আমার দেখা আমেরিকা (৩য় পর্ব)

আমার দেখা আমেরিকা (২য় পর্ব) আমার দেখা আমেরিকা (প্রথম পর্ব)

হ্যার্টসফিল্ড-জ্যাক্‌সন আটলান্টা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট

প্লেন থেকে নেমে প্রথম থমকে গেলাম লেখটা দেখে, “welcome to the busiest airport of the world”. ব্যাস্ততম বটে, বছর গড়ে ৪ বিলিয়ন যাত্রী এবং প্রায় ১০ লক্ষ ফ্লাইট আসা যাওয়া করে এই বিমান বন্দর দিয়ে। ডেলটা এয়ার লাইনস, এয়ার ট্রান, ডেল্টা কানেকশনের হাব এই বিমান বন্দর। বিশালত্ব দেখে মাথা খারাপ হওয়ার জোগার, কিন্তু ব্যাবস্থাপনা অসাধারন। কোথায় কিভাবে যেতে হবে তা সামান্য ইংরেজী(অথবা স্পানিশ) জানা মানুষের জন্য বের করা খুব সহজ। আমার পোর্ট অফ এন্ট্রি এখানে। লাগেজ নিয়ে চললাম ইমিগ্রেশনের দিকে। ভিন্ন ভাষা ভাষী মানুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন লাইন(দুঃখের বিষয় বাংলা লাইন নাই)। সবার পাসপোর্ট ভিসা চেক হচ্ছে, তার পর নেয়া হচ্ছে তাদের আঙুলের ছাপ আর চোখের স্ক্যান। আমার পালা আসতেই, কোনো কিছুই না নিয়ে বললো,” welcome to america,sir. you may proceed.” বেশ অবাক হয়েই তাকে জিজ্ঞেষ করলাম আমার হাতের ছাপ নিবেনা? “no sir, its A2 visa, its diplometic”.
এতক্ষনে পরিস্কার হলো কেন আমাকে লন্ডনে বিনা ভিসায় ঢুকতে দিয়েছিল। ডিপ্লোমেটিক ভিসার জোরে কোন লাগেজ চেক বা আর কোনো প্রকার বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়নি। সোজা ডোমেস্টিক টার্মিনালের দিকে যাওয়া শুরু করলাম। স্থানীয় সময় ২টা ৩০ মিনিট, পরবর্তী ফ্লাইট ৭টা ৩০ এ। আমার গেট নাম্বার E50। লাগেজ চেক ইন করে জিজ্ঞেস করলাম কিভাবে যাব এই গেটে। আমাকে জানানো হল নীচে যেয়ে ট্রেন ধরতে হবে।ভাবলাম, হাতে ৫ ঘন্টা সময় আর পিঠে এক হাল্কা ব্যাকপ্যাক, ট্রেন ধরার চেয়ে হাটাই শ্রেয়। পাক্কা ২০ মিনিট হাটার পর কনকোর্স T তে পৌছলাম, এর পর A,B,C,D তার পর E. পাতাল ট্রেনে প্রায় ১৫ মিনিট লাগলো আমার কনকোর্স E তে পৌছাতে। প্রথম এস্কেলেটর দেখলাম যার শুরু থেকে শেষ দেখা যাচ্ছেনা। উপরে উঠে পেলাম গেট E15. আরো ১৫ মিনিট লেগে গেলো পৌছাতে আমার নির্ধারিত গেটের কাছে। সরল হিসাব করে ফেললাম, ৬ টা কনকোর্স, প্রতিটায় ৫০টা গেট মানে এক সাথে ৩০০টা বিমানে যাত্রী উঠা নামা করা সম্ভব এই বিমান বন্দরে।

৬টা ৩০ এ ঘোষনা হলো, আবহাওয়া খারাপ থাকায় প্লেনের যাত্রা অনিশ্চিত। অনেকে ঘুরতে চলে গেলো, আমি বিরস বদনে একটা ঢাউশ চিপ্‌স আর কোক কিনে কাউন্টারের সামনে ফ্লোরেই বসে গেলাম। আর কতক্ষন থাকা যায়। ১৮ ঘন্টা হয়ে গেছে। অবাক করে দিয়ে সাড়ে সাতটায় বিমান যাবে নিশ্চিত হলো।আর মাত্র আড়াই ঘন্টা আমার ২৪ ঘন্টার যাত্রা শেষ হতে।

অবশেষে গন্তব্যে

আমেরিকানরা মিলিটারী বেস গুলোকে বলে ফোর্ট। ছোট শহর লওটন(LAWTON) এর সাথে ফোর্ট সীল এর নামটা সব সময় জুড়ে দেয়া হয়, কারন এই বিশাল মিলিটারী বেসটার জন্যই শহরটার জম্ন এবং বেচে থাকা। যেমন এত ছোট শহরে প্রতি দিন ৮টা বিমান আসাযাওয়া করে…কারন একটাই ফোর্ট সীল।লওটনে নামলাম স্থানীয় সময় ৯টায়, রাত ৯টা না বলে বিকাল ৯টা বলা ভাল কারন সূর্যাস্তের সময় ৯টা ৪৫ মিনিট।এয়ারপোর্টের অবস্থা অনেকটা আমাদের সৈয়দপুর বিমান বন্দরের সমান। একজন সার্জেন্ট সবসময় থাকেন ফোর্ট সীল এ আগতদের সহায়তার জন্য। তাকে খুজেপেতে বেশি সময় ব্যায় করতে হলনা।সে জানালো এডওয়ার্ড আসছে আমাদের নিয়ে যেতে। আমাদের! অবাক হলাম বাকীরা কোথায়? পরিচিত হলাম হ্যামিল্টন(কলাম্বিয়া), পপেস্কু(রুমানিয়া) এবং এভান্স(তাঞ্জানিয়া) এর সাথে। ৫ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার এক লোক, ৪৬ সাইজ পাঞ্জাবীর সমান এক টি শার্ট পরা হাসিমুখে আমাদের দিকে এসে বলল, ” হাই, আই এম এডি”। বুঝলাম এই সেই বিখ্যাত এডওয়ার্ড। ৯টা ৪০ এ আমরা এয়ারপোর্ট থেকে যাত্রা শুরু করলাম , আর লাগবে মাত্র ১৫ মিনিট। কেবল মাত্র গোধুলি সময়, সূর্যের আলো এখনো ম্লান হয়ে যায়নি, রাস্তার দুধারে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, এক বারের জন্যও মনে হচ্ছেনা আমেরিকা। চারদিক সবুজ, সোডিয়াম লাইট ফ্যাকাশে লাল হয়ে আছে জ্বলার অপেক্ষায় খুব পরিচিত মনে হল আশেপাশের সব। যারা আমেরিকা আসে, তারা বড় শহরে থাকে, জীবিকার জন্য নয়ত ভাল কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়ার জন্য; গ্রাম দেখতে কেউ আমেরিকা আসেনা। হায় কপাল আমি এসে পড়লাম এক গ্রামে যেখান থেকে নিকটতম বড় শহর ৩০০ মাইল দূরে। এইসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে হোটেলে পৌছে গেলাম। মিলিটারী লজিং, দুইটা ৬ তলা বিল্ডিং পাশা পাশি, অনেক সৌভাগ্য আমার লওটনের সর্বোচ্চ বিল্ডিং থাকার ব্যাবস্থা হল! পুরা শহরে দোতালার বড় বাড়ী খুব একটা নেই।

হোটেলের কাউন্টারে আমার জন্য সবচেয়ে বড় চমক অপেক্ষা করছিলো। ফ্রন্টডেস্ক ম্যানেজারের নাম লেখা মুহাম্মদ সিদ্দিকী। বুঝে গেলাম মুসলিম, চেহারা দেখে বাঙ্গালী হলেও হতে পারে টাইপ। আমার নাম জিজ্ঞেস করলো ইংরেজীতে, তারপর বাংলায় বলল, আপনার বাড়ী কই? বুঝলাম এক দেশী ভাই পেয়ে গেলাম, এই ছোট শহরে বাঙ্গালী পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। মুহাম্মদ সিদ্দিকী আমাকে বললেন, ভাই আপনি একটু বসেন, বাকীদের চেক ইন করে আপনার সাথে কথা বলবো। বাংলাদেশি একজন আসছে এটা তিনি জানতেন তাই আমাকে সহজেই তিনি চিনে নিতে পেরেছিলেন। কাজ শেষে আসার পর জানতে পারলাম তার বাড়ী সিলেটে। আমি কোথায় লেখাপড়া করেছি জানতে চাইলে বললাম, বরিশাল ক্যাডেট কলেজ। তিনি অবাক হয়ে বললেন, dont tell me you are joking. কোন ব্যাচ? আমি বললাম ১৫ ইন্টেক। সিদ্দিক ভাই আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন আমিও তো বরিশাল ক্যাডেট কলেজের, ৫তম ব্যাচের। মনে হল হায়রে দুনিয়া, সত্যিই খুব ছোট। ক্যাডেট মনে হয় দুনিয়ার কোনায় কোনায় ছড়ানো।

১,৩৫৬ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “আমার দেখা আমেরিকা (৩য় পর্ব)”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    সারওয়ার ভাই,ক্যাডেট মোটামুটি সারা দুনিয়ায় পাওয়া যায় এবং আমার অভিজ্ঞতামতে এরা জান দিয়ে একজন আরেকজনরে টানে।মজা লাগল আপনের কাহিনী পড়ে।ওই ভাইয়াকেও সিসিবিতে নিয়া আসা যায়না?

    জবাব দিন
  2. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    সারওয়ার ভাই, নিয়মতান্ত্রিক কোন বাধা না থাকলে আমেরিকার আর্মি বেজ গুলো নিয়ে কিছু লিখবেন প্লিজ-ছবি সহ সম্ভব হলে।মুভি দেখে দেখে এইটার উপর আমার অনেক কৌতুহল।

    জবাব দিন
  3. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    শেষ পর্যন্ত সহি-সালামতে আমেরিকা পৌছাইছেন, আমি এতেই খুশি।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।