আর একটা দিন

এক একটা দিন যায়, বিষণ্ণতা কেমন জড়িয়ে জড়িয়ে ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় পেরুনো মনটা আমার বারবার প্রশ্ন করে, এইটেই কি জীবন? ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। একদিন বাসায় ফেরার পথে আকাশ জুড়ে হেলিকপ্টারের শব্দ। প্রথমে ভাবলাম তপন চৌধুরী বুঝি খুব মিটিং করে বেড়াচ্ছেন। (রিসেন্টলি নতুন তথ্য জানলাম যে স্কয়ারের তপন চৌধুরী নাকি জ্যামের কারণে এখনে গাড়িতে চড়া ছেড়ে হেলিকপ্টারে ওঠা শুরু করেছেন। তার প্রতি অফিসের মাথায় আছে সুদৃশ্য হেলিপ্যাড। ;;) ) বাসায় এসেও দেখি হেলিকপ্টারের শব্দ যাচ্ছে না। ভয় পেয়ে গেছিলাম সেদিন বেশ।

এই ভয় জিনিসটা বেশ মজার। জীবনের এক্সপোসার যত বাড়ে, ভয়ের সাথে আস্তে আস্তে পরিচিতি হয়। আবার ভয়নাশের উপায়ের সাথেও। তবে সবকিছুর ওপরে চড়ে বসে থাকে ভয়টাই। ছোটবেলায় গরম চুলা খপ করে ধরেছিলাম হাত দিয়ে, এখন আর তা করব না। কারণ সেই এক্সপোসার। এখন আমি জানি চুলাটা গরম। সারা দেশটাই গরম এখন। তাই দেশটাকে মনে নিতে আর ইচ্ছে হয় না।

চারিদিকে দমবন্ধ করা ঘটনারা চেপে আসে, কেমন অসহায় লাগতে থাকে। চারিদিকে অস্থির অস্থিতিশীল একটা সময় চলছে। রামুতে আগুন, লিমনের পা, জিএম মাসরুল হুদা সিরাজী টুপ করে ঢুকে যান হলমার্ক কেলেঙ্কারী মামলার আসামী লিস্টে..আমার মাথা নিচু হয়ে আসে বারেবারে। মনটা খারাপ হয়ে যায়। রাতের বেলা ফোন আসে, এসব নিয়ে কথা হয়। নিশ্চুপ নিরালা কন্ঠস্বরে, ওপাশ থেকে নিচুস্বরে ভেসে আসে, ‘মন ভালো লাগছে না।’ আমি অসহায় হয়ে গিয়ে বলি, ‘বড় অসহায় লাগছে’। যুবক যুবতীর ভালবাসার সেই উচ্ছাস কোথায় গেল? রাত্তির বেলা মন খারাপ করে ফোন রেখে দেই দুজনেই। আমার ঘুম আসতে চায় না। দুপুর বেলা ঘটে যাওয়া ঘটনা বারবার মন পড়ে।

অফিসের গার্ড দুপুরে আমার সাথে বড় খারাপ ব্যবহার করেছে। মেজাজ খারাপ করে আমিও খুব খারাপ ব্যবহার করেছি। পরে খারাপ ব্যবহার করার জন্য স্যরিও বললাম, কিন্তু গার্ড তার ব্যাবহার অব্যহত রাখল। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সাথে এই ব্যবহার করবে কেন? কেন, তা বোঝা গেল গার্ডের ম্যানেজার কে দেখে। তিনি ঘটনা সঙ্গে সঙ্গে উলটে দিয়ে বললেন আমিই আগে কান্ডটা শুরু করেছি। বাক্যব্যয় না করে এবার সোজা গিয়ে বাড়িওয়ালার কাছে কমপ্লেইন করলাম, এবারে কাজ হলো। সব ঠান্ডা। শুনলাম আগেও আরেক ভদ্রমহিলার সাথে সে একই কান্ড করেছে।

আমরা সকালে অফিস করি আটটা থেকে। আমার অফিসের পিয়ন, সাড়ে নটায় অফিসে আসে। এসে সে চুপচাপ বসে থাকে। কোথাও পাঠাতে চাইলে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, আমি চিনিনা। প্রতি সকালেই অফিসের সবাইকে তার চা দেয়ার কথা, সেই চা চেয়ে না নিলে পাবার আশা ছেড়ে দেয়াই শ্রেয়। সারাদিন সে চেয়ারে বসে থাকে, দুপুরবেলা খানিক্ষণ আমিনীর ওয়াজ শোনে। এরপর খেতে যায়, খাওয়ার পর এসে যখন অফিসে কেউ থাকে না, তখন সে ফেইসবুকিং করে। সেদিন হুট করে ঢুকে দেখি তুহিনা খাতুন নামের কোন এক ভদ্রমিহিলার প্রোফাইল ঘাটাঘাটি করছে। ভালই। হুটহাট সে অফিসে আসে না, কৈফিয়তঃ অসুস্থতা। মাঝে মাঝে মনে হয় আর্কিটেক্ট না হয়ে পিয়ন হলে বেশ অসুস্থ হয়ে কাটাতে পারতাম। আমাদের এক কলিগ তাকে কাজে পাঠাতে গিয়ে উলটো দুকথা শুনে এসেছে। এরপর গত বুধবার ভাইয়া তাকে বেশ করে ধমকে দিয়েছে, আজকে সকালে এসে দেখি আমার টেবিলে বিশাল এক মগ চা জ্বলজ্বল করছে।

কদিন আগে আমার বড়াপুর গাড়িতে আরেক গাড়ি ধাক্কা মেরেছে। মেরে পালিয়ে যাচ্ছিল, বড়াপুর ড্রাইভার আবার সেই গাড়ির পেছন পেছন ধাওয়া করা শুরু করল। বাড়িতে পৌছে সেই গাড়ির ড্রাইভার নেমে এসে রেঞ্জ দিয়ে পিটিয়ে প্রথমে বড়াপুর গাড়ির উইন্ডশিল্ড ভেঙ্গে ফেলল, গাড়িতে বড় আপু আর ড্রাইভার থাকা অবস্থায়। এরপর বড়াপুর দিকে রেঞ্জটা ছুড়ে মেরেছিল সে, লাগেনি। পরে খোজ পাওয়া গেল সে একটি এলাকার চেয়ারম্যানের ড্রাইভার। তাদের কথায় বোঝা যাচ্ছিল এই ড্রাইভার আগেও এই কাজ করেছে, এবং এটা নিয়ে তারা খুব একটা ভাবিত নয়।

মানুষের সাথে মানুষের পার্থক্য এত বেশি বেড়ে যাচ্ছে, যে এই হিংস্রতাগুলো এখন আর কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মানুষের মাঝে ক্ষোভ জমে উঠছে চারিদিকের পরিস্থিতি নিয়ে, আর সেটার বিস্ফোরণ সে ঘটাচ্ছে সামনে থাকা মানুষটার ওপরই। সে যেই হোক। এসব দেখে শুনে মানুষের উন্মত্ততা আমার মাথার মাঝে ঘুরতে থাকে, ঘুরতে থাকে মানুষের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ, ক্রোধ, হিংস্রতা। এই দেশ নিয়ে আমার হতাশা গুমড়ে ওঠে। এই দেশ নিয়ে আমার কোন স্বপ্ন নেই, কোন আশা নেই, যেন কখন ছিলও না। আমি রেজা শাওনের লেখাগুলো আর একবার পড়ার খুব চেষ্টা করি, খুব চেষ্টা করি দুতিন বছর আগেকার আমি’টা হয়ে যেতে। ফোস ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলি, হাসি শাওনকে নিয়ে। মনে মনে ভাবি, বাচ্চা ছেলে, এখনও এভাবে ভাবে…যেন খুব বুড়ো হয়ে গেছি আমি।

ঘুম আসে না আর, চারিদিকের অস্থিরতা ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলে আমাকে। জিনিসপত্রের দাম, মানুষের সাথে মানুষের অর্থনৈতিক আর মানসিক ফারাক আমাদের অস্থির করে ফেলছে। আমরা আমাদের সামলাতে পারছি না, ক্ষোভে অস্থির হয়ে উঠছি। আমাদের নিয়ন্ত্রণের চাবি আমাদের হাত থেকে চলে গেছে পারিপার্শ্বিক সমাজের হাতে। আমার নিঃশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়। রাত দুইটা। আমি আর পারি না। বিছানা থেকে উঠে পানি খাই, রিমোট চেপে টিভি দেখতে বসি। একের পর এক খবর স্ক্রল করে যেতে থাকে মনিটরের নিচ দিয়ে, সিলেটে বাস ও মাইক্রোবাস সংঘর্ষে তের জনের মৃত্যু, চট্টগ্রামে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু, রাজধানীতে স্কুল ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যু, গর্তে পাওয়া গেছে দুই বছর শিশুর লাশ। আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকি, এ দেশে কি কোন ভাল খবর নেই? উপরে তখন চলছে সেরা নাচিয়েদের নাচের অনুষ্ঠান।

টিভিতে মৃত্যুর ওপরে রক্তরাঙ্গা ওষ্ঠ নিয়ে বালিকারা নেচে নেচে যেতে থাকে। চারটের দিকে ঘুম আসে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। এভাবেই চলে যায় আর একটি দিন। আমার বাংলাদেশে।

ডিসক্লেইমারঃ লেখা শেষে পড়তে গিয়ে দেখি কেবল ড্রাইভার, পিয়ন আর গার্ডের প্রসঙ্গ এসেছে। এনারা সকলেই যেহেতু তথাকথিত একটি বিশেষ শ্রেণীভুক্ত, কেউ আবার ভেবে বসেন না, কেবল তাঁরাই এ লেখায় টার্গেট। লেখাটি আমার জীবনের সমসাময়িক কিছু ঘটনা সাজানো। আমরা সবাই নিজেদের হারিয়ে ফেলছি সবসময়।

২,৪৬৪ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “আর একটা দিন”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    ঢাকার আকাশে হেলিকপ্টারের সংখ্যাও বাড়বে একদিন, আকাশেও জ্যাম লেগে যাবে। 😛
    আমাদের অনুভূতিগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
    মাসরুল হুদার ভাই দেখলাম লিখেছেন, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে চান।কি বেদনা থেকে মানুষটা এই কথা বলতে পারেন ভাবো!
    প্রতিদিনকার অপমান আর যন্ত্রণাগুলো থেকে আমরা মুখ ফিরিয়ে নিতে শিখে গিয়েছি বহুকাল - এর জন্য আমাদের যা যা মাশুল প্রাপ্য তার সবটাই ফিরে ফিরে আসছে।

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    🙁
    অনেক কথা বলার আছে।
    না তোমার বিপক্ষে না।
    বাইরে যাবো। বউ, বাচ্চাদের নিয়ে। অনেকদিন পর ছুটি মিলেছে।
    ফিরে এসে মন্তব্য করবো।
    আপাতত এই বলে রাখি পিয়নের বানানো চা খাওয়া ছেড়ে দাও।কারণ আবিরের কাছে জেনে নিও।
    ফেসবুকে তোমারে খুইজা পাই না। আমারে ব্লক কইরা দিছো নাকি?


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • সামিয়া (৯৯-০৫)

      ফেইসবুকে ব্লক করি নাই তো। আপনি কি আমার ফ্রেন্ড? খুজে দেখি দাঁড়ান।
      আর বহু চিন্তা করেও বের করতে পারলাম না, পিয়নের চা খাওয়া ছাড়তে হবে কেন। আর আবির তো আরও বলতে পারল না। তাত্তাড়ি বাসায় ফিরে বলে যান।

      জবাব দিন
      • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

        আগে ফ্রেন্ড ছিলা ফেবু তে। ক্যামনে ক্যামনে জানি অনেকে আনফ্রেন্ড হইয়া যায়। সে মনে করে আমি তারে আনফ্রেন্ড করছি, আর আমি মনে করি সে আমারে। আর এইটা এমনি একটা একটা বিষয় যে জিজ্ঞাসা করাও যায় না কে কারে আনফ্রেন্ড করলো!
        জুকের ভাইয়ের নামে মামলা করতে হইবো মনে হয়।
        ক্যাসিনো কি দেখছিলা নিরোর?
        পেসির ভাইয়ের রেস্তোরায় পুলিশ খাইতে আইলে সে থুতু মেশানো বার্গার/হটডগ সার্ভ করে।
        পারলে বিদায় করো ঐ বদমায়েশটারে।


        এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

        জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভালো কথা, লেখায় ৫ তারা দিছি। কিন্তু এ বড় দুঃখের ৫ তারা।
    যেমন নূপুর দার লেখা প্রিয় তে যায়; বড় দুঃখের এই প্রিয় তে যাওয়া।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  4. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    "এই মৃত্যু-উপত্যকা আমার দেশ না
    এই জল্লাদের উল্লাস-মঞ্চ আমার দেশ না
    এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
    এই রক্তস্মাত কসাইখানা আমার দেশ না"
    ... ... ...


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  5. রাশেদ (৯৯-০৫)

    হে অকাল বৃদ্ধ সামিয়া, আপনার মত মানুষদের কথা ভেবেই ঝাকড়া চুলের বাবরি দোলানো বিদ্রোহী কবি নজরুল বলে গিয়েছেন- "এদের উর্দির নিচে বার্ধ্যেকের কঙ্কাল" 😀


    মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

    জবাব দিন
  6. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    এরপরও সুখের তালিকায় এগারোতম। 🙂

    ঢাকায় থাকা নিয়া একটা সিরিজ শুরু করবো ভাবছি। অনেক অনেক ঘটনা।

    দেশের বাইরে গেলে পার্টি দিয়া তারপর যাইও।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  7. রাব্বী (৯২-৯৮)
    আমরা সবাই নিজেদের হারিয়ে ফেলছি সবসময়

    এই কথাটা খুব সত্যি। লেখাটায় কেমন একটা অনিশ্চিত সময়ের সংশয়ের কথা আছে। তুমিও বড় হয়ে গেলা! জীবন সবসময়ই আনফেয়ার, কিন্তু আশার কথা হচ্ছে এটার ড্রাইভিং সিটে তুমি।


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আসিফ মাহমুদ (০০-০৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।