ঢাকা ১১০০০ কিমি

গত ডিসেম্বর মাসে মিশনে আসার জন্য যেদিন নাম বের হল তারপর দিনই ইন্টারনেট থেকে লাইবেরিয়ার উপর বেশ কয়েক পৃষ্ঠা প্রিন্ট আউট নিয়ে নিলাম। ফেলুদাকে দেখেছিলাম তদন্তের বা পর্যটনের জন্য কোথাও গেলে সেই জায়গা সম্পর্কে বিশদ লেখাপড়া করে নিতেন। এমনও হয়েছে যে যাবার পথে প্লেনে বা ট্রেনে বসেও পড়ছেন। তো আমি ঠিক ফেলুদা না বরং কোথায় যেয়ে নাজিল হতে যাচ্ছি সেই জায়গাটা/দেশটা সম্পর্কে খানিকটা জানাই ছিল উদ্দেশ্য। মহা উৎসাহে সেই ২১ পৃষ্ঠাব্যাপী ফিচার পড়া শুরু করলাম। তারপর পদ্মা মেঘনা দিয়ে অনেক পানি প্রবাহিত হয়ে যেয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে, পৃথিবী তার অক্ষের উপর অনেকবার আপন মনে চক্কর খেয়েছে কিন্তু সেই ২১ পৃষ্ঠা আমার এখনও শেষ করা হয়ে উঠেনি 😛 ।

‘লাইবেরিয়া’ নামটা প্রথম আমার মেমোরিতে আসে ক্লাস সিক্সে। তখন ব্যাপক নেশায় ডাকটিকিট সংগ্রহ করতাম। পাশের বাসার এক বড় ভাই ছিলেন আমার জন্য অন্যতম অনুপ্রেরণা। উনার কাছ থেকেই প্রথম লাইবেরিয়ান স্ট্যাম্প পাই – ঝা চকচকে দু্ইটা টিকিটের একটা ছোট্ট সেট। দুটোর সাইজই আনুমানিক আড়াই বাই এক ইঞ্চি। একটাতে একটা আধুনিক ট্রেনের ছবি – পাশে লেখা ফ্রান্স। আরেকটায় একটা পুরনো স্টিম ইঞ্জিনচালিত ট্রেনের ছবি – পাশে লেখা জাপান। সেই দুটো স্ট্যাম্প এখনও আমার সংগ্রহে আছে।

এরপর লাইবেরিয়ার কথা মনে পড়ে কলেজে থাকাকালীন সময়ে। আমাদের টেনিউরের শেষ সিএসএম ছিলেন সার্জেন্ট আতাউর স্টাফ। লম্বা চওড়া দারুণ স্মার্ট লুকিং এই স্টাফকে অফিসার হলেই ভালো মানাতো বলে আমরা মনে করতাম। উনি এই লাইবেরিয়াতে প্রথম গৃহযুদ্ধের সময় অবজার্ভার হিসেবে মিশন করে গিয়েছিলেন। উনাকে নাকি একবার এখানের লোকজন ঘেরাও করে রেখেছিল লম্বা সময় ধরে – জীবনের আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছিলেন।

রাস্ট্রপতি থাকাকালীন লেজেহোমো এরশাদ তার ভাষনে “৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে” বলে বলে আমাদের অনেকের কোমলমতি মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশের মোট গ্রামের সংখ্যা ৬৮ হাজার (এ নিয়ে সাধারণ জ্ঞানে কিঞ্চিত ধরাও খাইছি 😀 )। পরবর্তীতে লেখাপড়া করতে যেয়ে বইপত্র থেকে শিখেছি এটার প্রকৃত সংখ্যা ৮৬ হাজারেরও বেশি। সেইরকম কিভাবে যেন আমাদের মাঝে প্রচলিত হয়ে গেল বাংলাদেশ থেকে লাইবেরিয়ার দূরত্ব ১৮ হাজার কিলোমিটার। আমরা চিন্তা করি আর লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলি – এত দূর দেশে যেতে হবে! সেখানে লম্বা একটা বছর থাকতে হবে!! এখানে আসার পর এই দীর্ঘশ্বাস আরও বাড়ে। ফোন করে বাসায় যখন দূরত্বের ব্যাপারটা মনে করিয়ে দিই তখন ঐপাশেও দীর্ঘশ্বাস ছড়ায়।

এটা এমন আহামরি কোন বিষয় নয় যেটা নিয়ে আমাদের নাওয়া খাওয়া হারাম করতে হবে। কিন্তু কথায় কথায় ব্যাপারটা আমার নজরে আনে আমারই এক সৈনিক। প্লেনে আসার সময় কন্টিনিউয়াস যে স্পিড দেখায় সেখানে কখনোই ৯০০ প্লাস হয়ে ১০০০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় পৌঁছেনি। আর আমরা ঢাকা থেকে মনরোভিয়া এসেছি মাত্র ১৬ ঘন্টায় – তার মধ্যে আবার জিবুতিতে রিফুয়েলিং এর জন্য চার ঘন্টার একটা ব্রেক ছিল। তাহলে কি আমরা ১২ ঘন্টায় ১৮ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছি? যদি তাই হয় তাহলে তো প্লেনের স্পিড হবার কথা ঘন্টায় প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার!

বিষুবীয় অঞ্চলে পৃথিবীর পরিধি প্রায় ৪০ হাজার কিলোমিটার। আমাদের বাংলাদেশ সাড়ে ২৩ ডিগ্রী, লাইবেরিয়া ৬ ডিগ্রী উত্তর অক্ষরেখায় অবস্থিত এবং এই দুই দেশের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ৬ ঘন্টা (লাইবেরিয়া GMT মেইনটেইন করে)। দু্‌ই দেশের অক্ষরেখাতেই পৃথিবীর পরিধি ৪০ হাজার কিলোমিটারের চেয়ে খানিকটা কম। কোণাকুণি দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়েছে বলে যদি বিষুবীয় অঞ্চলের পরিধিই ধর্তব্যে নিই আর ৬ ঘন্টা সময়ের পার্থক্যে তুলনা করি তাহলে বাংলাদেশ ও লাইবেরিয়ার মধ্যে দূরত্ব ১০ হাজার কিলোমিটার!

এরপর যখন আমাদের ছুটি যাওয়া নিয়ে তোড়জোড় শুরু হল তখন এমিরেটস এর ওয়েব সাইটে দূরত্ব মাপতে যেয়ে দেখলাম ঢাকা থেকে ঘানার রাজধানী আক্রার দূরত্ব ৯,৯৮১ কিলোমিটার। তার সাথে যোগ হবে আক্রা টু মনরোভিয়ার প্রায় ৯৫০ কিলোমিটার। সর্বসাকুল্যে প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার (যদিও প্লেনগুলো স্ট্রেট না যেয়ে অনেক জায়গাতেই কান্নি খেয়ে খেয়ে যায়)। এইবার হিসেব সুন্দর মিলে গেল ।

লাইবেরিয়ার ‘গান্তা’ (Ganta) নামক শহুরে স্থান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে আমাদের একটা ইউনিট (বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার – ৯) আছে। সেইখানে একবার যাবার সুযোগ হলে বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন স্থানের দূরত্ব ও দিক নির্দেশক একটা স্ট্যান্ড (আমাদেরই তৈরী) চোখে পড়ে। আমি আর দেরী করি না – চটপট সেটার ছবি তুলে নিই। অন্যান্য কয়েকটা স্থানের সাথে সেখানে লেখা আছে “ঢাকা ১১০০০ কিমি” O:-) ।

২৮ টি মন্তব্য : “ঢাকা ১১০০০ কিমি”

  1. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে হয়তো বাংলাদেশের সেনারা লাইবেরিয়া মিশন থেকে একেবারেই সরে যাবে কোনো এক সময়। কিন্তু এই কিলোমিটার ইন্ডিকেটর স্ট্যান্ড কিংবা ওই বিশাল বাংলাদেশ স্কয়ার চিরস্থায়ীভাবেই হাজার কিলোমিটার দূরের একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির ভিন্নরকম মানুষের দেশের মাটিতে গৌরবের সাথেই প্রতিনিয়ত জ্বল জ্বল করতে থাকবে আমাদের দেশটার নাম বুকে নিয়ে। ভাবতেই কেমনযেন লাগছে বুকের ভেতর।

    সায়েদ দোস্ত এই মুহূর্তে তোদের সবার জন্য :salute: :salute:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  2. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    তোমার ভৌগলিক জ্ঞান তো খারাপ না, মোটামুটি ভালই দেখি।

    তোমার ছবিটা সুন্দর হইছে, কান্দে একটা একে-৪৭ থাকলে আরও মানাইত।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  3. তাইফুর (৯২-৯৮)

    গত কিছুদিন ধইরা টেরাই মারতেছি 'আপনের' মত একটা কিছু লিখবাম। কিছুই দাঁড়ায় না আরেকটা 'সাকসেস অব পিলার' ছাড়া।


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  4. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    :shy: :shy: থ্যাংকস বস।
    আপনার তুলনায় আমি কিছুই না :salute: ।
    ইস্...কতদিন পর আপনাকে পাওয়া গেল বলেন তো!
    আপনার লেখার রেফারেন্স দিচ্ছিলাম আজ ৫৯ সাপোর্ট ব্যাটালিয়নের লেটেস্ট সিও'র কাছে 😀 ।


    Life is Mad.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জুনায়েদ কবীর(৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।