ক্যাডেট কলেজের দিনগুলো- (৩)

পরিচিতি পর্ব

দ্বিতীয় দিন আমদের ক্লাশ সেভেন এর নতুন বই ইস্যু করা হলো। আমরা যেহেতু প্রথম ক্লাশ সেভেন তাই বইগুলো আনকোরা নতুন। আমরা হাউস টিউটর ফনি ভূষণ বোশ সারের কাছে প্রত্যেকে ৫০ টাকা করে জমা দিলাম। কারন তখনকার দিনে ক্যাডেটদের জন্য মাসে ৫০ টাকা খরচ করা খুব কঠিন ছিল। তাছাড়া যেহেতু কোন ক্যন্টিন ছিলনা বিধায় খরচ করবো বা কোথায়? আমদের খরচ বলতে পেন্সিল, শার্পনার, খাতা, ইরেজার ইত্যাদি ক্রয়। কারো কোন কিছু প্রয়োজন হলে হাউস টিউটরের কাছে তালিকা দিতে হতো। উনি সবার তালিকা এক করে সাপ্তাহিক কেনাকাটা করতেন এবং যাতায়ত বাবদ খরচও আমাদের বহন করতে হতো। সাপ্তাহিক খরচ ৫ থেকে ১০ টাকার মতো হতো। কিছুদিন পরে সম্ভবত একটা ক্যান্টিন হলো এবং আমদেরকে টাকার বিনিময়ে কুপন ইস্যু করা হলো। সম্ভবতো প্রতিটি কুপনের দাম ২৫ পয়সা বা ৫০ পয়সা ছিল। আমরা ক্যান্টিন থেকে কি কিনতাম এখন ঠিক মনে পড়ছেনা।

আমাদের প্রথম প্রিন্সিপাল ছিলেন নৌবাহীনির কমান্ডার হাবিবুর রহমান তালুকদার। আমার যতদূর মনে পড়ে উনি খুব কোমল মনের মানুষ ছিলেন। উনাকে দেখার সৌভাগ্য বেশীদিন হয়নি। কারন উনি কিছুদিনের মধ্যে ক্যাডেটদের সাথে ভলিবল খেলতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ( ইন্না লিল্লাহে —) আমদের শিক্ষকরা খুব ফ্রেন্ডলি ছিলেন। উনারা আমদের সাথে গেমস পিরিয়ডে ভলিবল খেলতেন। মাঝে মাঝে প্রিন্সিপালও খেলতেন। আমদের ভলিবল মাঠটি ছিল হাউসের সামনে, এখন যেখানে নতুন মসজিদ হয়েছে। সেদিনও একই ভাবে ভলিবল খেলা চলছিল। হঠাত উনি মাটিতে পড়ে গেলেন। উনাকে রংপুর সি এম এইচ এ নিয়ে যেতে যেতে উনি ইহলোক ত্যাগ করেন। এর পর আসেন বিমানবাহীনির গ্রুপ ক্যাপ্টেন মাহতাব উদ্দিন। আমার বিবেচনায় উনি প্রশাসনিক ভাবে ভীষন দক্ষ ছিলেন। উনার কলেজ এসেম্বলির কথা কিছু কিছু মনে পড়ে। উনি ইংরেজী দিয়ে কথা শুরু করে বাংলায় চলে যেতেন। আমদের জন্য খুব ভাল হতো কারন আমরা ঐ বয়সে ইংরেজী সম্পূর্ণ বুঝতামনা। তাছাড়া নতুন কলেজ হওয়ার জন্য আমদের তেমন ইংরেজী বলার প্রচলন ছিল না। উনি শুধু ক্যাডেটই না সবার উদ্দেশ্যে কথা বলতেন, যেমন শিক্ষকরা কিভাবে পড়াবেন ইত্যাদি। আমাদের ক্যাডেট জীবনের শেষের দিকে পেয়েছি সেনাবাহীনির লেফটেন্যন্ট কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে প্রিন্সিপাল হিসেবে। উনার সময় অনেক দূর্ঘটনা ঘটেছে যা সময় এলে বলবো।

আমাদের প্রথম এ্যডজুটেন্ড ছিলেন আর্টিলারীর মেজর কীর্তি রঞ্জন চাকমা। উনি খুব কড়া ছিলেন। আমাদের সাথে পিটি, গেমস করতেন। ওনার উপস্থিতিতে কারও ফাকী দেওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। এরপর এলো একজন এক্স ক্যডেট, আর্টীলারির সম্ভুবত এস এস সি-২ মেজর ( নামটা মনে নাই)। উনি ছিলেন ক্যাডেট কলেজের এডজ়ুটেন্ডের মধ্যে সবচেয়ে ক্যাডেট ফ্রেন্ডলি। এক্স ক্যাডেট হওয়াতে আমদের সাইক্লোজি বুঝতেন এবং আমরা উনাকে অসম্ভব পছন্দ করতাম। সব শেষে পেয়েছি ইস্ট বেংগল রেজিমেন্টের মেজর মজাম্মেল কে।

মেডিকেল অফিসার হিসেবে আমরা সর্বপ্রথম পেলাম ক্যাপ্টেন ফাতানকে। উনি খুব হাসিখুশি মেজাজের ছিলেন। চেষ্টা করলেই এ্যটেন্ড সি পাওয়া যেত উনার কাছে। উনার পর আরও দুজন ছিলেন, মেজর জাকির এবং ক্যপ্টেন সাইফ। আমাদের মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যন্ড ছিলেন মিঃ রইস এবং আমদের প্রিয় ভবেশদা। মিঃ রইসকে সার বলে সম্বোধন করলেই এ্যাটেন্ড সি কনফারম। ভবেশদা ক্যাডেটদের খুব ভালবাসতো। এর পরে নির্মলদা কে পেয়েছি রইস সাহেব চলে যাবার পরে। প্রথমে আমদের এম আই রুম ছিল এ্যকাডেমিক বিল্ডিং এর নীচে একটা রুমে। পরে শিফট হয়ে আলাদা ভাবে বানান হয়।

হাউস মাস্টারদের কথা তো দ্বিতীয় পর্বে বলেছি। মেসিং অফিসার ছিলেন জিওগ্রাফির আল ফারুক সার। উনি শুধু কথায় কথায় বলতেন,” ব্লাডি গুফ” এর মানে বুঝতামনা। মনে করতাম ইংরেজি গালি বোঝার দরকার নেই। ডাইনিং হলের যাদের নাম মনে আছে তারা হলো মেস ওয়েটার বাচ্চু ভাই, এবং বাবুর্চি সিরাজ ভাই। একজন কাটখোট্টা বাটলার নাম মনে নাই। তিতুমির হাউসে হাউস বেয়ারার ছিল ফজলু ভাই, ওমর ফারুকে উমেদ আলি ভাই আর জাহাঙ্গির হাউসে কে যেন ছিল তার নাম মনে নাই।

এছাড়া প্রতিটি হাউসে একজন করে স্টাফ ছিল। তিতুমির হাউসে প্রথমে ছিল মজিদ স্টাফ। উনি শুধু বলতো ,” ডিউটি ক্যাডেট, ডিউটি ক্যাডেট নাম লিখ রে নাম লিখ” পরে মজিদ স্টাফ চলে যাবার পরে এল মান্নান স্টাফ। তাছাড়া একজন গ্রাউন্ডস ম্যান ছিল যিনি সবসময় এ্যডজুটেন্ডের ভয়ে তটস্থ থাকত। উনার যে কাজটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়তো তা হলো কুকুর দেখলেই বন্দুক দিয়ে কুকুর মারা।

৩৮ টি মন্তব্য : “ক্যাডেট কলেজের দিনগুলো- (৩)”

  1. রকিব (০১-০৭)
    কুকুর দেখলেই বন্দুক দিয়ে কুকুর মারা

    ভাইয়া, ব্যাপারটা বু্ঝলাম না :-/ :-/ আসলেই কি বন্দুক দিয়ে কুকুর মারতেন উনি??
    পুরোটাই ভালো লেগেছে :thumbup: :thumbup:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    আমাদের সময় লে। কর্নেল এমদাদ স্যারও ভলিবল গ্রাউন্ডে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। একটা পোষ্টে উনার কথা বলেছি

    উমেদ ভাইকে আমরা পেয়েছি জাহাংগীর হাউসে। ফজলু ভাই ছিলেন ওমর ফারুক হাউসে আর তিতুমীরে ছিলেন আলতাফ। আমাদের সময় অবশ্য দুইজন করে ছিলেন।

    কর্নেল জিয়াউদ্দিনের নাম অনেক শুনেছি। উনার ছেলে জাকিউদ্দিন ভাইতো এক্স-ক্যাডেট ছিলেন। শুনেছি উনি নাকি প্রায়ই হল ছেড়ে স্যারের বাসায় চলে যেতেন ঘুমাতে। ঘটনা সত্য নাকি?


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  3. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)
    এই কাজটা আমাদের কলেজে কয়েকবার করা হয়েছে

    হ্যাঁ...বিশেষ করে ভাদ্র মাসে যখন ওরা বংশের বাতি রক্ষা করার জন্য পাগল হয়ে যাইতো...


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  4. ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

    এডিসন বস,

    আপনি পারেনও বটে।
    এত খুটিঁনাটি মনে আছে আপনার।

    পড়তে গেলে মনে হয় - যেন আপনি চোখ বুজে এখনও সব দেখতে পাচ্ছেন অবিকল।

    পুরা HISTORY চ্যানেল। :boss:

    সালাম বস।
    :salute:


    সৈয়দ সাফী

    জবাব দিন
  5. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    সারোয়ার ভাইয়ের সিরিজটা চরম এক্সাইটিং লাগছে :boss: :boss:
    বস্ দারুন হচ্ছে। সামনের পার্টগুলো দুর্দান্ত হবে বুঝাই যাচ্ছে :clap: :clap:
    আর বিশেষ বিশেষ মৌসুমে আমাদের কলেজেও সারমেয় জাতির উপর এডজুটেন্ট স্যার নির্দেশিত জেনোসাইড চালানো হোতো বন্দুক সহকারে 😀 উনারা যেমনে অবাধে বঙ্সের্লাইট জ্বালানোর অপচেষ্টা চালাইতেন তাতে এইটা না কইরা উপায় থাকতোনা 😛


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আমিন (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।