দৈনিক ধারাবাহিক অভিনয়…

রাত ৯.১৫। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল। জহির বসে আছে বিছানায়।
তার মোবাইলটা বেজে ওঠে হঠাৎ। হাতে নিয়ে দেখে মা কল দিয়েছে গ্রাম থেকে। সে কলটা কেটে দিয়ে নিজেই কলব্যাক করে।

– হ্যালো, মা।
– হ্যালো বাবা কেমন আছিস রে?
– আমি খুব ভাল আছি মা। তোমার শরীর এখন কেমন? রাশেদ আর মিলি কেমন আছে?
– আমার শরীর এখন একটু ভাল। রাশেদ আর মিলি পড়ছে। তুই রাতে খেয়েছিস?
– হ্যাঁ, খেয়েছি। তোমার বুকের ব্যাথা কমেছে?
– কমেছে, বাবা কমেছে। তুই টেনশন করিস না তো? রাতে কী খেয়েছিস?
– মুরগির মাংস, সবজি আর ডাল দিয়ে ভাত। তোমরা কী খেয়েছো?
– আজ তোর বাবা বেশ বড় একটা বোয়াল মাছ কিনে এনেছিল বাজার থেকে। সবাই খুব মজা করে খেয়েছে।
– বাবার শরীর কেমন আছে?
– ভাল আছে। নে কথা বল তোর বাবার সাথে।
ওপাশে বাবার গলাঃ-
– জহির, ভাল আছিস?
– হ্যাঁ বাবা। তুমি কেমন আছো? তোমার কি আর শ্বাস নিতে কস্ট হয়?
– না রে। গত কয়েকদিন ধরে ভাল আছি। তুই টেনশন করিস না। তোকে যে বলেছিলাম টিউশনি ছেড়ে দিতে, দিয়েছিস?
– (একটু ইতস্তত করে) ছেড়ে দিয়েছি বাবা।
– তোর এগুলো করার দরকার নাই। আমার যত কষ্টই হোক তোকে আমি টাকা জোগার করে দেবো। তুই শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা কর। টাকা লাগলে আমাকে সাথে সাথে জানাবি। আর আমাদের জন্য কোন দুশ্চিন্তা করিস না। আমরা ভাল আছি সবাই।
– আচ্ছা তাহলে রাখি বাবা। আল্লাহ্‌ হাফেজ।
– আল্লাহ্‌ হাফেজ।

মোবাইল টা রেখে কিছুক্ষণ বিছানায় চুপ করে বসে থাকে জহির। পাশ থেকে রুমমেট সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করে- “জহির ভাত খেয়েছিস?” জহির ক্ষীণ কন্ঠে বলে- “না”। সাজ্জাদ- “চল ভাত খেয়ে আসি”। জহির বলে- “চল”। দুজনে উঠে গিয়ে একটু পর বসে হলের নিকটেই একটা ভাতের হোটেলে। সাজ্জাদ খাশির মাংস আর ভাতের অর্ডার দেয়। জহির বলে শুধু ভাত আর একটা সবজি। সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করে-“ কী রে শুধু সবজি দিয়ে ভাত খাবি?” জহির বলে- “আমার বেশি খিদে নেই, খেতে ইচ্ছা করছে না”।

খিদে নেই বললেও জহিরের পেটে তখন প্রচণ্ড ক্ষুধা। সে সবজি দিয়েই দুই প্লেট ভাত খেয়ে ফেলে। কি করবে সে? জুলাই মাস শেষের দিকে। হাতে একদম টাকা নাই। বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল সে অনেক দিন আগে। ওদিকে টিউশনির বেতনটাও দিচ্ছে না। সে জানে যে বাড়িতে বাবার হাতেও এখন কোন টাকা নাই। সে টাকা চাইলে হয়তো বাবা আবার ধার-কর্জ করতে যাবে, তাই সে চায় না। এমনিতেই বাবা-মা দুইজনেরই অসুখ, তার উপর ছোট দুই ভাইবোনের পড়ালেখার খরচ। জহির তাই কখনোই টাকা চায় না বাবার কাছ থেকে। সামনে আবার ঈদ আসছে। বাবা কি রাশেদ আর মিলিকে নতুন জামা-কাপড় কিনে দিতে পারবে? নাহ, টিউশনির আন্টিকে আজকেই একটা ফোন দিতে হবে। এরা এত বড়লোক, কোন কিছুতেই তাদের কোন কমতি নাই। অথচ, টিউশনির টাকাটা কখনোই ঠিক সময়ে দেয় না।

বাবা-মায়ের সাথে মোবাইলে কথা বলার সময় সে মিথ্যে কথা বলে; বলে সে খুব ভাল আছে। নইলে তারা খুব দুশ্চিন্তা করবেন।
.
.
.
.
জহিরের সাথে কথা বলে চুপচাপ তাকিয়ে জহিরের মায়ের দিকে থাকেন জহিরের বাবা আব্দুল জব্বার। তিনি সর্ষের তেল মালিশ করে দিচ্ছেন তাঁর বুকে। সকাল থেকেই তাঁর খুব শ্বাস কস্ট হচ্ছে। জহিরের মায়ের বুকের ব্যাথাটাও বেড়েছে দুদিন ধরে।

ছোট একটা অফিসের কেরানি আব্দুল জব্বার। সাড়া মাস অনেক কষ্টে চলার পরও মাসের শেষে হাতে কোন টাকা নেই বললেই চলে। জহিরের মায়ের জন্য ওষুধ কিনেছেন, নিজের জন্য কিছুই কিনতে পারেন নাই। কদিন ধরে শুধু আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত খাওয়া হচ্ছে। আজকেও ছেলেমেয়ে দুটো কান্না-কাটি করছিল খাওয়ার সময়।
জহিরকে তিনি কোন কষ্ট দিতে চাননা। তাই ওর সাথে কথা বলার সময় বলেন যে তাঁরা খুব ভাল আছেন। ছেলেটা দূরে থাকে। তাদের অসুবিধার কথা টের পেলে ও পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারবে না। তাই সে কল দিলেই উনি বলেন যে তাঁরা ভাল আছেন।

দিন থেমে থাকে না। এদিকে হলে কষ্ট করে থেকে পড়াশোনা চালায় জহির। ওদিকে গ্রামে তার বাবা-মাও জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত। অসুখবিসুখ আর অর্থ কষ্টের সাথে লড়াই চলে অবিরাম। তবু প্রতি রাতেই মুঠোফোনের দুই প্রান্তেই চলে সুখে থাকার অভিনয়ের পাল্লা।

২,২৭৫ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “দৈনিক ধারাবাহিক অভিনয়…”

  1. ফেরদৌস জামান রিফাত (ঝকক/২০০৪-২০১০)

    ::salute:: ::salute:: ::salute::
    এটা গল্প না, অসংখ্য পরিবারের দৈনিক কাহিনী। অসাধারন লিখসিস দোস্ত। সিসিবির আকাশে আজ ২০০৪-২০১০ ব্যাচের ঘনঘটা :goragori: :goragori:


    যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সামি(২০০৪-১০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।