মাসল টি ব্রেক

স্কুল কলেজে টিফিন টাইম বলে দশটা থেকে এগারোটার দিকে যেই সময়টা পাওয়া যায় ক্যাডেট কলেজে তার নাম “মিল্ক ব্রেক”। এসময় দুধসহ সামান্য নাস্তা পরিবেশন করা হয়। আর বিকেলের নাস্তা পানীয়ের নাম “টি ব্রেক”। নামেই এর পরিচয় – বিকেলে দুধের পরিবর্তে চা পরিবেশিত হয়।

সন্ধ্যার আগে টি ব্রেকের এই সময়টা খুব সংকীর্ণ। গেমস, গেমসের পর দ্রুত গোসল এবং মাগরীবের নামাজে হাজিরা দেবার ফাঁকে সময়টা যেন হুশ করে উড়ে যায়। তার উপর লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকা এবং লাইন ধরে ডাইনিং হলে আসার ভিতরেও ঝামেলা বড় কম নেই। তাই যখন নাস্তার পর গরম চায়ের কাপে আয়েশ করে চুমুক দিতে যাই তখনই প্রিফেক্টরা তাড়া লাগায়। তা না হলে মাগরীবের নামাজে দেরী হয়ে যাবে। জলদি করতে যেয়ে বেশ কয়েকবার জিভ পুড়িয়েছি। পরে একটা উপায় বের করে নিয়েছিলাম। তাড়াহুড়ো লাগলে অম্লান বদনে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিতাম চায়ের কাপে। চা পরিণত হতো শরবতে। এক চুমুকে শেষ করে ফেলতাম এক কাপ চা।

মুহম্মদ জাফর ইকবালের “বিজ্ঞানী সফদর আলীর মহা মহা আবিষ্কার” বইটা আমাদের ক্লাসে একসময় খুব হিট হয়েছিল। বিশেষ করে বানর চরিত্র ‘জংবাহাদুর’। কয়েকজন রীতিমত জংবাহাদুরের মতোন অঙ্গ সঞ্চালনও শুরু করেছিল। বইতে কলা চায়ে ডুবিয়ে খাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। বন্ধুদের কেউ কেউ টি ব্রেকে সেই কাজ শুরু করল, বাকিরা দেখে বহুৎ আমোদিত হয়েছিল।

এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালীন এবং প্রস্তুতিকালীন সময়ে অধিক রাত জেগে লেখাপড়া করার উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষ রাত দশটা নাগাদ একটা বিশেষ টি ব্রেকের আয়োজন করেন। শুধু পরীক্ষার্থীরা এসময় চা বিস্কুট পেতে পারে। ক্যাডেটদের রাত জাগার জন্য চায়ের প্রয়োজন খুব একটা হয় না। তবুও দল বেঁধে ডাইনিং হল পর্যন্ত যেতে, সবার সাথে নাতিদীর্ঘ একটা আড্ডা মারতে সবারই ভালো লাগত। সন্ধ্যা থেকে একটানা লেখাপড়ার ক্লান্তি কাটাতে সেটা টনিকের কাজ দিত।

ফল কিনে খাবার চেয়ে পেড়ে খাবার মজা বেশি। বিশেষ করে তা যদি নিষিদ্ধ গাছের ফল হয় তবে তো থ্রিলটাই আলাদা। রাতকালে চা ব্যবস্থা সবারই এরকম মনমতো হত না। চুরি করা ফল খাবার থ্রিল খুঁজতে কেউ কেউ নিজের মতোন করে চা বানিয়ে তবেই খেত। সেইরকমই একজন আমাদের রাজীব। ওর শখ ছিল ইলেকট্রনিক্স। এটাতে ওটাতে তার পেঁচিয়ে, কানেকশন দিয়ে এটা ওটা বানিয়ে রাজীব বেশ হাত পাকিয়েছিল। প্রথম দিকে এটা নিয়ে খোঁচাখুঁচি করলেও ইলেকট্রনিক্সে দখল দেখে শেষমেষ আমরা সবাই ওকে বেশ শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছিলাম। এর পাশাপাশি আরেকটা ব্যাপারে ও হাত (নাকি শরীর?) পাকিয়েছিল। তা হলো, বডি বিল্ডিং ও মার্শাল আর্ট। এটাতে ওর দখল কতটুকু তা যাচাই করা যায়নি। তবে মাঝেমধ্যেই আমাদের কাউকে খাটের উপর চড়িয়ে ও নিচে শুয়ে পুরো খাটসমেত উঁচুনিচু করত। এমনও শোনা যায়, রাজীব শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকত আর অন্তরঙ্গ বন্ধুদের বলত আগাপাশতলা পেটাতে। এই সুযোগ কেউ হাতছাড়া করত না 😀 । এরকম করতে করতে ওর হাতের, শরীরের মাংসপেশীগুলো থোক থোক আকার পেয়েছিল। রাজীব সেটা প্রদর্শনে কার্পণ্য করত না। প্রতিদিন তুচ্ছাতিতুচ্ছ কাজে অনাবশ্যকভাবে হাতের মাসল ব্যবহার আমাদের খোঁচাখুঁচির বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। বলা বাহুল্য এই কারণেই সে অনেকগুলো বিশেষনে ভূষিত হয়েছিল।

আমাদের রুমগুলোতে কোন সকেট নেই। রয়েছে দুটি ফ্যান ও তিনটি লাইটের জন্য সর্বসাকুল্যে পাঁচটা সুইচ। তাই আমাদের ইলেকট্রিক আউটপুটের দরকার হলে যে কোন সুইচের ঢাকনা খুলে একটা স্ক্রু পুরো এবং আরেকটা স্ক্রু আধাখোলা রেখে তার ভিতর টু পিন প্লাগ ঢুকিয়ে দিতাম। এতে খুব সুন্দর কাজ সমাধা হতো। প্লাগের পিন আর সুইচের দুটো প্রান্ত খুব বেশি ঢিলা হয়ে গেলে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করতাম। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক। কিন্তু একটু আধটু শক খাওয়া বড় কোন সমস্যা না।

রাতের চা খাবার জন্য যখন আমরা সবাই দল বেঁধে রওয়ানা দিচ্ছি তখন ২০৩ নম্বর রুমে লুকানো স্থান থেকে রাজীবের চা বানানোর সরঞ্জামগুলো বের হতো। এর মধ্যে একটা টু পিন প্লাগ, প্লাগের সাথে সংযুক্ত লম্বা তার এবং তারের মাথায় একটা হিটার লাগানো ছিল। বলা বাহুল্য, এই হিটারটা রাজীবেরই বানানো। একটা পুরনো ব্লেডের উপর অসংখ্যবার তামার তার পেঁচিয়ে সেটা তৈরী করা। হিটারের পাশাপাশি পানি গরম করার জন্য মগ, চিনির কৌটা, গুঁড়ো দুধের কৌটা আর টি ব্যাগের প্যাকেটও বের হতো। তার চা বানানোর পুরো প্রক্রিয়াটা ছিল দেখার মতোন।

প্রথম প্রথম এই অবিস্মরণীয় চা বানানো পর্ব অবলোকন এবং চা খাওয়াটা সেখানেই সারার মতলবে ঠিক সময় মতো আমরা রাজীবের রুমে হাজির হতাম। কিন্তু সেখানে গ্যাঞ্জামটাই করতাম বেশি। কেউ হয়তো গরম হয়ে ওঠা পানির অর্ধেকটা নিয়ে নিল, কেউ হয়তো এক চামচ চিনি মুখে পুরে দিয়ে তা ইন্ডিয়ান না দেশি তার বিচার শুরু করলো, কেউবা গুঁড়ো দুধের মসৃণতা ট্যালকম পাউডারের সঙ্গে তুলনা করার জন্য মেঝেতে ছিটিয়ে দিল খানিকটা, কেউ হয়তো হ্যাচকা টানে হিটারের কানেকশনটাই দিল খুলে। সবই আমরা করতাম শার্টের হাতা গুটিয়ে, অনাবশ্যক মাসল ফুলিয়ে, রাজীবকে দেখিয়ে দেখিয়ে। ত্যাক্ত-বিরক্ত রাজীব পরবর্তীকালে চা খাবার সময় হলেই দরজার ছিটকিনি তুলে দিত।

তাতে আমাদের উৎসাহের কমতি হতো না। জানালায় ভিড় লাগিয়ে আমরা তামাশা দেখতাম। বই খাতা টেবিল থেকে তিরোহিত হতো। সেখানে পানির মগে পানি গরম হচ্ছে। সাময়িক বিরতি নিয়ে রাজীব পাশে অপেক্ষা করছে। ইচ্ছা আছে, চা খেয়ে এমন পড়া দেবে যে বিদ্যাসাগর ফেল। মগে পানি টগবগ করে ফোটা শুরু করলে ও হ্যাচকা টানে হিটারের কানেকশন খুলত। ধোঁয়া ওঠা পানিতে প্রয়োজনমাফিক দুধ চিনি দিয়ে একটা টি ব্যাগ ডুবিয়ে বিছানায় উঠে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসত। সেখানে চামচ নাড়তে নাড়তে চলত ওর এক মগ চা খাওয়া। পুরো সময়টাতে ওর হাতের মাসল টগবগ করছে। স্যান্ডো গেঞ্জির আশপাশ দিয়ে মাসলের উঁকিঝুঁকি যেন বিদ্যুতের ঝিলিক। পুরো ঘন্টাখানেক লেগে যেত ওর এই চা বানানো ও খাওয়া পর্বে।

চা শেষ করে রাজীবের মনে হতো, উফ! অনেক পরিশ্রম হলো। চা খাওয়া তো নয় যেন দু্ই মাইল দৌড়! একটু রেস্ট নিই। এই বলে দেয়ালে হেলান দেয়া রাজীব বিছানায় এলিয়ে পড়া রাজীবে পরিণত হত। হয়তো বা সর্বোচ্চ দশ মিনিটের কথা মাথায় রেখে, কেননা সারারাত পড়তে হবে। কিন্তু কিভাবে যে কি হতো রাজীবের ঘুম ভাঙ্গতো সকালে ব্রেকফাস্টের সময় আমাদের ধাক্কাধাক্কিতে।

চা বানিয়ে, চা খেয়ে, ঐ চা বানানোর পরিশ্রমেই যে এমন লম্বা ঘুম দেয়া যায় তা রাজীবকে দেখেই শিখেছিলাম। পরে এটা নিয়ে আমাদের একটা টাইটেল খুঁজতে হয়েছিল। আর আমার প্রতিভাধর বন্ধুরা সেই কাজটি পর্যাপ্ত উৎসাহের সাথেই করেছিল।

******

[এটি যায় যায় দিনের “চা” সংখ্যায় প্রকাশের জন্য লিখেছিলাম বলে কিছু কিছু বর্ণনা (খানিকটা পরিমার্জনার পরও) অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে।]

৩,৫৩৫ বার দেখা হয়েছে

২৯ টি মন্তব্য : “মাসল টি ব্রেক”

  1. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    ইস কতোদিন কলেজের চা খাইনা 🙁 🙁 🙁
    আমিও চা খাপো :((


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  2. তৌফিক (৯৬-০২)

    সায়েদ ভাই, লেখাটা পড়তাছিলাম আর মুচকি মুচকি হাসতাছিলাম কিছু কথা মনে কইরা। আমাদের হাউসে আমরা ৫-৬ জন মিলা চা বানায়া খায়া ঘুম দিতাম, কারণ পরিশ্রমটা কম হইত না। পড়া শেষ কইরা দেখি কাহিনী একই।

    আসলে গ্রেট মাইন্ডস থিংক আলাইক। 😀

    জবাব দিন
  3. তাইফুর (৯২-৯৮)
    ফল কিনে খাবার চেয়ে পেড়ে খাবার মজা বেশি। বিশেষ করে তা যদি নিষিদ্ধ গাছের ফল হয় তবে তো থ্রিলটাই আলাদা।

    সেই আদম হাওয়া থিকা চইলা আসতিছে


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  4. হাসনাইন (৯৯-০৫)
    চা শেষ করে রাজীবের মনে হতো, উফ! অনেক পরিশ্রম হলো। চা খাওয়া তো নয় যেন দু্ই মাইল দৌড়! একটু রেস্ট নিই। এই বলে দেয়ালে হেলান দেয়া রাজীব বিছানায় এলিয়ে পড়া রাজীবে পরিণত হত। হয়তো বা সর্বোচ্চ দশ মিনিটের কথা মাথায় রেখে, কেননা সারারাত পড়তে হবে। কিন্তু কিভাবে যে কি হতো রাজীবের ঘুম ভাঙ্গতো সকালে ব্রেকফাস্টের সময় আমাদের ধাক্কাধাক্কিতে।

    আহা! ভাইজান ক্যান্ডিডেটস টাইমের কথা মনে করায় দিলেন। 🙂

    জবাব দিন
  5. সিরাজ (৯৪-০০)

    সদস্যঃ 10 জন অতিথিঃ 5 জন
    রবিন (৯৪-০০)
    মরতুজা
    ফয়েজ (৮৭-৯৩)
    তানভীর (৯৪-০০)
    সিরাজ (৯৪-০০)
    টিটো রহমান (৯৪-০০)
    হাসনাইন (৯৯-০৫)
    কামরুল হাসান (৯৪-০০)
    মুহাম্মদ (৯৯-০৫)
    মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)
    সাম্প্রতিক মন্তব্য
    (94-00 )=05..... :gulli2: :gulli2: :gulli2: :gulli2:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।