নরকবাস-৪

মিতাপু

এক।
‘আমার আপন কোন বোন নাই’, বাল্যকালে বুকের মধ্যে এই চাঁপা দুঃখটা ক্ষণে ক্ষণে জানান দিয়ে উঠতো; বিশেষ করে যখন ছোটভাইটাকে দিয়ে রাতে আমাদের শোয়ার খাটের মশারী টাঙ্গানো এবং সকালে বিছানা গোছানো এই দুইটা দুঃসাধ্য কাজ করিয়ে নেবার জন্য আমাকে বিস্তর ফন্দিফিকির করতে হত; অতঃপর সব ছলচাতুরী ব্যর্থ হবার পর কাজগুলো নিজেকেই করতে হত। আদর্শবান শিক্ষক পিতা-মাতার সন্তান হওয়ায় এবং মা-বাবা দুজনেই চাকুরীজীবি হওয়ায় অনেক ছোট থেকেই নিজের সব কাজ আমাকে নিজের হাতে করতে হত। এমনকি আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে গন্ডায় গন্ডায় কাজের লোক না থাকায় সংসারের অনেক কাজেও মা’কে সাহায্য করতে হত। তখন মাঝে মাঝেই মনে হত, “আহারে! একটা ছোট বোন থাকলে আমাকে এত ঝামেলা পোহাতে হত না।” কারন নানাবাড়িতে দেখতাম আমার থেকে বয়সে অল্প বড়, আমার ছোট খালা কি সুন্দর রেগুলার টু-পাইস ইনকাম ও এটা ওটা গিফ্‌টের বিনিময়ে হাসিমুখে আমার তিন মামা’র নানারকম ফাইফরমাস খাটছে। আর আমি কিছু করতে বললেই রেডিমেড মুখ ঝাম্‌টা দিয়ে বলত, “তোর কাজ কেন করব? তুই কি আমার বড়ভাই?” আমি আবারো মাথায় হাত দিয়ে বসে ভাবতাম, “আহারে! ‘বোনের ভাই’ হওয়ার কতই না মজা।” আমি অবশ্য আমার ছোট ভাই জন্মানোর আগে খুব আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কিন্তু ছোটটা শেষমেশ ‘ভাই’ হওয়ার পরে ‘ছোট পরিবারই যেহেতু সুখী পরিবারের মূলমন্ত্র’, সেহেতু আমাকে ছোট একটা বোনের আশা একেবারেই পরিত্যাগ করতে হল। এব্যাপারে একবার অভিযোগ করাতে অবশ্য আমার বাবা আমাকে স্বান্তনা দেবার জন্য বলেছিল এও মন্দের ভালো যে ছোটবোনের জন্য আমার যে অবৈতনিক দারোয়ান কাম বডিগার্ডের চাকরী করতে হত তা থেকে অন্তত আমি রেহাই পেলাম। কিন্তু এতে কি আর মনের দুঃখ যায়? ‘বোন’ তো ‘বোন’ই। আমি তাই এইবার এদিক সেদিক হাতড়াতে লাগলাম বোনের খোঁজে। কাজিনদের মধ্যে আমার সমসাময়িক কেউ নাই। সবাই আমার চাইতে হয় অনেক বড় নাহয় অনেক ছোট। তবে আমার মেজোচাচার মেয়ে মিতা আপু এদের মধ্যে বয়সে আমার কাছাকাছি; পাঁচ বছরের বড়। উনাকে অবশ্য আমি অনেক কারনেই পছন্দ করতাম। প্রথমত উনার মিষ্টি ঠান্ডা স্বভাব, দ্বিতীয়ত উনি দেখতে এতই সুন্দরী যে আমার সবসময়ই আফসোস হত আমি কেন যে উনার আপন ভাই হলাম না তাহলে আমার চেহারাটা হয়তো এত খারাপ হত না। এই মনোকষ্টের কথা আমি একবার সরলচিত্তে আমার আম্মুকে বলতে গিয়ে রামধমক খেয়েছিলাম। উনারা থাকতেন আমাদের গ্রামের বাড়িতে। আমি পালা-পার্বনে গ্রামে গেলেই মোটামুটি সুপার গ্লু’র মতো উনার সাথে লেগে থাকতাম। আমিও কিছুদিন পরে খুব হৃষ্টচিত্তে খেয়াল করলাম যে, উনি উনার বড়ভাইদেরকে খুব একটা পাত্তা দেয়না। বরং আমাকেই আড়ালে ডেকে লুকিয়ে লুকিয়ে উনার জলপাই আচার, আমসত্ত্ব, চালতা মাখা, বরই চাট্‌নী ইত্যাদির ভাগ দিত। গর্বে আমার বুকের ছাতি ফুলে সাত হাত। আমাকে উনি কখনো শুধু নাম ধরে ডাকতেন না। নামের পিছে একটা মিয়া যোগ করে বলতেন, ‘উপল মিয়া’। আমার মা’ও নিজের কোন মেয়ে না থাকার কারনেই হয়তো উনাকে অসম্ভব পছন্দ করতেন। মাঝে মাঝে গ্রাম থেকে আসার সময় উনাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসতেন আবার কিছুদিন পরে উনার বড় ভাই এসে নিয়ে যেত। ক্লাস সেভেনে উঠে ক্যাডেট কলেজে চলে যাবার পরে আমার আরো মজা হল। কারন আমার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ। ছুটি হলে আগে চলে যেতাম গ্রামের বাড়িতে, দুই দিন থেকে তারপর বাসায় যেতাম।

দুই।
এই মিতা আপার বিয়েও আমার আম্মুই ঠিক করেছিল। বিরাট ঝামেলা তৈরী হল উনাকে বিয়ে দেয়া নিয়ে। কারন উনার যখন বিয়ের বয়স হল তখন উনি প্রায় ৫ ফুট সাড়ে ৮ ইঞ্চি লম্বা। উনার ছবি দেখে পঙ্গপালের মত ছেলেরা এসে ভীড় করে এবং হাইট দেখে লজ্জায় অপমানে মুখ কালো করে চলে যায়। অনেক খোঁজাখুজি করেও যখন কমপক্ষে উনার সমান লম্বা কোন উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গেল না তখন বাধ্য হয়েই উনার থেকে এক ইঞ্চি ছোট জামাইয়ের সাথেই উনাকে বিয়ে দেয়া হল। আমার আম্মু খুব আগ্রহ করে এই সম্বন্ধটা ঠিক করেছিলেন, কারন জামাইয়ের বাড়ি ছিল খুলনার খালিশপুরে। আমাদের বাসার কাছে, তাই যখন তখন তাঁর আদরের এই মেয়েটিকে তিনি দেখতে পাবেন। আমি চাকরীর কারনে বিয়েতে হাজির থাকতে পারিনি। তবে ছুটিতে এলে উনার বাসায় যাওয়া হত আমার অনেকবার। অনেকখানি জমিসহ বড় পুকুরওয়ালা ফলের বাগানঘেরা পুরানো একটা দোতলা বাড়ি ছিল দুলাভাইদের। ঐ বাড়িতে গেলে আমার সময় যে কিভাবে কেটে যেত টের পেতাম না। এক বছরের মাথায় মিতাপু’র ফুটফুটে একটা মেয়ে হল। তার দুই বছর পরে একটা ছেলে। মামা হবার পর ভাগ্নে-ভাগ্নী’র টানে আমি আরো বেশী করে উনাদের বাসায় যেতাম। মিজান দুলাভাইয়ের ছিল পাইকারী মালামালের ব্যবসা, প্রধানত খাদ্যশস্যের। একটা গোডাউনও ছিল। ব্যবসা চলছিল তুমুল গতিতে। আর মিতাপু’র সংসার সুখে সমৃদ্ধিতে টইটম্বুর হয়ে ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল। দুলাভাই ছিলেন যতটা অমায়িক, ঠিক ততোটাই রসিক। আমার সাথে বন্ধুর মত তুই-তোকারি করে কথা বলতেন আর আশেপাশে আপু না থাকলে নীচু গলায় ফিস্‌ফিস করে মেয়েদের প্রসঙ্গে কথা বলতেন; যেমনঃ মেয়েদের কি দেখলে কি বোঝা যায়? কোন টাইপের মেয়ে কি রকম হয়? ইত্যাদি ইত্যাদি মেয়ে বিষয়ক সাধারণ জ্ঞানের চর্চা আর কি। আবার কথাশেষে ওয়ার্নিং দিতেন, “খবদ্দার তোর আপুরে কলাম এইসব আবার কতি যাইস্‌নে। এসব কতা তোর আর আমার শালা-দুলোবাই সিক্রেট। বুজ্‌লি?” এইসব সিক্রেট ব্যাপারগুলোর কারনেই আমি উনাকে আরো বেশী পছন্দ করতাম। আমার ঐ বয়সে এমন রসের আলাপ কেই বা অপছন্দ করে?

তিন।
২০০৫ সালের মার্চ মাসে আমি ছিলাম চট্টগ্রামে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণে। পড়াশোনা ও কাজের প্রচন্ড চাপ। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নাই। একদিন দুপুরে খাওয়ার পরে রুমে আসতেই আমার বাবা’র ফোন পেলাম। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমার বাবা কোনরকমে আমাকে জানালো যে কে বা কারা নাকি মিজান ভাইকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করেছে। উনার জবাই করা লাশ পাওয়া গেছে ওইদিন সকালে। উনি আর কিছুই বলতে পারলেন না। আমি ফোন হাতে হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম। চট্টগ্রামে আসার কয়েকদিন আগেই আমি উনার সাথে একদিন দুপুরে খেয়েছি। ওইদিনের দৃশ্যগুলো আমার চোখের সামনে টিভি’র পর্দার মত ভাসতে লাগল। এরপর ফিল্মের মত সারি বেঁধে আমার চোখের সামনে নাচতে লাগল মিতাপু, মৌলি আর মুন্না’র চেহারাগুলো। ওদের ছবিগুলো একের পর এক আসছে, কান্নার ছবি, হাসির ছবি, একের পর এক, মৌলি-মিতাপু-মুন্না, মিতাপু-মুন্না-মৌলি, একের পর এক। আমার প্রচন্ড কান্না পেতে লাগল। এবং আমি কেঁদে ফেললাম, আমার বাবার মত হাউমাউ করে।

চার।
তাৎক্ষণিক শোক কাটিয়ে ওঠার পর ছুটির জন্য গেলাম ট্রেনিং ইনচার্জ এর কাছে। সে সাফ জানিয়ে দিল, ট্রেনিং এর এই শেষের দিকে এসে ছুটি নিলে এই ট্রেনিংয়ে আমি ফেল করব। কারন মূল পরীক্ষাগুলো সব শেষের দিকে। বাসা থেকেও আমাকে বলল যে আমি এখন ছুটি আসা আর এক সপ্তাহ পরে আসা একই কথা। কারন যা হয়ে গেছে তাকে আমি তো আর ছুটিতে গিয়ে ফেরাতে পারব না। আর এ ঘটনার প্রেক্ষিতে যা যা করণীয় তা আমি পরেও করতে পারব। তারচেয়ে বরং আমি যেন আপাতত বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে খুনীদেরকে খুঁজে বের করার বিষয়ে তাগাদা দেই। ওইসময় আপাতত আমি তাই করতে লাগলাম। পরে ছুটিতে গিয়ে খুনের ঘটনা নিয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে যে পৈশাচিক বর্বরতার বিবরণ পেলাম তা মনে করলে আজো আমার গা শিউরে ওঠে।

পাঁচ।
মিজান ভাইয়ের ব্যবসাটা ছিল বাকি টাকা নির্ভর। অর্থাৎ ব্যবসার খাতিরে তিনি প্রচুর লোককে বাকিতে মালামাল দিতেন, তারা মালামাল বিক্রি করে ধীরে ধীরে তার টাকা পরিশোধ করে দিত। উনি যাদের সাথে ব্যবসা করতেন তাদের মধ্যে গফুর এবং হান্নান নামে দুইজন এই টাকা পরিশোধের ব্যাপারে ছিল খুবই অনিয়মিত। ফলে অনেকদিন ধরে একটু একটু করে এই দুজনের কাছে দুলাভাইয়ের প্রায় আঠারো লাখ টাকা বাকি পড়ে যায়। দুলাভাই বহুবার তাগাদা দেবার পরেও তারা বাকি টাকা শোধ না করায় উনি একসময় এদেরকে মাল সাপ্লাই দেওয়া বন্ধ করে দেন। এতে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে নানাভাবে হুমকি দেওয়ার চেষ্টা করলে উনিও পাল্টা ওদেরকে বাকি টাকা আদায়ের জন্য মামলা করে দেবার হুমকি দেন। এই হুমকিটাই উনার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এবার তারা আর হুমকি ধামকি না দিয়ে সরাসরি কাজে নেমে পড়ে। এলাকার কুখ্যাত খুনী ডাকাত বাবুকে ভাড়া করে উনাকে খুন করানোর জন্য। এদিকে দুলাভাইকে ফোন করে অনুরোধ যে সে যেন দয়া করে মামলা-টামলা না করে, তারা দুই দিনের মধ্যে পাওনা টাকার মধ্যে নগদ ১০ লাখ টাকা তাকে পরিশোধ করে দেবে, আর বাকি টাকা সপ্তাহখানেক পরে দেবে। একটু পরে আবার ফোন করে তাকে পরেরদিনই দৌলতপুর স্টেশনের কাছে হাটখোলা বাজারে একটা পাটের গদিঘরে টাকা নেওয়ার জন্য যেতে বলে। শুধু তাই না, তিনি যাতে পথিমধ্যে কারো সাথে কোন যোগাযোগ না করতে পারেন বা তিনি কোন সতর্কতা অবলম্বন করলে তারা যাতে তা আগে থেকে টের পায় সেজন্য তাকে নজরদারি করে নিয়ে আসার জন্য একজন লোককেও তার বাসায় পাঠায়। এক্ষেত্রে অজুহাত দেখায় যে গদিঘর পর্যন্ত রাস্তা নাকি খুব প্যাঁচালো, মিজান ভাই চিনতে পারবেন না। ঘটনাক্রমে যে লোকটা মিজান ভাইকে বাসা থেকে নিয়ে যাবার জন্য আসে তার সাথেই তিনি একসময় রেগুলার খালিশপুরের বড় মাঠে ফুটবল খেলতেন। তার নাম ছানাউল। ওইদিন ছানাউল দুপুর একটার দিকে উনাদের বাসায় আসে। মিতাপু দুলাভাইয়ের সাথে বসিয়ে খুব যত্ন করে তাকে নিজের হাতে ভাত বেড়ে খাওয়ায়। হাজার হলেও দুলাভাইয়ের একসময়ের খেলার সাথী। আহারে! সে যদি একটুও টের পেত, এই লোকটাই একটু পরে তার স্বামীকে নিয়ে খুনীদের হাতে তুলে দেবে। হাটখোলা বাজারে পৌঁছলে গফুর ও হান্নান তাকে সাদরে রাস্তা থেকে গদিঘরের ভেতরে নিয়ে যায়। ভেতরে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল খুনীরা; উনি ভেতরে ঢোকামাত্রই চারপাশ থেকে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এসময়ের বিভিন্ন দৃশ্যের বিবরণ জানতে পারি পরবর্তীতে এই কেসের একমাত্র জীবিতাবস্থায় ধরা পড়া আসামী ছানাউলের কাছ থেকে। মিজান ভাইকে প্রথমে ওরা গলায় ফাঁস লাগায়। উনার প্রচন্ড শক্তির সাথে ধস্তাধস্তিতে ওরা চারজন মিলেও নাকি পেরে উঠছিল না। ধস্তাধস্তির সময় উনি নাকি বারবার কাকুতি মিনতি করে বলছিলেন, “ওরে তোগের দোহাই লাগে, আমার দুইখেন ছোট ছোট বাচ্চা আছে, ওগের এতিম করিস্‌নে। তোরা চালি এমনিই তো আমি তোগের বিশ লাক টাহা দিয়ে দিতি পারি। ওরে আমারে মারিস্‌নে।” কিন্তু এত কথা শোনার সময় হয়তো তাদের হাতে ছিল না। তাই এসময় তারা উনার পেছন থেকে পিঠে ও মাথায় ছোরা ও চাপাতি দিয়ে উপর্যুপরি কোপানো শুরু করে। একসময় উনি নিস্তেজ হয়ে এলে উনার গলায়ও চাপাতি চালায়। নৃশংসতার এখানেই শেষ না। এইবার খুনীরা যা করে তাতে তাদের পেশাদারিত্বের পরিচয় মেলে। আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন যে আমাদের দেশে পুলিশের মধ্যে অনেকগুলো ভাগ আছে; যেমনঃ জেলা পুলিশ, মেট্রোপলিটান পুলিশ, র‌্যাব, আর্ম্‌ড্‌ পুলিশ ইত্যাদি। এছাড়া স্থানভেদেও পুলিশের কিছু প্রকারভেদ আছে; যেমনঃ জেলখানা পাহারা দেওয়ার জন্য জেলপুলিশ, রেলস্টেশন ও রেলওয়ে এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য রেলপুলিশ। এদের মধ্যে কাজে কর্মে সবচাইতে ঢিলা ঢালা হচ্ছে রেলপুলিশ। নিয়ম হচ্ছে কোন অপরাধ সংঘটনের ঘটনাস্থল যার আওতায় পড়বে তার অধীনেই সেই অপরাধের জন্য মামলা হবে। সুতরাং রেলস্টেশন, রেললাইন বা প্লাটফর্ম এলাকায় যদি কোন খুন হয় তবে সেই মামলার তদন্তও হয় রেলপুলিশের অধীনে এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এইসব মামলার ভবিষ্যত কি হয় তা আপনারা বুঝতেই পারছেন।

ছয়।
ডাকাত বাবু বহু মামলায় বহু বছর জেলখাটা আসামী। সুতরাং খুনী হিসেবে তার অভিজ্ঞতা ও পেশাদারিত্ব যে উঁচুমানের হবে তা বলাই বাহুল্য। তারা সন্ধ্যার পরে মিজান ভাইয়ের লাশ বস্তাবন্দী করে নিয়ে যায় রেললাইনের নির্জন এক জায়গায়। তারপর চলন্ত ট্রেনের নীচে লাশ ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে খন্ড খন্ড করে কাটে। খুন আসলে কোথায় হয়েছিল তার যেহেতু কোন প্রমান নেই, সেহেতু লাশ উদ্ধারের স্থান অনুসারে মামলাটা রেলপুলিশের অধীনেই হয়েছিল। মিজান ভাইয়ের লাশ যখন উদ্ধার করা হয় তখন তার ডান হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, পেট বরাবর শরীরটা দুটুকরো করে কাটা ছিল, গলায় শক্ত রশি দিয়ে ফাঁস বাঁধা ছিল, মাথায় ও পিঠে ছিল ধারালো অস্ত্রের অসঙ্খ্য জখমের চিহ্ন আর বাম পা টা খুঁজেই পাওয়া যায়নি। উনার লাশ উদ্ধারের একদিন পরে এক কৃষক রেললাইনের পাশে তার ধানক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে তার বাম পা টা খুঁজে পায়। এদিকে গফুর ও হান্নান গিয়ে মিজান ভাইয়ের অফিস থেকে তাদের সাথে পাওনা টাকা সংক্রান্ত যাবতীয় দলিল ও ভাউচার গায়েব করে ফেলে। এসব ঘটনা শুনে আমার খুব আক্ষেপ হতে লাগল। কারন আমি উনাকে অনেকবার বলেছি উনার এইসব দেনাপাওনা সংক্রান্ত সমস্যাগুলো আমার সাথে শেয়ার করতে। কিন্তু উনি এমনকি মিতাপু’কেও উনার ব্যবসার ব্যাপারে কিছুই বলতেন না। আর শ্বশুরবাড়ির কারো কাছ থেকে কোন সহায়তা নেবার ব্যাপারে উনার মারাত্বক ইগো প্রব্‌লেম ছিল। তাই তিনি আমাকেও কিছুই জানাননি। এই গফুর এবং হান্নান আবার তার জানাজাতেও অংশগ্রহন করে। তখন পর্যন্ত কেউ সামান্যতমও আঁচ করতে পারেনি যে কে বা কারা এই ঘটনাটা ঘটিয়েছে।

সাত।
এই খুনের সাথে জড়িত সবাই ছিল পেশাদার খুনী ও ডাকাত এবং দুই বা ততোধিক খুন ও ডাকাতি মামলার আসামী। ঘটনার চার মাসের মধ্যেই জড়িত মোট চারজন বিভিন্ন সময়ে র‌্যাব ও ডিবি’র সাথে এন্‌কাউন্টারে মারা পড়ে। একজন জীবিতাবস্থায় ধরা পড়ে। মিতাপু অবশ্য স্বাভাবিক নিয়মেই কেস চালিয়ে যাচ্ছিল। আমি ঢাকা থেকে ফোনে এব্যাপারে মিতাপু’র সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম। পরের ছুটিতে আমি সরাসরি মিতাপু’র বাসায় গেলাম। বাসায় ঢুকেই বৈধব্যের অলংকারহীন হালকা একরঙ্গা কাপড়ে মিতাপু’কে দেখে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। উনিও অনেক্ষণ কাঁদলেন। একটু শান্ত হবার পরে উনি বললেন, “উপল মিয়া, আমারে এক জাগায় নিয়ে যাবি?”
“কোথায়?”
“চল্‌, তারপর দেখিস্‌কেনে।”
আমি আর মিতাপু বেবীতে করে দৌলতপুরে এসে রিক্সা নিলাম। রিকশাওয়ালাকে উনি দৌলতপুর স্টেশনে যেতে বললেন। স্টেশনে নেমে আমরা রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে নতুন কালভার্ট নামে জায়গাতে এসে থামলাম। একটা জায়গায় এসে উনি হঠাৎ লাইনের স্লিপারের উপরেই বসে পড়লেন। বিড়বিড় করে কি যেন বলতে বলতে রেললাইনের উপরে হাত বোলাতে লাগলেন। আমার চোখ ভেঙ্গে আবার পানি আসতে লাগল। এদিকে স্টেশনে একটা ট্রেন ছাড়ার হুইসেল শুনতে পেলাম। আমি তাড়াতাড়ি উনাকে ধরে লাইনের উপর থেকে সরিয়ে আনলাম। সেই থেকে আমার মিতাপু আজো অব্দি কোনদিনই আর ট্রেনে চড়েননি।

৭,১৫৭ বার দেখা হয়েছে

৫৮ টি মন্তব্য : “নরকবাস-৪”

    • সাজিদ (১৯৯৩-৯৯)

      মিতাপু'র দুই বাচ্চাই বিশেষ করে ছেলেটা অসম্ভব মেধাবী। তার বাবা একদিন আমাকে দেখিয়ে তাকে বলেছিল যে মামা'র মত ক্যাডেট কলেজে পড়তে হবে। ঐটুকু বাচ্চা সেই কথা মনে করে নিজে নিজে পড়ে। মাশা'আল্লাহ্‌।


      অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক,
      জ্যোস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,
      কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।

      জবাব দিন
  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    আমার মতে এদের জন্য ক্রস্ফায়ার জায়েজ।আমাকে স্যাডিস্ট বলেন আর যা-ই বলেন,আমার আফসোস একটাই-ওই আসামীদেরকেও একইভাবে মারা হলে ন্যায় বিচারটা ঠিক মত হত।

    লেখা নিয়ে কি বলব-নতুন কিছু বলার নেই।নীলপদ্ম ভাই বোনের অভাবের কথা অসম্ভব মিষ্টি করে ফুটিয়ে তুলেছেন-এর ফলে পরবর্তী বীভৎসতাটা যেন আরো প্রকট হয়ে অন্তরে লেগেছে।

    x-( x-( আর নিজের চেহারা লেখকের মন্তব্য ডাহা চাপা x-( x-(

    জবাব দিন
  2. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    অক্ষম আক্রোশ ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনা দেখে মাঝে মাঝে নিজের উপর ঘৃনা এসে যায়।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  3. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    অসম্ভব মন খারাপ করা একটা লিখা। লেখাটা নিয়ে কী বলব!! কিছু বলতে পারছি না।
    নিজের কিছু কথা শেয়ার করি। মিতা নামে আমারও এক আপু ছিলেন। আমার নিজের আপন বোন নেই। আর ছোট বেলা থেকেই আমরা পাঁচ কাজিন একত্রে বড় হয়েছি। সো আপন বোন না হলেও আপনের চেয়ে কোন অংশে কম ছিলেন না আমার মিতাপু। আজ থেকে প্রায় পৌনে দুই বছর আগে ২০০৭ সালে নিজের দুই জমজ সন্তানকে জন্ম দিতে গিয়ে তিনি চলে যান। অকালে হারিয়ে যাওয়া আপুর জন্য কষ্ট বাড়ে তার জমজ ছেলে দুটিকে দেখলে। আপনার গল্প পরে নামটাই বড় বিঁধলো। মিতা নামের সাথেই কি কান্না মিশে থাকে???
    পরিচিত কাউকে "মিতা" নামটি রাখতে দেবো না কখনো.......

    জবাব দিন
  4. ভাইয়া, আপনার "নরকবাস" খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি। আপনার লেখনী অসম্ভব শক্তিশালী।
    এ পর্ব পড়ে মিতাপু'র জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেল। আপু আর বাচ্চাদের জন্য শুভকামনা। দোয়া করি, আল্লাহ তাদের সহায় হোন।

    জবাব দিন
  5. আব্দুল্লাহ্‌ আল ইমরান (৯৩-৯৯)
    মিতাপু দুলাভাইয়ের সাথে বসিয়ে খুব যত্ন করে তাকে নিজের হাতে ভাত বেড়ে খাওয়ায়। হাজার হলেও দুলাভাইয়ের একসময়ের খেলার সাথী। আহারে! সে যদি একটুও টের পেত, এই লোকটাই একটু পরে তার স্বামীকে নিয়ে খুনীদের হাতে তুলে দেবে।

    সব মানুষের মধ্যে দুইটা সত্তা আছে-মনুষত্ব আর পশুত্ব। পশুরাই পারে এরকম করতে।অন্যের ঘটনা শুনলে সেগুলো কাহিনী মনে হয় কিন্তু নিজের কাছের কারো ঘটনা শুনলে সেটি আর কাহিনী থাকেনা সেটি হয় বাস্তবতা।আর বাস্তবতার কাছে আমাদের আবেগ বারবারই পরাজিত হয়।তোর 'নরকবাস' আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি।এইটা পড়তে গিয়ে বাস্তবতার কষাঘাতে চোখ ভিজে গেল।লাস্ট কেঁদেছিলাম আমার ফ্রেন্ড সাখাওয়াতকে নিয়ে ফ্রেন্ডশীপ ডে'র ব্লগ লিখতে গিয়ে। :((
    আমার বড় খালার দুই মেয়ের জামাই মারা গেছেন। একজন রোড এক্সিডেন্টে আরেকজন সুস্থ, চলার পথে ষ্ট্রোক করে।তাদের দুইজনের সাথেই আমার শালা-দুলাভাই সূলভ সিক্রেট সম্পর্ক ছিল।আমি জানি আমার সেই স্বামীহারা বোনদের কি অবস্থা ! একজনের ছেলে আমাদের বাসায় থেকে লেখাপড়া করে,আমরা যথাসম্ভব সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করি।
    আজ এক মহিলা আমার দড়জায় কড়া নেড়েছেন "বাবা, আমার স্বামী মারা গেছে,মেয়ের বিয়ে খুব বিপদে পড়ে হাত পাতছি"
    মহিলাকে দেখে মনে হলো হাত পাতার মতো না নিতান্তই বিপদে পড়ে এসেছে।পঞ্চাশ টাকা দেওয়াতে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে" বাবা,এই বিল্ডিং এ কেউ চাইরানা পয়সাও দেয়নাই।আল্লাহ্‌ আপনেরে সুখে রাখুক"।
    এত কম টাকাও কারো কারো কাছে কত বেশি !

    জবাব দিন
    • সাজিদ (১৯৯৩-৯৯)

      দোস্ত... অনেকদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম বলে দেরীতে তোর কমেন্টস্‌এর জবাব দেবার জন্য দুঃখিত। আমার গল্প পড়ে তোর এই মানবীয় অনুভূতি খুব ভালো লাগল। তোর মত আরো কিছু মানুষ মনুষ্যত্ব সম্পন্ন হলে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর হত।


      অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক,
      জ্যোস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,
      কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।

      জবাব দিন
  6. রায়েদ (২০০২-২০০৮)
    সব মানুষের মধ্যে দুইটা সত্তা আছে-মনুষত্ব আর পশুত্ব। পশুরাই পারে এরকম করতে।

    সরি ভাইয়া, একমত হইতে পারলাম না। আমরা পশুকে যতটা নিকৃষ্ট মনে করতেসি ওরা আসলে ততটা নিকৃষ্ট না। খেয়াল করলে দেখবেন সবচেয়ে হিংস্র পশুও স্বজাতিকে এভাবে হত্যা করে না। শুধুমাত্র ক্ষুধায় ওদের স্বজাতিকে হত্যা করতে বাধ্য করে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : হাসনাইন (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।