ভালবাসা দিবস

ভালবাসা দিবসে প্রায় প্রতিবারই একটা ঘটনা মনে পড়ে যায়। আমরা তখন ক্লাস এইটে, এক্সটেম্পরের জন্য আমি আর পুষ্প দুইজন প্র্যাকটিস করছি, যে ভাল করবে সে যাবে (শেষ পর্যন্ত পুষ্প গেছিল কিন্তু:D) । আমাদের প্র্যাকটিস করান ক্লাস ইলেভেনের তামান্না আপা আর এমেল আপা। অসাধারণ পরিশ্রম করে এই দুজন মানুষ ধীরে ধীরে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন এইটের দুজন নবিশকে।

বৈচিত্রময় টপিক নির্বাচন করে তার চেয়েও বৈচিত্রময় করে কিভাবে কাহিনী বানাতে হয়, হাতে ধরে ধরে শেখাতেন তিনি আমাদের। একবার এমেল আপা বলেন, ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে কিছু বল। লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে যায়, আমার কাছে ভালবাসা তখন বড়দের ব্যাপার স্যাপার। আড় চোখে পুষ্পের এক্সপ্রেশন দেখার চেষ্টা করি। বুঝে পাইনা ও কিছু ভাবছে কিনা।

তামান্না আপা হো হো করে হেসে ওঠেন, পারিবারিক ভাবে চিনতেন আমাকে, বুঝে গেছেন আমার অবস্থা। কৌতুক মাখা চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, বলেন, আচ্ছা এই টপিকটা নিয়ে আমি বলি কিছুক্ষণ, তোমরা শেষ করবে।

কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে শুরু করেন তিনি, “ধরে নাও, আমি খুব দুষ্ট ছিলাম, কেবল টেলিফোন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অচেনা মানুষের সাথে আলাপ করতাম। একদিন হঠাৎ একজনের সাথে খানিকক্ষণ কথা বলে কেমন যেন মায়ায় পরে গেলাম। দিন যায়, তার সাথে কথা বলি, মায়া ঘিরে উঠতে থাকে তাকে জড়িয়ে…প্রতিদিন কথা হয়, প্রায়ই কথা হয়, কিন্তু শুধু কথাই হয়। দেখা আর হয় না। আমরা কথা বলি, আমরা বন্ধু হয়ে উঠি, আমরা লতার মত পরস্পরকে আঁকড়ে ধরি। ওর গলার স্বরটা আমার এত চেনা হয়ে যায়, আর আমারটা ওর…যে আমাদের কারও জীবনে পান থেকে চুন খসলেও অপরজন টের পেয়ে যেতাম। আমার চোদ্দ গুষ্টির ঠিকুজি ও মুখস্থ করে ফেলল কদিনের মাঝেই, আর আমি ভুলোমন, তাই আমি শুধু ওকেই চিনি, ওর চারপাশের মানুষের খবর নেয়ার কথা কোনদিন মনেও আসেনি।

ওকে দেখার জন্য আমি অস্থিরতা প্রকাশ করি, ও ক্লান্ত স্বরে আপত্তি জানায়। কিন্তু বন্ধুটিকে দেখার জন্য আমার আকুলতার কাছে সে পরাজিত হয়। ততোধিক ক্লান্ত স্বরে মেয়েটি আমাকে ঠিকানা জানায় তার। ঠিক করি, দুদিন পরের ভালবাসা দিবসটিতে আমরা দু বন্ধু দেখা করব।

আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি ঠিকানাটি একটি হাসপাতালের। দুরু দুরু বুকে ঢুকতেই ক্লান্ত মুখের বন্ধুটির দিকে চোখে পরে যায় আমার। আমরা কথা বলি, আমরা হাসি, ওর ক্লান্ত হাসির মাঝে ফুটে ওঠে আমার জন্য ভালবাসা। আমি এক বুক ভালবাসা নিয়ে বন্ধুটিকে শুধাই, কি হয়েছে তার।

ক্যান্সার। আমার বন্ধুটি খুব শীঘ্রই চলে যাবে এই পৃথিবী ছেড়ে, হাতে বেশি সময় নেই তার। সেদিনের সেই ভালবাসা দিবসে আমি শপথ নিয়েছিলাম, বাকি কটা দিন ভালবাসায় ভরিয়ে দেবো তার জীবনটাকে। আমি আমার শপথ রেখেছিলাম।

ভালবাসা তো কত ধরণেরই হতে পারে, সেদিনের ভালবাসা দিবস, আর আমার ভালবাসা, দুটোই ছিল একদম খাটি আর নির্ভেজাল।”

এটুকু বলে তামান্না আপা থামলেন। আমি টের পাই, এতক্ষণ আমি আর পুষ্প তন্ময় হয়ে ওনার কথা শুনছিলাম। কোন বিষয়কে উনি কোথায় টেনে নিয়ে গেছেন!

আর তাই, ঠিক চার বছর পর, যখন আমাকে তামান্না আপার জায়গায় বসতে হয়, আমি চেষ্টা করি ঠিক ওনার মতন যত্ন নিয়ে জুনিয়রদের গড়ে তুলতে। বিভিন্ন টপিককে কেমন করে বৈচিত্রময় করে তুলতে হয়, তার নিত্যনতুন আইডিয়া বের করার কাজে তুমুল ভাবে লেগে থাকি জুনিয়রদের সাথে। কেবল যখন ভ্যালেন্টাইন ডে টপিকটা ওদের প্র্যাকটিস করাতে যাই, তখন তামান্না আপার এই গল্পটা ওদের শুনাই।

গল্প শেষ করে আমি ওদের চোখে চোখ রাখি, চার বছর আগের সেই চেনা মুগ্ধতার ছায়া পড়ে। আমি একটু হাসি।

কম্পিটিশন শেষ হয়, আমার হাউস চমৎকার রেজাল্ট করে। তার পরদিন ছিল প্যারেন্টস ডে। প্যারেন্টস ডে শেষে আমি দেখি ক্লাস এইটের মেয়েটা, যে এক্সটেম্পরের প্রতিযোগী ছিল, সে আমার রুমের পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর বাবা ওর জন্য কেক নিয়ে এসেছিল, তার থেকে কয়েক টুকরো সে আমার জন্য নিয়ে এসেছে! এক্সটেম্পরে প্রথম হয়েছিল সে।

মেয়েটাকে আমি বকেছি অনেক, কিন্তু মেয়েটার জন্য আমার একটা প্রচ্ছন্ন ভালবাসা ছিল। চুপচাপ, শান্ত কিন্তু অসাধারণ একটা মার্জিত বোধ ওর মাঝে আছে। এই ব্যক্তিত্ব বোধটুকু সবার মাঝে থাকে না। জুনিয়র মানেই তেলের ডিপো, এই ধারণাটাকে সে বাতিল করে দেয় তার আচরণেই।

তারও প্রায় এক বছর পরে, যখন আমি কলেজ ছেড়ে চলে যাবো, তার আগের দিন মেয়েটাকে আমি আবিষ্কার করি আমার রুমের পাশে, আবারও, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রঙ্গিন কাগজে মোড়ানো একটা বাক্স এগিয়ে দেয় সে, আপা আপনার জন্য।

আমি চলে যাচ্ছি, তাই আমার জন্য তার ছোট্ট ভালবাসা। জুনিয়রের প্রতি স্নেহ প্রকাশ ক্যাডেট কলেজে বড়সড় দুর্বলতা, আমি তাই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারি না, ওর জন্য আমার মাঝে স্নেহের একটা জায়গা আছে। আমি গম্ভীর মুখে ওর ভালবাসা গ্রহণ করি, স্বার্থপরের মত।

কলেজ থেকে বের হয়েও কলেজ সংক্রান্ত সব কিছুতেই সমান আগ্রহ থাকে সকল ক্যাডেটেরই। সবার খবরাখবর আমরা জেনে যাই খুব তাড়াতাড়িই। একদিন তাই আমিও জেনে যাই, আমার স্নেহের এই ক্যাডেটটির ক্যান্সার হয়েছে। তামান্না আপার গল্পটি ওকে আমি শুনিয়েছিলাম, গল্পটি যে ওর জীবনেই সত্যি হয়ে যাবে, এই বোকা আমিটা চিন্তাও করতে পারিনি তখন। আমি খুব ভীরু, ওর সামনে গিয়ে আমার ভালবাসাটা প্রকাশ করতে পারিনি।

সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা, তুমি যেখানেই থাকো, যেন ভাল থাকো ফারজানা। এবারের ভালবাসা দিবসটায় আমার ভালবাসা জেনো, একদম খাটি আর নির্ভেজাল ভালবাসা।

৯,৯০৯ বার দেখা হয়েছে

৫৪ টি মন্তব্য : “ভালবাসা দিবস”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    তামান্না আপা আমার আপন চাচাতো বোন-আর এক্সটেমপোর স্পীচ হচ্ছে আমার ইভেন্ট-সংগত কারণেই খুব ভালো লেগেছে লতায় পাতায় হলেও কাহিনীটার সাথে জড়িয়ে যেতে।

    ফারজানার জন্যে ভালোবাসা-ভালো থেকো আপু!যেখানেই থাকো...

    জবাব দিন
  2. তৌফিক (৯৬-০২)

    তোমার পোস্টটাতেও ঢুকেছিলাম হালকা চালে একটা মন্তব্য লিখে চলে যাব। ভালবাসা দিবস নিয়ে মাতামাতিকে খোঁচা দিয়ে। দুইবার ঘুরে চলে যেতে হল, কিছু লিখতে পারলাম না।

    আমি সংশয়বাদী, বিশ্বাসের কাঁটাটা দুইদিকেই তিরতির করে কাঁপে সবসময়। তবে কিছু মুহূর্ত আছে, যেগুলোতে মনে হয় কেউ একজন আছেন যিনি চলে যাওয়া মানুষগুলোকে দেখে রাখছেন। আল্লাহ সব অকালে চলে যাওয়া ভাই-বোনদের ভালো রাখুন।

    জবাব দিন
  3. আহমদ (৮৮-৯৪)

    লেখাটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল।
    ভালবাসার মানুষ হারানো অনেক কষ্টের।
    লেখাটা মন ছুয়ে গেল। সামিয়াকে এজন্য অভিনন্দন।
    ফারজানার জন্য প্রান-ভরে দোয়া করছি।


    চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

    জবাব দিন
  4. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    মনটা খারাপ হলো।
    অদ্ভুত সুন্দর লিখছিস পিচ্চি। ছোট্ট মেয়েটার জন্য স্রষ্টার কাছে দোয়াই শুধু করতে পারি এখন 🙁 পলেন'এর মৃত্যুদিনও গ্যালোনা, দু'দিন আগে? আল্লাহ যেখানেই রাখুন ছোট আপু দুজনকে ভালো রাখুন।


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  5. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    সামিয়া তোমার এই লেখায় ক্যাডেট কলেজ, তামান্না আর অকালে চলে যাওয়া ফারজানার জন্য এক জীবন্ত অনুভূতি জাগিয়ে তুললে।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  6. সামিয়া খুব সুন্দর লিখ তুমি.....লেখাটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল।ফারজানার জন্য অনেক অনেক ভালবাসা।তোমার লিখা পরার সময় যেন কাডেট কলেজ এর সেই সময় এ ফিরে গেলাম ।ভাল থেকো ফারজানা………

    জবাব দিন
  7. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    লেখার শেষটা যে এমন হবে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না, লেখিকা হিসেবে তুমি সার্থক। কিন্তু যে ঘটনার বর্ননা তোমার লেখাকে এত বলিষ্ঠ করে তুললো সেটা বাস্তবে না ঘটলেই আমরা সবাই খুশি হতাম। ফারজানার যেন তার বর্তমান জগতে শান্তিতে থাকে আল্লাহর নিকট সেই প্রার্থনা করি। আর সামিয়ার মত করে এই ভালবাসা দিবসে ফারজানার জন্য রেখে দিলাম একদম খাটি আর নির্ভেজাল ভালবাসা যা চিরদিনের জন্য থাকলো।

    জবাব দিন
  8. রুবেল (৯৯-০৫)

    🙁 🙁 বরাবরই ইচ্ছা হয় মন খারাপ করা কিছু নিয়া না লিখতে,কারন কিছু কিছু টপিক থাকে যেগুলো হঠাৎ করে মনটাকে ভীত করে দেয়,
    কিন্তু সামিয়া -লেখার প্রশংসা করছিনা।তবে অনেক ধন্যবাদ ফারজানা কে নিয়ে লেখার জন্য, কাইয়ূম ভাইকেও থ্যাঙ্কস পলিন এর কথাটা মনে করার জন্য।আসলে সুখের সময় গুলোতে প্রায়ই আমরা পেছনে ফেলে আসা মুখ গুলোকে ভুলে যাই।
    লেখাটা পড়ে খুব ভাল লাগলো।থ্যাঙ্কস :dreamy:

    জবাব দিন
  9. সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

    সামিয়া,
    ছোট অথচ খুবই মর্মস্পর্শী লাগলো তোমার লেখাটি। প্রথমে ভেবেছিলাম এটি বুঝি শুধুই একটি গল্প। পরে মন্তব্যে দেখলাম ফারজানার নাম। এ নাম তো গল্পে দেখিনি। ফলে আবার পড়লাম গল্পটি। তখন বুঝলাম এটা গল্পের চেয়ে বেশী। ফারজানাকে আমি জানিনা, চিনিনা, কখনো দেখিনি - তবু অজানা তার কথা ভেবে অবাধ্য মনটা বড় বিষন্ন হয়ে গেলো।

    জবাব দিন
  10. ফারহানা (২০০১-২০০৭)

    একসাথে অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল আপা আপনার লেখা পড়ে।কলেজের চেনা মুখগুলোর অনেকেই আজ আর আমাদের মাঝে নেই।তবুও এই মুখগুলো কোনোদিন ভুলবার নয়।
    পলেন আপা,সাবা আপা ,ফারজানা ...........
    আল্লাহতাআলা তাদের শান্তিতে রাখুন।

    জবাব দিন
  11. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    সামিয়া, তোমার লেখাটা পড়ে কি মন্তব্য করবো বুঝে উঠতে পারছি না। এতোটাই আচ্ছন্ন হয়ে আছি। অসাধারণ একটা ভালোবাসার কথা, ভালোবাসার দিনে। এমন দিনেই তো ওদের স্মরণ করতে হয়।

    ফারজানা, পলেন..... কাছের মানুষ মনে হয় সবাইকে। আরো যারা আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছে, সবার জন্য ভালোবাসা।

    আপু, আরেকজনের কথা লিখবে? নিজে অনেক যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে যাচ্ছো। জানি কষ্ট হবে। রক্তক্ষরণ হবে। তবুও অনুরোধ, তোমার হৃদয় দিয়ে তুমি লিখবে তোমার আরেক ভালোবাসার কথা। ভাই বলো, বন্ধু বলো- সব দাবি নিয়ে এই অনুরোধ। বাবার কথা লিখ এবার ছোট্ট বোনটি। তোমার সঙ্গে বাবার সব সুখ-দুঃখের স্মৃতিগুলোতে আমাদের ভাগ দাও।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  12. রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

    সািময়া,একটা েসলুট করেত চাই।ফারজানা,ভাল থািকসের বোন.........


    আমার কি সমস্ত কিছুই হলো ভুল
    ভুল কথা, ভুল সম্মোধন
    ভুল পথ, ভুল বাড়ি, ভুল ঘোরাফেরা
    সারাটা জীবন ভুল চিঠি লেখা হলো শুধু,
    ভুল দরজায় হলো ব্যর্থ করাঘাত
    আমার কেবল হলো সমস্ত জীবন শুধু ভুল বই পড়া ।

    জবাব দিন
  13. নাবিলা (৯৯-০৫)

    কি লিখব বুঝতে পারছিনা...অনেকদিন পর ব্লগে এসে কাঁদব তা কল্পনাও করিনি...অসাধারণ হয়েছে লেখাটা।তুমি এত সুন্দর লিখ আমি আগে বুঝিনি সত্যি।tmr jnno onk koste banglae tinta line likhlam...u worth it.lvu

    জবাব দিন
  14. খুব সুন্দর একটি লেখা. খুব মন খারাপ করা একটি লেখা...
    প্রথম যখন পরা শুরু করলাম তখন ভাবছিলাম লেখিকা ভালো
    বানিয়ে বানিয়ে লিখতে পারে...
    কিন্তু লেখা পুরোটা পরে এখন অনুশুচনা তে ভুগছি যে কেন
    এমনটা ভাবলাম...

    যেখানেই থাকো ফারজানা ভালো থাকো...

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহমদ (৮৮-৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।