নরকবাস – ৬

গলাকাটা লাশ (দ্বিতীয় খন্ড)।
আমার প্রাথমিক ধারনা ছিল যে, ডাক্তার সোহেলকে যেকোন কারনে এবং যেকোন ভাবেই হোক, অপহরণ করা হয়েছে। কারন সে নিজের থেকে কোথাও গেলে তার গাইবান্ধাতে যাবার বা এত দীর্ঘসময় ধরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার কোন কারন নাই। আর অবশ্যই সাইফুল এই ব্যাপারটার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। কিন্তু কিছুতেই তার কাছ থেকে কোন কথা বের করা যাচ্ছিল না। এইরকম একজন রোগা পটকা চ্যাংড়া পোলার নাড়ী যে এত শক্ত হবে তা আমার ধারনাতেও ছিল না। যাই হোক, সবচাইতে জরুরী হল ডাক্তার সোহেলকে জীবিতাবস্থায় উদ্ধারের চেষ্টা করা। কারন বেশীরভাগ সময়ই দেখা যায় যে অপহরণের পরে বেশী দেরী হলে বা ঘটনা নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হলে অপহরণকারীরা ভয় পেয়ে তাড়াহুড়া করে সাব্‌জেক্টকে খুন করে বসে। এক্ষেত্রে এই দুইটিই ঘটেছে। অতএব খারাপ পরিণতির সম্ভাবনা অনেক প্রবল। তাছাড়া অপহরণ যদি খুন করার উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে তাহলে তো কথাই নেই। এতক্ষণে হয়তো সব শেষ। আর এই আশঙ্কাটাই ছিল সবচাইতে বেশী কারন ডাক্তার সোহেল নিখোঁজ হবার পর থেকে তখন পর্যন্ত অপহরণের অন্য কোন মোটিভ পাওয়া যায়নি, অর্থাৎ কেউ মুক্তিপন বা অন্য কোন কিছুই দাবী করেনি। তারপরেও নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে জীবিত পাওয়ার আশা ছেড়ে দেওয়া চলে না। সুতরাং সময় এবং গোপনীয়তা দুটোই আমার কাছে তখন সমান মূল্যবান।

প্রথমেই আমি আমার ভোল পালটে নিলাম। আমাদের দেশের একটা নামী মোবাইল কোম্পানীর লোগোসহ স্টীকার লাগালাম পুরো গাড়িতে। তাদের কোম্পানীর একটা ডাইরী বগলদাবা করে গলায় টাই আর চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে ঢুকলাম গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলায়। আমাদের কাছে কিছু মোবাইল নাম্বার ছিল যেগুলোতে সাইফুল অনবরত কল করেছে গাইবান্ধাতে যাওয়ার আগে ও পরে। সাইফুলের কাছ থেকে তাদের নাম ঠিকানাও পেয়েছিলাম। কিন্তু এখানে গোপনীয়তা রক্ষা ছিল সবচেয়ে মুখ্য বিষয়। তাছাড়া সাইফুলের দেওয়া তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। আর যারা এধরণের একটা ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তারা এত সরল-সোজা মানুষ হওয়ার কথা না যে আমি আমার পরিচয় দিয়ে ডাকা মাত্রই সুড়সুড় করে এসে হাজির হবে। সরাসরি ফোর্স নিয়ে ধরপাকড় করার তো প্রশ্নই ওঠে না। কারন তাতে জানাজানি হবে বেশী। মুহুর্তে এলাকা খালি হয়ে যাবে। পরের সব কাজ পন্ড হয়ে যাবে। তাই বিস্তর মাথা চুলকিয়ে এমন এক আইডিয়া বের করলাম যাতে কাক-পক্ষী তো নয়ই এমনকি যে ধরা পড়তে যাচ্ছে সে নিজেও টের পাবেন কোত্থেকে কি হল। খবর নিয়ে জানলাম গাইবান্ধাতে আমাদের দুটি টার্গেটের একটি উড়াল দিছে। সে নাকি পাগলের মত আজ এখানে কাল ওখানে ছুটোছুটি করছে। আরেকজন এলাকাতেই আছে। আমার ওতেই চলবে। কারন আমার ধারণা যদি একশত ভাগ ভুল না হয় তবে আসল জিনিশ আমার কব্জাতেই আছে। এখন প্রধানত দরকার নিখোঁজ ডাক্তার সোহেলের সন্ধান বের করা তা সে যে অবস্থাতেই থাকুক। এদিকে একইসাথে সাইফুলকেও জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। তার কাছ থেকে নতুন কিছু পাওয়া গেলে আমি তা মোবাইলেও জানতে পারব। তাই শুধু এমন একজনকে দরকার যে পুরো ব্যাপারটার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত আথবা নিদেনপক্ষে সে ঘটনাটা জানে। এতে ডাক্তার সাহেবের খোঁজ ও ঘটনার রহস্য বের করা অনেক সহজতর হবে। উপরন্তু একজন লাইভ এভিডেন্স পাওয়া গেলে তার মাধ্যমে ক্রস কোশ্চেনিং করে খুব দ্রুত কথা দিয়ে কথা বের করা যাবে। তাছাড়া যেকোন রহস্যের মীমাংসার ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলে গিয়ে ঘাটাঘাটি করার কোন বিকল্প নাই। আর আমার একটা লিমিটেশনও ছিল; তা হল আমার নিজস্ব কোন ফোর্স আমার সাথে ছিল না। স্থানীয় পুলিশের সহায়তা নিয়ে মূলত কাজ করতে হচ্ছিল। আমাদের পাশাপাশি ডিবি’ও কাজ করছিল। সুতরাং সব কাজ যে আমার একার করতে হবে এমন কোন কথা নাই। বরং আমার প্রয়োজন এবং গুরুত্ব বুঝে কাজ করাটাই সুবিধাজনক।

এই ছেলেটির নাম শাহীন। সে একজন মুদি দোকানদার। পলাশবাড়ী বাজারেই তার দোকান। কিন্তু দুইদিন দোকানের সামনে বসে থেকেও তার দেখা পেলাম না। সে মনে হয় কয়দিনের জন্য বাইরে বের হচ্ছে না। সংবাদপত্র পৌঁছে না এমন জায়গা দেশে কমই আছে। সুতরাং এই ঘটনায় হইচই কেমন হচ্ছে তা সবাই সবখানে টের পাচ্ছে। শাহীন আমার ওই মোবাইল কোম্পানীর একটা প্রি-পেইড সীম ব্যবহার করে। গ্রামের লোকজন সাধারণত কার্ড কেনে না। ফ্লেক্সিলোড করে। আমি পলাশবাড়ী বাজারের সব ফ্লেক্সিলোডের দোকানে নিজেকে ওই কোম্পানীর একজন মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে পরিচয় দিয়ে বললাম যে আমাদের কোম্পানী থেকে এই এলাকার গত তিন মাসের মধ্যে সর্বাধিক ফ্লেক্সিলোডদাতা দোকানদারকে পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং কে সর্বাধিক ফ্লেক্সিলোড করেছে তা দেখার অজুহাতে আমি প্রত্যেক দোকানের ফ্লেক্সিলোড লেখার রেজিস্টারটা চেক করা শুরু করলাম। এরকম মাত্র চারটা দোকান ছিল ওই বাজারে। বেশীক্ষণ লাগল না। তিন নাম্বার দোকানেই পেয়ে গেলাম। শাহিন এখান থেকে নিয়মিত ফ্লেক্সিলোড করে। এবার আমি দোকানদারকে একটু চিপায় নিয়ে গিয়ে আমার স্বমূর্তি দেখালাম আর ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে কানে কানে কিছু মন্ত্র পড়ে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সে শাহীনকে ফোন করে বলল যে মোবাইল কোম্পানী থেকে একটা লটারী করা হয়েছে যাতে শাহীন প্রথম পুরস্কার হিসাবে একটা মোটর সাইকেল জিতেছে। ব্যাস, আধা ঘন্টার মধ্যেই শাহীন নাচতে নাচতে হাজির। আমিও শাহীনকে অভিনন্দন জানিয়ে মোটর সাইকেল বুঝিয়ে দেবার জন্য আমার গাড়িতে তুলে নিয়ে রওনা দিলাম। যাবার আগে আবার ওই দোকানদারকে চিপায় নিয়ে গিয়ে তওবা করালাম যে সে কোনকিছুই দেখেনি বা শোনেনি।

শাহীনকে নিয়ে আমার খুব বেশী বেগে পেতে হল না। তবে তার দেওয়া তথ্য অনুসারে ডাক্তার সোহেলকে জীবিত উদ্ধার করা দূরে থাক, তার লাশটাও পর্যন্ত আমরা পুরোপুরি উদ্ধার করতে পারলাম না। আরেকটু গোড়া থেকে বলি। আমি পলাশবাড়ী আসার পরেই চারিদিকে গোপনে লোক লাগিয়েছিলাম জীবিত বা মৃত ডাক্তার সোহেলের খোঁজ বের করার জন্য। শাহীনকে ধরার পরেরদিন ভোর বেলায় জানতে পারলাম নিকটস্থ করতোয়া নদীতে একটা মাথা ও দুই পা বিহীন লাশ ভেসে উঠেছে। ডাক্তার সোহেল নিখোঁজ হবার প্রায় ৭ কি ৮ দিন পরের ঘটনা। পলাশবাড়ীর ওসি’কে সাথে নিয়ে লাশ দেখতে গেলাম। প্রায় ২০০ গজ দূর থেকেই তীব্র দুর্গন্ধ আমার নাকে এসে বাড়ি দিল। আমি রুমালে বডি স্প্রে ছিটিয়ে নাকে মুখে পেঁচিয়ে লাশের কাছে গেলাম। তাতেও খুব একটা কাজ হল না। একটা ভ্যানের উপরে হোগলার মাদুর দিয়ে জড়ানো লাশ। মাথাবিহীন, তাই স্বভাবতই পরিচয়বিহীন। তার উপরে আবার পা দুটিও কাটা। আমি হোগলার মাদুর খুলে ফেললাম ভালোভাবে দেখার জন্য। জীবনে ওই প্রথমবার এইরকম একটা লাশ খুব কাছে থেকে দেখছিলাম। ধারালো কোন অস্ত্র দিয়ে গলার একেবারে গোড়া থেকেই মাথাটা আলাদা করা হয়েছে। তবে বেশ কিছুদিন পানিতে পঁচার কারনে ওইখানটা কেমন কশের মত গলে গলে পড়ছে। একঝাঁক মাছি সেই কশঝরা ক্ষতমুখে হুটোপুটি করছে। আমি লাশটা আরো উলটে পালটে দেখতে লাগলাম। তলপেটের কাছে ধারালো চাকুর গভীর ক্ষত। বুকের কাছে একটা একইরকম ছোট ক্ষত। আর পিঠের বামপাশে আরেকটা বড় ক্ষত। এখানে আমি খুনীর কিছু প্রতিভার পরিচয় পেলাম। সে এই লাশটাকে কাটার সময় ইচ্ছা করেই পিঠের দিকে বড় একটা ক্ষত করেছে। এর কারন হল, যাতে লাশের দুই দিক থেকেই পর্যাপ্ত পানি ভেতরে ঢুকতে পারে। এতে করে লাশ দ্রুত পঁচে গলে যাবে। পোস্টমর্টেম করে কিছুই বোঝা যাবেনা। পানিতে থাকতে থাকতে কেমন ফ্যাকাসে নীলচে হয়ে গেছে সারা শরীরের চামড়া। কোথাও কোথাও চামড়া উঠেই গেছে, হয়তো মাছে ঠুকরে খেয়েছে। উরুসন্ধি থেকেই দুই পা কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। হাতদুটো শুধু টান টান হয়ে ধড়ের দুপাশে পড়ে আছে। স্বভাবতই আমি ধারনা করলাম, লাশটা হয়তো ডাক্তার সোহেলের। কিন্তু কোন প্রমান নাই। ডাক্তার সোহেলের রংপুর মেডিকেলের কিছু সহপাঠী ডাক্তার এলেন খবর পেয়ে। তাদের একজন লাশটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিশ্চিত করলেন যে এটা ডাক্তার সোহেলেরই। তবে তার কথাই তো আর শেষ কথা নয়। কারন ডাঃ সোহেলের বাবা, বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক ডাঃ মোজাফ্‌ফর আহমেদ তখন গাইবান্ধার পথে। উনি আমাকে ফোন দিয়ে বললেন থাকার জন্য। বৃদ্ধ ডাঃ মোজাফ্‌ফর এসেই ঘোষণা দিলেন যে তিনি নিজেই এই লাশের পোস্টমর্টেম করবেন। তিনি বারবার বলছিলেন যে এটা তার ছেলের লাশ হয়তো না। কারন মাত্র এই কয়দিনে নাকি পানিতে থাকা লাশের অবস্থা এত খারাপ হবার কথা না। তার উপরে শীতকাল, পানি বরফের মত ঠান্ডা থাকে বেশীরভাগ সময়। তিনি অবশ্য ডাঃ সোহেলের লাশ কিনা তা সনাক্ত করার জন্য একটা প্রমানের কথাও বললেন। ডাঃ সোহেলের নাকি হার্টের একটা বাইপাস সার্জারি হয়েছিল দিল্লীতে। সেখানে নাকি একটা পেতলের রিং বসানো আছে। ওইটা থাকলে প্রমান হবে যে লাশটা সোহেলের। জন্মদাতা পিতার মন, সন্তানের কোন খারাপ পরিনতি কখনো কল্পনাও করতে চায় না। অবশ্য পোস্টমর্টেম শেষে তিনি খুব খুশী এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। কারন বাইপাস সার্জারির ওই রিংটা লাশের ভেতরে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, “আমার সোহেল নিশ্চয়ই বেঁচে আছে, তোমরা ভালো করে খুঁজে দেখ বাবা।” উনার কথায় আমি আবেগাপ্লুত হয়ে উঠলাম। আমার বাবা’র চেহারাটা বারবার মনে পড়তে লাগল। আমি আর উনার কথার উপরে কোন কথা বললাম না। শুধু মাথা কাত করে সায় দিয়ে চলে এলাম। আহারে, উনার কথাটাই যদি সত্যি হত!

কিছুক্ষণ পরেই আমি ঢাকা থেকে ফোন পেয়ে জানলাম যে ডিবি পুলিশ সাইফুলের গাজীপুরবাসী চাচাতো ভাই ফিরোজকে গ্রেপ্তার করার পর সেও সবকিছু স্বীকার করেছে। পরে তার স্বীকারোক্তির রেকর্ড সাইফুলকে শোনানো হলে সেও সবকিছু স্বীকার করে। আমি মাথাবিহীন লাশটাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে শাহীনকে সাথে নিয়ে দ্রুত ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সাইফুল এবং ফিরোজকে দফায় দফায় আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকি। ধীরে ধীরে অনেক তথ্যই বের হয়ে আসে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুসারে ডিবি পুলিশ লাশের মাথা উদ্ধার করে একটা কলাবাগানের ভেতরে মাটি চাপা অবস্থায়। তার রক্তাক্ত কাপড় চোপড়ও সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। পা দুটিও কাছাকাছি একটা প্যাক কাদার নর্দমা ধরণের নীচু জমি থেকে উদ্ধার করা হয়। সাথে সাথে গ্রেপ্তার করা হয় লাশ লুকানোর সাথে জড়িত ফিরোজের আত্মীয় বুলুকেও। সাইফুল, ফিরোজ, বুলু ও শাহীন – এই চারজনের পৃথক পৃথক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যসমূহের সম্মিলনে হত্যাকান্ডের যে রোমহর্ষক বিবরণ পাওয়া যায় তা এবার আপনাদের সামনে তুলে ধরব।

সাইফুলের চাচাতো ভাই ফিরোজ মাঝে মাঝে গাজিপুর থেকে সাইফুলের কাছে ডাঃ সোহেলের বাসায় বেড়াতে এসে থাকত। মাসখানেক আগে ফিরোজ এরকম একবার বেড়াতে আসলে সাইফুল প্রথমবারের মতো তাকে খুনের পরিকল্পনার কথা বলে। খুনের কারন হিসাবে সাইফুল ফিরোজের কাছে তার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার কথা তুলে ধরে। সে ফিরোজকে জানায়, ডাঃ সোহেল নাকি তাকে তার কাজের বিনিময়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয় না। উপরন্তু কারনে অকারনে তাকে ধরে মারধর ও অপমান করে। এরপরে তারা খুনের জন্য একটি পরিকল্পনা দাঁড় করায়। ১০ জানুয়ারী তারিখ রাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী ফিরোজ ডাঃ সোহেলের বাড়িতে আসে। সাইফুল তাকে সরাসরি বাড়ির ছাদে নিয়ে লুকিয়ে রাখে। আসার সময়ই ফিরোজ সাথে করে খুন করার জন্য ছুরি ও চাপাতি নিয়ে আসে। সোহেল সাহেবের কাছে আগত অতিথিরা রাতের খাবার খেয়ে চলে যাবার সময় তিনি তাদেরকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেবার জন্য নিচে নামেন। এসময় সাইফুল মোবাইলে কল করে ফিরোজকে নীচে আসতে বলে। ফিরোজ এসে চাপাতি হাতে ঘরের এক কোনে লুকিয়ে থাকে। সাইফুলের কোমরে লুকানো ছিল ধারালো ছোরাটি। ডাঃ সোহেল উপরে ফিরে আসার পরেই সাইফুল তার হাতে একটা বাজারের ফর্দ ধরিয়ে দেয়। তিনি সেই ফর্দের প্রতি মনোনিবেশ করতেই ফিরোজ পেছন থেকে এসে তার মাথায় প্রথমে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। সাথে সাথে তিনি মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। এসময় সাইফুল তার ছোরা বের করে তার তলপেটে ও বুকে উপর্যুপরি আঘাত করে। এতে তার নাড়িভুড়ি পর্যন্ত বের হয়ে যায়। কোনরকম চিৎকার বা গোঙ্গানীর আওয়াজ যাতে বের না হয় সেজন্য সাইফুল ডাঃ সোহেলের মুখে একটা গামছা চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে। অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি মারা যান। এবার খুনী দুজন তার লাশ ধরাধরি করে বাথরুমে নিয়ে যায়। সেখানে ঠান্ডা মাথায় বসে বসে ধারালো চাপাতিটি দিয়ে লাশ থেকে প্রথমে দুই পা ও পরে গলাসহ মাথা আলাদা করে ফেলে। এরপরে প্রত্যেকটা টুকরো তারা পলিথিন দিয়ে ভালোমত পেঁচিয়ে নেয় যাতে তা থেকে রক্ত বা দুর্গন্ধ বের না হয়। গলা থেকে কোমর পর্যন্ত ধড়ের অংশটা বড় একটা স্যুটকেসে ভরে ফেলে। আর দুই পা ও মাথা একটি চটের বস্তায় ভরে ফেলে। এরপর দুজন মিলে ঘর ও বাথরুম খুব ভালোভাবে পরিস্কার করে রাখে যাতে খুনের কোন চিহ্নই না থাকে। রাত সাড়ে তিনটার দিকে তারা লাশভর্তি চটের ব্যাগ ও স্যুটকেসটা বাসার নীচে এনে সিঁড়ির গোড়াতে লুকিয়ে রাখে। আনুমানিক ভোর চারটার দিকে সাইফুল ঘুম ঘুম চোখে নীচে এসে বিরক্তমুখে দারোয়ানকে ডাঃ সোহেলের কথা বলে সিগারেট আনতে পাঠায়। দারোয়ান বাইরে বেরোনোর সাথে সাথে তারা দুজন লাশের ব্যাগদুটো নিয়ে সোহেলের গাড়ির বুটে ভরে আবার উপরে চলে যায়। পরে ধীরে সুস্থে সাইফুল সকাল আটটার দিকে গাড়ি নিয়ে মাছের বাজারে যাবার নাম করে বের হয়। এসময় ফিরোজ গাড়ির পেছনের সিটে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল। সাইফুল ফিরোজকে গাবতলী নিয়ে গিয়ে শ্যামলী পরিবহনে উঠিয়ে দেয় এবং লাশের স্যুটকেস ও ব্যাগটিও ওই গাড়ির ছাদে উঠিয়ে দেয়। এরপর সাইফুল আবার ধানমন্ডির বাসায় ফিরে আসে। সকাল দশটার দিকে সাইফুল আবার বের হয়ে শ্যামলী পরিবহনেরই আরেকটি গাড়িতে উঠে গাইবান্ধার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আসার পথেই সাইফুল তার বন্ধু মুদি দোকানদার শাহীনের সাথে যোগাযোগ করে। এদিকে সন্ধ্যা নাগাদ ফিরোজ গাইবান্ধা পৌঁছে লাশভর্তি ব্যাগ ও স্যুটকেস নামিয়ে নিয়ে সাইফুলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রাত আনুমানিক দশটার দিকে সাইফুল সেখানে পৌঁছলে তারা দুজন পলাশবাড়ি থানার শিমুলতলীতে ফিরোজের চাচাতো ভগ্নিপতি বুলুর বাড়িতে ওঠে। একপর্যায়ে বুলুকে তারা পুরো ঘটনা খুলে বলে তার সাহায্য কামনা করে। বুলু প্রথমে রাজি না হলে সাইফুল ধরা পড়লে তাকে ফাঁসিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে রাজি করায়। এরপর তারা শাহীনকেও মোবাইল করে ডেকে পাঠায়। শাহীন এসে সব শুনে নানারকম টালবাহানা করে কেটে পড়ে। কিন্তু এব্যাপারে কোথাও মুখ না খোলার ব্যাপারে ওয়াদা করে। পরে গভীর রাতে সাইফুল, ফিরোজ ও বুলু করোতোয়ার খালে ধড়, কলার বাগানে মধ্যে মাথা আর খালপাড়ে পঁচা কাদার ডোবায় পা দুটো পুতে ফেলে। এরপর সাইফুল ও ফিরোজ বুলুর কাছে বিদায় নিয়ে সাইফুলের গ্রামের বাড়ি শিমুলিয়ায় এসে রাত কাটায়। পরেরদিন সকালেই তারা গাজীপুরে ফিরোজের ডেরায় ফেরত যায়। সেখানে একরাত যাপন করার পরে সাইফুল পুনরায় ঢাকায় ধানমন্ডির বাসায় ফেরত আসে ও স্বাভাবিক আচরন ও চলাফেরা করতে থাকে। এমনকি ডাঃ সোহেলকে খুঁজে পাওয়া না যাওয়ায় সেও অন্যদের মত যথেষ্ট হইচই ও ছুটোছুটি করতে থাকে। এই ছিল মোটামুটি খুন ও লাশ সরানোর কাহিনী।
এদিকে সাইফুল বহু কসরতের পর খুনের কথা স্বীকার করলেও হত্যার মোটিভ সম্পর্কে আবার ক্রমাগত মিথ্যা কথা বলে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে শুরু করে। সে একবার বলে যে, ডাঃ সোহেলের একজন গোপন প্রেমিকা ছিল যার নাম সেতু। তার সাথে সোহেলের মনোমালিন্য হওয়ার কারনেই নাকি সেতু সাইফুলকে এক লাখ টাকা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে খুনটা করিয়েছে। আর সেতু নাকি তাকে ওয়াদা করেছিল যে পুলিশি ঝামেলা থেকে তাকে সে উদ্ধার করবে। অথচ ডাঃ সোহেলের পারিবারিক সূত্র থেকেই জানা গেল যে বিশেষ শারীরিক সমস্যার কারনেই তিনি অবিবাহিত ছিলেন। সুতরাং তার এধরণের একটা সম্পর্ক থাকা নিতান্ত অস্বাভাবিক। তাছাড়া সোহেলের কাছের বন্ধু ও কলিগরাও এ সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেন। তারা বলেন যে সেতু বিবাহিত এবং তার স্বামী ডাঃ সোহেলের দীর্ঘদিনের চিকিৎসাধীন একজন রোগী। এই পরিচয়ের সূত্রেই তাদের মধ্যে সামান্য জানা-শোনা ছিল, এর বাইরে কিছু নেই। আবার ডিবি’র কাছে জিজ্ঞাসাবাদে ফিরোজ জানায় যে সাইফুল নাকি তার সাথে দুর্ব্যবহারের প্রতিশোধ নিতেই ডাঃ সোহেলকে খুন করেছে। কিন্তু এই মোটিভটিও আমার কাছে অবান্তর মনে হল। কারন সাইফুল ডাঃ সোহেলের পরিবারে সাথে এক দুইটি বছর নয়, বরং তার চার বছর বয়স থেকে শুরু করে একুশ বছর পর্যন্ত মোট সতেরটা বছর কাটিয়েছে। ডাঃ সোহেলের মা দরিদ্র ঘরের ঠিকমত খেতে পরতে না পাওয়া চার বছরের বাচ্চাটিকে নিয়ে এসে অনেকটা নিজের ছেলের মতোই তাকে মানুষ করেছেন। তাকে লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছেন, কিন্তু সাইফুল লেখাপড়া বেশীদিন করেনি। পরে তার কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে তাকে ড্রাইভিং শিখিয়েছেন। বিশ্বাস করে নিজের গাড়ির ড্রাইভার ও বাড়ির কেয়ারটেকারের চাকরীও তাকে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সাইফুলের বাবা ডাঃ সোহেলদেরই গ্রামের জমি জমার একাংশ বর্গাচাষ করে তার সংসার চালায়। সাইফুল প্রায়ই নিজের বাড়ি গাইবান্ধাতে বেড়াতে যেত এবং ব্যক্তিগত মোবাইল ব্যবহার করত। এতে বোঝা যায় যে তার টাকা পয়সা বা ছুটি ছাটা নিয়েও তেমন কোন সমস্যা ছিল না। সাইফুল ছিল তাদের পরিবারেরই একজন। আর এত দীর্ঘসময় একসাথে থাকার পরে নিছক দুর্ব্যবহার করা নিয়ে কেউ কাউকে খুন করে বসতে পারে এটা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য না। অনেক জেরা-জিজ্ঞাসা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পরে খুনের মোটিভ সম্পর্কে আমরা মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম।

মূলত টাকা পয়সা ও সম্পত্তি হস্তগত করে রাতারাতি বড়লোক হবার লোভেই সাইফুল ডাঃ সোহেলকে খুন করে। ডাঃ সোহেলের বাবা তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর সাথে পুরানো ঢাকার আলুবাজারে আলাদা বাড়িতে থাকেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে ডাঃ সোহেলই ছিলেন বড়। তার ছোট ভাই পামেল কানাডায় এবং ছোট বোন মিলা আমেরিকাতে স্থায়ীভাবে থাকেন। ডাঃ মোজাফ্‌ফর আহ্‌মেদ ডাঃ সোহেলের মা ফিরোজা বেগমকে ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোডের এই বাড়িটি দিয়ে দেন। সাইফুল তাকে নানী এবং ডাঃ সোহেলকে মামা বলে ডাকত। সোহেলের মা সাইফুলকে প্রকৃত অর্থেই নিজ নাতীর মতো স্নেহ করতেন। ছেলে অবিবাহিত হবার কারনে ছন্নছাড়া বাড়ির দায়িত্ব তিনি সাইফুলের হাতে দিয়ে একপ্রকার নিশ্চিন্তেই ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ হয়ে তিনি বেশীরভাগ সময় চিকিৎসার সুবিধার্থে মেয়ের কাছে আমেরিকাতে থাকতেন। সাইফুল দেখল, এই সুযোগ। ডাঃ সোহেলের ভাই ও বোন কখনোই আমেরিকা-কানাডার সুখ-শান্তি ছেড়ে এই দেশে আসবেনা। নানী, অর্থাৎ ডাঃ সোহেলের মা’ও চিকিৎসার জন্য একপ্রকার আমেরিকাতেই সেটেল্‌ড্‌। বাবা তো থেকেও নেই। এই পরিবারের সাথে তার তেমন কোন সম্পর্কই বলতে গেলে নাই। এদিকে ডাঃ সোহেল অবিবাহিত হওয়ায় তারও কোন বংশধর বা ওয়ারিশ নাই। তাই এখন শুধু সোহেলকে যদি সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলেই তার মা-ভাই-বোনের আর দেশের সাথে কোনপ্রকার সংযোগ থাকবে না। তারপর এক্কেবারে ফাঁকা মাঠে গোলের পর গোল দেওয়া যাবে। তখন এই ধানমন্ডির বাড়ি, গ্রামের সম্পত্তি, গাড়ি ইত্যাদি কোটি কোটি টাকার এত এত সম্পদ ভোগ করবে কে? বৃদ্ধা ফিরোজা বেগমের আদরের বিশ্বস্ত পালক নাতি সাইফুল ছাড়া আর কার উপরেই বা তিনি এগুলোর দায়িত্ব দিয়ে ভরসা করবেন? কাগজে কলমে না হোক অন্তত হাতে কলমে তো এসবের মালিকানা ও ভোগদখল তার জিম্মাতেই থাকবে। আর এত বছর ধরে আদর দিয়ে পেলে পুষে যাকে মানুষ করলেন ফিরোজা বেগম, তাকে কি কাগজে কলমে তিনি একেবারেই নিরাশ করতে পারবেন?

আমি কোর্টে হস্তান্তর করার আগে শেষবারের জন্য সাইফুলকে আমার অফিসে ডেকে আনালাম। পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাফ বাঁধা অবস্থায় ও নিজের পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ওর সাথে কোন কথা বললাম না। শুধু ওর মুখের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে কল্পনা করার চেষ্টা করলাম, আজ থেকে সতের বছর আগে ও দেখতে কেমন ছিল? হতদরিদ্র আব্দুস সাত্তারের চার বছর বয়েসী নিরীহ রোগা ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফিরোজা বেগম তার মায়াভরা চোখে এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ঠিক কি কল্পনা করেছিলেন?

২,৫১৬ বার দেখা হয়েছে

৪৯ টি মন্তব্য : “নরকবাস – ৬”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    আশার কথা অধিকাংশ লোকই এরকম নয়।আমার নানা ৪ বছর বয়েসি একটি ছেলেকে পাকিস্তান আমলে নিজের বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন।সেই ছেলেটি গত চল্লিশ বছর ধরে আমাদের পরিবারের সাথে আছে।ঈদের সময় নিজের পরিবারের সাথে অল্প কিছুক্ষণ থেকে এখানে চলে আসেন তিনি-উনার ঈদ নাকি আমাদের সাথে।ইনি আমাদের রফিক মামা।রফিক মামার মত বিশ্বস্ত মানুষ এমনকী পরিবারের আপন সদস্যরাও হয় কি-না সন্দেহ।

    যার বাসায় এতদিন ধরে বড় হল,সম্পত্তির লোভে কি নির্মমভাবেই না তাকে হত্যা করল সাইফুল! পোষা কুকুর যে কখনো কখনো মানুষের চাইতে শত-সহস্রগুণে উত্তম এই জাতীয় মানুষ দেখলে তা-ই প্রমাণিত হয়।

    সাজিদ ভাই,গা-টা শিউরে উঠল লেখাটা পড়ে।আপনার এই লেখাগুলো নিয়ে একটা বই বের হলে চমৎকার হয়।আআমি নিশ্চিত,পাঠকের কোন অভাব হবেনা।

    জবাব দিন
  2. জুলহাস (৮৮-৯৪)

    ওই মিয়া...কাউয়া না কি কাউয়ার গোশ্‌ত খায় না!!!!!!!!
    আমরা কেন খালি খালি আমাগো মারি...কইবার পারো????? 😡 😡
    সবডির ব্যান্‌ চাই... x-( x-(
    আর, মাঝে মাঝে এইসব ব্যক্তিদের কারও কারও জনসম্মুখে ফাঁসি চাই...। 😡 😡 😡


    Proud to be an ex-cadet..... once a cadet, always a cadet

    জবাব দিন
  3. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    সাজিদ, দারুণ লেখা। ঘটনাটা পত্রিকায় পড়েছিলাম। কিন্তু তদন্ত, রহস্য উদঘাটন এমন সব তথ্য তো জানা ছিল না। তোমার বর্ননায় সবটাই পরিস্কার হলো। আবারো বলি, বইয়ের কথা ভাবো। আমি সাহায্য করতে পারি। :thumbup:


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • সাজিদ (১৯৯৩-৯৯)

      😀 আপনি সাহায্য করবেন???:tuski: :goragori: :guitar: :awesome: তাইলে ভাইয়া আমি কিন্তু সিরিয়াসলি চিন্তা ভাবনা শুরু করব। আপনার মোবাইল নাম্বারটা কাইন্ডলি দেন। আমি দেশে এসেই আপনার সাথে যোগাযোগ করব।
      আমার ভাই তোমার ভাই, সানা ভাই, সানা ভাই :salute:
      সানা ভাই সবার আগে, আমরা সবাই তাহার পিছে :hatsoff:


      অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক,
      জ্যোস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,
      কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।

      জবাব দিন
    • সাজিদ (১৯৯৩-৯৯)

      আমার লেখা পড়ে তোমাদের মুখ যত বেশী ঘৃণায় বিকৃত হয় ততই আমার প্রাপ্তি। কারন আমার লেখার উদ্দেশ্যই হল সমাজের অন্ধ গলিগুলোকে নগ্ন করে দেওয়া, সমাজের এসমস্ত জঞ্জালের বিরুদ্ধে বিবেকবান মানুষের মনে ঘৃনার বিষ ছড়িয়ে দেওয়া।


      অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক,
      জ্যোস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,
      কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।

      জবাব দিন
  4. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    পুরোটা পড়ার মানসিক শক্তি হয়নি। সেভ করতে গিয়ে গাল একটু কেটে গেলে আমি ভয়ে অস্থির হয়ে যাই আর এতো জীবন্ত মানুষকে কেটে ফেলা!

    কিছুই বলার নাই।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  5. রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

    😛


    আমার কি সমস্ত কিছুই হলো ভুল
    ভুল কথা, ভুল সম্মোধন
    ভুল পথ, ভুল বাড়ি, ভুল ঘোরাফেরা
    সারাটা জীবন ভুল চিঠি লেখা হলো শুধু,
    ভুল দরজায় হলো ব্যর্থ করাঘাত
    আমার কেবল হলো সমস্ত জীবন শুধু ভুল বই পড়া ।

    জবাব দিন
  6. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    ঘটনার বিভৎসতা বা মানুষের নিষ্ঠুরতা মাত্রা কোথায় যেতে পারে এ লেখা তার এক জ্বলন্ত দলিল।

    আমার অন্য একটা ব্যাপারে একটু প্রশ্ন জাগছে আমি বরং সেটা নিয়ে বলি। সেটা হলো খুনের মোটিভ। তুমি যেটা উল্লেখ করলে আমার কেন জানি সেটাকে যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। সাইফুল যেহেতু এ বাড়ির সব কিছুই দেখাশোনা করছে এতো ওয়ারিশ থাকা সত্ত্বে তার পক্ষে কিভাবে ভাবা সম্ভব যে ডাঃ সোহেলকে খুন করলেই সব তার হবে? তুমি এর পক্ষে তোমার নিজের যে যুক্তি দেখিয়েছ আমার কাছে তা বাস্তব সম্মত মনে হয়নি। আমাদের শ্রমিক ভাইরা যারা বিদেশে কাজ করে তারাই কিন্তু দেশে রেমিটেনস পাঠানোর ব্যাপারে বড় ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের শিক্ষিত এবং অবস্থাসম্পন্ন ঘরের প্রবাসীরা বরং দেশের সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে নিয়ে যায় কিম্বা দেশে এক ধরনের শান্িতর আবাস নিশ্চিত করে রাখে যাতে শেষ বয়সে প্রবাসের কষ্ট জীবন ছেড়ে দেশে আরামে কাটাতে পারে। আর বিদেশের উন্নত চিকিষাৎ কিন্তু অনেক ব্যয়বহুল। ডাঃ সোহেলের মার মতো কাউকে সেটা গ্রহন করতে গেলে (বুঝাতে চাচ্ছি যার নিজের কোন স্বাস্থ্য বীমা নেই, থাকলেও যা সব কিছু বহন করে না) সেটা নিজের পকেটের পয়সা দিয়েই গ্রহন করতে হবে। সুতরাং ডাঃ সোহেল না থাকলেই সম্পত্তি সাইফুলের হাতে চলে আসবে এমনটা ভাবার কারণ দেখছি না। এখন কথা হলো আসলেও সাইফুল কি ভাবছিল? এ পরিবারের সাথে এভাবে জড়িয়ে থাকার পর সে পুরোটা না হলেও কিছুটা বুঝতে পারবে না তা কি করে হয়? এতো কাছের মানুষকে খুনের যে বিভৎসতা সে দেখিয়েছে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে না একমাত্র লোভই পেছনের ড্রাইভিং ফোর্স হিসেবে কাজ করেছে।
    পেপারে, খবরে দেখি মনিব-ভৃত্যের (এই শব্দদুটোতে আমার যদিও আপত্তি আছে) সম্পর্কের নৃশংসতা যেভাবে দিন দিন ছাড়িয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে সিরিয়াস গবেষনা এবং এ দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য সেই গবেষনালদ্ধ ফল প্রচার করা উচিত। শিউরে উঠি যখন পড়ি যে গৃহকর্ত্রী দ্বারা ছয় সাত বছরের কাজের মেয়ের উপর নৃশংস অত্যাচার। সব অত্যাচার তো প্রকাশ পায় না। ছোটবেলায় কারো উপর খুব অত্যাচার হলে তার ভেতরে একটা স্যাডিস্ট মানুষ জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
    গবেষনার তথ্য উপাত্ত হিসেবে সাইফুলদের মতো লোকদের কথা শোনা দরকার। সে আসলেও ডাঃ সোহেলকে কেমন দৃষ্টিতে দেখতো? একমাত্র লোভই কি তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল নাকি সাথে আরো কিছু ছিল?
    ডাঃ সোহেলের কথা ভেবে খুব খারাপ লাগলো। ভগ্ন পরিবারে বড় হওয়া, নিয়তির কারণেই অবিবাহিত জীবনযাপন করা এবং পরিশেষে এরকম মৃত্যু!

    তুমি যদি বই বের করো তাহলে ফেলুদা আর মাসুদরানার সংমিশ্রন ঘটালে যে চরিত্রটা বের হয়ে আসবে - আমার খুব ইচ্ছে করছে তোমার বইয়ে তোমাকে সেভাবে দেখতে।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
    • মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

      তুমি যদি বই বের করো তাহলে ফেলুদা আর মাসুদরানার সংমিশ্রন ঘটালে যে চরিত্রটা বের হয়ে আসবে – আমার খুব ইচ্ছে করছে তোমার বইয়ে তোমাকে সেভাবে দেখতে

      :boss: :boss: ইস,এইরকম হলে কি মজাটাই না লাগবে বইগুলো পড়তে!

      জবাব দিন
    • সাজিদ (১৯৯৩-৯৯)

      আপুমনি, আপনার শুভকামনা আর দোয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনি খুনের মোটিভ সম্পর্কে যা যা বলেছেন তা খুবই সত্যি। তবে একটা বিষয় এখানে লক্ষনীয় যে, সাইফুল একজন অশিক্ষিত, অপরিপক্ক (২১ বছর বয়স) এবং জন্মসূত্রে গাইবান্ধা নামক প্রচন্ড অভাবতাড়িত এবং সর্বহারাপ্রবন এলাকার একটি ছেলে। মোটিভটাকে সাইফুলের দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করুন। সাইফুলের জায়গায় আমি বা আপনি হলে কিন্তু কখনোই সম্পত্তির ওয়ারিশ নিয়ে আমি যে বক্তব্য দিয়েছি সেরকম চিন্তা করতাম না। কিন্তু আমি খুনের মোটিভ হিসেবে সম্পত্তির লোভের যে ব্যাপারটা দাঁড় করিয়েছি সেই লোভের জন্ম কিন্তু সাইফুলের মনে। আর সে তো আমার বা আপনার মতো বিবেক্কসম্পন্ন মানুষ না। সে নিজেই এরকম চিন্তা করেছে, এটা আমার কল্পনাপ্রসূত না। এই ব্যাপারটি বেরিয়ে এসেছে তার সাথে ধরা পড়া অন্যান্য আসামীর দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্য থেকে। সে বিভিন্ন সময়ে ডাঃ সোহেলের পরিবারের সাথে তার দীর্ঘ অবস্থানের কারন ও তার ইপ্সিত স্বার্থ এবং এই সম্পত্তিতে তারো অধিকার ও অংশীদার আছে; এই ধরণের কথাবার্তা তার সহযোগিদের কাছে ব্যক্ত করেছে। তাছাড়া তার নিজের কিছু কিছু কথাবার্তাতেও এর আভাস পাওয়া গেছে, তবে এ বিষয়টা সে সরাসরি কখনোই স্বীকার করেনি। সে নিজে যে মোটিভের কথা আমাদেরকে বলতে চেয়েছে, অর্থাৎ সেতু নামক একজন মহিলার এক্ষেত্রে যোগসাজশের বিষয়ে কোনপ্রকার প্রমান পাওয়া যায়নি। তারপরে আসে প্রতিহিংসা, যা ফিরোজের বক্তব্য থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু ডাঃ সোহেল মামা বা অভিভাবক হিসাবে তাকে মাঝে মাঝে যে শাসন করত তা যেকোন পরিবার মাত্রেই হয়ে থাকে। আর যে পরিবারে সে ১৭ বছর ধরে আছে এবং এবং যেখানে পরিবারের একজন সদস্য, সেখানে তো আর সে মেহমানের মতো ব্যবহার আশা করবে না নিশ্চয়ই। আর প্রকৃতপক্ষেই সোহেল সাহেবের মা সাইফুলকে অত্যধিক স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন। উনি এমনকি দেশে আসার পরে সবকিছু দেখার ও জানার পরেও বিশ্বাস করতে চাচ্ছিলেন না যে সাইফুল এই কাজ করতে পারে। তবে এর পেছনে আরো একাধিক মোটিভ থাকাটাও অস্বাভাবিক না। সব আসামী ও আলামত জব্দ হওয়ার পরে কেসটা চালিয়ে নেবার দায়িত্ব যেহেতু শেষমেষ ডিবি পুলিশের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল, তাই এবিষয়ে আমাদের আর বেশী ঘাটাঘাটি করার সুযোগ হয়নি।


      অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক,
      জ্যোস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,
      কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।

      জবাব দিন
  7. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    সাজিদ ভাই,
    একটা ভিন্নমাত্রার কথা বলি।ক্রিমিনোলজিতে হায়ার স্টাডি করার কোন প্ল্যান কি আপনার আছে? বিশ্বের খুব বড় বড় ইউনিভার্সিটিতে কিন্তু এই সাবজেক্টে আপনার মত লোকেরা পড়াশোনা করে।আপনার অভিজ্ঞতার বর্ণনা এবং বিশ্লেষণ পড়ে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে যদি আপনি যদি এ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষায় অংশ নিতে চান তবে স্কলারশিপ যোগাড় করা আপনার জন্যে কঠিন কিছু হবেনা,আর এ ডিসিপ্লিনে অনেক অবদানও রাখতে পারবেন।লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স এন্ড পলিটিকাল সায়েন্স , অক্সব্রিজ অথবা ইউ সি বার্কলের ক্রিমিনোলজির ওয়েবসাইট গুলোতে একটু ঘাটাঘাটি করে দেখতে পারেন।

    জবাব দিন
    • সাজিদ (১৯৯৩-৯৯)

      এই বিষয়টাতে পড়াশোনা করার আগ্রহ আমার অনেক দিনের। কিন্তু সময়ের অভাবে এবং চাকুরীর কারনে অনেক ব্যাপারেই মাথা ঘামাতে পারি না। তোমার যদি এব্যাপারে কোন জানাশোনা থাকে তবে আমাকে দয়া করে বিস্তারিত জানিও।


      অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক,
      জ্যোস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,
      কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।

      জবাব দিন
      • মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

        সাজিদ ভাই,

        আপনার মত প্রফেশনাল ক্রাইম ফাইটারদেরকে যতদূর জানি ওরা সেধে সেধে ফুল স্কলারশিপ দিয়ে ডেকে নিয়ে যায়।আর আপনার একটা প্লাস পয়েন্ট হল বন্দুক আর লেখনির রেয়ার কম্বিনেশন-যা অনেক মানুষেরই থাকে না।আমি ওয়েবসাইটগুলোর কয়েকটা দিয়ে দিতে পারি-ওখানে ঘাটাঘাটি করলে প্রাথমিক ধারণা পাবেন(অথবা গুগলে সার্চ দিলেও হবে)।এই ব্লগের কুমিল্লার আহমেদ ভাই লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে পড়ছেন-উনার পরিচিত একজন পুলিশ অফিসার ফুল স্কলারশিপে ওখানে ক্রিমিনোলজিতে মাস্টার্স করছেন।আহমেদ ভাইকে বলে যোগা্যোগ করিয়ে দেওয়াটা খুব কঠিন কিছু হবেনা।সেনাবাহিনী থেকে একটু হয়তো বেশি ঝামেলা হবে কিন্তু অসম্ভব নয় মোটেই।আমাদের দেশে বিশ্বমানের ক্রিমিনোলজিস্ট নেই বললেই চলে-আর আমি বিশ্বাস করি উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে সেরকম কিছু হবার যোগ্যতা আমাদের ক্যাডেটদের আছে।ভাইয়া প্লিজ কথাগুল একটু মাথায় রেখেন।

        জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।