আইসিইউ, ঢাকা সিএমএইচ

৯ আগস্ট ২০০৭ এর রাত সাড়ে দশটার দিকে ফোন আসল শাইখের কাছ থেকে। যশোরে একটা বাইক এ্যাক্সিডেন্ট করে নাকি তিনজন এয়ার ফোর্স অফিসার আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে অবস্থা খারাপ রাজীবের। ওকে হেলিকপ্টারে ঢাকা সিএমএইচ’এ ইমার্জেন্সি ইভাকুয়েট করা হচ্ছে। এই খবর পাওয়ার পর আর বাসায় থাকা হলো না। এক ছুটে যখন সিএমএইচ এর পার্কিং লটে পৌঁছালাম ততক্ষণে রাজীবের সঙ্গীসাথী অফিসার কলিগরা এসে পড়েছে। রাজীবের বাবা মা’ও এক পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছেন। মোবাইলে আপডেট পাওয়া যাচ্ছে, হেলিকপ্টারের গতিবিধি ট্র্যাক করা হচ্ছে। আধা ঘন্টাখানেক পর এ্যাম্বুলেন্সে করে রাজীবকে আনা হলো।

আইসিইউ’তে নেয়ার ফাঁকে এক পলক দেখার সুযোগ মিলল। সারা শরীরে কোন আঘাতের চিহৃ নেই। মাথায় বাড়ি লেগে বেচারা অজ্ঞান হয়ে গেছে। ওকে নিয়ে শুরু হল ডাক্তারদের কসরৎ। প্রয়োজনীয় অক্সিজেন, স্যালাইন, ঔষধ দেয়া হলো। এক্সরে করানো হলো। কাঁচের জানালার বাইরে থেকে আমরা চুপচাপ দেখি আর নিয়তির দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে থাকি। কখনো ডাক্তার বাইরে আসলে মুখে প্রশ্ন ঝুলিয়ে আকুল নয়নে তাকাই। তারা বলে ৭২ ঘন্টা না গেলে কিছুই বলা যাবে না। এই কথার জেরেই কিনা জানি না তৃতীয় দিন রাজীবের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। কার্টেন দিয়ে ঢেকে জোর জবরদস্তি করে ভেন্টিলেটর দেয়া হলো। মেডিক্যাল বোর্ডের সব সদস্যদের আনাগোনা দেখা গেল। এয়ারফোর্সের কিছু সিনিয়র অফিসারকেও আইসিইউ এর বাইরে দেখা গেল। আন্টি খুব কাঁদছেন। ওয়েটিং রুমে তাঁকে অনেক্ষণ শক্ত করে ধরে বসে থাকলাম।

ইতিমধ্যে শুভানুধ্যায়ীরা আসছেন, অনেকটা সময় কাটাচ্ছেন আইসিইউ এর ভিতর বিছানায় ছড়িয়ে পড়ে থাকা রাজীবকে দেখে। দূরত্বর দিক থেকে বড় সুযোগ ছিল বলে দিনের মধ্যে তিন চারবার রাজীবকে দেখতে আসতাম। এরকমই একদিন সন্ধ্যা থেকেই আছি সেখানে। অনেকের সাথে তানিলা আর মারজিয়া এসেছে। তানিলা হলো রাজীব আর আমার এমআইএসটি ক্লাসমেট। আর মারজিয়া একাধারে আমার আর রাজীবের কলিগ এবং এমআইএসটি’তে একই ডিপার্টমেন্টে অধ্যয়নরত। সন্ধ্যা থেকে ওরাও আছে। দুজনেই আইসিইউ এর কাঁচের জানালার সামনে থেকে সরছে না। জানি তানিলা সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওয়ারিদে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে তবেই বাসায় ফেরে। মারজিয়াও ফিরবে মিরপুর ক্যান্টনমেন্টে। ওরা একটু আগায় আবার থমকে থমকে দাঁড়ায়।

একসময় মারজিয়া জানালা থেকে দূরে সরে এসে আস্তে করে আমাকে বলল, “স্যার, আমার আব্বা ঐ বেডটাতেই ছিলেন। পুরো একুশটা দিন। তারপর ওয়ার্ডে শিফট করে দিয়েছিল”। বাকিটা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি জানি বাকিটা কি। আঙ্কেল সেবার আর ফিরতে পারেননি। চলে গিয়েছিলেন না ফেরার দেশে। খানিক পরে তানিলাও সরে এলো। অপ্রত্যাশিতভাবে ও জানালো, “ভাইয়া, আমার আব্বা ঐ বেডটাতে ছিলেন। টানা ছয় দিন”। আমি জানতাম তানিলার আব্বা বেঁচে নেই, স্ট্রোক করে আর ফিরতে পারেননি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সেটা মনে করে বুকের ভিতরটা কেমন যেন নড়ে চড়ে উঠল। আমি আর ওদের বলতে পারলাম না “বাসায় যাও, রাত হয়ে যাচ্ছে”। চুপ করে কাঁচের জানালা দিয়ে রাজীবকে দেখতে থাকলাম। মনের ভিতর ভয় – কি হয়, কি যে হয়!! হে আল্লাহ তুমি আমাদের রাজীবকে রেখে যেও।

খুব আস্তে আস্তে, বোঝা যায় কি যায় না এমনভাবে রাজীব সেরে উঠতে থাকল। টানা এগারো দিন থাকার পর ওকে আইসিইউ ১ থেকে শিফট করে নিয়ে রাখা হয় আইসিইউ ২ তে। তারপর নেয়া হয় কেবিনে। ও স্মৃতিশক্তি একরকম হারিয়েই ফেলেছিল। আস্তে আস্তে সেটা ফিরতে থাকল। লম্বা একটা সময় হাসপাতালে থাকার পর ও ছাড়া পায়। আগের সেই রাজীবের অনেকটাই আগের মতোন নেই। তারপরও ও এখন অনেকটাই সুস্থ হয়ে যে স্বাভাবিক কাজকর্ম করছে, অফিসে যাচ্ছে আসছে, পরিবারের সাথে মিলেমিশে আছে সেটাই আমাদের জন্য বড় পাওয়া।

পাঠক, ওর জন্য দোয়া করবেন।

২,০১৪ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “আইসিইউ, ঢাকা সিএমএইচ”

  1. রায়হান আবীর (৯৯-০৫)

    যাক!! আমি ভেবেছিলাম শেষে এসে একই পরিণতি হবে রাজীব ভাইয়ের।

    উনি ভালো থাকুক। মানুষ যে কেন মটর সাইকেল চালায়!! সেদিন আইইউটির গেমন ইন্সট্রাক্টর মারা গেলেন হোন্ড একসিডেন্টে। 🙁 🙁

    জবাব দিন
  2. তাইফুর (৯২-৯৮)

    আই,সি,ইউ'এর গল্প ভাল লাগে না।
    প্রতিদিন কেউ না কেউ ...
    প্রতিদিন ...
    আই,সি,ইউ'এর গল্প ভাল লাগে না।


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফয়েজ (৮৭-৯৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।