কেন আমি আত্মহত্যা করবো??

কয়েক মাস আগে বাড়িতে গিয়েছিলাম ছুটিতে। আব্বুর সাথে কী একটা কথা বলতে বলতে হঠাৎ বললেন, “ইমন মারা গেছে জানো?”

আমি- “কোন ইমন?”

আব্বু- “তোমার আফতাব চাচার ছেলে”।

আমি- “কিভাবে মারা গেছে?”

আব্বু- “সুইসাইড করেছে”।

আমি- “কেন?”

আব্বু- “খারাপ ছেলেদের সাথে মিশতো নাকি, ড্রাগ নেয়া শুরু করেছিল। একটা মেয়ের সাথে নাকি সম্পর্ক ছিল। শেষের দিকে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। একদিন রাতে গলায় দড়ি দেয়……”

এইটুকু শুনেই আমার খুব খারাপ লাগছিল। ছেলেটা বয়সে আমার থেকে কমপক্ষে ৫/৬ বছরের ছোট হবে। চিন্তা করে কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না যে ওইটুকু একটা ছেলে সে জীবনের কীই বা দেখলো আর কীই বা বুঝলো যে এত তাড়াতাড়ি তাকে নিজের হাতে নিজের জীবনের ইতি টানতে হল।

এবার কুরবানির ঈদে বাড়িতে গিয়েও শুনলাম আরো দুই ছেলের আত্মহত্যা করার খবর। এইসব খবরগুলো কেমন জানি প্রচণ্ড গরমে গায়ে ঠান্ডা বরফ ছোঁয়ানোর মত আকস্মিক আর অস্বাভাবিক লাগে। মনের অনুভূতিগুলো শীতল হয়ে যায়। বুকের মধ্যে একটা চাপা কিন্তু খুব তীব্র ব্যথা ক্রমে চেপে বসে। মনে প্রশ্নের দাপাদাপি শুরু হয়। কেন ওরা চলে গেল এত আগে? মাত্র ১৫ কিংবা ২১/২২ বছর বয়সে কেন থেমে গেল ছটফটে একটা পাখির স্বতঃস্ফূর্ত ডানা ঝাপটানি?

ওদের স্বজনদের জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, ওরা চলে গেছে খুব তুচ্ছ কিছু কারণে। কারো হয়তো প্রেমের সম্পর্ক অকালে ভেঙ্গে গেছে কিংবা বড় ভাইবোন বা বাবা-মায়ের সাথে মনোমালিন্য হয়েছে। আবার কেউ হয়তো অকৃতকার্য হয়েছে কোন পরীক্ষায়। ফলে অসম্ভব রকমের অভিমান জেঁকে বসেছে বুকে, মনে নিজের প্রতি তীব্র রাগ আর ঘৃণা।

কেউ হয়তো পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে দুটো সান্ত্বনার কথা বলেনি। বলেনি, “একবার পারোনি তো কী হয়েছে? আমরা তো আছি তোমার সাথে সবসময়”। হয়তো বা কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছে, লাভ হয়নি। সে বেচারি দরজা বন্ধ করে কানে আঙ্গুল দিয়ে বসে থেকেছে। নিজের মনের আগুনে নিজেই জ্বলেছে।

এইসব মৃত্যুগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত, অস্বাভাবিক। যে পরিবারে কেউ আত্মহত্যা করে  সে পরিবারটা ধ্বংস হয়ে যায়, সারাজীবন আধমরা হয়ে থাকে মানুষগুলো।

যারা আত্মহত্যা করে তারা কি একবারও ভাবে না প্রিয়মুখগুলোর কথা? এত স্মৃতি, এত হাসিকান্না দিয়ে ভরা যে জীবনটা তাকে কি এক তুড়িতে উড়িয়ে দেয়া যায়? একবারও কি মনে হয় না যে তার চেয়েও আরো অনেক গুণ বেশি কষ্ট, যন্ত্রণা নিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেঁচে আছে?

মা-বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছে বলে যে ভাবছে তার জীবন এখানেই শেষ, তার একটু চিন্তা করা উচিত সেই অনাথ টোকাই ছেলেটার কথা। সারাজীবন কেটেছে রাস্তায়, কোনদিন একটা লোক ভালভাবে একটা কথা বলেনি, গায়ে বুলায়নি কেউ মমতার হাত। সারাদিন লাথিগুতা যার প্রধান খাবার। সে কিন্তু আশা ছেড়ে দেয় না। কোন একদিন, কেউ একজন তাকে ভালবাসবে এই আশাতেই সে দিন কাটায়। আর আপনি একদিনের ঝগড়া মিটিয়ে ফেলতে পারেন না? একবারের জন্য আপনজনদের কাছে নিজের মনের কথা খুলে বলতে পারেন না?

প্রেমিকের সাথে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে বলে যে মেয়েটি ভাবছে তার জীবনের কোন মূল্য নেই, তাকে বলছি। দুনিয়ায় মানুষের অভাব নেই। একটা প্রেম নষ্ট হয়েছে তো কী হয়েছে, আবার হবে। আপনার জীবনে তবু প্রেম, ভালবাসা এসেছিলো, একবার চিন্তা করুন তো রমনা কিংবা চন্দ্রিমা উদ্যানের দেহপসারিণী মেয়েটার কথা। জন্ম হয়েছে রাস্তায়, জীবন কেটেছে পোকায় কাটা ছেঁড়া বইয়ের মত। প্রতি রাতে যাকে পেটের দায়ে প্রেমিকা সাজতে হয় পরপুরুষের জন্য। যে সকাল আপনার কাটে নরম বিছানায়, সুখস্মৃতি কল্পনায়; সেই সকালে সে জেগে ওঠে ক্লেদযুক্ত শরীরে, তলপেটে অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে। যে যন্ত্রণা প্রতিদিন একটু একটু করে ফুরিয়ে যাওয়ার।

পরীক্ষায় ফেল করেছে বলে বাবা-মায়ের বকুনি আর প্রতিবেশীদের টিটকারিতে যার জীবন অতিষ্ঠ, তাকে কিছু বলার আছে আমার। একবারেই  কি সব কিছু শেষ হয়ে যায়? আরও দুয়েকবার চেষ্টা করেই দেখেন না। এরপরও যদি কাজ না হয়, কোন সমস্যা নেই। পড়াশোনা ভাল লাগেনা তো অন্য কিছু করেন। আপনার নিজের যে কাজ ভাল লাগে তার কথা সবাইকে জানান। খেলাধুলা করতে পারেন, গান গাইতে পারেন, ছবি আঁকতে পারেন; সৃষ্টিশীল যেকোন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারেন। পৃথিবীতে আনন্দদায়ক কাজের কোন শেষ নেই। খুঁজতে থাকুন, কিছু না কিছু পেয়ে যাবেন; হতাশ হবেন না।

আরও অনেক অবস্থায় অনেকেই জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বেঁচে থাকার উৎসাহ খুঁজে পান না। তাদের বলি, একবার আপনার চারপাশের মানুষ গুলোর দিকে তাকান। দেখবেন, আপনার খুব আশেপাশেই আপনার চেয়ে অনেক অনেক কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে অনেক মানুষ। ক্ষুধার কষ্ট, বস্ত্রের অভাবের কষ্ট, সম্মানহীনতার কষ্ট নিয়েও বেঁচে আছে তারা।

মনে রাখবেন, দুর্ঘটনায় হাত-পা হারানো পারালাইজড একজন মানুষও মরতে চায় না। জড়মাংসের পিণ্ড হয়েও সে বেঁচে থাকতে চায়। আপনি কী তার চেয়েও দুঃসময় অতিবাহিত করছেন?

নিজেকে প্রশ্ন করুন। ভেবে দেখুন আপনার প্রিয়মানুষ গুলোর কথা। জীবনের এতগুলো সময় পার করেছেন তাদের সাথে।

একবার ভাবুন তো আপনার সাথে তাদের শেষ দেখা হবে কোন চেহারায়-

*নিজের তৈরি ফাঁসির দড়িতে ঝুলে আপনার জিহ্বা বের হয়ে গেছে পুরোটা, হিমশীতল কাঠ হয়ে আছে আপনার শরীর।

*কিংবা আগুনে পুড়ে ঝলসানো আপনার দেহ, বিকৃত মুখ; দেখলে চেনা যায় না।

*অথবা, ট্রেনের চাকায় পিষ্ট হয়ে অগণিত খন্ড হয়ে যাওয়া আপনার একসময়ের কত আদরের শরীর।

এরকম কোন শেষ বিদায়ের দৃশ্য কি রেখে যেতে চান আপনার প্রিয় মানুষগুলোর জন্য? আপনার যে বিদায়ের দৃশ্যগুলো সারাজীবন তাদের দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়িয়ে বেড়াবে, নির্ঘুম রাত পার করবে তারা বেঁচে থাকবে যতদিন।

আমাদের এই জীবনটা আমাদের একার না। আমাদের সৃষ্টিকর্তার সর্বোচ্চ অধিকার আছে আমাদের জীবনের উপর। আমাদের আপনজনদের- বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজনদের অধিকার আছে আমাদের উপর। এত ভালবাসা, মায়া-স্নেহ কি এত সহজেই ঝেড়ে ফেলতে পারি আমরা?

নিজে থেকে নিজের জীবনের মানে খুঁজে বের করতে হবে। ভাল লাগছে না? একটা সুন্দর গান শুনুন, একটা ভাল বই পড়ুন, সিনেমা দেখুন। একটা গান কিংবা বই হয়তো আপনার মনকে পরিবর্তিত করে দিতে পারে। আবার আশা জাগাতে পারে জীবনে। মোটকথা, ধৈর্য ধারণ করতে হবে।

একটা রাত যত গভীর অন্ধকার আর কষ্টেরই হোক না কেন, সবসময় মনে রাখতে হবে- রাত অবশ্যই শেষ হবে; আলো আসবে আবার- নতুন সূর্যের আলো।

১,৭৯৮ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “কেন আমি আত্মহত্যা করবো??”

    • সামিউল(২০০৪-১০)

      ভাই, আমার মনে হয় একটা সুস্থ লোক কোন না কোন কাজ করতে পারবেই।
      কাজ করতে না পারুক শিখতে তো কোন দোষ নেই।
      চাইলেই একটা কিছু তে নিজেকে দক্ষ করে তোলা যায়। এর জন্য দরকার শুধু সদিচ্ছা আর নিজের প্রতি শ্রদ্ধা।

      আর আত্মহত্যা কখনোই একটা সমস্যার সমাধান হতে পারে না। এক জনের আত্মহত্যা অন্য আরও অনেকের জন্য হাজারটা সমস্যা সৃষ্টি করে। 😀


      ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

      জবাব দিন
  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    "কেউ হয়তো পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে দুটো সান্ত্বনার কথা বলেনি। বলেনি, “একবার পারোনি তো কী হয়েছে? আমরা তো আছি তোমার সাথে সবসময়”"
    এসব বলার লোক কোথায়?
    বরং "তুই মরতে পারিস না?"
    এইটা বলার লোকের কোনো অভাব হয় না.........


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
    • সামিউল(২০০৪-১০)

      মানসিকতার পরিবর্তন দরকার ভাই। অনেকেই আছে, কারো কারো উপরে ধৈর্যহারা হয়ে এসব বলে ফেলতে পারে। তার নিজের ভুলটা বুঝতে হবে। তারপর সেই অভাগা/অভাগীকে কাছে টেনে বলতে হবে ... "ভয় কী??? আমিতো আছি'


      ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোস্তাফিজ (১৯৮৩-১৯৮৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।