তিন চাকায় দুই গল্প

-এই রিকশা যাবেন?
-কই যাইবেন?
-খিলগাঁও
-চলেন, ৬০ ট্যাকা।
-কী?? ৪০ টাকায় যাবেন?
– না।

রিকশাটা রেখে এগিয়ে যায় রাশেদ। আরেকটা রিকশা সামনে। রিকশাওয়ালা একটু পরপর আশেপাশে তাকাচ্ছে। খুব তাড়া আছে দেখে মনে হচ্ছে।

– খিলগাঁও যাবেন?
– যামু, খিলগাঁও কই?
– গোড়ান, কত?
– যা ভাড়া হয়, দিয়েন মামা।
– ৪০ টাকা।
– আচ্ছা, ওঠেন।

রিকশায় উঠতে গিয়ে রাশেদ দেখে সিটের উপরে পলিথিনে মোড়ানো একটা প্যাকেট। দেখে মনে হচ্ছে খাবারের প্যাকেট।

প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স হবে রিকশাওয়ালার। রাশেদকে একটু লজ্জিত ভাবে বলে – “মামা, আপনে উইঠ্যা বইসা একটু ধইরা রাখবেন প্যাকেটটা?”
সাধারণত রিকশায় উঠে কোনদিন এরকম কিছু দেখে নাই রাশেদ। তাই জিজ্ঞেস করে- ” কী আছে এখানে?”
রিকশাওয়ালা বলে- ” দুপুরবেলা খাই নাই তো। আপনেরে নামায়া দিয়া খাবো। ”

আর কিছু জিজ্ঞেস করে না রাশেদ। হাতে প্যাকেটটি নিয়ে উঠে পড়ে রিকশায়। হাতে নিয়ে প্যাকেটের উচ্চতা দেখে মনে হল, দুইটা প্যাকেট। দুইজনের খাবার হয়তো।

চলতে থাকে রিকশা। চুপচাপ বসে আছে সে। মিলিকে আজকে বেশ একটা সারপ্রাইজ দেয়া যাবে, ভাবছে রাশেদ। অফিস তারাতারি ছুটি হয়ে গেল আজ।

বিয়ে করেছে কয়েক মাস হল। মিলি প্রতিদিনই বলে, বাসায় গিয়ে লাঞ্চ করতে। অফিসে লাঞ্চের ব্রেক দেড়ঘন্টা। বাসা থেকে অফিস যেতে রিকশায় আধাঘণ্টা লাগে প্রায়। কিন্তু রাস্তায় জ্যাম থাকে আর প্রায়ই ব্রেকের সময়ে কিছু না কিছু কাজ থাকে বলে তার আর যাওয়া হয় না। অফিসের সামনের হোটেলেই কিছু একটা খেয়ে নেয় প্রতিদিন।

আজ হঠাৎ করেই ছুটি হল এত তারাতারি অফিস।
মিলিকে তাই ফোন না করেই চমকে দেয়ার জন্য সে আজ যাচ্ছে বাসায়।

রিকশা বেশ দ্রুত চালাচ্ছে চালক। জ্যাম বা ভিড় দেখলেই কোন একটা ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে তার মধ্য দিয়েই চালিয়ে দিচ্ছে। দেখে রাশেদের মনে হল, চালকেরও মনে হয় খুব তাড়া আছে।

-মামা, একটু আস্তে দেখে শুনে চালান।
-চিন্তা কইরেন না মামা। আমি ২৫ বছর ধইরা এই কাম করি।

বলে একটু হাসে রিকশাওয়ালা।

– থাকেন কই মামা?
– এই আপনের খিলগাঁও।
– পরিবার আছে এখানে?
– আছে মামা।
– ভাল। তা মামা, আপনি ৪০ টাকা বলতেই রাজি হয়ে গেলেন যে? এই টাইমে তো ৫০ টাকার কমে কেউ যেতেই চায় না।

– আসলে মামা, আপনে যেখানে যাইবেন, সেখানে আমারো যাওয়া লাগবো তো। একটু আর্জেন্ট কাম
আছে। তাই আর বেশি ট্যাকা চাই নাই। এই টাইমে ওইদিকের যাত্রীও পাওয়া যায় না খুব বেশি ।
– ও আচ্ছা। বুঝতে পারছি।

আর কিছু বলে না রাশেদ। মনে বেশ একটা ফুরফুরে অনুভূতি।
মিলি তাকে দেখে কেমন খুশি হবে সেটাই ভাবছে। হয়তো খুশিতে লাফিয়েই উঠবে মেয়েটা বাচ্চাদের মত। দরজা খুলে তাকে দেখে জড়িয়ে ধরে কি দুয়েকটা চুমু দিয়ে দিবে তাকে??
খুব বেশি মজা লাগছে রাশেদের।
ছুটিরদিন গুলো ছাড়া তো তাকে সময়ই দিতে পারেনা খুব একটা। একসাথে লাঞ্চ করে বিকালে নাহয় একটু ঘুরতে যাবে তাকে নিয়ে।

ভাবতে ভাবতেই দেখে চলে এসেছে সে। রিকশা থেকে নামে বাসার সামনে। ১৪ তলা বিল্ডিং এর ৬ তলায় তার বাসা।
এই বিল্ডিং এর পাশেই আরেকটা নতুন বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। ইট ভাংছে কয়েকজন মহিলা পুরুষ।

রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দেয় সে। হাত থেকে প্যাকেটটা রেখে দেয় সিটের উপরে।

চিনি ফুরিয়ে গেছে, সকালে বলছিল মিলি। তাই পাশের দোকানে একটু দাঁড়ায় সে।

রিকশাওয়ালা চলে যেতে থাকে রিকশা নিয়ে। সে দেখে রিকশাটা আস্তে আস্তে পাশের বিল্ডিং তৈরির কাজের জায়গাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
ইট ভাংগা এক মহিলার কাছে গিয়ে থামলো সেটা।
রিকশাওয়ালা প্যাকেটটা নিয়ে এগিয়ে গেল তার দিকে।
তাকে দেখেই হাতের হাতুড়ি পাশে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সেই মহিলা।
আঁচল খুলে নেয় কোমর থেকে, ঘামে ভেজা মুখটা মুছে নেয়। মাথায় ছোট একটা ঘোমটা দেয়।
হাসিমুখে তার দিকে প্যাকেটটা এগিয়ে দেয় রিকশাওয়ালা।
মুচকি হেসে প্যাকেট হাতে নিয়ে বসে পড়ে সে। তার পাশে রিকশাওয়ালা।
প্যাকেট খোলে।
বাতাসে মুরগী পোলাওয়ের গন্ধ কি ভেসে আসে রাশেদের নাকে??

কে জানে?? খুব ব্যস্ত হাতে কলিংবেল টেপে সে।

২,৪৩৩ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “তিন চাকায় দুই গল্প”

মওন্তব্য করুন : Khairul Ahsan (1967-1973)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।