আমার দেখা আমেরিকা (পর্ব ৪)

পর্ব-১ পর্ব-২ পর্ব-৩

সিদ্দিক ভাই

পুরো নাম মুহাম্মদ সিদ্দিকী, নামটা শোনার পর পাকিস্তানী নাম মনে হয়, মুহাম্মদ হোসেন অথবা মুহাম্মদ আসিফ টাইপ, কি যেনো একটা কম আছে নামে। বাঙ্গালি নাম সাধারনত বাহারী হয়, বেশ লম্বা, আগেপিছে অনেক লেজুর যুক্ত। আমার ক্লাস মেটের নাম ছিল হাসান গনি মোহাম্মদ ফজলে রাজিক রানা, আমার নিজের নাম ও মাশাল্লা কম না। সোজা সিদ্দিক ভাইকে জিগাইলাম আপনার ক্যাডেট নাম কি ছিল? বললেন “আলম”! খুব অবাক হইলাম, আলম কই? সিদ্দিক ভাইয়ের পুরা নাম ছিলো মুহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী, এই তো বাঙ্গালী নামের মত হচ্ছে। ভাই নাম ছোট বানাইলেন কেনো?
আরে কলেজে পোলাপান আলম নিয়া এত খেপাইছে আমেরিকা আইসা প্রথমেই নামের থিকা আলম বাদ দিছি। আমার নাম লিখি মুহাম্মদ এন সিদ্দিকী।এতক্ষনে আলম কেন সিদ্দিকী বুঝতে পারলাম। মাত্র কয়েক ঘন্টায় আমরা এত আপন হয়ে গেলাম যেন জনম জনমের চেনা। হাজার হোক একই গন্ডিতে, একই চেনা জগতে আমরা জীবনের বিশাল একটা সময় পার করেছি। এটা এখন কেমন , তখন কেমন ছিল, মোল্লা স্যার কে পেয়েছি কিনা, মসজিদটা শেষ হয়ার পর কেমন হয়েছিল……এরকম আরও কত অপ্রয়োজনীয় আড্ডা দুই জনের কখন রাত ১২ টা বেজে গেলো টের পেলাম না। তিনি তখনি তার বাসায় নিয়ে যাবে, সমস্যা বের হল আমার আই ডি কার্ড নেয় এতো রাতে বের হলে আমাকে আর ঢুক্তে দিবেনা। ক্লান্তি সব দূর হয়ে গেল, রুমে গেলাম ঘুম আর আসেনা, বুঝলামনা ঘটনার আকস্মিকতায়, নাকি অন্য কিছু। পরের দিন দুপুরে বুঝলাম এতটা আবেগী আমাদের শরীর হয়ে উঠতে পারেনি…বউএর সাথে কথা বলতে বলতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। টানা তিন দিন উলটা পালটা টাইমে ঘুমাইতে থাকলাম। এরেই মনে হয় বলে জেট ল্যাগ।

ঘুম থেকে উঠলাম ফোনের শব্দে, আমাকে আবার কে ফোন করবে? কে আর কলেজ ভাই, আমাকে তার বাসায় ডিনারের জন্য নিয়ে যেতে আসছেন। বিকাল ৬ টায় ডিনার, বেশ অবাক হলাম। সন্ধ্যা হয় সাড়ে নয়টায় আর লোকজন বিকাল ৬টার মধ্যে রাতের খাবার সেরে বসে থাকে। ভুল বললাম বসে থাকে না, ক্লাবে, বারে চলে যায় ফুর্তি করতে। সিদ্দিক ভাইয়ের বাসায় যেতেই বুঝতে পারলাম বেশ ধনী তিনি। এক ছেলে এক মেয়ে, রিয়া আর তাইসির; দুজনের কেউ বাংলা বলতে পারেনা। রিয়া বড় সে বাংলা বুঝে কিন্তু তত ভালো ভাবে না। ভাবীকে দেখে আরো মুগ্ধ হলাম এতো আন্তরিক আর মিশুক মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। প্রথম দেখাতেই বলে দিল আমার ৭ মাসের সংসারে কিকি লাগবে তার লিস্ট দিতে আগামীকাল তিনি আমাকে সেগুলো দিয়ে আসবেন। ভাবী সন্ধ্যা অব্দি চাকুরী করেন, এসে আবার রান্না, মাশাল্লা এনার্জী আছে বটে! পেট ভরে খেলাম, প্রায় ২ দিন পর দেশী স্বাদের খাবার পেলাম, আর ভাবীর রান্না অতুলনীয়। খেতে খেতে ঘরের দেয়ালে লাগানো ছবিগুলো দেখছি আর শুনছি কোনটা কার ছবি। একটা ছবি দেখলাম দু তিন জন আমেরিকান আর্মির সদস্য একটা ট্যাংক এর উপর বসে। এরা আবার কারা? সিদ্দিক ভাই বলল দেখ চেনো কিনা। কাছে থেকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে গেলাম, ৩ জনের এক জন আমাদের সিদ্দিক ভাই। আমি অবাক হয়ে শুধু বললাম, আপনি আর্মিতে, ইউ এস আর্মিতে? কেমনে? কিভাবে? সিদ্দিক ভাই বলল, খাওয়া শেষ কর বলছি।

সিদ্দিক ভাইদের বাড়ী সিলেট জেলায়, বাবা সরকারী চাকুরী করতেন। তার বড় ভাই এক্স ফৌজিয়ান, সেনাবাহিনীতে ছিলেন, পরে লেঃ কর্নেল হওয়ার পর চাকুরী ছেড়ে দেন। তার বাবার ইচ্ছা ছিল সিদ্দিক ভাইও আর্মিতে যাক। তার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা ছিলোনা আর্মিতে যাওয়ার। কলেজ থেকে বের হওয়ার পর তাই রাগ করে বাসা থেকে চলে আসেন ঢাকায়। থাকতেন তার এক বোনের কাছে, ছোট খাট চাকুরীও যোগার করেছিলেন, পাশাপাশি প্রাইভেট পড়াতে। কাকে পড়াতেন বলার প্রয়োজন আছে? আমার দেখা অধিকাংশ ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হয়ে যে মেয়েকে দেখে তারই প্রেমে পড়েছে। সিদ্দিক ভাইয়ের ক্ষেত্রেও তাই।

চাকরী করা অবস্থায় ডিগ্রীতে ভর্তি হয়েছিলেন আর ডিভি লটারীর ফর্ম পুরন করেছিলেন। ডিভির বদৌলতে আমেরিকা চলে গেলেন তিনি, কিন্তু কি করবেন কিছুই বুঝলেন না, ছয় মাস ক্যাব চালালেন, গাদাগাদি করে ৮ জনের সাথে নিউইয়র্ক ছিলেন। টিকতে পারলেন না যা টাকা জমেছিলো নিয়ে দেশে ফিরে আসলেন। দেশে এসে বুঝলেন , সংসারে তিনি এখন কুলাঙ্গার বান্দা, দেশে কিছু তাকে দিয়ে আর হবেনা। আবার উড়াল দিলেন আমেরিকা। আবার ক্যাব চালনা, নিসংগ জীবন, টাকা এতে অনেক পাওয়া যায় হয়তো , কিন্তু নিরাপত্তাহীন, ভবিষ্যত বিহীন এক জীবন। একদিন দেখলেন আর্মিতে লোক নেয়া হচ্ছে। কৌতুহহ বশত গেলেন কি হয় দেখতে , নিয়ে নিলো তারা তাকে আর্মিতে তার আপটেক আর ইংরেজীতে দক্ষতা দেখে। বাংলাদেশ আর্মিতে যোগ দিবেননা বলে আমেরিকা পালালেন আর কপালে যদি লেখা থাকে তাকে কি এড়ানো যায়, আবার আর্মিতে। আরো কঠিন আর্মিতে।

প্রাইভেট সিদ্দিকি হিসেবে যোগ দিলেন ইউ এস আর্মির আর্টিলারী কোরে। পোস্টিং ফোর্ট ড্রাম, নিউইয়র্ক। ভাইজানের খায়েশের কমতি নাই, এর মধ্যে এয়ারবর্ন কোর্স করেছেন। মেধা আর উৎসাহের কমতি ছিলনা তার কম সময়েই প্রমোশন পেয়ে গেলেন। নতুন পোস্টিং হলো জাপানে, ফিরে এসে কোরিয়াতে তার পর জার্মানী। আমেরিকাতে আর্মিতে লোক যেতে না চাওয়ার প্রধান কারন এটা, এক বছর দেশে তো দুই বছর বিদেশে। সিদ্দিক ভাইয়ের বিদেশ যেতে কোনো সমস্যা ছিলনা, কারন আমেরিকাও তার কাছে বিদেশ, আর তার তখন স্থাবর স্বম্পত্তি ছিল একটা বাটি, একটা চামচ।

৫ বছর পর দেশে ফিরলেন, দেশের টানে না। বিয়ে করার জন্য। ভাবীকে সাথে নিয়ে ফিরে গেলেন। বিয়ে করার সময় ভাবীর বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। তাড়াহুড়ার কারন তার পোস্টিং হয়েছিল হাওউয়াই দ্বীপে। পুরা তিন বৎসর ছিলেন সেখানে, বিনা খরচে লম্বা হানিমুন। ফেরত এসে পোস্টিং হলো ফোর্ট সীলে।২ বছর থাকার পর যোগ দিলেন ইরাক যুদ্ধে। ইরাক থেকে এসে ঠিক করে ফেললেন এই চাকুরি আর করবেন না। একটা যুদ্ধ দেখলে মানুষের মানবিক দিক আস্তে আস্তে মরে যায়। মানুষ মরতে দেখলে কোন মানুষেরই ভালো লাগেনা, তা সে যে ই হোক। এতদিনে সিদ্দিক ভাইইয়ের র‌্যাঙ্ক এস এফ সি (সার্জেন্ট ফার্স্ট ক্লাস)। আর্মি তাকে ধরে রাখার জন্য টোপ দিল। পড়, যতদুর ইচ্ছা, সব খরচ আর্মি দিবে। পড়া শেষ হলে আর্মিতে অফিসার হিসেবে যোগ দিতে হবে। এই প্রোজেক্টের আওতায় সিদ্দিক ভাই তখন তার মাস্টারস করছিলেন। বাসায় বউ বাচ্চার জন্য পড়া সমস্যা তাই হোটেলে আসেন কাজে সন্ধ্যায়; কাজ ও হল, ঝামেলা কম এই হোটেলে তাই শান্তিতে পড়তেও পারেন তিনি।

অফটপিকঃ
সিদ্দিক ভাই আবার আর্মিতে ঢুকতে নারাজ, কিন্তু ভাবীর খুব ইচ্ছা, বউরা মনে হয় এমনি হয়। আমেরিকান আর্মিতে সার্জেন্টের বেতন লিওটেন্যান্ট এর চেয়ে বেশি, প্রায় ক্যাপ্টেনের সমান। আর সার্জেন্ট ক্ষমতা ক্যাপ্টেন এর বেশি। মানো আর না মানো বেসে বহু যায়গা আমি দেখেছি যেখানে লেখা ‘ONLY FOR COL AND CSM’. আমি আসার আগেই সিদ্দিক ভাই চুক্তিটা সই করে ফেলে অফিসার হিসেবে জয়েন করার। তার শর্ত ছিলো তিনি ট্রেনিং এর সাথে থাকবেন। ১০ বছরের এই চুক্তি শুধু মাত্র সাইন করার জন্য তিনি বোনাস পেয়েছিলেন ৩৬০০০ ডলার। যারা আমেরিকা সম্পর্কে জানে তাদের জন্য বলছি, আর্মি মানি, ট্যাক্স ফ্রী। আরো একটা তথ্য দেই সিদ্দিক ভাইয়ের বেতন ছিলো ৮০০০ ডলার। ভাতা মিলে কত হয় হিসাব করিনাই। আমি গরিব দেশের গরিব অফিসার মাসিক বেতন ডলারে হিসাব করলে হবে ২০০ ডলার। বর্তমান পে স্কেলে সর্বোচ্চ বেতন যেনো কতো। সিদ্দিক ভাইয়ের চারটা খরগোশ আছে যার পিছনে মাসে প্রায় ২০০ ডলার খরচ হয়। আমি আমার বউ, বাচ্চা, কাজের মেয়ে সব মিলে ৪ জন; মুজতবা আলীর পন্ডিত মশাই এর কথা মনে পড়ে গেলো।

১,৮৫০ বার দেখা হয়েছে

৩৩ টি মন্তব্য : “আমার দেখা আমেরিকা (পর্ব ৪)”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    এই পর্বটা আসলেই অনেক বেশি ভালো লাগছে।আলম ভাইয়ের ইউএস আর্মি গেটাপে ছবি দেয়া যায়না একটা এইখানে?কি অদ্ভুত মানুষের জীবন-বাংলাদেশ আর্মি থেকে পালিয়ে ইউ এস আর্মিতে!
    নাহ,ভাবতাছি ইউ এস আর্মিতে একটা টেরাই দিমু- বিএমএ থিকা রিজাইন দিছি তো কি হইছে ইউ এস এম এ থিকা কমিশন লমু,তারপর অগো টাকায় আইভি লিগ কলেজগুলার এট্টা থিকা হায়ার স্টাডিজ...(এট্টু টাল অবস্থায় আছি কেউ মাইন্ড খায়েন না)

    সারওয়ার ভাই,এই বিচিত্র অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দুর্দান্ত যোগ্যতার অধিকারী আমাদের আলম ভাইকে কি কোনভাবে সিসিবিতে আনা যায়?প্লিজ ভাইয়া একটু সিরিয়াসলি চেষ্টা করে দেখেন না!

    জবাব দিন
  2. রেজওয়ান (৯৯-০৫)
    সিদ্দিক ভাইয়ের বেতন ছিলো ৮০০০ ডলার। ভাতা মিলে কত হয় হিসাব করিনাই

    লেফটেনেন্টের বেতন ৭,১২৫ টাকা ,ভাতা ছাড়া :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :(( :((

    জবাব দিন
  3. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
    আমার দেখা অধিকাংশ ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হয়ে যে মেয়েকে দেখে তারই প্রেমে পড়েছে।

    আমি পারিনি ক্যানু :(( ~x(


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  4. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    ভ্রমণ কাহিনী? আবার তাও না। গল্প? সেটাও পুরো না। লেখার ধরণটা ভালো। আকৃষ্ট করে রাখে। সারওয়ার দারুণ লাগছে। সিদ্দিকের কাহিনী তো আরো অসাধারণ। :thumbup:


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সারওয়ার হায়দার (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।