ফুড প্রসেসর

গল্পটা দারিদ্র্যের। গল্পটা আপেক্ষিকতার। পাথরকুচি গাছকে কেটে ফেলে দিলেও তার মৃত পাতা আর প্রোথিত শিকড় থেকে যেমন জন্ম নেয় অসংখ্য গাছ, তেমনি দারিদ্র্যেরও কোন বিনাশ নেই। অভাবকে উতরে যাওয়া অনেক সাফল্যের গল্প আছে। কিন্তু সে গল্পের পরে আরও গল্প থাকে। পড়াশোনা শেষ করেই যে কয়েকজন ভাগ্যবান ছেলে অতিদ্রুত ভালো চাকরিতে ঢুকতে পারে রকিব তাদের মধ্যে একজন। বরাবরই সে খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল। জীবনের এতগুলি বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসলই যেন এই চল্লিশ হাজার টাকা বেতনের চাকরি। চল্লিশ হাজার টাকা তার কাছে অনেক টাকা। এতদিন টিউশনির আট হাজার টাকার বাজেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তার বিলাসী জীবন যাপন, পড়াশোনা আর লুকিয়ে লুকিয়ে টান দেওয়া সস্তা সিগারেটের প্যাকেট কেনার খরচ। মাঝে মাঝে দরকারে গ্রামের বাড়িতে দু’ এক হাজার টাকাও পাঠাত এই বাজেট থেকে।মাসে মাসে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে বছর দুয়েক আগে একটা বিলাই চক্ষু শার্ট কিনেছিল সে। ব্র্যান্ডের শার্ট বলে টিউশনিতে প্রতিদিন পরে যেত রঙ চটা সেই শার্টটি ।ছাত্রী তো একদিন বলেই বসল, স্যার এ মাসের বেতন পেয়ে অবশ্যই একটা শার্ট কিনবেন।

চাকরিতে যোগ দেয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগল তার সাদামাটা একঘেয়ে জীবন। হলের কোলাহলময় পরিবেশ ছেড়ে তিন বন্ধু মিলে ভাড়া নিল একটি ফ্ল্যাট। প্রেয়সীকে দেয়ার জন্য একটি গোলাপ কিনতে যে রকিব পাঁচ দোকানে গিয়ে বিশ মিনিট ধরে দরদাম করত, সেই রকিবই সেদিন বিনা দরদামে একগুচ্ছ ফুলের তোড়া কিনে হাজির হল প্রেয়সীর সামনে। এমনকি প্রথম বেতন পাওয়া উপলক্ষে বন্ধুদেরকে স্টার কাবাবে ভরপেট খাওয়াতেও কোন কার্পণ্য করেনি।ভেবেছিল, এই বুঝি সে উতরে গেল দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র। বাড়িতেও পাঠিয়েছিল অনেক গুলো টাকা। তার বাবা হারেস মিয়াও সেই খুশিতে গ্রামের তিনটি মসজিদে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছিল। হাটে গিয়ে সবাইকে জানিয়েছিল যে, তার ছেলে রকিব চাকরি পেয়েছে। বেতন চল্লিশ হাজার টাকা। রকিবের গ্রামের বন্ধু বান্ধব এবং পাড়া প্রতিবেশীদের মত হারেস মিয়ারও ধারনা হল এই বুঝি তাদের অবস্থার পরিবর্তন হল। হারেস মিয়ার চার ছেলে আর দুই মেয়ে। নিজের দুই বিঘা জমিতে ধান আর পাট চাষ করে সে। বাড়িতে কয়েকটা গাভী আর ছাগল পালন করে জুলেখা বেগম। এভাবেই ধান, পাট আর গরুর দুধ বিক্রি করে ছয় ছেলেমেয়েকে বড় করেছে তারা। এদের মধ্যে একমাত্র ছোট ছেলে রকিব বাদে আর কেউই হাইস্কুলের গণ্ডী অতিক্রম করতে পারেনি। এই ছেলেটা কিভাবে কিভাবে জানি নিজের চেষ্টায় স্কুল, কলেজ তারপর ইউনিভার্সিটির সীমা পেরিয়ে এখন এত বড় চাকরি করছে। জুলেখা বেগমের খুশী তাই আর বাঁধ মানে না। বড় দুই ছেলে রহিম আর রমিচের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে তাইতো সে সন্ধ্যের পর ছোট কাকুর গল্প শোনায়।

এক বছর যেতে না যেতেই রকিব জানালো যে, সে বিয়ে করতে চায়। পাত্রী তারই ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। বাসা ঢাকায়। মেয়ের মা বাবা আর দেরী করতে চাইছে না। একথা শুনে হারেস মিয়া বেশ চিন্তার মধ্যে পড়ে গেল। কিছুদিন আগেই এক বিঘা জমি বন্ধক রেখে ছোট মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছে। এখনই ছেলের বিয়ের আয়োজন করা তো বেশ কষ্টের ব্যাপার। কিন্তু বাবাকে আশ্বস্ত করল রকিব। সে বলল যে, গ্রামে তেমন কোন আয়োজনই করা লাগবে না। বিয়ে হবে ঢাকাতে। আর বিয়ের খরচ মেয়ের বাবাই বহন করবেন।আর বাকিটা ও ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে পার করে দিতে পারবে। পাত্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখে মেয়েপক্ষ ছেলের আদি নাড়ী নক্ষত্রের তেমন বাছ বিচার করেনি। হারেস মিয়া আর জুলেখা বেগম ঢাকায় গিয়েছিলেন ছেলের বিয়েতে। বৌমা তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। বেয়াই বেয়ানও তাদের খুব সমাদর করলেন। কিন্তু তারপরও হারেস মিয়ার কেন জানি নিজেদেরকে অতিথি অতিথি মনে হতে লাগল। বিলাসবহুল কমিউনিটি সেন্টারের চেয়ারে বসে মনে হতে লাগল, সে তার ছেলের বিয়েতে নয় , যেন অন্য কারো বিয়ের দাওয়াতে এসেছে। গ্রামে ফিরে গিয়ে জুলেখা বেগম পাড়ার সবার কাছে তার ছেলে রকিবের বিয়ের চমকপ্রদ বর্ণনা দিতে লাগল। কিন্তু কিছুক্ষণ বলার পর নিজেই উপলব্ধি করল যে, মনের ভেতর থেকে সে কোন সাড়া পাচ্ছে না। ওর বাবার কত ইচ্ছা ছিল রকিবের বিয়েতে সাত গ্রামের লোকজনকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবে। যাই হোক, ছেলে এখন মস্ত বড় চাকরি করে, ওর কি এত দিক দেখতে গেলে চলে?

এক বিঘা জমি বন্ধক রেখে হারেস মিয়া একটু টানা পোড়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ছোট ছেলের বর্তমান অবস্থান তাকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে না হলেও মানসিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে অনেক ঐশ্বর্যবান করে তুলেছে। অপরদিকে রকিবের বেতন বৃদ্ধি পেয়ে পঞ্চাশের ঘরে এলেও ধীরে ধীরে সে উপলব্ধি করতে থাকে যে, তার অভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। এমনিতেই বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে গেছে বিয়েতে। এছাড়া ডিওএইচএসে যে ফ্ল্যাটে স্ত্রীকে নিয়ে সে থাকে বেতনের একটা বড় অংশ চলে যায় সেটার ভাড়া দিতে। কাঁচা বাজারে গেলেই হাতের ফাঁক দিয়ে দুই তিন হাজার টাকা বেরিয়ে যায়। অথচ ছোটবেলায় সে দেখেছে আধা মণ ধান বিক্রি করে বাবা ঝাকারি ভরে মাছ, তরি তরকারি কিনে আনত। তাছাড়া নতুন একটা সংসার গোছাতেও তো অনেক খরচ। বাসাটা না গোছালে কাউকে বাসাতে দাওয়াতও দেয়া যায় না। এক্ষেত্রে স্ত্রীর পক্ষ থেকে একটু চাপ তো থাকেই। না, না, তার স্ত্রী হিন্দী সিরিয়ালের কোন দজ্জাল চরিত্র নয়। কিন্তু একটা ফ্রিজ, স্মার্ট টিভি, ওয়াশিং মেশিন , ওভেন এগুলো তো ন্যায্য আবদার। এখন সে ফার্মগেটের ফুটপাথ থেকে দেড়শ টাকার শার্ট আর একশ বিশ টাকার জুতা কিনে পরতে পারে না। কারন, সমাজে মানুষের টানা জীবন যাত্রার সীমারেখার নিচে এতদিন হাতড়ে ফেরা নিম্নবিত্ত রকিব আজ সীমা ভেঙে জাতে উঠেছে। কেতা দুরস্ত না হয়ে তো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে অফিস করা যায় না। মাসের শুরুতেই সে বেতনের আর খরচের হিসাব নিয়ে বসে।কিন্তু চুলচেরা হিসাব করেও অবশেষে লিস্ট থেকে বাদ পড়ে অনেক কিছু।এছাড়া বেতন পাবার সাথে সাথেই ব্যাংক লোনের কিস্তির টাকাটাও দিতে হয় অবধারিতভাবে। তাইতো মাসের মাঝখানে কোন নিকটাত্মীয় বাসায় বেড়াতে এলে রাকিবের মনে হয়, হায় হায় এটাতো খরচের লিস্টে ছিলনা। তখন ছোটবেলায় যার কোলে পিঠে উঠে মানুষ হয়েছে সেই ব্যাক্তিই হয়ে যায় রকিবের মত হত দরিদ্র্যের মনঃকষ্টের কারণ। অথচ তাদের গ্রামের বাড়িতে যখন মামা বা ফুফিরা কেউ বেড়াতে আসত তখন সারা বাড়িতে আনন্দের ঢেউ বয়ে যেত। মা দৌড়ে গিয়ে খোপের সবচেয়ে বড় মোরগটার গলায় বটি চালাত অবলীলায়।

সে তো গরীব, হত দরিদ্র্য। তা না হলে ছোটবেলার বন্ধু রমেশকে তার বিপদের দিনে অবশ্যই সাহায্য করত। রমেশ সেদিন ফোন করে খুবই ইতস্তত করে বলেছিল যে, আসছে বর্ষার আগেই সে তার ঘরটা ঠিক করতে চায়। রকিব তাকে হাজার দশেক টাকা ধার দিতে পারবে কিনা। পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতনভোগী বন্ধুর কাছে এটা নেহায়ৎ অন্যায় আবদার না।রকিব সেদিন রমেশের মুখে হাসি ফোটাতে পারেনি।বন্ধুকে বোঝাতে পারেনি তার দৈন্যতা। রমেশ কিন্তু ক্লাস সেভেনে থাকতে ঠিকই তার মুখে হাসি ফুটিয়েছিল। এক জোড়া বুট আর জার্সির অভাবে যখন দূর্দান্ত মিড ফিল্ডার রকিব পাড়ার ফুটবল ক্লাবে খেলতে পারছিল না, তখন ওই ভ্যানচালক রমেশ তার জমানো টাকা থেকে এগার’শ টাকা দিয়ে ওর মুখে হাসি ফুটিয়েছিল। দেব দেব করেও কেন জানি সেই এগার’শ টাকা এখনও দেয়া হয়নি। রকিব কারো মুখেই হাসি ফোটাতে পারেনি । না তার বাবা মার মুখে, না বন্ধু বান্ধবের মুখে, না তার স্ত্রীর মুখে। আর তার নিজের মুখের কথাটা অপাংক্তেয়ই থাক। তার স্ত্রী নীলা প্রতিদিন ইউ টিউব দেখে নতুন নতুন রান্না শেখে। ওদের বাসায় মাইক্রোওভেন আছে। কিন্তু নীলা একটা ইলেক্ট্রিক ওভেন আর ফুড প্রসেসরের অভাবে কয়েকটা আইটেম তৈরি করতে পারছে না। গত কয়েক মাস ধরে প্ল্যান করলেও এখনও এগুলো কেনা সম্ভব হয়নি। তার শিক্ষা দীক্ষা তাকে সামাজিক মর্যাদার এমন এক হাতির পিঠে চড়িয়েছে, যার খাবারের যোগান দিতে গিয়েই সে আজ নিঃস্ব। তাইতো মাঝে মাঝে তার মনে হয় এর চেয়ে পায়ে হেঁটে জীবন পথ পাড়ি দেয়াই সুখের ছিল। মনে হয় যদি সে আবার উল্টা ঘুরে হাটতে পারত অল্পে তুষ্টির সেই পথে।

দশটা পাঁচটা অফিসের চাকাটা অবশেষে থামে ঈদের দুই দিন আগে। নীলাকে নিয়ে রকিব যায় গ্রামের বাড়িতে। গত ঈদে যেতে পারেনি। এবারের ঈদটা তাই গ্রামেই করবে। তাদের আগমনে পুরো বাড়িতে আনন্দের রোল পড়ে যায়। কৃষি নির্ভর গ্রামটিতে পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতনভোগী রকিব যেন এক ভীনদেশী আগন্তুক। সবাই বাড়িতে এসে শহরের গল্প শোনে। রমেশও এসেছিল। রকিব ভেবেছিল, রমেশ তার ছোটবেলার এগার’শ টাকা ঋণের মাহাত্ব্য এবং প্রয়োজনের সময় তাকে সাহায্য না করা বিষয়ক কিছু সূক্ষ্ম খোঁচা দিবে।এর দাঁতভাঙা কি জবাব দেয়া যায় সেটাও রকিব ঠিক করে রেখেছে। সামান্য কিছু টাকা ধার দিয়ে মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? কিন্তু রমেশ সে সবের ধার দিয়েও না গিয়ে মন খুলে ছোটবেলার গল্প করা শুরু করল। এতে রকিব মনে মনে আরও উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগল। কেন রমেশ তার কাছে এগার’শ টাকা চাইছে না। এই প্রসঙ্গ না উঠলে সে টাকাগুলো দিতে পারছে না। গল্প শেষ করে রমেশ চলে গেল। রকিবের মনে হল, টাকার কথা না তুলে সে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। পাওনা টাকার চাপ না দিয়েও তার চেয়ে যে হাজার গুণ চাপ সে রকিবের উপর দিয়ে গেল সেটা নিতান্তই অন্যায়।

দেখতে দেখতে শেষ হয়ে এল ছুটি। রাতের বেলা বাবা মা তাকে ডাকল পাশের ঘরে। যে ভয়টা সে করছিল সেটাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে বাবা বলল, অনেক দিন তো হয়ে গেল। বন্ধক রাখা জমিটা এবার ছাড়ানো দরকার। রকিবেরও ইচ্ছা করে দেড় লাখ টাকা দিয়ে জমিটা বাবাকে ছাড়িয়ে দিতে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে তো নিরুপায়। নিজের দৈন্যদশা বাবাকে বোঝানোর জন্য সে বলল যে, তার এখন অর্থের এতই সংকট যে নীলাকে একটা ফুড প্রসেসরই কিনে দিতে পারছে না। বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোন প্রফেসর? প্রফেসর না প্রসেসর, রান্না করতে লাগে। দূর্বোধ্য লাগে জুলেখা বেগমের কাছেও। রকিব বলতে থাকে, নীলারও তো বয়স বেড়ে যাচ্ছে। এখন বাচ্চা না নিলে পরে অনেক কমপ্লিকেসি হয়। আর একটা বাচ্চা হওয়ার জন্য অনেক প্রস্তুতি লাগে। অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার। কত রকম যে ঝামেলা আছে তোমাদের বোঝাতে পারব না। অপলক দৃষ্টিতে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে জুলেখা বেগম। ছয় সন্তানের জননী ঝাপসা চোখে ছেলের চোখে পড়ার চেষ্টা করে বাচ্চা হওয়ার কমপ্লিকেসি। রকিবেরও বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠে। আপেক্ষিক অভাবের তাড়না পরিবার আর তার মাঝখানে যে আদৃশ্য দেয়াল তুলেছে, সেই দেয়ালটা যেন দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে।

পরদিন বিকালেই চলে যাবার কথা রকিবদের। ভ্যানে করে যেতে হবে শিমুলতলী বাজারে। তারপর নাইট কোচে করে রওনা দিবে ঢাকায়। ব্যাগ গুছিয়ে তখন থেকেই অপেক্ষা করছে তারা। আজ হাটবার। বাবা দুপুরের আগেই হাটে গেছে ধান বেচতে। এখনও ফেরেনি। তাদেরকে বিদায় দিতে উঠোনে এসেছে অনেক মানুষ। কেউই খালি হাতে আসেনি। দেখতে দেখতে খৈ, মুড়ি, কুমড়োর বড়ি ইত্যাদির প্যাকেটে ভরে যায় ভ্যান। একটু পরেই একটা মুরগি, বেঢপ সাইজের লাউ আর এক প্যাকেট বরই নিয়ে আসে রমেশের ছেলে। এতগুলো জিনিস সামলাতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে অপুষ্টিতে ভোগা ছেলেটা। অবলীলায় ভ্যানের উপর সেগুলো রেখে শুধু বলল, মায়ে দিছে। রকিব এবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না। দীনহীনের দয়ার দানে সিক্ত হয়ে ধনী রকিব নিঃস্বতার জারে পড়ে থাকে তলানী হিসেবে। সংবিৎ ফিরে পেয়ে হাত দেয় পকেটে। মানিব্যাগ থেকে বের করে এগার’শ টাকা। কিন্তু ততোক্ষণে ভ্যানের টায়ারের পিঠে লাঠির বাড়ি দিয়ে চালাতে শুরু করেছে ছেলেটা। সেদিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে রকিব, অর্থ উপার্জনের সীমা হয়ত অতিক্রম করেছে সে, কিন্তু দারিদ্র্যের সীমা অতিক্রম করতে পারেনি। হয়ত পারবেও না কোনদিন। মনে মনে আকস্মাৎ ক্ষেপে ওঠে রকিব। তার দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে সবাই তাকে যাচ্ছেতাই করে অপমান করে যাচ্ছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভেতরের রাগটুকুও ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগলো। আর কারও উপর প্রকাশের সুযোগ না থাকায় অনুপস্থিত বাবার উপর গিয়ে পড়ল সব রাগ। ভদ্রলোকের আজই কেন হাটে যাওয়া লাগবে ধান বিক্রি করতে? দুদিন পরে করলে কি সংসার থেমে যেত? এগুলো সবই বোধ বুদ্ধির অভাব। এর কিছুক্ষণ পরই যখন বিকেলের মৃদু আলো আরও ফিকে হয়ে আসতে লাগল, তখন দেখা গেল হারেস মিয়া মেঠো পথ ধরে তার পুরনো সাইকেল চালিয়ে ফিরে আসছে। উঠোনে নামার সাথেই তেঁতে উঠল রকিব। বাবার কাণ্ডজ্ঞানহীনতা এবং নির্বুদ্ধিতা উল্লেখ করে কিছুক্ষণ বাক্যব্যয় করল সে। সেদিকে মনযোগ না দিয়ে ধীরে ধীরে পেয়ারা গাছটায় সাইকেলটা হেলান দিয়ে রাখল হারেস মিয়া। তারপর লুঙ্গির কোঁচা থেকে ধান বিক্রির টাকাগুলো বের করে রকিবের হাতে দিয়ে বলল, বৌমাকে একটা ফুড প্রসেসর কিনে দিস।

ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ করে ধূলোমাখা পথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভ্যানটা। দূরে টায়ার চালাতে চালাতে যাচ্ছে একদল বাচ্চা ছেলে। হয়তো রমেশের ছেলেটাও আছে ওই দলে। অচিরেই নীলিমার নীল মিশে যাবে গোধূলীর ছায়ায়। রকিব তাকিয়ে আছে মুষ্টিবন্দি ময়লা নোটগুলোর দিকে। অনেক্ষণ থেকেই গলার কাছে কিছু একটা আটকে ছিল। ধীরে ধীরে সেটা বাষ্প হয়ে উপরে উঠতে লাগল। চোখের নীলাকাশে ক্রমে জমা হচ্ছে বাষ্প। আস্তে আস্তে মিলিত হচ্ছে ছোট ছোট জলকণা। হয়ত অচিরেই ঝাপসা হবে চোখের আঙিনা।

৮ টি মন্তব্য : “ফুড প্রসেসর”

  1. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    :clap: :clap:

    ফুড প্রসেসর দারুণ লাগলো, সেলিম রেজা। গল্পকথকের পরিমিতিবোধ তোমার আছে। লেখালেখি চলতে থাকুক। আরো অনেক লেখা চাই তোমার থেকে।

    আমার শুভাশীষ জেনো।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : লুবনা জাফরিন

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।