৭৩ এর যুদ্ধবন্দী

ব্যাপারটা যে কাকতালীয় তাতে সন্দেহ নেই – “সবুজ সিল্ক শাড়ী” পরা মহিলাটির সাথে আমার দেখা হয়ে গেল। আমি তাকে দেখামাত্রই চিনতে পেরেছি। ইন ফ্যাক্ট আমরা চোখাচোখি হওয়া মাত্র একে অন্যকে চিনতে পেরেছি। সে আমার দিকে হাত নাড়ল। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর একসাথে বসব বলে সাব্যস্ত হল।

১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরের কোন এক সকালে তার সাথে আমার প্রথম ও শেষ দেখা। ১৯৭১ এর পাক-ভারত যুদ্ধের সহস্র যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে সেও একজন। তারা অপেক্ষার প্রহর গুনছিল পাকিস্তানে ফেরত যাবে বলে। সে নয়, বরং তার চার বছরের ছেলে আমার মনোযোগ আকর্ষন করেছিল। অনুষ্ঠানের বক্তারা কে বা কি ছাইপাশ সব বলছে তাতে সম্পূর্ণ আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। তার উপস্থিতি আমাকে ১৯৭৩ এর ডিসেম্বরে নিয়ে গেল।

*****

আর্দ্র ডিসেম্বরের সকাল ৫ টা, তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে – ওয়াগাহ’র রেইলহেড আত্তারীতে “তেজা সিং” এর জন্য অপেক্ষা করছি। যুদ্ধবন্দীদের পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ট্রেনের এইধারা নামই দিয়েছিল স্থানীয়রা। আমি আইসিআরসি (ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ দ্যা রেড ক্রস) এর সদস্য হিসেবে যুদ্ধবন্দী প্রত্যাবর্তনের পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম। আমাদের কাজ হল যুদ্ধবন্দী বিষয়ে জেনেভা কনভেনশনের সকল নিয়মকানুনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা। যুদ্ধবন্দীদের কেউ জানে না যে কে কে আজ ঘরে ফিরবে। তারা শুধু জানে তাদের ছেড়ে আসা যুদ্ধবন্দী ক্যাম্পের দুঃসহ স্মৃতির কথা। আজ কারও কারও দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষ হবে আর বাকিদের জন্য এটা অন্যান্য দিনের মতোই আরেকটা হাড় কাঁপানো, কুয়াশাচ্ছন্ন, বিরক্তিকর, সিক্ত দিন।

সুতীব্র সাইরেন বাজিয়ে তেজা সিং স্টেশনে আসল – দরজা জানালা আটকানো, পর্যাপ্ত সৈন্যের পাহারায়। ট্রেন থেকে প্রথমেই অসুস্থদের নামিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে পাঠানো হল। তারপর একের পর এক দরজা খুলে দিতেই বাকি যুদ্ধবন্দীরা নামতে থাকল। তাদের নিঃশব্দ পদচারণা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে তারা বাড়ি ফেরার কথা ভাবারও সাহস করছে না – তার আগেই যা খুশি কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। সকাল সাড়ে ৫টার তীব্র ঠান্ডার মধ্যে একজন মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। সৈন্যরা ধরাধরি করে তাকে এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে গেল। বেচারা মারা গেল কিছুক্ষণের ভিতেরই – হার্ট এ্যাটাক!

যুদ্ধবন্দীদের একটা সামিয়ানার নিচে সকালের নাস্তা ও চা দেয়া হল। এরই মধ্যে একজন সবুজ সিল্ক শাড়ি পরা মহিলা ট্রেনে গেল তার ছেলেকে খুঁজতে। ছেলেকে পাওয়া গেল তেজা সিং এর কাছে, একজন সৈনিকের সাথে রীতিমত ঝগড়া করছে। সে ট্রেনে ফেরত যেতে চাচ্ছে আর সৈনিকটি যেতে দিচ্ছে না। সে তার মাকে দেখে তীব্র প্রতিরোধে চিৎকারসমেত মাটিতে পা দাপালো – সে “কুউউক…কুউউক” চড়বে। অন্য আরেকজন সৈনিক কায়দা করে ছেলেটিকে তুলে নিয়ে ট্রেন থেকে দূরে একটা পার্ক করে রাখা লরির ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে দিল। বাচ্চা ছেলেটা এবার তার নতুন খেলনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে চালানো শুরু করল।

সকালের নাস্তা শেষে মহিলা আর বাচ্চাদের লরিতে তোলা হল। খাকী ওভারঅল পরা পুরুষ যুদ্ধবন্দীরা হাঁটা শুরু করল। ঠিক যেন অনেকবার মহড়া দেয়া সিনেমার দৃশ্য। গন্তব্য চার কিলোমিটার দূরে ওয়াগাহ চেক পয়েন্ট। আমি তাদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রতিবারই আমার দৃষ্টি ফিরে ফিরে আসল। আজ তাদের জীবনের এক মহান দিন। আজ তাদের বাড়ি ফেরার দিন! কিন্তু তাদের চেহারা যেন পাথরে খোদাই করা – কোন অভিব্যক্তিই নেই।

ওয়াগাহ’তে আবারও মহিলা ও বাচ্চাদের সামিয়ানার নিচে বসিয়ে চা দেয়া হল। দূর থেকে সেই সবুজ শাড়ি পরা মহিলাকে দেখলাম তার গো ধরা ছেলের সাথে কথা বলছে। আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে ছলছল চোখে মহিলাটি চমৎকার নির্ভুল ইংরেজিতে বলল, “আমরা যখন যুদ্ধবন্দী ক্যাম্পে প্রথম যাই তখন ছেলেটার বয়স ছিল মাত্র ২ বছর। সেখানে সে কোনদিন লরি দেখেনি। আজ সে এতটাই মুগ্ধ যে সে এখান থেকে যেতেই চাচ্ছে না”। সে তার ছেলেকে বর্ডারের ওপারে ফুলেল আর রঙিণ পতাকাশোভিত তোরণ দেখালো। সে বোঝানোর চেষ্টা করল যে ওপারেও গাড়ি, লরি, ট্রেন আছে। কিন্তু নাছোড়বান্দা ছেলে সেটা বিশ্বাস না করে আবার লরিতে উঠতে গেল। এবার একজন আইসিআরসি সদস্য তাকে সযত্নে বর্ডারের কাছে নিয়ে গেল। সেখানের রঙিন সামিয়ানা, টিভি ক্যামেরা, ফুল হাতে অপেক্ষমাণ মেয়েদের সারি আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুসজ্জিত বাদকদল কোনকিছুই বাচ্চা ছেলেটার মনে ধরে না। সে তার এক্সাইটিং লরিতে করে আত্তারীতে ফেরত যেতে চাইছে। অতঃপর তাকে তার মা’র কাছে ফেরত দেয়া হল। সবুজ শাড়ি পরা মহিলাটির নিজ বাড়িতে ফিরে যাবার সম্ভাবনার আনন্দ তার ছেলের লরিতে ফিরে যাবার বায়নার কাছে ফিকে হয়ে যাচ্ছিল। আর আমার উপস্থিতি তাকে বিব্রত করছিল মাত্র।

অজানার আশঙ্কা অধিকাংশের চোখেমুখে অত্যন্ত স্পস্ট – বিশেষ করে বিহারী মুসলিমদের। তাদের অধিকাংশের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে এটাই প্রথম পদার্পন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা পূর্ব পাকিস্তানের জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়েছিল, তাদের ভাষা রপ্ত করেছিল, তাদের সংস্কৃতিতে অবগাহন করেছিল। আর এখন তাদেরকে তাদের “মার্তৃভূমি”তে ফেরত পাঠানো হচ্ছে – যে ভূমি তাদের কাছে অপরিচিত, আনকোরা, অনিশ্চিত। হাতে গোনা অল্প কিছু মানুষের জন্য আজকের দিনটা নিঃসন্দেহে আনন্দময় – তারা তাদের নিশ্চিত জীবনে ফিরে যাচ্ছে।
সৈনিকদের ভিতরে অনুভূতিটা মিশ্র। তিক্ততা নিয়ে একজন সৈনিক বলল, “আমার ছেলেটা কেমন অনুভব করবে যখন স্কুলে আরেকটা বাচ্চা আঙুল তুলে তাকে বলবে যে তার বাবা পূর্ব পাক্স্তিানে আত্মসমর্পন করেছিল”! এই তিক্ততা আরও অনেকের – এই ভেবে সারা হচ্ছিলাম যে, ভবিষ্যতের যুদ্ধ তাদের জন্য কতটা রক্তক্ষয়ী হবে!! একজন অফিসার মন্তব্য করলেন, “আমরা এক বন্দীশিবির থেকে আরেক বন্দীশিবিরে যাচ্ছি”। আবেগের তীব্রতা বাধ মানল না আরেকজনের কথায়, “আনন্দিত! আমি দু-ই বছর পর আমার বাড়ি যাচ্ছি। আমি আমার ছেলেকে প্রথমবারের মতো দেখব – আর তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছ আমি আনন্দিত কিনা”!! আশেপাশের কোন কিছুতেই সৈনিকদের ভ্রুক্ষেপ নেই। শুধুমাত্র যখন সামরিক কেতায় কিছু আদেশ করা হচ্ছে তখন খানিকটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় তাদের মাঝে – তারা আদেশ মেনে চলে।

সোয়া আটটার দিকে বর্ডারের উভয় দিকে সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তারা হাজির হলে যুদ্ধবন্দী প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হল। প্রথমে অসুস্থরা, তারপর অফিসার আর সৈনিকরা বর্ডার অতিক্রম করল। সমান তালে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পূরণ হতে থাকল। একে একে সবার শেষ হয়ে গেলে সবুজ শাড়ি পরা মহিলাটিকে দেখা গেল তার ছেলেটিকে হিড়হিড় করে টেনে আনতে। আমি তার মনোযোগ আকর্ষন করতে মৃদু খাকাড়ি দিলাম। পাছে আবার পানি গড়িয়ে পড়ে – তাই নিজ চোখদুটোকে খানিকটা শাসন করে সে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, “দেখ তো কেমন বেয়াড়া হয়েছে ছেলেটা”। তারপর ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ঐ আন্টিকে বাই বাই বল”। বাচ্চাটা তার কান্নাভেজা মুখটা আমার দিকে ফেরালে বললাম, “বাই বাই বেটা, খোদা হাফেজ”। তার সবুজ সিল্ক শাড়ি পরা মা তাকে টেনে নিয়ে বর্ডার পার হয়ে নিজ দেশে চলে গেল।

*****

আজ সে আমার সামনে, ইতস্ততভাবে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে – যেমনটা সে করেছিল সেই ডিসেম্বরের সকালে। আমি তাকে চিনি না, তার নামটাও জানি না কিন্তু সে আরও নয়শত মুখের মধ্যে একটা মুখ যা আমার কাছে বারবার ফিরে আসে। আমি অবাক হয়ে ভাবি, সে কি কখনও আমার কথা ভেবেছে! এখন আমি জানি সে ভেবেছে। আমি তাকে তার ছেলের কথা জিজ্ঞেস করলাম, “সে নিশ্চয়ই এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। সে কি এখনও গাড়ি আর ট্রেনের পাগল! আমার এখনও সেই সকালের কথা মনে পড়ে …………আই এ্যাম সরি, আমি তোমাকে দুঃখ দিতে চাইনি……”। আমি জানি না আমি কি করেছি – তার চোখে মুখে অমাবস্যার অন্ধকার।

অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে কোন দূর পানে তাকিয়ে সে বলল, “নো। তুমি কিভাবে জানবে! বর্ডার ক্রস করার সাথে সাথে সেলিম ওপারে সারি সারি গাড়ি পার্ক করা দেখেছিল। সেগুলোর রং আর ডিজাইন দেখে সে বুনো আনন্দে এই গাড়ি থেকে ওই গাড়ি করে বেড়াচ্ছিল। আর আমার জানার আগেই সে একটা চলন্ত গাড়ির নিচে পড়ে……”। মনে হচ্ছে আমি অনেক দূর থেকে তার কথাগুলো শুনছি – বিশ্বাস করতে পারছি না। সে আমার দিকে ফিরে বলল, “তোমার মনে পড়ে কিভাবে আমি ওকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম”?
স্তব্ধ আমি যখন তার দিকে তাকালাম তখন আমি নিশ্চিত জানি যে আমার সবুজ সিল্ক শাড়ি পরা মহিলাটি চিরদিনের জন্য ৭৩ এর যুদ্ধবন্দী হয়েই থাকবে। এটাই তার নিয়তি।

*****

পুনশ্চঃ এটা ডো নায়ার লিখিত “আই ম্যারিড দ্যা আর্মি” বইয়ের একটা চ্যাপ্টারের অনুবাদের দূর্বল চেষ্টা। লেখিকা ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন জেনারেলের স্ত্রী হিসেবে দীর্ঘ ২৮ বছরের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছেন বইটিতে।

১১ টি মন্তব্য : “৭৩ এর যুদ্ধবন্দী”

  1. মুজিব (১৯৮৬-৯২)

    ঝরঝরে অনুবাদ।
    আসলে, যুদ্ধ মানেই বহু মানুষের জীবনে নেমে আসা ভয়াল বিভিষিকা, যার হাত থেকে তাঁরা আমৃত্যু মুক্তি পান না।
    বহুমাত্রিক এই বিভিষিকার রূপ যে যেভাবে দেখে (কিংবা দেখতে চায়) সেভাবেই বর্ননা করেন। আক্ষেপ হয়, যেসকল লক্ষ-কোটি বাঙালী পাক-নারকীয়তার শিকার হয়ে চিরদিনের জন্য ৭১ এর যুদ্ধে বন্দি হয়ে আছেন তাঁদেরকে নিয়ে কোন ভিনদেশী যদি এমন আবেগময় কাহিনী লিখতেন! যা আছে তা নিতান্তই অপ্রতুল এবং পাদপ্রদীপের আলো থেকে অন্য পক্ষের প্রচারনার চেয়ে যোজন যোজন ক্রোশ দুরে। সেরকম কিছু হাতে পেলে অনুবাদ করবো, আশা রাখি।


    গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

    জবাব দিন
  2. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    টুশকি ভাই, কেমন আছেন?
    খুব সাবলীল অনুবাদ। যেকোনো যুদ্ধেই বিজয়ী বা বিজিত থাকে, কিন্তু দিনশেষে আসলে পরাজিত হয় মানুষ। (সম্পাদিত)


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  3. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    সায়েদ, বহুদিন পর। চমৎকার হয়েছে অনুবাদ। এভাবে পুরো বইটাই করে ফেলো না? খুব খুশি হবো। মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি অধ্যায় আসুক আমাদের সামনে।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  4. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    টুশকিদা,
    আপনি সিসিবিতে?? কতদিন পর আসলেন...ব্লগের ঠিকানা মনে ছিল? কেমন করে? 😛

    সানা ভাই এর মত আমিও বলি- ধীরে ধীরে পুরোটাই অনুবাদ করে ফেলুন।
    দারুণ একটি ব্যাপার হবে! 😀


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  5. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    খুব ভালো লেগেছে এই লেখা।
    "শুধুমাত্র যখন সামরিক কেতায় কিছু আদেশ করা হচ্ছে তখন খানিকটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় তাদের মাঝে – তারা আদেশ মেনে চলে।" - লেখিকার এই পর্যবেক্ষণটাও সুন্দর হয়েছে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।