ফোন কিচ্ছা

ইভটিজিং একটি বৈচিত্র্যময় অপরাধ। নানা উপায়ে আপনি এই অপরাধ সংঘটিত করতে পারেন, যার একটি হলো অচেনা ইভদের ফোন করে করে তার গলা যে কত সুন্দর, তা বোঝানোর চেষ্টা করা। মেয়ে হিসেবে এই ধরণের ফোনের ভুক্তভোগী আমিও, তবে দুঃখের বিষয় আমাকে যারা ফোন করে তারা কেউ চাওয়ালা, পানের দোকানদার, কিংবা পতাকা বিক্রেতা। তবে দিন সবার খারাপ যায় না, তাই এবার আমার ভাগ্যে একজন প্রবাসী যুবক জুটেছে, নিজের সাফল্যে আমি কিঞ্চিত গর্বিত, আনন্দে আহ্লাদিত হয়ে কি করব বুঝতেসি না।

এই সমস্যার সবচেয়ে কার্যকরী সমাধান হলো পাত্তা না দেয়া, আমিও সাধারণত তাই করে থাকি। এবারকার যুবক অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল, আমি ধরা না পর্যন্ত সে ফোন করেই যেতে থাকে। আজকে রাতে ঘুমানোর মোটে মিনিট চল্লিশেক হয়েছে, হঠাৎ ফোনের শব্দে তড়িঘড়ি জেগে উঠে দেখি সেই যুবক। সে বলার চেষ্টা করছে আমার গলা তার কত শ্রুতিমধুর লাগে…রাগে আমার কান্না পেয়ে গেলো। মেজাজটা প্রচন্ড খিঁচড়ে আছে। কাঁচা ঘুমে হঠাৎ জেগে ওঠায় মাথা ভার লাগছে, অনেক্ষণ এপাশ ওপাশ করলাম, এই রাত্রে বেলা আর ঘুমও আসছে না। এই যুবক কি বোঝে তার সাময়িক আনন্দের জন্য সে যে কাজটি করছে, তা অপর মানুষটির ওপর কতটা প্রভাব ফেলে?

আমার বাবা আমাকে প্রচুর ফোন করতেন, একটু পর পর ফোন দিয়ে খোঁজ নিতেন আমি কোথায়, কি করছি, গাড়ির তলে চাপা পড়েছি না গাড়িতে বসে আছি, যে রিকশায় উঠেছি তার চালক কি ছিনতাইকারী??…ইত্যাদি ইত্যাদি…এইজন্য প্রায়ই আমি বিরক্ত হয়ে আব্বুর ফোন ধরতাম না। আব্বুর তখন মাথাখারাপ হয়ে যেত। কয়েক কোটি বার ফোন দিয়ে ফেলতো, তারপর পাগল হয়ে বড়াপুকে ফোন দিতো। বড়াপু আমাকে ফোন দিয়ে ধমক দিতো, তারপর আমি আব্বুর ফোন ধরতাম, তারপর বাসায় এসে আব্বুর সাথে ঝগড়াঝাটি করতাম। তারপর আবার আব্বুর ফোন ধরতাম না, এবং আবার বাসায় তুলকালাম, আবার ঝগড়া…আব্বু তার সারা জীবনে সবচেয়ে বেশি আমার ধমক খেয়েছে, এবং আমি আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি আব্বুর সাথে ঝগড়া করেছি। প্রায়ই আমি হুমকি দিতাম, যে আব্বুর কল ব্লক করে রাখবো।

এরকম করতে করতে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিনে ঘুম থেকে উঠতে দেরী করায় আমি আমার আব্বুর একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ কল মিস করি। সকালে উঠে মোবাইল হাতে নিতে দেখি মোবাইল এ অনেকগুলা কল…আব্বুর, আম্মুর, বড়াপুর। আমি ভাবলাম আব্বু তো নিশ্চুই খাইসি নাকি, ঘুমাইসি নাকি টাইপ কারণে ফোন দিসে…জরুরী কিছু না, তার চেয়ে আম্মুকে কল ব্যাক করি, আম্মু অকারণে ফোন করে না।

আম্মুকে কল ব্যাক করে কারণ শোনার পরবর্তী মিনিট খানেকের মাঝে আমি আব্বুকে কলের পর কল করে যেতে থাকি, কিন্তু সেইদিন আব্বু আমাকে ফাঁকি দেয়, আমার ফোন আর ধরে না। আমি পাগলের মত ফোন দিতে থাকি আর চিন্তা করতে থাকি এইবার আব্বু ধরলে আমি ঠিক কি কি বলে বকা দিবো, কিন্তু সেই বকাগুলা আমার আর দেয়া হয় না।

সেই থেকে ফোন ধরার ব্যাপারে আমি অনেক সচেতন হওয়ার চেষ্টা করি। আজ মাঝরাতে তাই কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে তড়িঘড়ি ফোন ধরতেই, যখন সেই যুবকের প্রেমময় গলা শুনতে পেলাম, তখন রাগে আক্ষরিক অর্থেই আমার চোখে পানি চলে আসলো। এরা কি আসলেই বোঝে অপরপক্ষের ওপর কি চাপ তারা সৃষ্টি করে?

৬,৯৪৮ বার দেখা হয়েছে

৪২ টি মন্তব্য : “ফোন কিচ্ছা”

  1. রকিব (০১-০৭)

    শুরুতে পড়তে গিয়ে আপনাকে খোঁচানোর নতুন উপাদান পেয়েছি ভেবে উৎফুল্ল হচ্ছিলাম; শেষটায় আর কিছু বলার মতো অবস্থায় নাই আপু।
    ভালো থাকবেন।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    সামিয়া তুমি তুমি খুব অনুভূতি ছুঁয়ে যাওয়া লেখা লেখ। এবারেরটা খুব বেশি ছুঁয়ে গেল।

    বদ প্রবাসীকে আচ্ছা ধোলাই। সাধেই আর লোকে প্রবাসীদের অপছন্দ করে না।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  3. রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

    😐
    প্রথমে ভাবসিলাম আমিও কিছু লিখি "এ্যাডাম টিজিং" নিয়ে । পড়তে পড়তে নীচের দিকে নামতে আর কোন ভাষা নাই 😐 😐 😐


    আমার কি সমস্ত কিছুই হলো ভুল
    ভুল কথা, ভুল সম্মোধন
    ভুল পথ, ভুল বাড়ি, ভুল ঘোরাফেরা
    সারাটা জীবন ভুল চিঠি লেখা হলো শুধু,
    ভুল দরজায় হলো ব্যর্থ করাঘাত
    আমার কেবল হলো সমস্ত জীবন শুধু ভুল বই পড়া ।

    জবাব দিন
  4. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    সকালে মোবাইলে লেখাটা পড়তে পড়তে চোখে কখন যে পানি চলে এলো বুঝতেই পারিনি। অনেকক্ষণ স্তব্দ হয়ে ছিলাম। তোমার কাঁচা ঘুম ভাঙানো 'যুবকে'র জন্য কেন জানি কোনো ক্ষোভই জন্ম নিল না। বরং ইচ্ছে করলো, একটা ফোন দিয়ে খোঁজ নিও। কিন্তু 'বকা' খাওয়ার ভয়ে এখনো ফোনটা করার সাহস করে উঠতে পারলাম না।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  5. আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

    আমার ছোট ছেলে, তোমাদের বয়সীই হবে। ওর প্রত্যেকটা ছুটি শেষে যখন ইউ কে তে ফিরে যায়, প্লেন থেকে নামার পরই থাকে আমার কল। হিথ্রু থেকে ৪/৫ ঘণ্টার বাস জার্নি কার্ডিফ পর্যন্ত।ও বাসে আরামে ঘুমায়, আমার দায়িত্ব থাকে যেন ফোনে ঘুম ভাঙিয়ে দিই।আমি সারা রাত জেগে বসে থাকি। ৪ ঘণ্টার আগে থেকেই কল দিতে থাকি, ঘুম ভাঙেই না।না উঠালেতো বাস নিয়ে যাবে অনেক দূর।
    পরিক্ষার দিন গুলোতে, প্রতিটি রাতে, প্রতি বার বেড়াতে যাবার বেলায়ও, আমার একি রকম সতর্ক পাহারা।
    সামিয়া তোমার বাবার উৎকণ্ঠা আমি নিজের ভিতর অনুভব করি। আমার বাবাও এই পঞ্চাশ বছরের বুড়ো খোকা কে নিয়ে এই মাঝ জানুয়ারি পর্যন্ত একই রকম করতেন। এখন আর করেন না। হয়তো এরই মাঝে আমারো আর করা হয়ে উঠবে না ,আমাদের বাবাদের মত কোন এক দিন!! ভালো থেকো ।


    Smile n live, help let others do!

    জবাব দিন
    • সামিয়া (৯৯-০৫)
      আমি সারা রাত জেগে বসে থাকি

      আপনাদের এই আত্মত্যাগগুলি আমাদের বড় বিপদে ফেলে দেয়। 🙁 আব্বুর সাথে কত যে ঝগড়া করেছি, কত বাজে বাজে কথা বলেছি...সব এখন শূলের মত এসে বিঁধে। আমার মধ্যে একটা কুসংস্কার আছে, পরীক্ষার আগে আব্বুর সাথে ঝগড়া না করে গেলে আমি পরীক্ষায় ভাল করতে পারতাম না। 😛 বুয়েট এডমিশন, ক্যাডেট কলেজের এডমিশন...প্রতিটা পরীক্ষার আগে আমাদের বাসায় তুলকালাম হয়ে যেত আমাকে নিয়ে।

      এখন মনে হয়, জীবনে কোনদিন আর আমি কিছুতে ভাল করতে পারবা না।

      জবাব দিন
    • Emran(89-95)

      সামিয়া, ব্যাপারটা কেমন হবে বলতো, যখন তোমার আব্বুর সাথে ঝগড়ার স্বাদটা ভবিষ্যতের কোন একদিন নতুন করে তোমার হবু ছেলের(তোমার নতুন বাবা) কাছ থেকে পাবে? সেদিন কিন্তৃ আবার একটা চমৎকার লেখা চাই।

      জবাব দিন
  6. মাহমুদ (৯৯-০৫)

    আমি সাধারনত কমেন্ট দেই না অলসতার কারনে, কিন্তু অলসতা ভেঙ্গে উঠে আসতে বাধ্য হলাম,তোমার লিখা কমেন্ট deserve করে। অসাধারন লিখা,অসাধারন বললেও কম বলা হয় :clap:


    মাহমুদ

    জবাব দিন
  7. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    এই লেখাটা পড়তে শুরু করেছিলাম বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে। মনে করেছিলাম বেশ কিছু আলোচনা হবে, এই অবাঞ্চিত ফোন গুলো যে কতটা কষ্ট দেয় তা জানি বলেই চিন্তা করছিলাম আলোচনা হোক। কিন্তু শেষ করে কিছু না বলেই ফিরে গেছি।
    আপু তুমি ভাল থেক অনেক অনেক।

    জবাব দিন
  8. ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

    ইফতারের দিন এই লেখাটার কথা শুনেছিলাম।
    পরদিনই পড়েছি।
    কি লিখব ঠিক করতে পারিনাই।
    হৃদয় ছোঁয়া লেখনী তোমার আপু।
    আজো পারলাম না।

    তবে আজ যা বলতে এসেছি - আমার মেয়েটার বয়স এখন ছয় মাস।
    কারনে অকারনে কোন কথা উঠলেই বাবা আগে বলতেন - 'যেদিন বাবা হবি তখন বুঝবি।'
    আজো সব বুঝিনাই - কিন্তু বাবা- মা'র ভালবাসা আর আত্মত্যাগের সাগরসম গভীরতা হয়তো আন্দাজ করতে পারি।

    দুনিয়ার সকল বাবা-মা'র জন্য কোটি কোটি সশ্রদ্ধ সালাম...
    ::salute::


    সৈয়দ সাফী

    জবাব দিন
  9. মেয়েটা, কখনো তোমাকে বলি নি কিন্তু আমি তোমার লেখার বিশাল ফ্যান। খুব ভেতরের কথাগুলো এমন ঝরঝর করে বলে ফেলা অনেক বেশি কঠিন! এতো সহজ করে কঠিন কাজটা করো যখন তখন বোঝা যায় যে মেয়েটা অনেক বেশি স্পেশাল! তোমার জন্য অনেক ভেতর থেকে অনেক অনেক অনেক ভালবাসা...

    জবাব দিন
  10. সাবিহা জিতু (১৯৯৩-১৯৯৯)

    আজকের দিনে খুজে খুজে এই ব্লগটা বের করে আরেকবার পড়ে গেলাম। বুকের ভিতরটা মনে হয় কেউ যেন দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে দেয় তোমার এই খুব সহজ ভাষায় লেখাটা যতবার পড়ি।
    তোমার নতুন জোবন সুখী হউক। (সম্পাদিত)


    You cannot hangout with negative people and expect a positive life.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সামিয়া (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।