সিসিবি’কে নিয়ে যত কথা

গত মার্চ মাসের দ্বিতীয়ার্ধে এখানে (লাইবেরিয়া) আসার পর থেকে জীবনযাত্রা বেমালুম বদলে গেল। আগে সকালে পিটি, বিকেলে গেমস এর মধ্যে অফিস করার পর সন্ধ্যার পর পুরো সময়টা আমার থাকত। তার সাথে উইকএন্ডের দুইটা দিন। কিছু ইমার্জেন্সি বাদে আমি নিজের ও পরিবারের জন্য এই সময়টুকু একরকম নিরুপদ্রবভাবেই পেতাম। নিজের ও বৌয়ের বাসা থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধবদের বাসা, বাজার অথবা বৌয়ের ইউনিভার্সিটি প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও দৌঁড় খাটতে হত। জীবনের অংশ হিসেবে সেটা মন্দ ছিল না। সেখানের তুমুল ব্যস্ততার পর এখানে এসে জীবনটা বন্দী হয়ে গেল ১০০ বর্গমিটারের মধ্যে। সকালের পিটি থেকে শুরু করে রাত্রে একত্রে ডিনার পর্যন্ত সমস্ত কার্যক্রম সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল ক্যাম্পের ভিতরে। এমনও হয়েছে যে সারাদিনে সর্বোচ্চ দূরত্ব অতিক্রম করেছি ৫০ মিটার!!

প্রথম দেড় দুই মাসের ভিতরেই সাথে করে নিয়ে আসা মুভি এবং গল্পের বই শেষ হয়ে গেল। ইউএন এর ইন্টারনেটের বদৌলতে প্রতিদিন মেইল চেক করাটা হয়ে উঠত কিন্তু নিরবিচ্ছিন্নভাবে সংযুক্ত থাকা হতো না। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে অফিসিয়াল কাজ নিয়ে মনরোভিয়া থাকতে হল প্রায় এক মাস। সত্যিকার অর্থেই তখন অথৈ সাগরে পড়লাম। কারণ এখানে কোন ইউএন নেট কানেকশন নেই। তখন হাতের সামনে অপশন হয়ে আসল মোবাইল কোম্পানীর জিপিআরএস সার্ভিস। বাংলাদেশের চাইতে দ্বিগুণ রেটে সেটাকেই আপন করে নিলাম। সর্বক্ষণ নেটে সংযুক্ত হয়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াই। কিন্তু কোথাও থিতু হয়ে বসা হয় না।

জুন মাসের কোন এক রাত্রে ক্যাম্প ডিউটি অফিসারের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সেন্ট্রিপোস্ট ইন্সপেক্ট করছি। এমন সময় সিরাজ (১৯৯৪-২০০০) এলো গাড়ি হাকিয়ে – ও আবার এরিয়া ডিউটি অফিসার হিসেবে আমাদের এখানের সবগুলো ক্যাম্প ইন্সপেকশনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। এসেই হড়বড় করে অনেকগুলো কথা বলল। তার মধ্যে খানিক বুঝতে পেরেছি, খানিক ধোঁয়াশা। তখনই প্রথম ‘ব্লগ’ শব্দটার সাথে পরিচিত হলাম। আরও বুঝলাম এটা এমন একটা প্ল্যাটফম যেটা ইতিপূর্বে কখনও এক্সপেরিয়েন্স করিনি। যথারীতি গুঁতাগুঁতি করে নিজেকে মেম্বার করে নেয়ার চেষ্টা। একটু একটু করে নিয়ম কানুন, সিস্টেম ইত্যাদি শিখতে থাকলাম। পরিচিত হতে থাকলাম সবার সাথে। টুকটাক কমেন্টও করা শুরু করলাম। একটু লজ্জা লজ্জা লাগতো প্রথম প্রথম। কে কি ভাবে এই নিয়ে টেনশন। কে সিনিয়র কে জুনিয়র, কে কোথায় দিয়ে মাইন্ড খায়, ভুল বোঝাবুঝির সুষ্টি হয় ইত্যাদি চিন্তা খুব কাজ করত। কিন্তু দেখি সবাই দুহাত বাড়িয়ে আছে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করার জন্য।

আমার বাংলা টাইপের হাতেখড়ি বছর খানেক আগে এমএস ওয়ার্ডে বিজয়ের মাধ্যমে। এই ব্লগে আসার আগ পর্যন্ত বিজয় ছাড়া দ্বিতীয় কোন অপশনও জানা ছিল না। “অভ্র” হাতে এলো আকাশের চাঁদ হয়ে। ২০০৬ এর সেপ্টেম্বরে বেক্সকা’র একটা অনুষ্ঠানে প্রকাশিত সাময়িকীতে আমার যেই লেখাটা ছিল (৫১ একরে সীমাবদ্ধ জীবন) সেটা দিয়ে শুরু করলাম সিসিবি’তে লেখালেখি। কি প্যাঁচ দিয়েই না লিখতে হত তখন। প্রথমে এমএস ওয়ার্ডে লিখতাম। সেখান থেকে অভ্র কনভার্টার দিয়ে প্রসেস করে সিসিবি’তে তুলে দিতাম। তাতেও শেষ রক্ষা হতো না। অনেক অনাকাঙ্খিত ট্যাগ যুক্ত হয়ে যেত পুরোটা লেখা জুড়ে। সময়ে সময়ে জিহাদদের হাত ধরে শিখলাম সেগুলো থেকে পরিত্রাণের উপায়। সময়ে অসময়ে শিশুতোষ ডাউট দিয়েছি। ধৈর্য্য ধরে মডারেটররা সেগুলো ক্লিয়ার করেছেন (তাদের সবাইকে স্যালুট)। এভাবে এক ছাড়া গরু থেকে সিসিবি’তে বান্ধা গরুতে পরিণত হলাম।

আমি যখন শুরু করি তখন এখানের লেখা ছিল তিনশ’র কোঠায়। পুরনো লেখাগুলো পড়তে যেয়ে কখনো হাসি, কখনো কাঁদি, কখনো গর্বে বুকটা ভরে ওঠে, আবার কখনো ভালোবাসায় আপ্লুত হই। নিজেকে আবিস্কার করতে থাকি সবার একজন হিসেবে। যাই লিখি না কেন সবাই সেটা বিশাল হৃদয়ের উদারতা দিয়ে গ্রহণ করে। এটা আমাকে অণুপ্রাণিত করেছে। অনেক অনেক কথা ছিল যেগুলো এখানে শেয়ার করব কি করব না ভেবে আকুল হতাম। এই উদারচিত্ত অণুপ্রেরণা সেগুলো শেয়ার করতে উৎসাহ দিয়েছে। নতুন অনেক কিছু ভাবতে এবং শেয়ার করতে শিখিয়েছে। এর ফাঁকে ফাঁকে চলে পরিচিত এক্স ক্যাডেটদের ধরে ধরে এখানের মেম্বার বানানো। ইদানিং এই কাজটার মতোন আনন্দ আর কিছুতেই পাই না।

আমার ১০০ বর্গমিটারের দৈনন্দিন জীবনের একটা বড় সময় কাটত সিসিবি’তে। কার কি লেখা জমা পড়ল, কি কি কমেন্ট করল ইত্যাদি দেখতে দেখতেই সময় পার। নভেম্বরের ১৫ তারিখে সেই ক্যাম্প জীবন পরিবর্তিত হল মনরোভিয়ার অস্থায়ী নিবাসের জীবনে। এখানে এখন আমার দৈনিক গাড়ি দাবড়াতে হয় প্রায় ৫০ কিলোমিটার (সুদে আসলে শোধ হচ্ছে আর কি)। তার সাথে সাথে চলে আমার সিসিবি ব্রাউজিং। মাঝে মাঝে ভাবি পরিবার পরিজন, বন্ধুবান্ধবহীন এই বদ্ধ জীবনের মাঝে সিসিবিরূপী জানালাটা না থাকলে যে কি করতাম (এমন কি অন্য কোন ব্লগেও মন টানে না)! সিসিবি’ই যথেষ্ট মনে হয়। এটা ঠিক যে এখন অপার সময় আছে সিসিবি’কে দেয়ার জন্য – দেশে গেলে হয় তো সেটা থাকবে না। কিন্তু ভাবতে ভালো লাগে এটাকে ছাড়া লম্বা সময় থাকতে পারব না। সুস্বাস্থ্যের জন্য যেমন সবরকম খাদ্য উপাদানের সুষম বন্টনের প্রয়োজন আছে তেমনি সিসিবি আমার মনের জন্য এক অপরিহার্য উপাদানই বটে।

জয়তু ক্যাডেটস।
জয়তু ক্যাডেট কলেজ।
জয়তু ক্যাডেট কলেজ ব্লগ।

সানাউল্লাহ ভাইয়ের পথ ধরে আলাদা ব্লগ হিসেবেই নিজের কথাটুকু লিখলাম।

৫,২৯৯ বার দেখা হয়েছে

৫২ টি মন্তব্য : “সিসিবি’কে নিয়ে যত কথা”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)
    এখন অপার সময় আছে সিসিবি’কে দেয়ার জন্য - দেশে গেলে হয় তো সেটা থাকবে না।

    আমরাও এই ভয়টা পাইতেছি... 🙁 😕 :(( :bash:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. জিহাদ (৯৯-০৫)

    সায়েদ ভাই হৈতেসে আমাদের ব্লগের অতন্দ্র প্রহরী। কারণ আমি যতক্ষণ থাকি অনলাইনে সায়েদ ভাইরেও ততক্ষণ দেখি।

    সিসিবি কে যে মানুষটা এত এত ভালবাসে বিনিময়ে সিসিবিও তাকে না ভালবেসে থাকতে পারে? :hug:


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  3. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    ভাইয়া আপনার অপার সময় সিসিবিকে দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। বিনিময়ে সিসিবি দিয়েছে আপনাকে ভালবাসা আর একগাদা কমেন্ট। সবচেয়ে বেশি কমেন্ট মনে হয় আপনিই পেয়েছেন। অল্প সময়ের অল্প একটা অংশ যেন সবসময় সিসিবির জন্য বরাদ্দ থাকে।

    জবাব দিন
  4. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    সিসিবির এইসব পোলাপাইনগুলারে বন্ধুর চেয়ে বেশিই মনে হয়। আমার বউ মাঝে মধ্যে ব্লগাতে দেখে ক্ষেপে। তার কথা কেন আমি সিরিয়াস কিছু লিখি না? পত্রিকার জন্য। তাকে তো বলতে পারি না, সিসিবির মতো বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা থাকলে মন আর কিছুতেই বসে না।

    সায়েদ, আমার নাম দিয়া বরিশালের একটা পোস্ট বাড়াইয়া নিলা!! :thumbup:


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  5. রহমান (৯২-৯৮)

    অত্যন্ত চমকার আর সাবলীল লেখা দোস্ত :boss: । এক টানে পড়ে শেষ করলাম।

    এটা ঠিক যে এখন অপার সময় আছে সিসিবি’কে দেয়ার জন্য - দেশে গেলে হয় তো সেটা থাকবে না

    তোর এই সমস্যা সমাধানের কয়েকটা সাজেশন দেইঃ

    ১। তোর তো হিলে পোষ্টিং হবে না, প্লেইন ল্যান্ডেই থাকবি, সো প্রতি সিসিবি গেট টুগেদারে সশরীরে হাজির হয়ে যাবি (তোর আর তোর শ্বশুরের বাসা দুটাই যে ঢাকাতে এইটা কাউকে আর নাই বা বললাম 😀 )

    ২। ল্যাপটপ কিনে মোবাইলে জিপিআরএস নিবি অর্থাৎ, "যেখানেই থাকুন, সিসিবিকে সাথে রাখুন"

    ৩। ভাবীরেও সিসিবির মেম্বার বানাইয়া ফেলবি 😉 তাইলে আর সিসিবি নিয়ে পড়ে থাকলে বাগড়া দিবে না 😀

    জবাব দিন
  6. বেশ কিছুদিন ধরে ক্যাডেট কলেজ ব্লগে অনাহুতের মত ঘুরাঘুরি করছি।আমি কোন ক্যাডেট কলেজের না, আমার কোন ক্যাডেট নাম্বার ও নেই। তবে এখানে আসলে কেন জানি খুব ভাল লাগে।সবাইকে খুব আপন এবং পরিচিত মনে হয়।আমার সকল প্রিয়জন কোন না কোন ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ক্যাডেট, সে কারনে বোধহয়।
    সায়ীদ স্যার আর আমি পাশাপাশি রুম এ থাকি, রাতে দুই রুমে কীবোর্ডে খটখট আওয়াজ শোনা যায়। স্যার লিখেন সিসিবিতে আমি লিখি সচলায়াতনে।সিরাজ এর কল্যানে আমিও বাংলা লেখা শিখলাম, একই সময়ে।অধ্যাপক আবু সায়ীদের ভাষায়, লেখার আনন্দ সন্তানের পিতা হওয়ার আনন্দের চেয়ে কোন অংশে কম নয়, আর ব্লগে লেখার আনন্দ ত আর বেশী। আমি সন্তানের পিতা হওয়ার আনন্দে আরো বেশী আনন্দিত হতে চাই।লিখতে চাই এই আলোকিত মানুষদের মাঝে। এই আনন্দ আমি পাব কি?

    জবাব দিন
  7. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)
    পুরা কাঠ সিভিল । তারে সিসিবি আর ক্যাডেটের মর্ম বোঝানো শক্ত ।

    বস, আমার মত একটা ব্রেইনওয়াশ কোর্স দিয়া দেখতে পারেন...ক্যাডেট ছাড়া অন্য পাবলিকদের সাথে বেশি মিশতে দিবেন না, আর সু্যোগ পাইলেই "ক্যাডেটরা কেন সিভিল দের চেয়ে ৬ বছর এগিয়ে"- এই বিষয়ে লেকচার দেওয়ার চেষ্টা করবেন... :grr:

    টুশকি ভাইয়া হইল আমাদের সিসিবির ডালিমকুমার...তার প্রাণভোমরা টুশকি ভাবীরও সিসিবির মর্ম না বুইঝা উপায় আছে? :tuski:


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  8. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    ক্যাডেট কলেজের কথা শুনলে যতটা ভাল লাগে,এখন সিসিবি-র কথা শুনতেও সেরকম ভাল লাগছে। চমৎকার লেখা সায়েদ ভাই।
    দেশে আসার পরও যেন আপনার লেখা কমে না যায় সেই আশা করছি।

    জবাব দিন
  9. তানভীর (৯৪-০০)
    এটা ঠিক যে এখন অপার সময় আছে সিসিবি’কে দেয়ার জন্য - দেশে গেলে হয় তো সেটা থাকবে না।

    সায়েদ ভাই, খুব ভয় এবং দুঃখের কথা। 🙁

    দেশে আসার পরও যেন আপনার লেখা কমে না যায় সেই আশা করছি।

    সহমত।

    জবাব দিন
  10. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)
    আর শালা যেমনে আগেই ভাবীর নামে ডাউট দিয়া ফাকিবাজির রাস্তা খোলা রাখতাছোস

    বস,
    আপ কা নাম্বার কাব কায়েগা?... :-/
    মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম হইলো না... ;))


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তাইফুর (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।