খঞ্জনী

আমাদের গল্পটা শীতের শেষের দিকে এক বিকেলের। ম্যাড়মেড়ে, ক্লান্ত কিংবা ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে বসে থাকার কোন বিকেল নয় সেটা। ঝরা পাতার মর্মর শব্দ আর ঠান্ডা বাতাসের শো-শো আওয়াজের সাথে উজ্জ্বল হলদে রোদে ভরা সে বিকেল। এমন সময়ে মনে হয় না কারো ইচ্ছে করে লেপ-কম্বল গায়ে ঘরে বসে থাকতে। বরং ইচ্ছে হয় গরম কাপড় গায়ে চড়িয়ে পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে একলা পথে হাঁটতে। আমি তাই পথে বেড়িয়ে পড়ি।

আমি হেঁটে বেড়াই একা শহরের ফুটপাত ধরে। এখানে ওখানে শীতের পিঠার দোকান। ছেলে-মেয়ে, শিশু-বুড়োদের ভিড় লেগে আছে। কেমন একটা উৎসবের আমেজ। এই শহরবাসীরা সবসময়ই জীবন- জীবিকার তাগিদে ব্যস্ত দিন কাটায়। একটা উৎসব পেলে তারা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। শীতের বিকেল গুলোতে কীভাবে যেন তারা শহরের রাস্তায় কৃত্রিম উৎসবে মাতে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প-গুজব করে, শিশুরা গুটি গুটি পায়ে ঝরা পাতার মাঝে ছুটোছুটি করে বেড়ায়। মন ভাল করে দেবার জন্য এই কি যথেষ্ট নয়?
আমার বরাবরই হাঁটতে ভাল লাগে। একা কিংবা দুজন। দুজন হলে হয়তো গল্পে গল্পে সময় কেটে যায়, একা হলেও আমার আপত্তি নেই। আমি মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে সময় পার করে দিতে পারি। একেকটা মুখ অসংখ্য গল্পের সমষ্টি। সবারই নিজস্ব গল্প থাকে। কেউ কারোটা জানেনা। আমিও জানি না। তবে নিজের মত কল্পনা করে নিতে আমার খুব বেশী কষ্ট হয় না।

হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার এক প্রান্তের পার্কে এসে বসি। মানুষ দেখতে থাকি। হঠাৎ মুঠোফোন বেজে ওঠে। রিংটোনে “আহা আজি এ বসন্তে”র গীটারের ধ্বনি। এই রিংটোন আমি কখন দিলাম বুঝতে পারি না। মনে পড়লো রাত্রির কথা। কাল সন্ধ্যায় যখন বসে ছিলাম একসাথে তখন ও বলছিল বসন্তের কথা। বলছিল যে বসন্ত তো প্রায় চলে এল, তাই আমার ফোনে এই বসন্তের আগমনী গানটা রিংটোন হিসেবে রাখতে বলল। ও নিজেই হয়তো সেট করে দিয়েছে। সারাদিন আজ ফোনের রিংটোন অফ করা ছিল তাই এতক্ষন টেরও পাইনি। এই মেয়েটা একটু অন্যরকম, শহরের আধুনিক মেয়ে হয়েও সে এখনো বৈশাখ, ফাল্গুন-বসন্ত, বর্ষার প্রথম বৃষ্টি এইগুলো নিয়ে মাথা ঘামায়।

ফোন করেছে রফিক ভাই। ধরলাম। জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথায় আছি। বললাম আমার অবস্থান। জবাবে ডাকলেন ভার্সিটির বটতলায়, ওখানে নাকি কিসের একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। উনি ওখানেই আছেন। আমি বললাম, “আসছি”।
ভার্সিটি খুব বেশী দূরে নয়। হাঁটা পথে পনেরো মিনিট, রিকশায় গেলে দশ। আমি হাঁটতে লাগলাম।
রফিক ভাই বয়সে আমার চেয়ে প্রায় বছর পনেরোর বড় হবেন। আমার ছোট চাচার চেয়েও বেশী বয়স তার। সাধারণত বয়সে এত বড় কাউকে চাচা বলে ডাকি আমি। রফিক ভাইয়ের সাথে যখন পরিচয় হয় তখন তাকে আমি চাচা বলেই সম্বোধন করেছিলাম। উনিই বলেছিলেন ভাই বলে ডাকতে।

তার সাথে পরিচয় ভার্সিটিতে পড়ার সময়। আমরা সেবার বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করছিলাম। গানের শিল্পী নিয়ে আসার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। একটা ব্যান্ডের সাথে চুক্তি করতে গিয়ে উনার সাথে কথা হয়। আমরা শিল্পী চাই শুনে উনি বলেছিলেন যে উনার কাজই হল শিল্পী জোগাড় করে দেওয়া। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর একটা প্রতিষ্ঠান চালান উনি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিল্পী, বাদ্যযন্ত্র, খাবার, এমনকি ডেকোরেশন এর ব্যবস্থাও উনার প্রতিষ্ঠান করে দেয়। তিনি অনেক কম খরচে আমাদের অনুষ্ঠানটা বেশ ভালভাবেই পার করে দিয়েছিলেন। সেই থেকেই তার সাথে বেশ খাতির আমার। বেশ মিশুক লোক। সব ধরনের শিল্পীদের সাথে তার ওঠা-বসা আছে। পাড়াগাঁয়ের একতারা হাতে বাউল থেকে শুরু করে আজকালকার হিপ-হপ, রক, মেটাল গাওয়া ব্যান্ডের শিল্পীদের সাথেও তার প্রচুর খাতির। আসলে তার জীবিকা বা পেশাই হচ্ছে এই কাজ। তিনি তার পেশায় পুরোপুরি কর্তব্য নিষ্ঠ এবং সফল।

বটতলায় পৌঁছে গেলাম একটু পরেই। দেখলাম মাঝারি গোছের একটা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। এক মাঝবয়সী পুরুষ শিল্পী লালন গীতি গাইছেন। সাথে বাজছে গীটার, কীবোর্ড আর ড্রামস। রফিক ভাই মঞ্চের পাশেই একটা চেয়ার পেতে বসেছিলেন। আমি কাছে যেতেই একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন। বসে পড়লাম। অনেকদিন পর দেখা। কুশল বিনিময়ের পর তিনি জানতে চাইলেন আমার খবর। বললাম যে মাস্টার্স শেষ করে বসে আছি। টুকটাক এখানে ওখানে কিছু কাজ করি, চলে যাচ্ছে মোটামুটি। আমি তার পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করলাম। জানালেন সংক্ষেপে, দুই মেয়ে আর স্ত্রী ভালোই আছে।

কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, এই যে উনি লালন গীতি গাইছেন, তো সাথে গীটার, কীবোর্ড এগুলা কেন? হারমোনিয়াম বা একতারা এই টাইপ যন্ত্র গুলো কই?” প্রশ্ন শুনে রফিক ভাই মৃদু হাসলেন, “তুমি এই যুগের ছেলে হয়েও একথা জিজ্ঞেস করছো কেন? জানোই তো এখনকার সবাই ওই সব সেকেলে মিউজিক ভাল বাসেনা। এখন সবাই শুনতে চায় ফিউশন, রক, পপ, হেডব্যাঙ্গিং এইসব। তুমি মিয়া আছো কই?” আমি বললাম, “তাই বলে লালন, রবীন্দ্রনাথ এদের গানের নিজস্বতা বলে কিছু থাকবে না?” তিনি বললেন, “তুমি আমি বললে তো হবে না, সবাই এখন এই গুলোই তো চায়”। আমি বললাম, “আচ্ছা বাদ দেন। তা আপনি এই পেশায় আসলেন কেন?” জবাবে বললেন, “আমি ছোটবেলা থেকেই গান বাজনার প্রতি খুব আগ্রহী ছিলাম। কিছুদিন গান শিখেও ছিলাম এক ওস্তাদের কাছে। তবে ভাগ্য সহায় ছিল না। আমার বাবা মারা যান যখন আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেই। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে হওয়ায় সংসারের হাল ধরতে হল আমাকেই, কারণ মা আর ছোট দুই বোন ছিল। তখনই ভাবলাম এই পেশায় আসার কথা। নিজে গান না গাইতে পারলেও অন্তত শিল্পীদের আশেপাশে থেকে জীবনটা পার করে দিতে পারবো এই ভেবেই শুরু করলাম এই কাজ। এখন তো জানোই, আমার দিন মন্দ কাটে না। আমার প্রতিষ্ঠান যেখানেই অনুষ্ঠান আয়োজন করে আমি চলে যাই। বসে বসে গান শুনি, সময়গুলো বেশ ভালোভাবেই কেটে যায়”।

কথা বলতে বলতে লালন সংগীত গাওয়া শেষ হয়ে গেল। মঞ্চে আসলো নতুন এক গানের দল। কয়েক জন কমবয়সী ছেলে। গিটার, কীবোর্ড, ড্রামস দখল করলো একজন একজন করে। সাথে দেখলাম বেশ বেঁটে, চিকন করে এক লোক। হ্যাঁ ছেলে গুলোর তুলনায় তাকে লোক বললেই ভাল মানায়। মুখে দাঁড়ি-গোঁফ নেই, চুল গুলো লম্বা ঘাড় পর্যন্ত। পড়নে লাল রঙের সাইজে বড় একটা ঢোলা শার্ট আর কালো প্যান্ট। তার হাতে একটা “খঞ্জনী”। গোল রিঙের মত, তার গায়ে অনেকগুলো চাকতি বসানো। ওটা এক হাতে ধরে অন্য হাতের তালুতে বাড়ি দিয়ে বাজাতে হয়।

পুরো ব্যান্ডের দিকে তাকালে কেন জানি তার দিকেই প্রথম চোখ চলে যায়। দলটির ভোকাল অর্থাৎ প্রধান গায়ক একে একে দলের সবার সাথে দর্শকদের পরিচয় করে দিতে লাগলো। সবার শেষে দিল তার নিজের পরিচয়। এরপর সেই লাল শার্ট পড়া লোকটি ভোকালের কাছে গিয়ে কী যেন বলল কানে কানে আর নিজের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলো। তখনই ভোকাল বলে উঠলো, “ওহ হো, আমি দুঃখিত। একজনের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলে গেছি। উনি হচ্ছেন খঞ্জনী হাতে আমাদের হাসান ভাই। তার জন্য একটা হাততালি……”। দর্শকরা সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো।

আমি রফিক ভাইয়ের দিকে ফিরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই এই ব্যান্ড কোথাকার? এদেরকে আগে কখনও দেখেছি বলে তো মনে হয় না”। ভাই বললেন, “ওরা মফস্বলের ব্যান্ড, নিজেরাই গান লেখে, নিজেরাই গায়। আমাকে এই অনুষ্ঠানের আয়োজকের বলছিল নতুন কোন ব্যান্ড নিয়ে আসতে। আমি এদের গান শুনেছি, বেশ ভাল লেগেছে। তাই আজকে এদের নিয়ে আসলাম”। আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম, “আর ওই লোকটা?” উনি বললেন, “কোন লোকটা?” আমি, “আরে ওই যে লাল শার্ট, হাতে খঞ্জনী”।
রফিক ভাই –“ও, ওটা তো হাসান আলী। ও তো এই ব্যান্ডেই আছে। বেশ ভাল খঞ্জনী বাজায়, দেখোই না একবার…”।

আমি ভাবতে লাগলাম অনেক গানই তো শুনলাম জীবনে, কই খঞ্জনী ছাড়াই তো ভাল গান হয় শুনেছি কত। ওটাও আবার লাগে নাকি গানের জন্য?

গান শুরু হয়ে গেল। বাজনা-টাজনা ভালোই বাজাচ্ছিল ওরা। ভোকালের গলাটাও বেশ লাগছিলো। প্রথমে ভেবেছিলাম মফস্বলের ব্যান্ড, হয়তো আঞ্চলিক কোন গান গাইবে। না, এতো দেখি বেশ আধুনিক ধাঁচের গান, সাথে মানানসই মিউজিক। সবচেয়ে দেখার বিষয় হচ্ছে, সেই হাসান আলীর খঞ্জনী বাজানো। ড্রামস, গীটারের তালে তালে সে ও তার হাত চালাচ্ছিল। আর গানের চরম বীট গুলোতে লাফিয়ে উঠছিল বারবার। মাঝে মাঝে ঘুরে ঘুরে কোমর বাঁকিয়ে নেচে বেড়াচ্ছিল পুরো মঞ্চ। তাতেও তার খঞ্জনীর ছন্দের তাল হার হারাচ্ছিল না। আমি বেশ মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম। দর্শকরাও বুঝলাম ভালোই উপভোগ করছে। যত বার হাসান আলী লাফিয়ে বা নেচে উঠছে ততবারই হাততালিতে মুখর হয়ে উঠছে পুরো চত্বর।

রফিক ভাইকে আমি জিজ্ঞেস করলাম কোথা থেকে তিনি এই ব্যান্ডের খোঁজ পেয়েছেন। আর এই হাসান আলীই বা কে? জবাবে বললেন-“জানোই তো আমি শিল্পীদের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় যাই। কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম শহরের অদূরে একটা উপজেলায়। ওখানেই এদের কথা শুনতে পাই। আর এই হাসান আলী এদের সাথেই আছে অনেকদিন ধরে। ওর জীবন কাহিনী একটু অদ্ভুত”। আমি গল্পের আভাস পেয়ে বললাম,-“বলেন না, শুনি। কী রকম অদ্ভুত তার জীবন”।
তখন সন্ধ্যার আঁধার আস্তে আস্তে নামতে শুরু করেছে। মঞ্চে গান চলছে পুরোদমে। চলছে মুহুর্মুহু হাততালি। রফিক ভাই বলতে শুরু করলেন-

“হাসান আলীর এই কাহিনী আমি শুনেছি ওরই ব্যান্ডের একজনের কাছে। হাসানের বাড়ি এক দূর গ্রামে। এই শহর থেকে অনেকদূরে। যেখানে বিশ-তিরিশ বছর আগেও আধুনিক গানের চল ছিলনা একেবারেই। তার বাপ ছিল এলাকার গায়েন। লোকটা মুখে মুখে গান বানাতে আর সুর বাঁধতে বেশ ওস্তাদ ছিল। এলাকায় তার খুব নামডাক ছিল। তার ছিল গানের একটা দল। বিভিন্ন সময়ে না-না স্থানে সে দল গান গেয়ে বেড়াতো। লোকটা ছিল গানপাগলা। গান গাইতে পারলেই খুশি, আর লোকজন পছন্দ করে দুটো মিষ্টি কথা বললে একদম আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেত। গান শুনে যে যা টাকা পয়সা দিত তাতেই তার সংসার বেশ ভালভাবে চলে যাচ্ছিল। হাসান একটু বড় হবার পর সেও বাবার সাথে গানের দলে ভিড়ে যেতে চাইলো। তার উৎসাহ দেখে তার বাবা হাতে তুলে দিলেন খঞ্জনী। গান করার সময় সে মহা আনন্দে সেই খঞ্জনী বাজিয়ে নাচতো। লোকজন দেখে মজা পেত খুব। দিন এভাবেই কেটে যাচ্ছিল তাদের।

এর মধ্যে আসলো এক বিপত্তি। ১৪-১৫ বছর বয়সে হাসানের হঠাৎ করেই টাইফয়েড হল। গ্রামের মানুষ, রোগ বুঝতে না বুঝতেই অনেক দিন পার হয়ে গেল। অবশেষে শহরের ডাক্তার তার রোগ সারিয়ে জীবন বাঁচাতে বটে, কিন্তু সে আর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলো না। মানে তার ব্রেনে কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেল। সে শারীরিক ও মানুসিক ভাবে ঠিকমত বেড়ে উঠতে পাড়লো না। তার শরীরের গঠন দেখেই মনে হয় তা বুঝতে পারছো কিছুটা। তার আচার-আচরণ ও রয়ে গেল প্রায় শিশুর মত। আরেকটা জিনিস ঘটলো তার মধ্যে। তাহল, সে রোগ থেকে সেরে উঠেই সারাদিন শুধু তার খঞ্জনী নিয়ে পড়ে থাকে। খাওয়া-দাওয়া, গোসলের সময় এমনকি রাতে ঘুমানোর আগেও সে খঞ্জনী হাতে বিছানায় যেত। তার বাবা তার উপর সব আশা ছেড়েই দিলেন। সে নিজের মনে খেলে বেড়ায় তার খঞ্জনী হাতে।

এখানে একটা কথা বলে রাখি। হাসান যখন খুব বেশী অসুস্থ ছিল তখন তার পাশের বাড়ির মায়া নামে একটা মেয়ে প্রায়ই তাদের বাড়িতে এসে হাসানের সেবা করতে তার মাকে সাহায্য করতো। সে ছিল হাসানের শিশুকালের খেলার সাথী। যাইহোক, এই মায়ার কথা যথাসময়ে বলা হবে।

বছর চার-পাঁচ এভাবেই কাটলো। তারপর একদিন হাসানের বাবা গান গাইতে গাইতে ভরা আসরে স্ট্রোক করে মারা গেলেন। নতুন এক অভাবনীয় বিপদে পড়লো তার পরিবার। সংসারে ছিল হাসানের মা আর ছোট দুই ভাইবোন। তারা এত ছোট যে অর্থ উপার্জনের মত কোন কাজ করার যোগ্যতা তাদের ছিলনা। তার মা পড়লেন অথই পাথারে। কিছু জমানো টাকা ছিল, তা অল্পদিনেই ফুরিয়ে গেল। একপেটা, আধপেটা করে দিন কাটতে লাগলো। এর মধ্যে হাসানের এক চাচা এসে হাসানের মাকে বললেন যে হাসান তো খঞ্জনী বাজাতে পারেই, ওকে কোন একটা গানের দলে ঢুকিয়ে দিলে হয়তোবা ওর পরিবারের না খেয়ে থাকতে হবে না। চেষ্টা চরিত্র করে তিনিই হাসান কে একটা গানের দলে ভিড়িয়ে দিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, সে কাজ কর্মে অনেক ধীর গতির হলেও এবং কথা বার্তা কম বললেও, গানের ছন্দের প্রতি তার কেমন একটা অন্ধ মোহ ছিল। এখানে সে ভাল করতে লাগলো। গানের দলটির সাথে সে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেত, নেচে নেচে খঞ্জনী বাজাতো। লোকজন তার নাচ দেখে খুশি হয়েই তাদের তারিফ করতো, টাকা পয়সাও ভালোই দিচ্ছিল। দলের প্রধানও তাকে খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু সমস্যা হল অন্য যায়গায়। হাসান টাকা পয়সার হিসাব রাখতে পারতো না। তার হাতে টাকা দিলে সে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার আগেই দেখা যেত কেউ তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে হাত খালি করে নিয়ে গেছে। এই ব্যাপার দেখে তার মা এরপর থেকে তার সাথে সব অনুষ্ঠানে যেতে লাগলেন। অনুষ্ঠান শেষে হাসানের পক্ষে তিনিই টাকা নিজের হাতে নিতে লাগলেন। হাসান ও তার পরিবারের জীবন মোটামুটি ভালোভাবেই কেটে যেতে লাগলো। এরমধ্যে ঘটলো এক চমৎকার ঘটনা”।

–এই টুকু বলে থামলেন রফিক ভাই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হল, থামলেন কেন? কী চমৎকার ঘটনা ঘটলো?”
রফিক ভাই বললেন- “প্রথম ঘটনা হল হাসানকে এই ব্যান্ডের লোকজন নিয়ে নিলো। ওরা তো অনেক জায়গায় গান-টান করে, রোজগার ভালোই হয়। হাসানের কপাল খুলে গেল বলতে হয়। আর দ্বিতীয় ঘটনা হল হাসানের বিয়ে”।
আমি চমকে উঠে বললাম-“হাসানের বিয়ে? তা কী করে হয়?”
তিনি মুচকি হেসে বললেন, “সেটাই তো মজার ব্যাপার। বলা যায় সেটাই হাসানের জীবনে সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।

হাসানের মায়ের কাছে হঠাৎ একদিন এসে হাজির হল তাদের পাশের বাড়ির সেই মেয়ে, মায়া। সে হাসানের সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব দিল নিজের মুখেই। হাসানের মা প্রথমে অবাক ও পরে বেশ বিরক্ত হলেন। তিনি ভাবলেন যে মায়া বুঝি তাঁর সাথে ফাজলামি করতে এসেছে। মায়ার পরিবারের অবস্থাও ভাল ছিলোনা। হাসানের মায়ের মনে এই চিন্তাও আসলো যে মায়া বুঝি হাসানের টাকা পয়সা দেখে লোভে পড়ে এই প্রস্তাব দিচ্ছে। তা না হলে ওই রকম অসুস্থ ছেলেকে কি কেউ বিয়ে করতে চায়? তখন মায়া তাঁকে মনে করিয়ে দিল হাসানের অসুস্থতার দিনগুলোর কথা। তখন তো হাসানের টাকা ছিল না কিছুই। সে আসলেই হাসানকে ভালবাসে, তার সাথেই সে ঘর করতে চায়। সে আরও বললো যে তিনি যখন থাকবেন না, তখন হাসান আর তার ভাইবোনদের কে দেখবে? মায়া এইসব দায়িত্ব নিতে রাজি আছে। আরও না-না কথায় সে হাসানের মাকে বুঝিয়ে রাজি করলো।

ওদিকে মায়ার বাপ-মা রাজি ছিলেন না। তারা গরিব হলেও একটা প্রতিবন্ধীর সাথে তাদের মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইলেন না। কিন্তু কে শোনে কার কথা, মায়ার জেদ প্রচুর। সে বাপমায়ের অমতেই হাসানকে বিয়ে করলো। বিয়ের পরেই হাসানের পরিবারের চেহারা পাল্টে গেল। মায়া তার সংসার খুব ভাল ভাবে গুছিয়ে নিল। স্বামী, শাশুড়ি আর দেবর ননদকে নিয়ে তার দিন সুখেই কাটতে লাগলো। এরপর হাসান কোথাও গানের অনুষ্ঠানে গেলে তার সাথে মায়াই যায়। টাকা পয়সা বুঝে নেয়। সংসার সে’ই চালায়। হাসানের মা’ও তার উপর খুব খুশি ছিলেন। বছর দুই আগে তিনি মারা গেছেন। হাসানের কোন সন্তান হয়নি। তার ছোট ভাইবোন দুটোও মায়ার বেশ ভক্ত। মোটকথা বলা যায়, মায়ার কাছে পরম মায়ার আশ্রয় পেয়েই হাসানের পরিবার এখনো সুখে শান্তিতেই জীবন কাটাচ্ছে”।

শেষ করলেন রফিক ভাই। আমি বললাম, “ভাই এ কী কাহিনী শোনালেন! মায়া নামের সেই মায়াবতী কে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তাকে একবার সালাম জানাতে ইচ্ছে করছে”।
রফিক ভাই-“তুমি চাইলেই কিন্তু পারো সেটা, মায়া আজকেও এসেছে হাসানের সাথে। ওই যে দেখো স্টেজের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, ঘোমটা দিয়ে”।

আমি ফিরে চাইলাম সেদিকে। ততক্ষণে গান শেষ হয়ে গেছে। হাসান আলী মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছে নিচে। সামনে দাঁড়ানো এক নারীর দিকে এগিয়ে গেল সে। সে হাসানকে নিয়ে গেল স্টেজের পিছনে। নেচে নেচে খুব ঘেমে গেছে তার শরীর। দেখলাম সেই নারী তার আঁচল দিয়ে পরম মমতায় হাসান আলীর শরীরের ঘাম মুছে দিচ্ছে, হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তার মাথায়।

একবার সেদিকে পা বাড়িয়েও থমকে গেলাম। মঞ্চের সামনে প্রচুর আলো, চোখ ঝলসে যাওয়ার মত। তার পিছনেই গাঢ় অন্ধকার। সেই জায়গাটা ভেসে যাচ্ছে ব্যাখ্যাহীন অদ্ভুত ভালবাসার বন্যায়।

১,৩৯৭ বার দেখা হয়েছে

১৩ টি মন্তব্য : “খঞ্জনী”

মওন্তব্য করুন : সামি(২০০৪-১০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।