যাদের সাথে বসবাস

লাইবেরিয়াতে আসার আগে বৌ’কে নিয়ে মুশফিকের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সাথে ছিল শামীম। ও বছরখানেক আগে পার্শ্ববর্তী দেশ আইভরী কোস্টে শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করে গেছে। গাড়ীতে বসে শামীম নানান পরামর্শের সাথে সাথে পশ্চিম আফ্রিকার বিপদজনক রোগবালাইয়ের কথা বলছিল। ম্যালেরিয়া, ইয়েলো ফিভার, টাইফয়েডের সাথে ছিল লাসা ফিভারের কথা। লাসা ফিভারে আক্রান্ত হয়ে একজন সৈনিক মারা গেলে স্টিলের কফিনে ৪০ ফুট মাটির নিচে লাইবেরিয়াতেই সমাহিত করা হয়। মৃতদেহ দেশে নেয়ার রিস্কটা পর্যন্ত নেয়া হয়নি। এর বর্ণনা শুনে আমার বুকে মাথা রেখে নতুন বিয়ে করা বৌ বেচারী থরথর করে কাঁপা শুরু করেছিল। শামীমকে থাবড়া দিয়ে থামিয়েছিলাম সেদিন।

এখানে আসার আগে এবং আসার পরপর পুরনোদের কাছ থেকে অনেক ব্রিফিং পেয়েছিলাম। একে তো নতুন জায়গা – ‘ফিয়ার অফ আননোন’ আছেই, তার সাথে যোগ হয়েছে কিছু কীট পতঙ্গ, পোকামাকড় আর জীবজন্তুর কথা। এগুলো আবার একটা থেকে আরেকটা ওস্তাদ।

লাসা ফিভার:

এটা একটা ইঁদুর বাহিত ভাইরাসজনিত রোগ। ইঁদুরের লালার মাধ্যমে এর জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। যে কোন উন্মুক্ত খাদ্যদ্রব্য, গাছের ফল যেখান ইঁদুর অনায়াসে চলাচল করতে পারে সেখানে লাসা ফিভারের জীবাণুর সংক্রমণ নিশ্চিত বলে ধরে নেয়া যায়। আমরা এই ইঁদুরের হাত থেকে বাঁচার জন্য নানান আয়োজন করে থাকি। স্থানীয় কোন ফলমূল খাই না। এখানের গাছের আম তলায় পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যায় – কেউ ধরেও দেখে না। প্রত্যেকটা ঘরে, বিশেষ করে ডাইনিং রুম এবং স্টোর রুমে ইঁদুর প্রতিরোধে সবোর্চ্চ ব্যবস্থা (নেট ব্যবহার, বিষ প্রয়োগ, ফাঁদ পাতা ইত্যাদি) নেয়া থাকে। এর সাথে প্রাকৃতিক ইঁদুর নিধন ব্যবস্থা বিড়াল পালন তো আছেই।

[ইনারা খুব আরামে আছেন। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় লাইবেরিয়ায় সবচেয়ে সুখী কারা, তাহলে আমি উত্তর দেব এখানের “বিড়াল সম্প্রদায়”।]

লাসা ফিভারে আক্রান্ত হয়ে ইতিপূর্বে এখানে বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেছেন। পাকিস্তানী এক সৈনিক একটা ক্যানড কোক খেয়েছিল না ধুয়েই। সেটার উপর দিয়ে যে ইঁদুর নড়েচড়ে লালা ছড়িয়ে গিয়েছিল সেটা তার জানার উপায় ছিল না। আমাদের একটা ক্যাম্পের নাম “ক্যাম্প মিল্টন”। বাংলাদেশী এই বেচারাও লাসার শিকার হয়েছিল।

এই জ্বরের কারণে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে বাৎসরিক মৃত্যুহার প্রায় ৫০০০ জন। স্থানীয় অধিবাসী বলে লাইবেরিয়ানদের শারীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের চাইতে বেশি। তথাপি আমরা লাসা জীবাণুমুক্ত করার জন্য খাদ্যদ্রব্য পরিস্কার করে পানিতে ধোয়া, সেটাকে ফ্রিজের মাইনাস তাপমাত্রায় ঘন্টাখানেক রাখা ইত্যাদি পদ্বতি ফলো করি। আর ইঁদুর? ওই ব্যাটাদের টিকিটাও এখানে এখন দেখা যায় না।

লাসা ফিভার নিয়ে বিস্তারিত আরও জানতে আছে ‘উইকিপিডিয়া’

ম্যালেরিয়া:

ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা এখানে সবচেয়ে বেশি যত্ন নিই সেটা হল ম্যালেরিয়া। এখানের ম্যালেরিয়া মানেই যে সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া তা নয় কিন্তু এটা একেবারে ছেড়েও কথা বলে না। এতটুকু অসতর্ক হলেই নির্ঘাত মৃত্যু – নিদেনপক্ষে ১৫/২০ দিনের নিশ্চিত হাসপাতালবাস।

দেশ থেকে আসার সময় আমাদের প্রস্তুতির একটা অংশ ছিল সাপ্তাহিকভাবে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক ট্যাবলেট (ম্যাফলোকুইন) সেবন করা। আমরা এখানেও সেটা রেগুলার খেয়ে যাচ্ছি। প্রতি বুধবার আমরা ফলইন করে ম্যাফলোকুইন খাই। এটা যে খাওয়া হয়েছে সেটা বিভিন্ন রেজিস্টারেও লিপিব্দ্ধ থাকে। দফায় দফায় ফল-ইনগুলোতে মনে করিয়ে দেয়া হয়। কেউ যাতে ভুলে না যায় সেই জন্য প্রত্যেক রুমের দরজায়, এখানে সেখানে লেখা আছে, “আজ বুধবার। ম্যালেরিয়া ঔষধ সেবন করেছেন কি”? এছাড়া একজন আরেকজনকে শর্টকাটে মনে করিয়ে দেয়, “আজকে ম্যালেরিয়া খাইছিস”? আমি ভাবি ম্যালেরিয়া আবার খায় ক্যামনে!!

দেশ থেকে আমরা সাথে করে নিয়ে এসেছি প্রায় ২০০ টা এসিআই এ্যারোসল ক্যানিস্টার, প্রায় সমান সংখ্যক মশার কয়েল, কিছু গ্লোব ম্যাট ও ইলেকট্রিক ফ্লাই বিটার। প্রচুর মশারীর কাপড় আনা হয়েছে যা পর্দার মতোন দরজা জানালায় ব্যবহার হয়। নেট আনা হয়েছে বেশ কয়েক রোল। এখানের প্রতিটা জানালায় এ্যাডিশনাল নেট লাগানো আছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রত্যেকে মশারী আর অডোমস নিয়ে এসেছে। রাত্রে ঘুমানোর সময় অথবা ডিউটি দেয়ার সময় কেউ মাস্তানী করার কথা চিন্তাও করে না। ঠিক ঠিক মশারী আর অডোমস ব্যবহার করে।

এখানের মশার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে খালি চোখে দেখা যায় না বললেই চলে। আর এইজন্যই সতর্কতাটা একটু বেশি দরকার। ঝোপঝাড় কেটে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। খালি কেটেই শান্তি নাই। কাটার পর আবার আগুন লাগানো হয়। এসব ব্যবস্থা নিয়ে ম্যালেরিয়া ছাড়া মোটামুটি ভালোই আছি।

বৃশ্চিক:

সন্ধ্যার সময় আমাদের এক সৈনিকের আওয়াজ পাওয়া গেল, “স্যার দেইখা যান এইডা কি ধরছি”। মেস থেকে সবাই বের হয়ে দেখি সে একটা লাঠির মাথায় চেপে ধরে আছে কুচকুচে কালো রঙের একটা দশাসই সাইজের বৃশ্চিক (Scorpion)। মাথাটা লাঠির নিচে চেপে ধরা বলে লেজের প্রান্তের হুলটা দিয়ে সে অনবরত লাঠির গায়ে আঘাত করে যাচ্ছে বটে কিন্তু সুবিধা করতে পারছে না। চর্মচক্ষে সেটাই আমার প্রথম বৃশ্চিক দর্শন।

এই প্রাণীটা হুড়মুড় করে দৌঁড়ে চলে আর মাটির গর্তে, পাথরের খাঁজে খাঁজে বসবাস করে। আমাদের লোকজন এর ব্যাপারে খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিল না। ফলে তারা এটাকে নিয়ে ডিল করত খুব দায়সারা ভাবে। কিন্তু এই একটা পাকড়াও হবার পর তাদের সচেতনতা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।

সাপ:

লাইবেরিয়ায় ক্যাম্পে এসে প্রথম যেই জিনিসটা দেখে সবচেয়ে মজা পেয়েছিলাম সেটা হল দরজায় দরজায় লেখা “সর্প হইতে সাবধান”। কিন্তু এই মজাটা উড়ে যেতে সময় লাগেনি। এখানে সেখানে সাপ আবিস্কৃত হতে থাকল। ঘাস ঢাকা পথ তো বটেই ওস্তাদেরা কংক্রিটের উপর এসেও বসে থাকা শুরু করল। তখন কিছু এসপার ওসপার ব্যবস্থা নেয়া হল।

পুরো ক্যাম্প এলাকার ঘাস শুধু কাটা নয় একেবারে চেঁছে ফেলা হল। কার্বলিক এসিডের বোতল এখানে ওখানে রাখা হল (কিন্তু কিছু স্মার্ট সাপ এই বোতলকে পেঁচিয়ে বসে থেকে ভালোবাসা প্রকাশের চেষ্টা করেছে)। পুরনো গাছের গুড়ি গুড়িয়ে দেয়া হল। ময়লা আবর্জনার স্তুপ বহুত দূরে নিক্ষেপ করা হল। প্রতিটা রুমে একফুট উঁচু এন্টি স্নেক ব্যারিয়ার দেয়া হল। দিনে রাতে সবসময় ফুল ট্রাউজারের সাথে বুট অথবা গোড়ালী ঢাকা জুতা ব্যবহার করতে বলা হল। রাতে টর্চলাইট ব্যতিত একটা স্টেপও যাতে না ফেলা হয় সেটা বারবার করে বলে অভ্যস্থ করে ফেলা হল। বিশেষ ক্লাসের আয়োজন করে সর্প দংশন ও এর প্রতিকার নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হল।

এর মাঝেই রোমহর্ষক কিছু গল্প কানে আসতে থাকল। সাপের কামড়ে বেশ কয়েকজন হাসপাতাল পর্যন্ত দৌঁড়ালো। তাদের সবারই ভাগ্য খুব ভালো – ওগুলো কোনটাই বিষাক্ত সাপ ছিল না। কোন একটা অফিসের টয়লেটের হাই কমোড পেঁচিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল এক মোটাতাজা সাপকে। মারার আয়োজন করতে করতেই পগার পাড়। একদিন সকালে বুট পড়তে যাবে এক সৈনিক দেখা গেল সেখানে সুন্দর কুন্ডলী পাকিয়ে বসে আছে একজন। কম্পিউটারের কী-বোর্ডের উপর ইন্টারনেট ব্যবহার (!) করতে আসা এক সাপকে জীবন দিতে হয়েছিল লাঠির ঘায়ে (বেচারা)। আমাদের এক কম্যান্ডো সহকর্মীর হাতে কপাল দোষে এক সাপ বেচারা জ্যান্ত পাকড়াও হয়েছিল। তাকে আর দেখতে হয়নি। গলার কাছে দুই আঙ্গুলের চাপেই সে ইহধাম ত্যাগ করেছিল। যাবার আগে সে আমাদের যথেষ্ট এন্টারটেইন করে গেছে অবশ্য – তাকে নিয়ে আমরা বেশ একটা ফটোসেশন করেছিলাম।

আমি আমার রুমে একটা পাঁচফুটি বাঁশের লাঠি রেখেছি। ২৫ ইউএস ডলার দিয়ে একটা হামানদিস্তা টর্চলাইট (ইউএস পুলিশ স্ট্যান্ডার্ড ইস্যু) কিনেছি – যা দিয়ে প্রয়োজনে সাপও পিটানো যাবে। লাইবেরিয়ায় নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপগুলো পাওয়া যায়। কোথায় এই তথ্য শুনেছিলাম মনে নেই তবে এই ওয়েবসাইটটা মনে হয় লাইবেরিয়ার সাপের ব্যাপারে একবারে মন্দ না।

৩১ টি মন্তব্য : “যাদের সাথে বসবাস”

  1. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    আপনাদের তো বিশাল ঝামেলা। পদে পদে একেবারে মৃত্যুভয়। এমন লাইফ লিড করা তো দূরের কথা, সচক্ষে কাউকে লিড করতে দেখার সৌভাগ্যও হবে না। মনে হয়, এইটাই লাইফ। মৃত্যুভয় না থাকলে আবার লাইফের মজা কি। আমরা তো বোধহয় জীবন কাকে বলে জানিই না। 🙁

    জবাব দিন
  2. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    আপনার দেয়া "Venomous Snakes of Liberia and West Africa" সাইটে গিয়া দেখি, সাপগুলা দেখতে অইন্যরকম। হওয়ারই কথা। তবে আপনার হাতে তোলা কয়েকটা ছবি দেখতে পারলে সেইরকম হইতো। বিলাইয়ের পর এইবার সাপ দিয়া ট্রাই করবেন নাকি?!

    জবাব দিন
  3. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    ছবিটা চরম হইছে। তয় এইডাতে চলবো না। কামরুল ভাইরে ভয় খাওয়ানোর জইন্য আরো ভয়ংকর সাপের ছবি চাই। বীভৎস আর ভয়ংকর। কুত্তা নিয়া সামনে ব্লগ আসতাছে।
    আর পুলিশ নিয়া তো কুন চিন্তাই নাই। মাসরুফ ভাই পুলিশ হওনের পরে ইউনিফর্ম পরা একটা ছবি তার প্রোফাইলে রাখনের ব্যবস্থা করা হইবো।
    সামগ্রিকভাবে এইটা কামরুল ভাইরে ব্লগ ছাড়া করনের সুদূরপ্রসারী দূরভিসন্ধি। :grr:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সায়েদ উল হাসমত (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।