নরকবাস ২ – পুরুষ মানুষ

একটি কৌতুকের মতো।
ক্লাস নাইনের গরমের ছুটিতে আক্‌লিমা গেল তার ছোট খালার বাড়িতে বেড়াতে। ছোট খালা-খালু দুজনই তাকে নিজের মেয়ের মত আদর করে। বিশেষ করে খালুজান তো তার সাথে ‘মা’ ছাড়া কোন কথাই বলে না। খালার বিশাল বাড়িতে আক্‌লিমা একা এক ঘরেই ঘুমাতো। একদিন ঘুমের ঘোরে আক্‌লিমা স্বপ্ন দেখলো যে একটা গোখ্‌রা সাপ কিলবিল করে তার শরীর বেয়ে উঠে গলায় পেঁচাতে চাইছে। এরকম বিশ্রী একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ভয়ে ঘুম ভেঙ্গে ধড়ফড় করে উঠতে যেতেই সে টের পেল যে স্বপ্নে নয়, বাস্তবেই একটা সর্পিল হাত তার শরীরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কয়েক মুহুর্ত পরে ঘোর কাটতেই সে আবিষ্কার করলো, এ আর কেউ নয়, তারই পিতৃতুল্য খালুজান। প্রচন্ড বিস্ময়ে দম আটকে আসলেও সে অস্ফুটস্বরে বলল, “এ কি!… আপনি? ছি! ছি! ছি!… আপনি না আমার খালু?” আবছা অন্ধকারে ফ্যাঁস্‌ফেঁসে গলায় ওপাশ থেকে উত্তর এল, “পুরুষ মানুষ কখনো খালু হয় না রে…।”
আপনারা আবার ভাববেন না যে এইটাই আমার আজকের গল্প। না না, এইটা স্রেফ একটা কৌতুক। আমি জাস্ট এর সাথে একটু গল্পের ফ্লেভার দিলাম, এই আর কি। আর শেষের লাইনটি আমাদের এলাকায় লোকমুখে প্রচলিত একটি প্রবাদ যা সাধারণত খুব লুচ্চা প্রকৃতির লোকদেরকে ইঙ্গিত করে ব্যবহার করা হয়। প্রবাদটা আমার কাছে খুব মজার লাগলেও আমি কখনোই তা বিশ্বাস করতাম না। কারন এখানে আপামর পুরুষ জাতিকে দোষারোপ করা হয়েছে। আমি নিজেও তো একজন পুরুষ। তাছাড়া বাবা, চাচা, মামা, খালু এ ধরণের পিতৃস্থানীয়দেরকে নিয়ে এরকম জোক্‌স্‌ করার কোন মানে হয় না। মনে হতো এ নেহাতই একটা বাজে কৌতুক। কিন্তু তখন আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে এই কৌতুক বা প্রবাদের চাইতেও ভয়ঙ্কর কোন ঘটনা আমার চোখের সামনেই একদিন ঘটবে। এমনই একটি ঘটনা যা মনে পড়লে আজও আমার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে আর অশ্রাব্য একটি গালি বহু কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে মুখের ভেতরে আটকে রাখতে হয়। আসলে গল্প-উপন্যাস-কবিতা-নাটক বা শিল্প-সাহিত্যের যেকোন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অঙ্গই কখনো শূন্য থেকে সৃষ্টি হয় না। মানুষ তার নিজের জীবন থেকেই এগুলোর রসদ সংগ্রহ করে। মানুষ প্রকৃত অর্থে কোনোকিছু সৃষ্টি করতে পারে না, সে শুধু পরিচিত কোনোকিছুরই আকৃতি পরিবর্তন করে তাকে অপরিচিত একটা রূপ দেয় মাত্র।

সেই ফেরেশ্‌তার মতো মানুষটি।
নভেম্বরের শুরুর দিকেই আবহাওয়ার সাথে সাথে এলাকার পরিস্থিতিও যেন কিছুটা ঠান্ডা মেরে গেল। আমাদের মোহম্মদপুরের অপদেবতারা বেশিরভাগই হয় জেলে ঢুকেছে নয়তো জঙ্গলে বা ভারতে পলায়ন করেছে। এলাকার জনগন খুশীতে বাক্‌বাকুম। কাজের চাপ অনেক কমে গেছে, তাই আমিও মহাখুশী। গৌহাটির মত এত খারাপ একটা জেলা এত সহজে ঠান্ডা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতনা যদি না এলাকার কিছু বিশিষ্ট ভদ্রলোক আমাদেরকে একান্তভাবে সহযোগিতা না করতেন। এদের মধ্যে আমার খুব পছন্দের একজন ছিলেন আজমত মোড়ল। বছর পঞ্চাশেক বয়সের লম্বা-চওড়া, শক্ত-সমর্থ সুপুরুষ। সুন্দর নুরানী চেহারার উপরে কাঁচা-পাকা চাপদাঁড়ি, চান্দির উপরে সার্বক্ষণিক সাদা টুপি আর কপালের উপরে নামাজের মোটা দাগ মিলে চেহারায় কেমন একটা সুফি সুফি ভাব এনে দিয়েছে। নামে মোড়ল হলেও পেশায় তিনি একজন স্কুলশিক্ষক। সম্ভ্রান্ত পরিবারের ভদ্র নীতিবান মানুষ। পারিবারিক সূত্রে খুব ধনী হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত নিরহঙ্কার ও বিনয়ী। উপরন্তু আমার মা-বাবা দুজনই কলেজের শিক্ষক হওয়ার কারনে আমি তাকে একটু আলাদা সন্মানের চোখে দেখতাম। যেকোন কাজে যেকোন সময় ডাকা মাত্রই সব কাজ ফেলে তিনি আমার কাছে ছুটে আসতেন। বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে যেকোন কাজ হাসিমুখে এবং নিঃস্বার্থভাবেই করতেন। কারন তাকে কখনোই কোন ব্যক্তিগত কাজে আমার কাছে অনুরোধ করতে দেখিনি। এমন ফেরেশ্‌তা বরাবর সাচ্চা আদ্‌মিকে পছন্দ না করার কোনোই কারন নাই। সবচেয়ে খারাপ লাগতো এই ভেবে যে উনার মত এত ভালো একজন মানুষকেও আল্লাহ্‌ তায়ালা এত দুঃখ-কষ্ট দিয়েছেন! উনার ব্যক্তিগত জীবন ছিল খুবই বেদনাদায়ক। একমাত্র ছেলে সেলিম জন্ম থেকেই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি। ছেলেটার বয়স এখন ২৫, রাজপুত্রের মত চেহারা। একবার আমার অফিসে নিয়ে এসেছিল, এমনিতে শান্ত-শিষ্ট, কিন্তু ভালোমত খেয়াল করলে তার চোখ ও চাহনিতে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে। আজমত মিয়ার আর কোন ছেলেপুলে হয়নি। এর মধ্যে দুই বছর আগে তার স্ত্রী আচম্‌কা প্যারালাইসিস্‌ হয়ে একেবারে বিছানায় পড়ে যান। এসময় সংসার টিকিয়ে রাখতে এই আধাপাগল ছেলেকেই ধরে-বেন্ধে গরীব ঘরের একটা মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য কখনো একা একা আসেনা, ঝাঁক বেঁধে আসে। এক বছরের মাথায় হঠাৎ একদিন তার অসুস্থ স্ত্রী রোগ-দুঃখ-হতাশায় জীবনের প্রতি ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে ইদুর মারা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। এখন ছেলের বউটা সংসারের হাল ধরে আছে, তাও নাকি ইদানিং সে ঘর-সংসারের প্রতি মনোযোগী না, কথায় কথায় বাপের বাড়িতে চলে যেতে চায়। উনি নিজে থেকে না বললে আমি উনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে বেশী একটা জিজ্ঞেস করতাম না, কারন এমন দুঃখী একজন মানুষকে বার বার তার দুঃখের কথা মনে করিয়ে দিয়ে লাভ কি? এসব বিভিন্ন কারনে উনার প্রতি আমার সহানুভূতি এতটাই বেড়ে গেল যে, আমি একদিন এলাকার কিছু গন্য-মান্য ব্যক্তিবর্গের এক সমাবেশে তার নাম উচ্চারণ করে বলেই ফেললাম, “আজমত মোড়লের মত কিছু লোক আছে বলেই আমরা এখনো দেশের মানুষের জন্য সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারছি।” ওইদিন সভার পরে আজমত মিয়া এসে আমার দুই হাত জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে ফেলল, “ছার, আমারে আইজ পইর্যন্ত এত বড় সুম্মান কেউ দিইনি।” আজমত মিয়ার খুশী দেখে মনে হল, সে যেন শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পেয়েছে। আহারে! গ্রামের সাদা-সিধা মানুষগুলো কত অল্পতেই কত বেশী খুশী হতে পারে।
যা বলতেছিলাম, আমার দিনকাল বেশ ভালোই কাটছিল। অভিযোগ আর দর্শনার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমে আসছিল। যদিও মাঝে মাঝে দুই একজন মোস্ট ওয়ান্টেড লোকজনের এলাকায় ঘোরাফেরার কথা বাতাসে উড়ো উড়ো শোনা যায় কিন্তু আমি এইসব উড়ো কথায় কান দিতাম না। কারন আজমত মাষ্টারের মত এমন বিশ্বস্ত তথ্যদাতা থাকতে মানুষের ঢোলের বাড়িতে খামোখা নাচার কোন মানে হয়না। আমার বেকার সময় তাই ‘সময় যেন কাটে না…’ টাইপের মরা মরা গান শুনে আর হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস জাবর কাটতে কাটতে পার হয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে আজমত মাষ্টার আবার কি কাজে দুইদিনের জন্য জেলা-শহরে গেছে। নাহলে তার সাথে গল্প-গুজব করেও ভালোই সময় কাটে। কাজের অভাবে কয়েকদিন যাবৎ আমি শুধুই কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিলাম। ঘুম থেকে উঠি, আবার বোধহয় অতিরিক্ত ঘুমের ক্লান্তিতেই ঘুমিয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে শুধু বিছানায় বসে বসেই বকের মত গলা বের করে ভাত খাই। এইরকম চরম অলস এক সন্ধ্যায় আমার অফিস কাম বাসার সামনের রাস্তায় হাঁটা হাঁটি করার সময় খেয়াল করলাম, কালো বোরখা পরা ছোটখাট এক মহিলা আমাদের মেইন গেটের সামনে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করতেছে। সে একবার গেটের খুব কাছে এসে ফাঁক ফোকর দিয়ে আমাকে দেখে, আবার পাশে সরে যায়। আবার এদিক ওদিক তাকিয়ে কি যেন খোঁজে। আমি সেন্ট্রি পাঠিয়ে তাকে আমার অফিসে ডেকে পাঠালাম। এর মধ্যে আমিও অফিসে গিয়ে বসলাম। ভদ্রমহিলা আমার অফিসে ঢুকে তার মুখের উপর থেকে নেকাব সরাতেই আমি বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। এত সুন্দরী কোন মেয়ে এই এলাকায় আসার পর থেকে আমার চোখে পড়েনি। বয়স বড়জোর ২০/২১ বা আরো কম হতে পারে। গোবরে পদ্মফুল বলতে যা বোঝায় আর কি। আমি তাকে বসতে বলে একজনকে ডেকে চা দিতে বললাম। মেয়েটির দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই মেয়েটি কথা বলতে আরম্ভ করল, “ছার আমার নাম নার্গিস। আমি আপনার এই মুহম্মদপুরিই থাহি। আমি ছার বিরাট বিপদে পড়িছি। আপনি ছাড়া আমারে আর কেউ বাচাতি পারবিনে। আমি আপনার কাছে আয়ছি এডা জানতি পারলিও ওরা আমারে মাইরে ফেলবেনে।” এত সুন্দরী একটা মেয়ের এত বড় বিপদের খবরে আমি আগ্রহী না হয়ে পারলাম না। কিন্তু এর পরের পাক্কা দুই ঘন্টা ধরে সে আমাকে খানিক কান্না আর খানিক কথা মিশিয়ে যা যা বলল তাতে আমার বিস্ময়ের আর কোন সীমা পরিসীমা রইল না। আমি বজ্রাহতের মত হা করে তার কথা শুনতে লাগলাম। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। প্রচন্ড পানির পিপাসা পেয়েছিল কিন্তু হাত নড়ানোর পর্যন্ত শক্তি পাচ্ছিলাম না।
মেয়েটার কান্নাসহ কথার বিবরণ দিতে গেলে এক আরব্য রজনী হয়ে যাবে। তাই আমি সংক্ষেপে আপনাদের বলি। মেয়েটার নাম আমি আগেই বলেছি, নার্গিস। তার আসল পরিচয় হল সে আমার পরম প্রিয়পাত্র আজমত মাষ্টারেরই বেটার বউ। তার কথা অনুসারে, আজমত মাষ্টারের ছেলে সেলিম নাকি জন্ম থেকেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধি ছিল না। এমনকি বিয়ের সময়েও তার অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না। তবে কিশোর বয়েস থেকেই সে ছিল ভীষণ রকম মাদকাসক্ত। হিরোইন, ফেন্সিডিল, গাঞ্জা কোনটাই বাদ দিত না। যার ফলে তার আচার আচরণে কিছুটা অসামঞ্জস্যতা অবশ্য ছিল, তবে সবচেয়ে বড় যে সমস্যা হয়েছিল তা হল তার পুরুষত্বহীনতা। আর এসবকিছু গোপন রেখেই আজমত মিয়া দেশের আরেক কোনা থেকে নিতান্ত হত-দরিদ্র পরিবারের বাপ-মা মরা নার্গিস’কে নিয়ে আসে নপুংসক ছেলের বউ করে। বিয়ের পরে নার্গিস তার স্বামীকে মাদক থেকে ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। কারন বাবা হিসেবে আজমত মিয়ার এই ব্যাপারে কোন আগ্রহ তো ছিলই না, উপরন্তু আজমত নিজেই নিয়মিত তার ছেলের মাদক সেবনের পয়সার যোগান দিত।
আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “নিজের ছেলেরে গাঞ্জা-হিরোইন কেনার পয়সা দিত? কি বলেন এসব?”
মেয়েটি মৃদু হাসল, “ছার, সেলিম কি তার নিজির ছেলে? সেলিম হলগে তার মা’র আগের ঘরের স্বামীর ছেলে। সেলিমের বাপ সেলিম কোলে থাকতিই ক্যান্সার হইয়ে মরে। সে ছেল মিলা টাহা পয়সার মালিক, মইরে যাওয়ার আগে সব সেলিমির মার নামে থুয়ে যায়। এই আজমত ছেল তহন পথের ফহির। সে এই বিষয় সম্পত্তির লোভে পইড়ে সেলিমির মার সাথে বিয়ে বসে।”
আমি ভেবে অবাক হলাম যে, আজমত মিয়া আমার কাছে এই ব্যাপারটা খুব সুক্ষভাবে গোপন করে গেছে। কিন্তু আমার জন্য তখনো আরো ভয়াবহ কিছু বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। নার্গিসের কথামতো, সেলিমের মা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হবার পর পরই আজমত মিয়া সেলিমকে বিয়ে দেয়। নেশাখোর ও কিঞ্চিৎ অপ্রকৃতিস্থ সেলিম বেশীরভাগ রাতই কাটাতো বাড়ির বাইরে। এদিকে আজমতের স্ত্রীরও বিছানা ছেড়ে নড়ার ক্ষমতা নেই। এই সুযোগে এক ঝড়ের রাতে আজমত মিয়া প্রথমবারের মত নার্গিস’কে ধর্ষণ করে। নার্গিস তার পরদিনই এ ঘটনা স্বামী ও শ্বাশুড়িকে জানায়। কিন্তু আধপাগলা সেলিমকে কিছু বলা আর একটা কলাগাছকে বলা সমান কথা। এমনিতেই অক্ষম হওয়ার কারনে স্ত্রীর প্রতি তার কোন টান ছিল না। তার উপরে আজমত মোড়লকে সে যমের মত ভয় পেত। আর যা হবার তা তো নার্গিসের উপর হচ্ছে, তার গাঞ্জার পয়সা নিয়ে তো আর টানাটানি হচ্ছে না। তাছাড়া তার মত পাগল ছাগলের কথা কেইবা বিশ্বাস করবে? সুতরাং চুপ থাকাই ভালো। তবে এই ইস্যুতে আজমত মাষ্টারের বিরুদ্ধে বিছানায় শুয়ে শুয়েই যুদ্ধ শুরু করল সেলিমের মা। কিন্তু চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই কাজের মেয়েকে দিয়ে ওষুধের সাথে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে চীরদিনের মত তাকে থামিয়ে দেয়া হলো। বলাই বাহুল্য, এই কাজের মেয়ের ঘরেও রাত-বিরাতে আজমতের হরদম আসা যাওয়া ছিল। এখন সেলিমের মা’র অগাধ সম্পত্তি চলে আসল তার হাতের মুঠোয়। এদিকে হতভাগী নার্গিসের যাওয়ার মত কোন জায়গা দুনিয়াতে নাই। পনের বছর বয়সে সে তার মা’কে হারায়। মা’র মৃত্যুর মাত্র তিন মাস পরেই এক ঝড়-বাদলের সন্ধ্যায় তার দিনমজুর বাবা মাথায় বাজ পড়ে মারা যায়। এরপর যে দূরসম্পর্কের মামা’র বাড়িতে তার ঠাঁই হয় সেখানকার পরিস্থিতিও এর চাইতে খুব ভালো ছিল না। কথায় বলে, ‘অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়।’ আর বাইরের লোকসমাজে আজমতের যে ভালোমানুষী লেবাস্‌, তাতে তার বিরুদ্ধে এইসব কথা মানুষজনকে বিশ্বাস করানোও কঠিন। অতএব প্রতিনিয়ত আজমত মিয়ার নানা অত্যাচার মুখ বুজে সয়ে সে কোনরকমে মাটি কামড়ে পড়ে থাকল। এদিকে প্রচুর টাকা-পয়সা হাতে পেয়ে আজমত মোড়ল তার নিজস্ব সাম্রাজ্য গুছিয়ে আনা যখন শুরু করল ঠিক সেই সময় তার ‘বাড়া ভাতে ছাঁইয়ের মত’ এই দেশের রঙ্গমঞ্চে আমাদের আবির্ভাব। কিন্তু শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান আজমত খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের নেকনজর ও আস্থা অর্জনে সক্ষম হল। এতে তার লাভ হল বিস্তর। প্রথমত, টাকা হওয়ার সাথে সাথে সবারই কম বেশী শত্রু তৈরী হয়। আজমত মাষ্টার আমাদের আস্থাভাজন হওয়ার কারনে তার শত্রুরা ভয়ে কেউ তার পিছে তো লাগতই না এমনকি তার বিরুদ্ধে আমাদের কাছে কোনপ্রকার কানকথা লাগাতেও সাহস পেত না। তাই তার কোন কুকীর্তির কথাই আমাদের জানার উপায় ছিল না। দ্বিতীয়ত, নিজে সম্পৃক্ত না হয়েও বিভিন্ন লোকজনকে দিয়ে অভিযোগ করিয়ে পরোক্ষভাবে খুব কৌশলে সে একে একে এলাকা থেকে তার পথের কাঁটাগুলো দূর করছিল। কারন ক্ষমতা ছাড়া টাকার স্বাদ ততোটা মিষ্টি হয় না। তাই পরবর্তী নির্বাচনে পৌর কমিশনার পদে দাঁড়ানোর একটা সুপ্ত বাসনা তার মনে তৈরী হয়েছিল। এছাড়াও সে আমাদের নাম করে ভয় দেখিয়ে একে ওকে হুমকি-ধামকি দেওয়া এবং এর মাধ্যমে এলাকায় নিজ কর্তৃত্ব বিস্তারের কাজটাও করছিল খুব সতর্কতার সাথে। এলাকার অনেক বড় বড় লোকজনও তখন নানা কাজের জন্য আজমত মাষ্টারকে তোয়াজ করে চলত। সূর্যের চাইতে বালি তো চীরকালই বেশী গরম থাকে। তৃতীয় ব্যাপারটাই ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে আশঙ্কাজনক। আজমত আমাদের সাথে চরম মুনাফেকী করে তলে তলে বড় বড় সন্ত্রাসীদেরকে আশ্রয় দেয়া থেকে শুরু করে সবরকম সহযোগীতাই করছিল। এর বদলে মোটা টাকার লেন-দেনের ব্যাপার তো ছিলই, তাছাড়া সারাজীবন তো আর আমরা মাঠে-ময়দানে থাকব না। তখন এলাকায় নিজের প্রভাব টিকিয়ে রাখা থেকে শুরু করে ইলেকশনে জেতা পর্যন্ত সব কাজে এইসব দুষ্টু দেবতাদের আশীর্বাদ ছাড়া উপায় কি? নার্গিসের কাছ থেকেই জানলাম যে ঐ মুহুর্তে আজমতের আশ্রয়ে তারই বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিল আমাদের মোস্ট ওয়ান্টেড ‘কসাই মান্নান’। কিন্তু কে কোথায় লুকিয়ে থাকল না থাকল তা নিয়ে নার্গিসের তেমন মাথাব্যথা নেই, বরং তার সমস্যা আরেকটু ব্যাপক। সে জানালো, “আমার উপরে তো ছার উনি পিরাই রাত্তিরিই অত্যিচার করে। ইদানিন আবার উনি আমারে কয় কসাই মান্নানের কাছে যাতি। রাইত বিরেতে এডা ওডা কাজের ছুতোয় আমারে ওর ঘরে যাতি কয়। আর আমি না গেলি আমারে ধইরে খালি মারে। আমি ছার আপনার ধারে আরো আগেই আসতি চায়ছি কিন্তুক আমারে উনি বাইরি মোটে বেরোতি দেয়না। উনি বাড়িতি না থাক্‌লিউ উনার কাজের বিটি আমারে পাহারা দেয়। উনি শহরে গেছে বইলে আমি আইজ পলায় আয়ছি। আপনি ছার আমারে বাছান।” এই পর্যন্ত বলেই নার্গিস কান্নার অঝোর ধারায় ভেসে যেতে লাগল। কান্না সংক্রামক ব্যাধি। টের পাইনি, কখন যে আমার দুচোখ থেকেও কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। যে দেশের প্রত্যেক নির্বাচনে যেকোন একজন মহিলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, সেই দেশের মেয়ে হয়ে নার্গিসের জন্যে নারী হয়ে জন্মানোটাই আজ পাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু নার্গিস না, আজমত মিয়া তো তাহলে এতদিন যাবত আমাদেরকেও তার হাজারো স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে! রাগে-দুঃখে-অপমানে আমার মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল, আমি কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছিল, “আজমত মাষ্টার, তোরে আমি খাইছি! তুই এই রকম? বাইরে যার এমন ফেরেশ্‌তার মত চেহারা, ভিতরে সে এইরকম!!!”

পরিশিষ্ট।
এই কাহিনী এখানেই শেষ করলে বা আজমত মাষ্টারের কি পরিণতি হল তা না জানালে আপনারা বোধহয় আজমতের সাথে সাথে আমারো বিচার দাবী করে বসবেন। সুতরাং বাকিটুকুও বলি শোনেন; আমি ঐদিন নার্গিস’কে চুপচাপ বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। পরদিন আজমত মাষ্টার শহর থেকে এসে আমার সাথে দেখা করলে আমি তার সাথে খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করি এবং তাকে জানিয়ে দিই যে জরুরী কাজে আমি ওইদিনই বিকেলে কয়েকদিনের জন্য ঢাকায় চলে যাচ্ছি। সুতরাং আমাকে যেন সন্ধ্যার পর থেকে আর খোঁজ না করে। এরপর রাত তিনটার দিকে আমি অতর্কিতে আজমত মাষ্টারের বাড়িতে হাজির হয়ে অস্ত্রসহ কসাই মান্নান ও আজমতকে আটক করি। আজমতকে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় যখন আমার সামনে আনা হল তখন ও মাথা নীচু করে নুন খাওয়া জোঁকের মত গুটিয়ে এতোটুকু হয়ে মাটিতে বসেছিল। ওকে দেখামাত্র ঘেন্নায় আমার বমি পেতে লাগল। মুখের ভেতর ক্রমাগত থুথু জমা হচ্ছিল। আমি একদলা থুথু ওর সামনের মাটিতে ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, “বেজন্মা কুকুর।”

৪,১১০ বার দেখা হয়েছে

৫৬ টি মন্তব্য : “নরকবাস ২ – পুরুষ মানুষ”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    সাজিদ ভাই,মনে হচ্ছিল রোমাঞ্চকর কোন উপন্যাস পড়ছি।আসলেই-ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশান।

    চালিয়ে যান বস!এই নরকবাস নিয়ে একটা খুব সুন্দর ই-বুক এমনকী হয়তো ভবিষ্যতে দুর্দান্ত একটা টিভি সিরিয়াল বানানো যেতে পারে।কথাটা হেসে উড়িয়ে দিয়েন না।

    জবাব দিন
  2. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    সাজিদ ভাই, আপনার ফোন নাম্বারটা যদি একটু দিতেন...
    mash34th@hotmail.com

    যদি জেগে থাকতেন তাহলে কথা বলতাম আপনের সাথে-নরকবাস পড়ে আমি পুরা পাঙ্খা হয়ে গেছি আপনের :boss: :boss:

    জবাব দিন
    • সাজিদ (১৯৯৩-৯৯)

      সঠিক... কিন্তু আমরা আজকাল মানবাধিকারের ব্যাপারে অনেক সচেতন।


      অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক,
      জ্যোস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,
      কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।

      জবাব দিন
      • রকিব (০১-০৭)

        ভাইয়া, একটা ব্যক্তিগত মতামত দেই। আমার মনে হয় আজকাল মানবাধিকারের নামে অমানবসূচক কর্মকান্ড অনেক বেড়ে গিয়েছে। যতদূর জানি, (ব্যাপারটা সঠিক না হলে ক্ষমাপ্রার্থী) সরকয়ার পরিবর্তনের পর র‌্যাবের ক্ষমতা আগের থেকে অনেক কমিয়ে দেয়া হয়েছে। পূর্ববর্তী সরকারের কালেও বিভিন্ন তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থাগুলো ভীষনভাবে চিল্লাপাল্লা করেছে। কিন্তু র‌্যাব এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারীদের এগ্রেসিভ ভূমিকার কারনে কিন্তু অপরাধ অনেকাংশেই কমছিল। সবচেয়ে বড় কথা, বড় বড় খুনী- অপরাধীদের জেলে ভরে বেশিদিন রাখা যায় না। কোন না কোনভাবে তারা বের হয়েই আসে। সেক্ষেত্রে বরং নিরীহ মানুষের মৃত্যুর কারণ হবার পূর্বেই এদের গুলি মারাটা মন্দ ছিল না(এভাবে বলা ঠিক না, কিন্তু না বলেও পারছি না)। কিন্তু কী আর করা মানব জন্ম স্বার্থক করতে মানবাধিকারের অপপ্রয়োগ তো আমাদের চাইই চাই।


        আমি তবু বলি:
        এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

        জবাব দিন
          • মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

            মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতি(ঢালাওভাবে বলছিনা-সত্যিকারের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা এখানে বাদ) আমার কেন জানি কিছুটা এলার্জি আছে।শুনতে খারাপ শোনাবে, সুশীলরা চিল্লাচিল্লি করবেন-তারপরেও বলিঃ সন্ত্রাসীদের আমি মানবের পর্যায়ে ফেলি না।কাজেই তাদের ক্ষেত্রে মানবাধিকার খাটা উচিৎ না।মহাভারতে আমার প্রিয় চরিত্র কর্ণ যখন যুদ্ধক্ষেত্রে তার রথের চাকা থেমে যাওয়ায় রিতি অনুযায়ী সেটা ঠিক করার জন্যে অর্জুনের কাছে সময় চেয়েছিল-শ্রীকৃষ্ণ তখন বলেছিলেনঃ"সারা জীবন অধর্মের পথে থেকে বিপদে পড়ে তুমি এখন ধর্মের নাম মুখে এনেছ,তাইনা?ধর্মের ছায়া পাওয়ার অধিকার তোমার নেই"

            এইসম সন্ত্রাসীরা সারা জীবন অ-মানবের মত কাজ করে আর এদের মারতে গেলেই মানবাধিকার সংস্থাগুলো গেল গেল রব তোলে।আবার ওদিকে সন্ত্রাসী হামলার নূন্যতম আঁচ গায়ে লাগলেই আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর দিকে আঙ্গুল তোলে।

            সে আমেন টু হিপোক্রেসি।

            জবাব দিন
  3. দিহান আহসান

    সাজিদ ভাই, ধন্যবাদ লেখা দেয়ার জন্য। একটানে পড়ে গেলাম। 🙂
    আপনি খুব সুন্দর করে সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পের বিষয় নিয়ে নতুন করে আর কি লিখব।

    জবাব দিন
  4. আব্দুল্লাহ্‌ আল ইমরান (৯৩-৯৯)

    চমৎকার লেখনি, চালিয়ে যা। আমিও এদের মানুষ ভাবিনা। :just: :gulli2: :gulli2: :gulli2:
    রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে র‌্যাবের কর্মকান্ড অনেকটাই ব্যহত বলে কষ্টিত। ডালপালা কাটতে কাটতে শেকড় পর্যন্ত চলে গেলে যে তাদেরও ভয়ের কারন আছে বৈকি :goragori: :goragori:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।