাদের সবাইকে (দুই দলকেই) গুদামের পেছনে নিয়ে যাওয়া হল, সেখানে আগে থেকেই অনেক আর্মির লোক ছিল। সহজ শিকার দেখে ক্ষুধার্ত জংলী প্রাণী যেমন খুশি হয়, আমাদেরকে দেখে তারা তেমনি খুশি হয়ে উঠল। যা খুশি প্রশ্নের সাথে শুরু হল লোহার রড ও লোহার তারের চাবুক দিয়ে কোন বাছ বিচার ছাড়া এলোপাতাড়ি মার। ভয়ঙ্কর আর্মির দল আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমাদের কিচ্ছু জিজ্ঞেস করা বা বলার ছিলনা।

আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম, জ্ঞান ফিরে আসল যখন তখন অনেক রাত। শরীরের প্রচন্ড ব্যথায় গুঙ্গিয়ে উঠলাম। নড়া চড়া করতে পারছিলামনা, শুধু নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছিলাম। এ সময়ে হঠাৎ মনে হল আমার বাবা-মাও কোন দিন আমার গায়ে হাত তোলেননি। দিনে রাতে এরকম অবর্ণনীয় কষ্ট ও শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে দিন কেটে যেতে লাগল। প্রতি ৩৬ থেকে ৪৮ ঘন্টায় এক বার নষ্ট হয়ে যাওয়া পচা রুটি ছাড়া আর কিছু খেতে দেয়া হতনা আমাদের। এমনকি পানিও না। ৩৬-৪৮ ঘন্টা পর পর গ্লাসে করে সামান্য পানি দেয়া হত। এক সপ্তাহের মধ্যে ওই গুদামে প্রায় ৬০ জন বন্দীকে রাখা হল। তাদের কাউকে বাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থা থেকে তুলে আনা হয়েছে, কাউকে বাজার থেকে ধরে আনা হয়েছে আর কাউকে কাউকে ক্ষেত থেকে তুলে আনা হয়েছিল। সবাই আখাউড়ার আশে পাশের গ্রামের লোক।

এত লোকের কারণে বন্দীদের অবস্থা আরো করুণ হয়ে দাঁড়ালো। দুই দিন পর পর একটি ছোট্ট বালতিতে পানি দেয়া হত, কোন গ্লাস নাই। জানোয়াররা যেভাবে পানি খায়, পিপাসার্ত বন্দীরা সেভাবে বালতি থেকে পানি খেত। সাধারণত বালতি থেকে অনেকটুকু পানি মাটিতে গড়িয়ে পড়ে যেত। কবুতরের বিষ্ঠা মিশ্রিত সেই পানি হাতে ধরে নিয়ে মুখে দিতাম। প্রথম দিকে এভাবে পানি পান করতে খুব সমস্যা হত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা শিখে গিয়েছিলাম।

ঘাম ও কবুতরের বিষ্ঠার মিশ্রনে তৈরি তরলে মাখা মাখি হয়ে থাকত আমাদের সারা শরীর। এভাবেই আমরা ঘুমাতাম। শব্দ ও ভাষায় আমাদের অবস্থা ও এই শারীরিক ও মানসিক শাস্তির বর্ণনা দেয়া সম্ভব না, এখন মাঝে মাঝে মনে হয় মৃত্যুও বোধ হয় এই অত্যাচারের চেয়ে অনেক ভালো।

বন্দীদশার প্রথম দিকে বাবা-মা,ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের কথা মনে হয়ে কষ্টে বুকটা ফেটে যেত। মনে হত জীবনে আর এক বার যদি ওদেরকে দেখতে পারতাম!

অনেকেই ক্রমাগত কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যেত। পরে এমন হয়েছিল যে কারো চোখ দিয়ে আর পানি বের হতনা। এত অত্যাচার আর নির্যাতন সহ্য করার পর এই ছিল আমাদের অবস্থা।

ওই অন্ধকার গুদামে আমরা ছিলাম ২২ দিন। নভেম্বরের ১ তারিখে একজন পাঞ্জাবী কোয়ার্টার মাস্টার রেজিষ্টার খাতায় আমাদের সবার নাম এন্ট্রি করে নিয়ে গেল। সে জানালো যে আগামী কাল আমাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে। আবারো আমরা সবাই আমাদের ছদ্ম নাম দিলাম।

সেদিন আমরা সবাই খুশীতে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরছিলাম আর সবাইকে নিজ নিজ বাড়িতে দাওয়াত দিচ্ছিলাম। এর মধ্যেই বাচ্চু নামের কিশোর ছেলেটির কান্নার তীব্র আওয়াজ ভেসে আসলো। বাচ্চু আমাকে খুব ভালবাসতো আর প্রায়ই তার ছোট ছোট আনন্দের কথা, দুঃখের কথা আমার কাছে বলতো। জিজ্ঞেস করতে বলল ওর নাম ওই খাতায় তোলা হয়নি, এবং প্রমোদ, গৌরাঙ্গ, অমর-কোন হিন্দুদের নামই তোলা হয়নি। সবাই ধরেই নিল যে ওদেরকে মেরে ফেলা হবে। বাচ্চু কে স্বান্তনা দেয়ার মত কোন ভাষা আমাদের জানা ছিলনা। হঠাৎ রাত এগারটার দিকে গুদামের দরজা খুলে গেল, আমাদের সবাইকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হল, আমাদের সবার আনন্দ ধূলায় মিটে গিয়ে আবার সবার মুখে অন্ধকার আতংক নেমে আসলো। ভয় পাচ্ছিলাম আমাদের সবাইকেই হয়তো একটু পরেই মেরে ফেলা হবে। কিন্তু ট্রেন চলে যাবার পর আবার আমাদের বাঁধন খুলে দেয়া হল। পরের সকালেই আমাদের মধ্য থেকে ৪৫জন কে আবারো বেঁধে বাইরে নিয়ে আসা হল এবং বলা হল তাদেরকে কে ছেড়ে দেয়ার জন্য থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেই চার জন হিন্দু এবং ঢাকার ভাইদেরকে বাঁধা হলনা। আমাদেরকে বাইরে নিয়ে এসে পাঞ্জাবী কোয়ার্টার মাষ্টার বলল আমাদেরকে আর থানায় নিয়ে যাওয়া হবেনা বরং একটু পরেই সরাসরি ছেড়ে দেয়া হবে।

সেই ৪৫ জন হাত বাঁধা বন্দীদের প্রত্যেককে একে একে গুলি করে মারা হল।

নভেম্বরের তিন তারিখে আসে পাশের গ্রাম থেকে আরো কিছু লোক কে বন্দী করে এনে আমাদের সাথেই রাখা হল। তারা বলল যে মার্চের পর থেকে হাজার হাজার লোককে এই গুদামে গুলি করে মারা হয়েছে, এবং পরে আরো হাজার হাজারে লোক কে গুদামের লাগোয়া পানির ট্যাংকের কাছে মারা হয়েছে আর এখন রেল লাইনের পাশে লাইন ধরিয়ে মানুষ মারা হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে আরো জানা গেল কাছেই ইমামবাড়ি নামক স্থানে অনেক মহিলা কে ধরে রাখা হয়েছে এবং স্বামী-সন্তানের সামনেই তাদের কে ধর্ষন করা হচ্ছে। অসহায় স্বামী সন্তানেরা কান্না ছাড়া কিছু করতে পারছেনা। আরো জানা গেল মৌদাইল গ্রামের ২৭ জন হাজী কে একই ভাবে মারা হয়েছে। ক্ষেতে কাজ করা লোক কে গুলি করে মারা হয়েছে, চোখের সামনে যাকে দেখেছে তাকেই গুলি করেছে। এক বিতঘর গ্রাম থেকেই ১৭৫ জনকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।

নভেম্বরের চার তারিখ বিকেল তিনটার দিকে আবারো আমাদের হাত বাঁধা হল এবং বলা হল আজকে থানা থেকে আমাদের কে ছেড়ে দেয়া হবে। আমরা কেউই এটা বিশ্বাস করিনাই কারন থানা ছিল দক্ষিনে গঙ্গাসাগর ক্যাম্পের দিকে, আর আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল উত্তরে।

সামনে পেছনে লোডেড রাইফেলধারীরা, আর মাঝে লাইন ধরে এক সারিতে আমরা হাটছিলাম। বন্দীরা গায়ে গা ঘেঁসে থাকার কারনে হাটতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। প্রায় এক ঘন্টা পর আমরা গঙ্গা সাগর আর্মি ক্যাম্পে পৌছে দেখি বটগাছের তলায় এক আর্মি ক্যাপ্টেন বসে আছে। তাদের কথা শুনে বোঝা গেল আমাদের কে এখানেই গুলি করা হবে। একজন বেলুচ সিপাই চোখ মুখ শক্ত করে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল আমাকে কোত্থেকে এবং কেন ধরে আনা হয়েছে। আমার উত্তর শুনে সে খুব অবাক হয়ে গেল এবং পাশের অন্য একজন সিপাই কে বলল আমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য। সেই সিপাই এবং অন্য সিপাইরা ওই বেলুচ সিপাইর কথায় ক্ষেপে গেল। এর মধ্যে ক্যাপ্টেন আমাদেরকে আরো দক্ষিনে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিল, আমরা বুঝলাম এই আমাদের শেষ। আমাদেরকে মনিয়ন্দী গ্রামের দিকে নিয়ে যাওয়া হল এবং রেল লাইনের কাছে ছোট্ট সেতুর কাছে লাইন ধরে দাঁড় করানো হল, ওখানে ইতঃস্তত ছড়ানো ছিটানো অনেক কংকাল দেলখতে পেলাম। এক পাশে দেখলাম কালো একটা কুকুর মৃতদেহের ভুড়ি বের করে খাচ্ছে।

তারপর শুরু হল নারকীয় হত্যা। লাইনের সবার সামনের লোকটার হাত খুলে ব্রীজের উপরে নিয়ে গুলি করা হল। এভাবে একের পর এক জনকে লাইন থেকে বের করা হচ্ছিল, ব্রীজের পশ্চিম দিকে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হচ্ছিল। এভাবে ছয় সাতজনকে গুলি করার পর বাচ্চুর পালা এল। সে আমার দিকে ফিরে দেখলো, আমার চোখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই গুলিতে মারা গেল। আমার পালার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি এই নৃশংস গণহত্যা দেখছিলাম- প্রতিটা মুখই আমার চেনা। মাত্র যখন আর চার জন বাকি আছে এ সময়ে সেই বেলুচ সিপাই ঘাতকের রাইফেল ধরে বলল, আর কাউকে মেরনা, এই কয়েকজনকে ছেড়ে দাও, একটু দয়া কর, তোমার কি কোন আত্মীয় স্বজন নাই? এ কথা শুনে ও লাইনের সামনে দাঁড়ানো বেলুচ সিপাইকে দেখে জল্লাদ থামলো। আমরা কেউ বলতে পারবোনা ঠিক কখন এবং কিভাবে ওই জল্লাদ সিপাই থামল আর আমাদের কে ব্রীজ থেকে মৃত দেহ সরাতে বলল। আদেশ পালন করার পর আমাদের কে ছেড়ে দেয়া হল।

হিন্দুদের নাম রেজিষ্টার খাতায় না তুলেই হত্যা করা হয়েছে, মুসলমানদেরকে সাধারণত খাতায় নাম উঠানোর পর মারা হত। গুদামে যেখানে আমাদেরকে বন্দী রাখা হয়েছিল সেখানে আমরা রেজিস্টার খাতার স্তুপ দেখেছি।

নির্মম ভাবে হত্যা করা সেই সব মানুষের কান্নার আওয়াজ এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কোথায় ন্যায় বিচার? মানবাধিকার কি কোথাও আছে?

২৪ টি মন্তব্য : “অনুবাদঃ পাকিস্তান কিভাবে ১৯৭১ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেঃ কয়েকটি সাক্ষ্য”

  1. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    আপু, অনেক ধন্যবাদ। কষ্ট করে অনুবাদ আর শেয়ার করার জন্য।
    একদিন এই জানোয়ার গুলা ওদের পাওনা পাবেই।

    ফেসবুকে শেয়ার করতে পারি?


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  2. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    আপু মুক্তিযুদ্ধ ট্যাগ টা যদি লাগিয়ে দেন তাহলে আর্কাইভে একসাথে থাকত। তাছারা মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভেও মনে হয় ট্যাগ থেকে সংযোগ করার একটা অপশন এর কথা শুনেছিলাম।

    জবাব দিন
  3. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    সেলিনা,
    অনুবাদ খুব ভালো হয়েছে। যুদ্ধকালীন এমন মর্মস্পর্শী বর্ণণা পড়ে বেশীক্ষণ স্থির থাকা যায়না।
    বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, এসব মুহূর্তের মধ্য দিয়ে মানুষকে যেতে হয়েছে। মৃত্যুর বুক থেকে ফিরে আসার রুদ্ধশ্বাস বার্তা শোনাচ্ছেন তাঁরা।
    তবু রাজাকারেরা রাজনীতি করে বাংলাদেশে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে ওড়ে রাজাকার মন্ত্রীর গাড়িতে। সবাই, মুক্তযুদ্ধের ধ্বজাধারীরাও আপোষ করে ফেলে নির্বিকারচিত্তে, রাজনীতির নামে, ভোটের নামে।
    বাকী অংশগুলোও অনুবাদে হাত দাও সময় করে নিয়ে।

    জবাব দিন
    • সেলিনা (১৯৮৮-১৯৯৪)

      ধন্যবাদ নুপুরদা।
      আসলেই তাই, এরকম বর্ণণা পড়ার পর স্থির থাকা যায়না। রাজনীতিবিদরা তো ভুলবেই তবে তাদেরকে ভোট দেয়ার সময় শিক্ষিত, মূর্খ সবাই আমরা ও ভুলে যাই কাকে /কাদেরকে ভোট দেই। মনে হয় একটা দুষ্ট চক্র। তবে হতাশ হলে চলবেনা, এর মধ্য দিয়েই ঠিক কাজটি করতে হবে আর করে যেতে হবে। আজকাল আমি এভাবেই ভাবছি। 🙂 🙂

      জবাব দিন
  4. রাব্বী (৯২-৯৮)

    সেলিনা আপা, খুব ভাল উদ্যোগ নিয়েছেন। অনুবাদটাও খুব ভাল হয়েছে। আমাদের জেলিফিস স্মৃতিতে সব বিস্মৃত হয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি কেমন করে যেন। এমন দগদগে নৃশংসতার স্মৃতি আমাদের রাজনীতি কিভাবে ভুলে যেতে পারে সেটাই খুব বিক্ষুদ্ধ করে আমাকে। হয়তো এই বয়ানগুলো সামনে আসলে নতুন প্রজন্ম একাত্তরকে জানতে পারবে সঠিকভাবে।

    অনুবাদ এবং উদ্যোগটিকে বলে কয়ে পাঁচ তারা। অনুবাদটি চালান আপা।


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন
  5. আসাদুজ্জামান (১৯৯৬-২০০২)

    এইসকল নির্মমতার কোনো শোধ হয় না। সেই সকল যুদ্ধাপরাধী যারা এইসকল অত্যাচারে সহায়তা করেছে দয়া করে তোরা এইগুলা একটু পড়ে ভাব, একটু অনুতপ্ত হো। তোদের আমরা কোনো শাস্তি দিব না। কেননা ওইসকল নিষ্ঠুরতার প্রতিশোধ নেয়ার মত অমানুষ আমরা নই। তবে তোরা করজোরে এইদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাইবি। কাঁদবি, অন্তর থেকে। আর বলবি যতদিন বেঁচে থাকবি, কোন রাজনীতি না, কোন দলাদলি না। এতগুলা মানুষের উপর নির্মম অত্যাচারের জন্য তাদের পরিবারের গোলামি করবি, আমৃত্যু। তাও যদি প্রায়শ্চিত্ত হয়।

    জবাব দিন
  6. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    ধন্যবাদ সেলিনা এরকম একটি কাজ করার জন্য। তুমি যেহেতু আইসিএসএফের ই-লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত আছো, তাই মাঝে-মধ্যে আমাদেরও এর কিছু ভাগ দিও। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে (ভন্ডদের সংখ্যা অবশ্য বাড়ছে)। তাই তাদের কথা, অভিজ্ঞতা যতোটা ধরে রাখা যায়, আর নতুনদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায় ততোই ভালো। প্রথম আলো অবশ্য এখন প্রতিদিন একজন মুক্তিযোদ্ধার কথা ছাপছে।

    ফেসবুকে শেয়ার নিলাম তোমার লেখাটা। কাজটা সময় লাগলেও করে যেও। ভালো থেকো।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  7. এমন মর্মস্পর্শী বর্ণনা ! দুর্দান্ত অনুবাদ হয়েছে !
    শুধু ধন্যবাদ নয়, কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আশা করি এ কাজটা আপনি নিয়মিত করবেন সেলিনা।
    অভিনন্দন জানাই। ফেসবুকে শেয়ার করলাম।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাদিক (২০০০-২০০৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।