জুলি

দুই বছর বয়সী জুলিকে নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটায় ইউসুফ মোল্যা। ওর জন্য সারাদিনের অন্য সকল কাজকে বিসর্জন দিয়েছে সে। সমস্যা হল বাচ্চাটা কিছুই খেতে চায় না। না খেলে যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে এই চিন্তাই সারা রাত ইউসুফের চোখে অনিদ্রার বীজ বোনে। জুলির অসুস্থতার কথা সে কল্পনাই করতে পারে না। ওর জন্য সব কিছু করতে রাজি আছে সে। তার এই প্রবাস জীবনের একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে জুলি। অন্য প্রবাসীদের চেয়ে কুয়েতে ইউসুফ অনেক বিলাসী জীবন যাপন করে। বিশাল বড় বাড়ির সামনের দিকটায় প্লাস্টিকের ঘাস দিয়ে কার্পেটিং করা। ভোরের শিশির সেই কৃত্রিম ঘাসের ডগায় সহস্র উত্তাল দর্পন তৈরি করে। অতঃপর সূর্যরশ্মি ঝিকিমিকি আলোর প্রতিফলন ঘটায় সেখানে। তার সামনেই কোমর পর্যন্ত উঁচু ঝাউ গাছের বেড়া দিয়ে ঘেরা বাড়ির চারপাশ। প্রতিদিন সকালে উত্তাল দর্পন পায়ে মাড়িয়ে নিজ হাতে কাঁচি দিয়ে গাছের উশৃংখল ডালগুলো ছাঁটাই করে ইউসুফ। ঠান্ডা লাগার ভয়ে সকালে জুলিকে বাইরে আনে না। কিন্তু বিকেলের নরম আলোয় তাকে নিয়ে ঘাসের চাদরে খেলতে বসে। মাঝে মাঝে সন্ধ্যাবেলা জুলিকে নিয়ে হাওয়া খেতে বের হয় সে। প্রাডো গাড়িটা সাঁ সাঁ করে ছুটতে থাকে আরব উপসাগরের তীর দিয়ে। অ্যাকুয়া পার্ক, কুয়েত টাওয়ার পিছে ফেলে এগিয়ে যায় গাড়ি। অবশেষে মেরিনা বীচের প্রশস্ত চত্বরে এসে দাঁড়ায় ইউসুফ। সমুদ্রের তীর ঘেঁষে অনুচ্চ গাছের সারি। মাঝখান দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে ওয়াক ওয়ে। রঙ বেরঙের ফুলে ভরে গেছে চারপাশ। কোলাহলে মূখর সমুদ্রতট। উজ্জ্বল আলো আর সীসার ধোঁয়ার মাদকতা প্রাণ প্রাচুর্য্যের ছবি আঁকে। ছোট ছোট ফোয়ারা ঘুরে ঘুরে পানি ছিটায় ঘাসের রাজ্যে। জুলির আকর্ষন সেদিকেই। ছোট হাত দিয়ে খামচে ধরতে চায় ফোয়ারা। প্রতিবার ছুটে গিয়ে ইউসুফ বুকে তুলে নেয় বাচ্চাটাকে। কোনভাবেই যাতে ঠান্ডা না লাগে। জুলির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তার ভবিষ্যত।

এদেশে অনেক নিয়ম কানুন। জন্মের পরেই জুলির নাম, নাম্বার রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। খোলা হয়েছে তার হেলথ কার্ড। প্রতি মাসে রুটিন চেক আপের জন্য নিয়ে যেতে হয় ডাক্তারের কাছে। নিউট্রিশিয়ান দুই মাস পর পর এসে ডায়েট প্রোগ্রাম চেক করে যায়। ভ্যাকসিনও দিতে হয় নিয়মিত। সবকিছুই ঠিকমত চলছিল। কিন্তু বিপত্তি বাধল ইয়টে করে ফাইলাকা দ্বীপে যাবার সময়। বাড়ির সবার সাথে জুলিও যোগ দিয়েছিল সেই প্রমোদভ্রমণে। আরব উপসাগরের উত্তাল ঢেউ ক্রমে চুমে যাচ্ছিল ইয়টের ধবল দেহ। শীতের শেষের বিকেলময় সেই বিকেলে ভদ্র আরবীয় বাতাসও যেন চেয়েছিল ইয়টারোহীদের উপর হিমেল পরশ বুলিয়ে যেতে। ঈষৎ ঠান্ডা বাতাসে যখন উড়ুউড়ু সবাই ঠিক তখনই ঠান্ডাকে নিজের বুকে স্থায়ী করে নিল জুলি। ভ্রমণ শেষে বাড়িতে আসার পরই অসুস্থ হয়ে পড়ল সে। আস্তে আস্তে খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে দিল। দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল সারা বাড়িতে। ইউসুফের চোখের ঘুম উবে গেল বাতাসের সঙ্গী হয়ে।

পরদিন বিকেলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল জুলিকে। সবকিছু পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না ডাক্তার। একটু রাগত স্বরেই তিনি বললেন, এই বিড়ালকে তো সাধারণ বিড়ালের মত পালন করলে হবে না। অনেক টেক কেয়ার করতে হয়। আপাতত বাড়িতে নিয়ে গিয়ে এই ওষুধগুলো খাওয়ান। অবস্থার উন্নতি না হলে কাল এন্টিবায়েটিক হবে। কুয়েতী মালিক এমনভাবে ইউসুফের দিকে তাকায় যেন সে ই এই অনিষ্টের জন্য দায়ী। ইউসুফের আত্মারাম তখন খাঁচা ছাড়া হওয়ার যোগাড়। ভয়ে ভয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে সে। গাড়ি চালাচ্ছে মালিক, আর তার পাশে বসা স্ত্রী বার বার ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে পেছনের সিটে বসে থাকা জুলিকে। আর লেটেস্ট মডেলের প্রাডোর পেছনে মালপত্রের সাথে ঠাসাঠাসি করে বসে পেছনের কাঁচের মধ্য দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে ইউসুফ। উজ্জ্বল আলোতে পাশের মালপত্রগুলোও মাঝে মাঝে আলোকিত হয়ে উঠছে, কিন্তু তার মুখকে আলোকিত করার জন্য এই আলো যথেষ্ট নয়।

পাঁচ বছর আগে মাসিক দেড় লক্ষ টাকা বেতনের আশ্বাসে বসতবাড়ি বন্ধক রেখে আর চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কুয়েতে এসেছিল সে। দালালের হাতে তুলে দিয়েছিল নগদ সাত লক্ষ টাকা। শুধু এক টুকরো স্বপ্নকে বুকে লালন করে স্ত্রী আর এক বছরের ছেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল । কিন্তু বিদেশের মাটিতে পা দিয়েই সে বুঝতে পেরেছিল জুন মাসের গনগনে তপ্ত দুপুরের চেয়ে বাস্তবতা আরও কঠিন। কর্মজীবি ভিসায় আসা সব বাংলাদেশীর মুল বেতন ৬০ দিনার যার দেশী মুল্যমান ১৬ হাজার টাকা। কল্পনার শ্বেতশুভ্র মেঘময় আকাশে যেন সহসাই বজ্রপাত এসে হুমকি দিয়ে যায়। কিছুদিন পরেই ইউসুফকে পাঠানো হয়েছিল মরুভূমিতে উটের খামারে। জাহান্নাম দেখেনি সে, কিন্তু আযাবের ভয়াবহতা টের পেতে শুরু করে সাথেসাথেই। ধূ ধূ মরুভূমির মধ্যে ছোট্ট একটা তাঁবুতে সীমাবদ্ধ ছিল তার জীবন, তার স্বপ্ন আর গ্রামে রেখে আসা স্ত্রী পুত্রের স্মৃতি। সারাদিন উট চরিয়ে সাঁঝের বেলা তাঁবুতে ঢুকলে সেটাকে মনে হত উত্তপ্ত লোহার কড়াই আর নিজেকে মনে হত পরোটা। সূর্যের গনগনে তাপ তার দেহের ক্যানভাসে কালো রঙের প্রলেপ দিত প্রতিনিয়ত। গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে মাঝে মাঝেই পানির সরবরাহ আসত না খামারে। পানি জমানোর ক্ষমতা উটের আছে; কিন্তু সে তো মানুষ। যতই দিন যেতে থাকে অকৃপণ সূর্যও উদারহস্তে উত্তাপ বিলাতে থাকে। মাঝে মাঝেই ইউসুফের মন চাইত পালিয়ে যেতে। কিন্তু চাকরিতে ঢোকার পরেই পাসপোর্ট আর ভিসা জমা রেখে সে পথটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাই সে চেষ্টা করে মাটি কামড়ে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বনটা টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সে সর্বংসহা ধরিত্রীর মত হতে পারেনি। একসময় অনন্যোপায় হয়ে পাসপোর্ট ছাড়াই পালিয়ে যায় খামার থেকে। আশ্রয় নেয় বাঙ্গালীপাড়া নামে খ্যাত জিলিব আল শোয়ায়েখে। কাজ নেয় একটি খাবারের দোকানে। মরুভূমির চেয়ে জীবন এখানে সহজ। রাতে না ঘুমিয়ে অন্য কোথাও ওভার টাইম কাজ করা যায় বলে রোজগারটাও নেহায়েৎ খারাপ হয় না। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে যখন কিছুদিন পর পরই পুলিশ রেইড দেয় ভিসাহীন অভিবাসী ধরার জন্য। ছয় মাসের মধ্যে দুইবার পুলিশের কাছে ধরা পড়ে জমানো টাকার সিংহ ভাগ ঘুষ দিয়ে রক্ষা পায় সে। এভাবেই শত শত ইউসুফের স্বপ্ন চুরি হয়, হাতছাড়া হওয়ার অপেক্ষায় থাকে বসতবাড়ি, মরে যায় বেঁচে থাকার ইচ্ছা; শুধু বেঁচে থাকে ঘুষ, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে।

আবারও ফিরে গিয়ে মালিকের হাতে পায়ে ধরে উটের খামারে যোগদান করে সে। ততদিনে সূর্যও কিছুটা কৃপণ হতে শুরু করেছে। শুধু এলোপাতাড়ি হাওয়ায় ভর করে যখন বালুকণাগুলো কালবৈশাখীর মত উড়িয়ে নিতে চায় তার তাঁবু, কোনায় বসে দোয়া কালাম করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না তার। শীতে মরুভূমিতে তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাংকের নিচে। কৃপণ সূর্যকে কটাক্ষ করতে মরুর বুকে দাপট দেখাতে থাকে শৈত্যপ্রবাহ। এমনি করে উত্তপ্ত সূর্য আর হিম বাতাসের অন্তর্দ্বন্দ্বের সাক্ষী হয়ে কয়েক বছর মরুভূমিতে কাটিয়ে দেয় ইউসুফ।রাতের বেলায় বালুতে শুয়ে অন্ধকার আকাশে অজস্র তারা দিয়ে স্বপ্নের বীজ বোনে। বউ আর বাচ্চাটাকে নিয়ে ছোট্ট একটি সংসারের স্বপ্ন দেখে সে। কিন্তু ভোরের সূর্য কালো আকাশের স্লেট থেকে স্বপ্নের আঁকি বুকি মুছে দেয় প্রতিনিয়ত। হঠাৎ করেই তার জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করে দেয় জুলি। বছরখানেক আগে বাচ্চা বিড়ালটাকে চড়া দামে কিনে এনেছিল খামারের মালিক। পশুপ্রীতির চেয়ে আভিজাত্য প্রকাশ মূখ্য হওয়াতে কর্মহীন মুহূর্তগুলো থেকে সামান্য সময় বের করে বিড়ালের পরিচর্চা করাকে আদিখ্যেতা মনে হয় মালিকের। তখনই উটের খামার থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয় ইউসুফকে। জুলিকে দেখাশোনার পাশাপাশি বাগানেও কাজ করত সে। জুলিকে খাবার খাওয়ানো, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, নিয়মিত ভ্যাকসিন দিতে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাকেই করতে হয়। এইতো কিছুদিন আগে জুলির জন্মদিনের অনুষ্ঠান তো সে এক হাতেই করেছে। এইসব কাজ করতে গিয়ে সঙ্গোপনে কিছু টাকা পয়সা পকেটে ঢোকায় সে। মাঝে মাঝে কিছুটা অপরাধবোধেও ভোগে। আবার ভাবে যারা তার স্বপ্ন চুরি করেছে, যারা পৃথিবী থেকে মানবিকতা চুরি করেছে, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের শ্রেষ্ঠত্ব চুরি করেছে তাদের বিচার না করে আল্লাহ্‌ হয়ত তার চুরির বিচার করবে না। ইউসুফের স্বপ্ন ছিল আরও কিছু টাকা পয়সা গুছিয়ে আগামী বছর দেশে যাবে। গত পাঁচ বছর বউ বাচ্চার মুখ দেখেনি। জুলির বেঁচে থাকাটা তাই অনেক জরুরি। জুলির উপর ভর করে টিকে আছে একটি পরিবার। জুলি মারা গেলে আবার তার নিবাস হবে উটের খামার। আবার স্বপ্নগুলো রোদে পুড়বে, শীতে জমবে অথবা উড়ে যাবে বালুঝড়ে।

ইউসুফের ছেলেটার ডায়রিয়া হয়েছে। দিন দিন কাহিল হয়ে পড়ছে সে। ছেলেটাকে নিয়ে দিশেহারা বউ। কিন্তু এসব কিছু ইউসুফকে উদ্বিগ্ন করছে না। তার সমস্ত চিন্তা জুলিকে নিয়ে। সারারাত জুলির পাশে বসে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে সে। আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থণা করেছে আল্লাহ্‌ যেন জুলিকে বাঁচিয়ে দেয়; তার স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে দেয়। ফোন করে বউকেও বলেছে জুলির জন্য দোয়া করতে। সাড়ে চার হাজার মাইল দূরে অসুস্থ বাচ্চার পাশে বসে ইউসুফের বউও আল্লাহর কাছে কান্না কাটি করতে থাকে বিড়ালের বাচ্চার জন্য। জুলি অবশ্যই সুস্থ হয়ে উঠবে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের ফরিয়াদ আল্লাহ্‌ কবুল না করে পারবেন না।।

৫,৫১৬ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “জুলি”

মওন্তব্য করুন : সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।