নরকবাস – ৫

অসাংবিধানিক অসতর্কীকরণঃ
গল্প বলতে এসে এটা মনে করা যাবে না তো ওটা খেয়াল করা যাবে না এতসব বায়নাক্কা করা গল্পকারের জন্য অসাংবিধানিকই বটে। তবে এই গল্পের শুরুতে এই ইটালিক ফন্টের লেখাটুকু কিন্তু আপনাদেরকে সতর্ক করার জন্য না, বরং অসতর্ক করার জন্য। কারন নরকবাসের আগের গল্পগুলোর মত এখানে প্রকৃত স্থান, কাল বা পাত্রের ক্ষেত্রে কোনপ্রকার পরিবর্তন বা ছলনার আশ্রয় নেওয়া হয়নি। সম্পূর্ণ ঘটনাটাকে আমার বানরতুল্য স্মৃতিশক্তির সাধ্যমত তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। বহুল আলোচিত এই ঘটনাটা অনেকেরই জানা থাকতে পারে। তাই কোন ভুলভ্রান্তি হলে ‘সংশপ্তক’ নাটকের ‘কাজী মোহম্মদ রমজানে’র (অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী) মত পাঠকের দুই পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইছি। এই গল্পটা আমার লেখার মানের প্রেক্ষাপটে পাঠকের ধৈর্য্যের তুলনায় একটু বড় মনে হওয়াতে দুই খন্ডে বিভক্ত করে দিলাম।

গলাকাটা লাশ। (প্রথম খন্ড)
ছুটির সকালটা আমার স্বপ্নের মত সুন্দর করার জন্য আমি কতই না আয়োজন করি! সাধারণের চাইতে একটু বেশী রাত জেগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আলস্যমাখা জীবনানন্দের কবিতা বা সুনীলের কোন ভালোবাসার গল্প পড়ি। ঘুমানোর আগে মৃদু মোহময় সুরে সাউন্ড সিস্টেমে চালু করে দিই হরিপদ চৌরাসিয়া’র বাঁশি বা রইস খাঁনের রোমান্টিক সেতার। ভোরে ফজরের আজানের সময় ঘড়ির এলার্মে যখন ঘুম ভাঙ্গে, তখনো সেই সুরের মাদকতা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। নামাজ শেষে বারান্দায় ইজি চেয়ারটায় বসে কোরান তেলাওয়াত করতে করতে ভোর হওয়া দেখি। তারপর আবারো হালকা সুরে আশা ভোঁস্‌লে বা রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা’র রবিন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে ঘুমের দ্বিতীয় অধ্যায় রচনা করি। সেই ঘুম আমার ভাঙ্গার কথা কমপক্ষে বেলা এগারোটায়। কিন্তু এই একটা জায়গায় এসে আমার শনি সবসময়ই বৃহস্পতিকে গ্রাস করে। আর আমার মোবাইল ফোন গ্রাস করে আমার স্বপ্নের সকালটাকে। সরকারি মোবাইল; বন্ধও রাখতে পারি না, আবার তুলে আছাড়ও দিতে পারি না। বাধ্য হয়ে ওই বিরক্তিকর বস্তুটিকে কানে লাগিয়ে আরো বিরক্তিকর কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

সেদিনও তার ব্যতিক্রম হল না। আশা ভোঁস্‌লে’র ‘ডেকো না আমারে, ডেকো না… ডেকো না’ শুনতে শুনতে আমার চেতনা যখন ঘুমের অতল সমুদ্রে তলিয়ে যেতে চলেছে, ঠিক তখনই আমাকে নির্দয় কর্কশ স্বরে ডাকতে শুরু করল আমার মোবাইল। ধ্যাৎ–তেরি! প্রথমে ভাবলাম, পাত্তা না দিলে খানিক চেঁচিয়ে চুপ হয়ে যাবে। কিন্তু কিসের কি? থামার নাম নেই। খুব কষ্টে চালের বস্তার মত ভারী লাগতে থাকা মোবাইল সেটটাকে উঁচু করে কোনমতে একচোখ খুললাম যাতে ঘুমটা ছুটে না যায়। তাকালাম স্ক্রীনের দিকে। ওহ্‌ নো…ওওও, যা ভাবছিলাম তাই, আমার বস্‌! ওই মুহুর্তে আমার বসের চেহারাটা বীভৎস হয়ে আমার কল্পনার চোখে ভাসতে লাগল। মনে হচ্ছিল উনার মাথার উপরে দুটো শিং গজিয়েছে, ঠোঁটের কোনা দিয়ে ড্রাকুলার মত চোখা চোখা দুটো দাঁত বের হয়েছে আর উনি উনার রোমশ হাতের লম্বা লম্বা নখ দিয়ে খাঁমচে ধরে আমাকে বিছানা থেকে তুলতে চাইছেন। আমি আঁধশোয়া হয়ে ইয়েস বাটন চাপতেই ওপাশ থেকে উনার গলা শোনা গেল।
“এই হ্যালো, এই শুনতে পাচ্ছ? ঘুমাচ্ছ নাকি? আরে ঘাপলা হয়ে গেছে তো তোমার এলাকায়।”
“কি হইছে স্যার?”
“আরে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের এক প্রফেসারকে নাকি দুই দিন যাবৎ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ফ্যামিলির লোকজন দাবী করতেছে তারে কিডনাপ করা হইছে। বুঝছ?”
“দুই দিন ধরে পাইতেছে না, আর আইজকা ছুটির দিন খুঁজে বের করে তারা রিপোর্ট করতেছে! আর একটা দিন ওয়েট করতে পারল না? পুরুষ না মহিলা স্যার?”
“পুরুষ, পুরুষ। নাম হইলো ডাঃ সোহেল।”
“ও…ও। মহিলা ডাক্তার হইলে ভালো হইতো স্যার। কেইসটা একটু ইন্টারেস্টিং হইতো।”
“আরে ব্যাটা, ফাইজলামি করিস না। তাড়াতাড়ি যা স্পটে, এলাকা গরম হয়ে গেছে। আমি তোর কাছে গাড়ি পাঠায় দিছি।”
“ঠিকাছে স্যার, যাইতেছি। এক্ষণি যাইতেছি। আস্‌সালা…মু আলাইকুম।”
“অলাইকুম, তাড়াতাড়ি যা।”

ছুটির দিন, রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি খুব তাড়াতাড়িই আসবে। ঘড়ি দেখলাম। আটটা পঁচিশ। খুব তাড়াতাড়ি রেডি হতে পারার ক্ষমতার জন্য আমি ক্যাডেট কলেজের কাছে বরাবরই কৃতজ্ঞ। পঁয়তাল্লিশের মধ্যে আমি পুরা রেডি। অফিসে ফোন করে বলে দিলাম আমার জন্য নাস্তা আনিয়ে রাখতে। রুমে তালা দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের লনের দিকে তাকাতে না তাকাতেই আমার গাড়ি এসে হাজির। ছুটির দিনের সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হল খুব তাড়াতাড়ি অফিসে পৌঁছানো যায়। কথাটা মনে হতেই আমার হাসি পেল। হুম, ভালোই বটে! সবাই যখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে আমি বেয়াক্কল তখন একা একা অফিসে যাচ্ছি। আরেকটা ভালো দিক হল, যা ইচ্ছা তাই ড্রেস পরে অফিসে যাওয়া যায়। তা তো যাবেই, কারন আমি ছাড়া আর কেউ তো অফিসে নাই। হা হা হা। এরকম শনিবার সকালে অফিস করার উপকারিতা খুঁজে বের করতে করতে আমি ওয়ার্কিং ডে’র দেড় ঘন্টার রাস্তা মাত্র পঁচিশ মিনিটে পার হয়ে অফিসের গেটে পৌঁছলাম। ওয়েটিং রুমে মাথা নীচু করে দুইজন লোককে ঝিমাতে দেখলাম। এরাই বোধহয় অভিযোগ নিয়ে আসছে। মনে মনে বললাম, “এখন ঝিমাও কেন বাবারা? আমারে ডাকার সময় মনে ছিল না যে এইটা শনিবার?” অফিসে ঢুকেই দ্রুত নাস্তা করে ওই দুজনকে ডাকতে বললাম। উনারা দুজনই ডাঃ সোহেলের বন্ধু ও কলিগ। পরিচয়পর্ব শেষে তারা বলতে শুরু করলেন ডাঃ সোহেলের হঠাৎ অন্তর্ধানকাহিনী। ডাঃ মোফাক্‌খারুল আহ্‌মেদ সোহেল, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের সার্জিক্যাল ডিপার্টমেন্টের রেজিস্ট্রার। পশ্চিম ধানমন্ডিতে তার বিশাল চার তলা বাড়ির চতুর্থ তলাতে থাকেন। বয়স পঁয়তাল্লিশের উপরে কিন্তু অদ্যাবধি অবিবাহিত। বাবা পৃথক হয়ে গেছেন অনেক আগে। মা থাকেন ছোট বোনের সাথে কানাডায়। বাড়িতে সে ছাড়া শুধু একজন কেয়ারটেকার কাম ড্রাইভার তার সাথে থাকে। এই কেয়ারটেকারের নাম সাইফুল, বয়স মাত্র একুশ বছর। ডাক্তার সাহেবের মা তাদের গ্রামের বাড়ি থেকে একদম ছোট থাকতে সম্ভবত মাত্র ৪ বছর বয়সে হতদরিদ্র পরিবারের এই ছেলেটাকে নিয়ে আসেন। তারপর থেকে এখানেই আছে সে। এরাই তার সবকিছু। ডাক্তার সাহেবকে মামা আর তার মা’কে নানী বলে ডাকে সে। অবিবাহিত ডাক্তারের জীবন অনেকটাই ছন্নছাড়া হওয়ায় ঘরবাড়ির দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব একরকম এই অতি বিশ্বস্ত সাইফুলের হাতেই ন্যস্ত। ঘর-দোরের কাজ কর্ম ও রান্নাবান্নার জন্য ছুটা কাজের লোক ও বাবুর্চী আছে। তারা এসে সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যার আগেই চলে যায়। টুকটাক রান্নাবান্না সাইফুল নিজেও করতে পারে। বেশীরভাগ সময়ই ডাঃ সোহেল সন্ধ্যার পর পর্যন্ত বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাইরে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতেন। মাঝে মাঝেই ঢাকার বাইরেও ঘুরতে যেতেন। বাড়িতে যতক্ষণ থাকতেন ডুবে থাকতেন বইপত্রের মধ্যে। এই ছিল মোটামুটি ডাঃ সোহেলের নিজস্ব ও নিঃসঙ্গ পারিবারিক জীবন। নিজের বাড়িতেও তিনি ছিলেন একরকম অতিথির মত। ‘নিজ ভূমে পরবাসী’ বলতে যা বোঝায় আর কি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭ টা নাগাদ তিনি অফিস থেকে বাসায় চলে যান। এর খানিক পরে তার কাছে দুজন মেহমানও এসেছিল। রাতে তাদের সাথে খাওয়াদাওয়ার পর তিনি নাকি তাদেরকে নীচে গেট পর্যন্ত এগিয়েও দিয়ে যান। পরেরদিন অর্থাৎ শুক্রবার সকালে আটটার কিছু আগে নাকি তিনি বাসা থেকে কি কাজে সামনে যাবার কথা বলে বাইরে বেরিয়ে যান। এর পর থেকে তিনি আর ফিরে আসেননি। ডাঃ সোহেলের বন্ধুরা এই তথ্যগুলো জানতে পারেন কেয়ারটেকার সাইফুলের কাছ থেকে। ওইসময় সাইফুল ছাড়া আর কেউ ছিলও না ওই বাড়িতে। সুতরাং তার কথাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হওয়ার কথা।

আমি সরাসরি সাইফুলের কাছ থেকেই পুরো ব্যাপারটা শোনার জন্য ওকে ডেকে পাঠালাম। ছোটখাট সাইজের হ্যাংলা পাতলা একটা ছেলে। গলার স্বর খানিকটা কর্কশ এবং চিকন। রোগা রোগা হাত পা, গালের চাপা চোপা ভাঙ্গা। দেখলেই মনে হয় ঠিকমত খেতে পায় না, অথচ ধানমন্ডির মত একটা জায়গায় একটা বিত্তশালী পরিবারের কেয়ারটেকারের চাকরী করে। সাধারণ কেয়ারটেকার বলা ভুল হবে। অনেকটা পরিবারের সদস্যের মতোই থাকে সে। হিরোইন-গাঞ্জা-টাঞ্জা টানে নাকি? সন্দেহ হল আমার। যাহোক, অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপারে কথা না টেনে আমি ওর কাছে থেকে ওইদিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি মুহুর্তে ঘটা প্রত্যেকটা ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে চাইলাম। ডাক্তারের বন্ধুদের বলা কথারই পুনরাবৃত্তি করল সে, একেবারে হুবহু দাঁড়িকমা, ফুলস্টপসহ। তবে আরো কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদের পরে এইটুকু অতিরিক্ত তথ্য পেলাম যে, ডাক্তার বের হয়ে যাবার ঘন্টাদুই পরে সে নিজেও বের হয়। তার নাকি আগে থেকে সোহেল সাহেবের কাছ থেকে ছুটি নেওয়া ছিল, গাজিপুরে তার চাচাতো এক ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য। যাবার সময় সে বাসার চাবি দারোয়ানের কাছে রেখে যায়। এইখানে কথাপ্রসঙ্গে আরো জানতে পারলাম যে বাড়িতে দুজন দারোয়ানও আছে। পালাক্রমে ডিউটি করে। তবে একজন ছুটিতে থাকায় আপাতত রহমত মিয়া একাই ডিউটি করতেছে। সুতরাং কেউ গেট দিয়ে বের হলে এই দারোয়ানের অবশ্যই জানার কথা। দারোয়ানকেও আলাদাভাবে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম। জানা গেলো সে কিছু দেখেনি। তবে তাকে নাকি একেবারে ভোরবেলায় সাইফুল বাইরে পাঠিয়েছিল ডাক্তার সাহেবের জন্য সিগারেট আনতে। ওই সময়টা সে গেটে ছিল না। একটু খটকা লাগল মনের মধ্যে; ভোর বেলায় সিগারেট! কেন? আমার কাছে সাইফুল এই কথা বলল না কেন? আবার মনে হল, হয়তো অপ্রাসঙ্গিক বলেই বলেনি।
“তুমি ডিউটি শেষ করে ঘুমাইতে গেছিলা কয়টার সময়?”
“রাইত বারোটায় ছার।”
“সকালে উঠছিলা কয়টায়?”
“উই যে ছার সিগারেট আনতে উঠছিলাম।”
“তাইলে তো তোমার দেখার কথা কখন ডাক্তার সাব বাইরে বের হল।”
“তা ঠিক ছার। কিন্তু আমি নাস্তা করতে খানিক সময় ভিতরে গিছিলাম। ওই টাইমে মনে হয় বাইর হইছে।”
“আর কিছুই দেখো নাই তুমি? ভালো করে মনে কর ব্যাটা।”
“ও ছার, এট্টা জিনিশ মনে হইছে। সাইফুল ভাই সকালের দিকে একবার গাড়ি নিয়ে বাইর হইছিল।”
“একাই বের হইছিল?”
“জ্বে স্যার। আবার ঘন্টাখানিক পরেই ফিরা আইছে।”
আমার খটকাটা আরেকটু বাড়ল। কারন জিজ্ঞাসাবাদের সময় এই কথাটাও আমার কাছে সাইফুল গোপন করছে। অথচ আমি তাকে বলেছিলাম কাটায় কাটায় সেকেণ্ড মিনিট ধরে ধরে প্রত্যেকটা ঘটনা আমাকে বলতে। আমি আবার সাইফুলকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। সে একেবারেই ভুলে গেছিল এমন ভাব করে বলল যে ডাক্তার সাহেব নাকি অনেকসময়ই রাত জেগে পড়াশোনা করে, সেক্ষেত্রে তার গভীর রাতে এমনকি ভোর বেলায় মাঝেমাঝে সিগারেট শেষ হয়ে গেলে আবার সিগারেট এনে দিতে হয়। আর গাড়ি নিয়ে বাইরে যাবার কথা জানতে চাওয়াতে সে বলল যে কারওয়ানবাজারে ভোর বেলায় ভাল মাছ ওঠে; সেই মাছ কেনার জন্য সে এত সকাল সকাল নাকি বেরিয়েছিল। সকালে রিক্সা পাওয়া কঠিন আর যেহেতু সে নিজেও ছুটিতে যাবে তাই তাড়াতাড়ি করার জন্য সে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল। আমি চুপচাপ শুনলাম। সাইফুল যা যা বলল তা বিশ্বাসযোগ্য। এমন তো হতেই পারে। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ওকে চলে যেতে বললাম। কিন্তু মনের সেই খটকাটা আমার কিছুতেই দূর হল না।

ছোটবেলায় রহস্য-রোমাঞ্চ বা গোয়েন্দা গল্প-উপন্যাস পড়তে গিয়ে অনেকবার খেয়াল করেছি, ফেলুদা বা কিরীটী রায় আশেপাশে কাউকেই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেয় না, আর দেখা যায় যাকে মোটেও সন্দেহ করা যায় না এমন একজনই আসল অপরাধী। আমি আগেও আপনাদেরকে এক জায়গায় বলেছি, গল্প-উপন্যাসের উপাদান মানুষ তার জীবন থেকেই সংগ্রহ করে। নিজে থেকে তৈরী করতে পারে না। বাস্তবে অসংখ্যবার একই ধরণের কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, ঘটনাটা গল্পের বইয়ের মতো সবসময়ের জন্য একইরকম না হলেও অনেকক্ষত্রেই ব্যাপারটা খেটে যায়। আমার ‘মিতাপু’ গল্পটিতেও হয়তো লক্ষ্য করেছেন যে যারা এমনকি আমার মিজান দুলাভাইয়ের জানাজা নামাজে অংশ নিয়েছে তাদের মধ্যেই কেউ কেউ ছিল তার প্রকৃত খুনী। যাই হোক, যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম; ঘটনার আগে-পিছে, ডানে-বামে, সামনে-আঁড়ালে সবাইকেই মোটামুটি সাস্‌পেক্ট করা এবং প্রয়োজনবোধে শুরুতেই দীর্ঘ একটা সন্দেহের তালিকা তৈরী করা আমার কাছে প্রায়শই বেশ কার্যকরী পন্থা বলে মনে হত। এবারও তাই করলাম। তালিকা তৈরী করলাম। বিশেষ এক পদ্ধতিতে ঘটনার দিন ও তার আগে পরের কয়েক দিনে সবার গতিবিধি ও অবস্থান বের করার চেষ্টা করতে শুরু করলাম। দারোয়ান, রাতে আগত অতিথি, সাইফুল, এমনকি ডাক্তার সোহেল কাউকেই এর থেকে বাদ দিলাম না। সব তথ্য উপাত্ত হাতে পাওয়ার পরে পুরো একদিন নিজের রুমে ঘাপটি মেরে বসে সেগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ শুরু করলাম। ঘাটাঘাটি করতে করতে খুব আশ্চর্যজনক কিছু ফাইন্ডিংস্‌ বেরিয়ে এল। আমার চোখের সামনে বিদ্যুত চমকাতে লাগল। আশার আলোর ঝলকানি, হাজারো সন্দেহের মেঘ, সাথে ভয়ানক কিছু শংকা সব একসাথে কুন্ডলী পাকাতে লাগল। দারোয়ান বা সোহেল সাহেবের গেস্টদের ব্যাপারে খুব অস্বাভাবিক কিছু জানা গেল না। ডাক্তার সাহেবের দুটি অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পেলাম; সকালের দিকে গাবতলী, আর সন্ধ্যার দিকে একেবারে তার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধাতে। খুবই অবাক হলাম। কিন্তু পুরোপুরি হতবাক হলাম এই দেখে যে, আমাদের সাইফুল মিয়া গাজিপুর গেছে ঠিকই, কিন্তু তার আগে কমপ্লিট একটা দিন সেও ছিল গাইবান্ধাতেই!!! ওই একই সময়ে!! আমি মাথা চেপে ধরে রকিং চেয়ারে দোল খেতে খেতে ভাবতে লাগলাম। নিজের অজান্তেই বার বার আওড়াতে কাগলাম আমার প্রিয় একটা ডায়লগ, “ডাল মে কুছ্‌ কালা হ্যায়… সাইফুল… আ-যা মেরা দোস্ত্‌।”

পরদিন অফিসে গিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে সাইফুলকে আমার অফিসে আসার জন্য অনুরোধ করলাম। আমি কাউকে পাঠালামও না ওকে ধরে আনার জন্য। কারন আমি জানতাম ও এমনিতেই আসবে। আর ও ঠিকঠাকমত চলেও আসল, একেবারে আমার দেওয়া সময় মতোই। কারন ও খুব ‘সেয়ানা’। আর ও নিজেকে যতটা সেয়ানা মনে করে তার চাইতে অল্প একটু বেশী সেয়ানা হচ্ছি আমি। প্রায় পুরো ব্যাপারটা আমার সামনে খুব অস্পষ্টভাবে এসে দাঁড়িয়েছে, যেন জানালার ঘষা কাঁচের এপাশ থেকে আমি ওপাশের কাউকে দেখছি। সাইফুলকে সামনে বসিয়ে খুব ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করা শুরু করলাম। ওর গাইবান্ধা যাবার কাহিনী ও রহস্য জানতে চাইলাম। ও আমার দিকে এমন একটা চাহনি দিল যেন জিবরাঈল ফেরেশতা ওকে এইমাত্র আকাশ থেকে আমার অফিসের সামনে ড্রপ করে দিয়ে গেছে। এইবার আমি একটু মুখ গোমড়া করে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করতেই ও হড়বড় করে একগাদা মিথ্যা কথা বলতে শুরু করল। সে নাকি তার কোনো এক প্রেমিকার সাথে গোপন অভিসারে মিলিত হতে গাইবান্ধা গেছিল, তাই আমার কাছে বলেনি। আ…হা হা… সে এক বিরাট ‘গরু’র রচনা। কখনো গরু নদীর কাছে আসে, আবার কখনো নদী গরুর কাছে যায়। আমার খুব হাসি পেল। কারন ঘটনার এই সিকোয়েন্সটা আমার বেশ পরিচিত। মিথ্যা কথা অনেকই বলা যায়, কিন্তু তীক্ষ্ণ একেকটা প্রশ্ন যখন বুলেটের গতিতে আসতে থাকে তখন মিথ্যার ঢাল দিয়ে তাকে ঠেকানো যায় না। খুব সহজে প্রমাণ হয়ে গেল যে ও যা যা বলছে সবই মিথ্যা। আমার হাতে তখন সময় কম। ওকে জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব অন্য লোকের হাতে দিয়ে আমি আমার কলিগকে নিয়ে দ্রুত গাইবান্ধার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। (দ্বিতীয় খন্ডে সমাপ্তব্য… চোখ রাখুন ‘সিসিবি’র রঙ্গিন পর্দায়)

২,৬৪৩ বার দেখা হয়েছে

৩২ টি মন্তব্য : “নরকবাস – ৫”

    • সাজিদ (১৯৯৩-৯৯)

      ভালো আছি ভাবী। ঈদ খুবই বোরিং কেটেছে। কিছুদিন যাবৎ প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে, সিসিবি'তে ঢোকারই সময় পাইনা। পরের পর্ব ইনশা আল্লাহ কয়েকদিনের মধ্যেই দিতে পারব বলে আশা করি।


      অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক,
      জ্যোস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,
      কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।

      জবাব দিন
  1. তৌফিক (৯৬-০২)

    পত্রিকায় ঘটনাটা দুই তিন ধরে পড়েছিলাম। অনেকটা লাইভের মতো। আপনিই যে তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন কে জানত! অধীর আগ্রহে পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করে রইলাম। 🙂

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    অপেক্ষায়...

    বস কিছু ডাউট দেই, মনে কিছু না নিলে...
    অয়োময়’ নাটকের ‘কাজী মোহম্মদ রমজানে... অয়োময় না সংশপ্তক?

    বন্যা মির্জা’র রবিন্দ্রসঙ্গীত... বন্যা মির্জা না রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা?

    ডাউটের জন্য আগেই :frontroll:
    বাসী ঈদ মোবারক 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. হাসনাইন (৯৯-০৫)
    আমি আগেও আপনাদেরকে এক জায়গায় বলেছি, গল্প-উপন্যাসের উপাদান মানুষ তার জীবন থেকেই সংগ্রহ করে। নিজে থেকে তৈরী করতে পারে না। বাস্তবে অসংখ্যবার একই ধরণের কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, ঘটনাটা গল্পের বইয়ের মতো সবসময়ের জন্য একইরকম না হলেও অনেকক্ষত্রেই ব্যাপারটা খেটে যায়।

    এক্কেবারে সহমত ভাই।
    সাইফুলের খবর হইছে মনে হয়, মুখে-পিঠে কয় টন পড়ছে কে জানে। 😡
    পরের পর্বের অপেক্ষায়। 🙂

    জবাব দিন
  4. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    তোমার লেখার ধরণটা মজা লাগে। নিজের উপস্থিতি আড়াল করো না বলেই হয়তো। ভবিষ্যতে বই আকারে করার চিন্তা রাখতে পারো। :thumbup:


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ইফতেখার (৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।