ফেরা

স্টেশনে আমি পৌছালাম শেষরাতের দিকে,
বহু পুরনো ঠিকানা আমার,
জানতাম না আবার ফিরে আসতে পারবো কিনা;
হোক না অন্যভাবে, তবু এসেছি আমি আবার।

রফিক চাচা, হোসেন আর কামাল এসেছে-
আমাকে নিয়ে যেতে,
অনেক চেনা জায়গা এটা; তবু এসেছে ওরা।
কারণ, আসতে হয়।

আমাকে নিয়ে এগুতে থাকে ওরা-
সামনেই নতুনবাজারের মোড়।
হাহ, নতুনবাজার!
৬০-৭০ বছরের পুরনো বাজার।
তবু কপাল থেকে নতুন নামটা ঘুচে নাই।

মনে আছে-
কতবার হাটের দিন বাবার সাথে এসেছি এখানে,
খুরমা, কদমা আর বাতাসার লোভে বাজারের ব্যাগ বয়ে হেঁটেছি তার পাশে পাশে।
আচ্ছা, এখনো কি হাট বসে? কোন কোন দিনে?

বাজার পেরিয়ে পাশের খোলা মাঠের দিকে চেয়ে আমি থমকে যাই,
অন্ধকারে ঢাকা সব,
তবু স্পষ্ট আমি দেখতে পাই-
ইতির সাথে ছুটে ছুটে হাট্টিমাটিম টিমের ডিম খুঁজে বেড়ানো দিনগুলো।
কী দুষ্টুই না ছিল মেয়েটা!
সংসারের যাঁতাকলে কেমন আছে সে এখন?

অনেকের কথাই মনে ভেসে ওঠে,
জানতে ইচ্ছে করে অনেক না জানা গল্প।

সরকার পাড়ার হিজল গাছের নিচে দাড়িয়ে
শেফালীকে একদিন বলেছিলাম- “তর জন্যি মনডা পুড়ায়”
হেসে বলেছিল সে- “পানি দিয়া যাবানি একদিন”।
কত বর্ষার জল গড়িয়ে গেল, কত বৃষ্টি কত আগুন নেভালো-
কেন আসেনি শেফালী, জানা হল না।

নিঃসন্তান কাদের চাচা কি বেঁচে আছে?
প্রাইমারী স্কুলের গেটের পাশে কি এখনো বসে থাকেন?
বাচ্চাগুলোর দিকে তাকানো তার সেই চাহনি ভুলবো না কোনদিন।
ভুলবো না-
বাইশ বছর বয়সে তিন সন্তানের বাপ হওয়া জলিলের দিকে চেয়ে তার দীর্ঘশ্বাস।
অসহায়ত্ব নাকি হতাশা, কী ছিল তার চোখে বোঝা হল না আর।

সেই জোবেদা পাগলী কি আজো রাত দুপুরে গোসল করে পুকুর পাড়ে?
ছোট্ট রতন হিসু করতে বের হয়ে আর কি ভয় পায় তাকে দেখে?
এখনো কি সে গাছের বেল বিক্রি করে সংসার চালায়?
স্বজনহীন ভাবে এতগুলো বছর কিভাবে সে বেঁচে রইলো, জানা হল না।
জানা হল না, “কুমড়ার বিচি গুল্লা গুল্লা” শুনলেই কেন সে তেড়ে মারতে আসতো।

এক ঠ্যাং ভাঙ্গা সেই কুকুরটার কথা কি আর কারো মনে পরে?
বেওয়ারিশ কুকুরটা যখন এসেছিল গ্রামে-
জব্বার শেখ বলতো-
“এই কুত্তা অমঙ্গল নিয়া আইছে, গেরামে একদিন ডাকাইত আইবো দেখিস”।
একমাসের মাথায় ডাকাতরা যে রাতে শেখের পরিবারকে কচুকাটা করে গেল,
সে রাতের প্রথম লাশ ছিল ওই কুকুরটার।

আরো কত কী প্রশ্ন মনে পরছে আজ,
জানি কোনটারই উত্তর এখন আর জানা যাবে না।
সকল জানা-অজানার উপরে আজ আমার অবস্থান।

ফজরের আজান হচ্ছে,
এরপরই নাকি আমার জানাজা, তারপর দাফন।

সূর্য উঠি উঠি করছে;
এবার আমি ঘুমাবো-
বহু প্রশ্নের জমে থাকা ক্লান্তির ঘুম।
কে জানে, হয়তোবা শান্তির ঘুম।

১,৪৮৪ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “ফেরা”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    ইদানিং কমেন্টে প্রথম হওয়া বড় সহজ। কবিতা পড়ে, ভাব বুঝে, আরাম করে লিখলেও প্রথম হওয়া যায়।

    খুব ভাল লাগলো। খুবই। বহু প্রশ্নের জমে থাকা ক্লান্তির ঘুম! :thumbup:


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    ভাই তুমি তো আমারে লজ্জায় ফেলে দিলা।
    আমি বুঝি খালি ভুল ধরি?

    লেখা খুব ভালো লেগেছে। অবশ্য শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলাম, এ অন্যরকম ফেরা -- একটা বাক্যের কারণে --

    কারণ, আসতে হয়।

    তবে সেটা বড় কথা নয়। এ লেখার আসল শক্তি তার জীবনবোধে। একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র যেন দেখলাম।

    সকল জানা-অজানার উপরে আজ আমার অবস্থান।

    এ কথাটা অনুক্ত থাকলেই যেন উচ্চারিত হতো আরো অনেক বেশী জোরের সাথে।

    'ঘুচে নাই' এর বদলে 'ঘোচেনি' আরো ঠিক শোনাতো।
    লেখার জন্যে আবারো মুগ্ধতা।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।