আমার জীবন আমাদের জীবন : থমকে যাওয়া মুহূর্ত

আমার জীবন, আমাদের জীবন : হৃদয় ভাঙ্গার কাল

১. বেলাল স্যারের (রসায়ন) উপস্থিতি আমার জন্য কখনোই আরামপ্রদ নয়। এর কারণ সম্ভবত উনার আনপ্রেডিক্টেবল আচরণ। কখন কোন কথায় মাইন্ড করেন আর কখন কোন কথার উত্তরে যে হাসি আশা করেন বুঝতে পারতাম না। একদিন কি মনে করে যেন স্যার আমাদের ক্লাসের অন্যতম ধার্মিক ক্লাসমেট জামালকে একটা সমস্যা টাইপ প্রশ্ন করে বসলেন। সিরাজগঞ্জের (অথবা পাবনা, ঠিক মনে নেই) কোন এক প্রত্যন্ত এলাকায় মিশনারীদের পরিচালিত একটা চিকিৎসা কেন্দ্র আছে যারা কুষ্ঠ রোগীদের চিকিৎসা করে। সেখানে একজন খ্রীস্টান বৃদ্ধা মহিলা আছেন যিনি তার জীবনের প্রায় পুরোটাই মানবসেবায় এই দেশের মাটিতেই কাটিয়ে দিয়েছেন। নিজ হাতে কুষ্ঠ রোগীদের সেবা করেছেন। এখন স্যারের প্রশ্ন, “এইবার বল, এই মহিলা মৃত্যুর পর বেহেশতে যাবেন নাকি নরকবাসী হবেন”? জামাল তার যতটুকু জানা আছে সেখান থেকে মনে করে বলল, “সে নরকবাসী হবে”। স্যার গেলেন খেপে। হরম বড়ম করে অনেক কথা বললেন। সারাটা জীবন অসুস্থ মানুষের সেবায় আত্মনিবেদিত একজন মানুষ শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বলেই নরকে যাবে! ইহকালের কর্মফলই তো পরকালে বেহেশত আর দোযখ হয়ে আসে। তাহলে তার সারা জীবনের ভালো কাজের কি কোন মূল্য নেই? আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল স্যার বুঝি জামালের উপরই খেপেছেন। কিন্তু তার চোখ মুখ বলেছিল অন্য কথা। মনে হচ্ছিল নিজেকে নিজে স্বান্তনা দিতে না পেরে তিনি নিজেই ব্যথিত, যন্ত্রণাক্লিষ্ট।

২. জুতো নিয়ে আবু সাঈদ বিশ্বাস স্যারের (জীববিজ্ঞান) কিছুটা দূর্বলতা মতোন ছিল। তিনি “জুতো” শব্দটা খুব আরাম করে বাড়তি জোর প্রয়োগে উচ্চারণ করতেন, বেশি বেশি উচ্চারণ করার চেষ্টা করতেন। আর যেটা করতেন সেটা হল হাউসের করিডোরের মাথায় জুতো খুলে রেখে এসে ক্যাডেটদের রুমে হানা দিতেন। উদ্দেশ্য, শব্দবিহীন হেঁটে এসে ক্যাডেটদের দুষ্টামিরত অবস্থায় বমাল পাকড়াও করা। স্যারের কয়েকটা সফল রেইডের পর ক্যাডেটদের কেউ কেউ একটা বিহিত করার জন্য উঠেপড়ে লাগল। যথারীতি কোন এক মাগরীবের নামাজের সময় স্যারের নতুন স্যান্ডেল সু’র একপাটি উড়ে চলে গেল গেটের বাইরে খালের কচুরীপানা ভর্তি পানিতে। আরেক পাটি যেয়ে আশ্রয় নিল মসজিদের ছাদে। এরপর সবাই অবস্থান নিল তামাশা দেখার জন্য। নামাজ শেষে একে একে ক্লাস টুয়েলভ, সেভেন, এইট, নাইন,……ক্যাডেটরা বেরিয়ে আসছে। সবাই দেখছে একজন সিনিয়র হাউস মাস্টার বোকা, হতবিহবল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কারণ ক্যাডেট কলেজের মসজিদের মতোন জায়গা থেকে তার স্যান্ডেল সু গায়েব হয়ে গেছে! প্রথম প্রথম স্যারের হাতে যারা নাজেহাল হয়েছে তারা খুব একচোট আমোদ পেয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই পয়সার অন্য পিঠটাও দেখা গেল। পুরো কলেজের তিনশ ক্যাডেট এবং নামাজ পড়তে আসা অন্যান্য স্টাফ দেখলেন বোকা হযে থাকা সাঈদ বিশ্বাস স্যারকে। আমার চোখে আজও স্যারের সেই হতবিহবল চেহারা ভাসে।

স্যার কি আমাদের মাফ করেছেন? আমি জানি না।

৩. বিকেলের টি-ব্রেকের সময় ডাইনিং হলের সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছি (তখন আমরা ক্লাস নাইন অথবা টেন)। কিছু একটা হট্টগোল করার চিন্তা মাথাটার মধ্যে কুরকুর করছিল আমাদের কারও কারও। এক সময় কলেজ গেট ইন করানো হল। আমাদের পালা আসতেই আমরা দেখলাম ডাইনিং হলের সামনে রাখা এ্যাকুরিয়ামের বড় টিনের ঢাকনাটা খোলা, ভিতরে পানিসুদ্ধ মাছ গায়েব (মেইনটেন্যান্স চলছিল)। আমাদের কুরকুর করা মস্তিস্কসমূহের ইঙ্গিতে “উহ্, আহ্, একি, হায়-হায়” টাইপের বেশ একটা শোরগোল শুরু হয়ে গেল। ঘাড়ের উপর দাঁড়ানো জুনিয়র প্রিফেক্টরা সাথে সাথে গগণবিদারী শাউট করে আমাদের ক্লাসকে বাইরে নিয়ে আসল। কি কপাল, সেখানে ততক্ষণে ডিউটি মাস্টারের চড় শুরু হয়ে গেছে (এই স্যার আবার লং রেঞ্জ চড় মারার জন্য কলেজ বিখ্যাত)! আমি চড়টা খাবার আগে শুনলাম স্যার বলছেন, “কেন? এরকম হবে কেন?” পরক্ষণেই দেখলাম আমার আর স্যারের মধ্যে ব্যবধান দুই ফুট থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে কম করেও ১০ ফুটে। আমি এত দূরে কিভাবে আসলাম জানি না। খালি মনে আছে কান, মাথাসহ বাম গাল ভো ভো করছিল।

রাত্রে প্রেপের পর ডিউটি মাস্টারের ডাকে হাউস অফিসে হাজিরা দিলাম। স্যারের জিজ্ঞাসা, “তখন কি হয়েছিল রে”? আমি কি উত্তর দিয়েছিলাম মনে নেই তবে অভিমানে বুকটা ভরে উঠেছিল। মনে মনে স্যারকে বলেছিলাম, “আপনি কোন কারণ না জেনে না শুনেই এরকম বিরাশি শিক্কা ওজনের চড়গুলো মারলেন”! এখন মনকে প্রবোধ দিই – এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন না কোন কল্যাণ নিহিত আছে।

৪. ক্লাস টুয়েলভের শেষের দিকের কোন একটা প্যারেন্টস ডে। প্যারেন্টস আদৌ আসবেন কি না জানি না। আমি আর শাহীন রেজা দুজনে কোনরকমে ব্রেকফাস্ট শেষ করে কালো জুতা আর টাই লাগিয়েই একাডেমী ব্লকের দিকে রওয়ানা দিয়েছি। ব্লকে ঢোকার মুখেই সাঈদ বিশ্বাস স্যারের (জীববিজ্ঞান) সাথে দেখা। এক অভাবনীয় ভালোলাগা তার চোখেমুখে ফুটে উঠেছে। বললেন, “এতটা সিনিয়র হবার পরও ছেলেরা প্যারেন্টস এর জন্য এভাবে অপেক্ষা করে থাকে”? স্যারের সেই মমতামাখা মন্তব্য আমার আজও কানে বাজে।

৫. আমি আমার ক্লাসমেটদের ছবি আঁকা, গল্প – কবিতা লেখা ইত্যাদি খুব আগ্রহ সহকারে লক্ষ্য করতাম। কখনো কখনো উতসাহ দিতাম। বেশি ভালো লাগলে নিজের ডায়রীতে কবিতা কপি করে রেখে দিতাম। এরকমই একদিন রাজীকের ডায়রী পড়ছিলাম বসে বসে। সেখানে অনবদ্য সব কবিতা লেখা সুন্দর হস্তাক্ষরে। এক জায়গায় ছন্নছাড়াভাবে একটা লাইন লেখা, “আমি বেলাল স্যার (রসায়ন), মোস্তাফিজ স্যার (ইংরেজি) আর রফিক নওশাদ স্যারের (বাংলা) কষ্ট খানিকটা হলেও অনুভব করতে পারি”। কারণ রাজীক ওর বাবা মায়ের বিয়ের সুদীর্ঘ ২৬ বছর পর জন্মলাভ করা একমাত্র সন্তান আর উল্লেখিত তিনজন স্যারের প্রত্যেকেই নিঃসন্তান।

ক্যাডেট অবস্থায় কলেজে থেকে স্যারদের জন্য এমন অনুভূতির প্রকাশ আমি আর কোথাও দেখিনি।

উৎসর্গ : রাজীকের অনুভূতিতে সিক্ত স্যারদের জন্য।

*************

এখানের অভিজ্ঞতাগুলোও আগে এক জায়গায় (বেক্সকা রিইউনিয়ন সাময়িকী’ ২০০৮) শেয়ার করেছি। কিন্তু ওখানে পৃষ্ঠার অভাবে অনুভূতির প্রকাশ অনেকটাই সীমিত ছিল। এখানে সেটাকেই ঘষামাজা করে, আরও কিছু যোগ করে নতুন করে দেয়ার প্রয়াস পেলাম।
(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য…)

১,৮১৬ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “আমার জীবন আমাদের জীবন : থমকে যাওয়া মুহূর্ত”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    সায়েদ ভাই, আহসান ভাই , তৌহিদ ভাই- আপনাদের দেখি আর অবাক হই। কঠোর সামরিক জীবনে থেকেও আপনাদের ভিতরে এত অদ্ভুত কোমল মনের উপস্থিতি দেখে নিজেকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি-ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে যান্ত্রিক হয়ে যাওয়ার অজুহাত আমরা যারা দিতে ভালবাসি, তাদের অজুহাত আসলে কতটুকু যুক্তিযুক্ত আর কতটা ঔদাসীন্য?? কিভাবে লেখেন এত সুন্দর করে???

    জবাব দিন
  2. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    তোমার এই অদ্ভুত সুন্দর কমেন্টে আমি অনেকটাই আবেগ আপ্লুত, অভিভূত। নিজেকে এর জন্য উপযুক্ত মনে হচ্ছে না। এখন বসে বসে শব্দ আর বাক্য হাতড়াচ্ছি - খুঁজে পেতে বডড সমস্যা হচ্ছে।

    সত্যি বলতে কি জান, আমরা সবাই একইরকম জায়গায় আমাদের জীবনের সবচেয়ে স্বর্ণোজ্বল সময়টা কাটিয়ে এসেছি। আর সেখানের যেই সুরে আমরা বাঁধা পড়ে গেছি সেই সুর থেকে বের হয়ে আসা তো অসম্ভব। মনের গহীনে যে কথা উঁকি দেয়, যে অনুভূতি নাড়া দেয়, যে সুর বেজে চলে তার প্রকাশের জন্যও চাই সেইরকম একটা মানুষের সঙ্গ, সেইরকম পরিবেশ। ক্যাডেট কলেজ ব্লগটা কি সেইরকম জায়গা নয়? অন্তরের বন্ধুত্ব যার সাথে তার সাথে যেমন সবকিছু - সবকিছু শেয়ার করা যায়, এখানটাতেও সেইরকমভাবে নিজেকে মেলে ধরা যায়। আর ঠিক সেই কারণেই জংলি রঙের পোষাকের ভিতর থেকে খানিকটা সময়ের জন্য হলেও বেরিয়ে আসা, সবার সাথে একাত্ম হবার প্রয়াস পাওয়া, সেই স্বর্ণোজ্বল সময়ে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করা।

    এর বেশি আর কিছু নয়।


    Life is Mad.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।